স্মৃতির রত্ন ভাণ্ডার

স্মৃতির নির্মাণ সৃষ্টি করে শিল্প। স্মৃতির সেই সতত সুখের গহীন থেকেই জন্ম হয় স্বপ্নের। স্বপ্ন দেখায় আগামীর সঙ্কেত। আমরা সেই সঙ্কেতেই নির্মাণ করি ভবিষৎকে--


স্মৃতি নির্মাণ একটা শিল্প। অন্যান্য জীবজন্তুর কতটা স্মৃতি থাকে জানি না, মানুষের থাকে। স্মৃতি একটা সম্পদ। থেকে যায়। স্মৃতি রোমন্থনে একটা সুখ আছে। যে ঘটনাগুলির ভিতর দিয়ে অতিক্রম করার সময় খুব কষ্ট পেয়েছি, সেই ঘটনা স্মৃতিতে রূপান্তরিত হলে দুঃখ-কষ্ট কীভাবে আনন্দ হয়েই ফিরে আসে। যে আনন্দের কথা রবীন্দ্রনাথে নানা ভাবে পাই। এ জন্যই প্রতিভা বসুর স্মৃতিচারণা মূলক একটি বইয়ের নাম ছিল 'স্মৃতি সতত সুখের'।


বেশি বয়সে অনেকেরই স্মৃতিভ্রংশ হয়। তখন নিকট স্মৃতিগুলিই আবছা হয়, কিন্তু দূরের স্মৃতিগুলি ছবি হয়েই থাকে। গত কালকের কথা ভুলে গেলেও চার/পাঁচ দশকের কোনও কোনও কথা স্পষ্ট মনে থাকে। ভাগ্যিস মনে থাকে, সেই সবই তো আমাদের জীবন সম্পদ। একজন লেখকের কাছে সেই সব শৈশব-কৈশোর স্মৃতিই সম্পদ। পরবর্তীকালের লেখায় ঘুরে ফিরে আসে সেই সব স্মৃতি কথা। শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি ছাড়াও আরও নানা অভিজ্ঞতা আছে যা অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করে। কর্মজীবনের স্মৃতি, প্রিয় মানুষের স্মৃতি, এমন আরও কত।

স্মৃতিকথায় আমরা পাই লেখকের সামাজিক মন। অর্জিত মূল্যবোধের পরিচয়ের অভিজ্ঞানও হয়ে ওঠে। স্মৃতিকথা ইতিহাসেরও উপাদান। ছাত্রজীবনে পড়েছিলাম ফকিরমোহন সেনাপতির আত্মকথা। অবিস্মরণীয়। রবীন্দ্রনাথের 'জীবনস্মৃতি' পড়েছিলাম আরও ছোট বয়সে। 'ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা' ছিল শিবরাম চক্রবর্তীর আর একটি অনন্য অভিজ্ঞতা। তসলিমা নাসরিনের 'আমার মেয়েবেলা' এবং 'দ্বিখণ্ডিত', বাদল বসুর 'পিওন থেকে প্রকাশক', সবিতেন্দ্র নাথ রায়ের। কলেজ স্ট্রিটের সত্তর বছর', ভগীরথ মিশ্র আর তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'আমলাগাছি' এবং  তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'অক্ষরের সঙ্গে একটা জীবন'। এ-রকম কত বইয়ের কথা মনে পড়ে— যা আমি পড়েছি। 'বিষাদবৃক্ষ' পড়েছি, যেটা পড়ে দেশভাগ পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানের একটা নির্মোহ ছবি পেয়েছি— মানবিক আবেদনে ভরা। রাসসুন্দরী দেবীর 'আমার জীবন' এ-রকম আরেকটি বই। অনন্ত সিংহ, ইলা মিত্রর স্মৃতিচারণার বই পড়েছি একটি উপন্যাস লেখার প্রয়োজনে। এখন বেতার সম্প্রচার নিয়ে উপন্যাস লেখার প্রয়োজনে পড়তে হচ্ছে পঙ্কজ কুমার মল্লিকের 'আমার যুগ, আমার গান', লীলা মজুমদারের 'পাকদণ্ডী', কানন দেবীর 'সবারে আমি নমি' ইত্যাদি। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, বাণীকুমার, ইন্দিরা দেবী তেমন কোনও স্মৃতিকথা লিখে যাননি। এক সময়ে ডিজি পদে থাকা পি সি চ্যাটার্জি ইংরেজিতে একটা লিখে গেছেন। কিন্তু তাতে পর্যাপ্ত উপাদান পাওয়া যায় না। সাম্প্রদায়িক অত্যাচারে অত্যাচারিত মানুষেরাও ওদের কথা সে ভাবে লিখে যাননি, যা ইতিহাসের উপাদান হতে পারত। কিন্তু একটা সামাজিক বোধ কাজ করেছে— যা হল ‘নোংরা ঘাটব না’।


আমার সামগ্রিক লেখাপড়ার পরিধি বেশি নয়। তবে নিজেকে দিয়ে দেখেছি ‘সাহিত্য’-র চেয়ে আত্মকথা বা স্মৃতিকথা আমাকে বেশি টানে। দূরে কোথায় দূরে দূরে নিয়ে যায়। আজ আমি এখানে গত এক বছরে পড়া কয়েকটি এই ধরনের বই পড়ার অনুভূতি ভাগ করে নিতে চাই। বইগুলি হল বিষাণ বসুর ‘টুকরো স্মৃতি ছেঁড়া শোক...’, যশোধরা রায়চৌধুরীর ‘হারিয়ে যাওয়া গানের কথা’, ইমানুল হকের ‘কাদামাটির হাফলাইফ’, অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামীর ‘স্মরচিহ্ন’।
এই বিন্যাসটি কিছুটা বয়সানুপাতিক হতে পারে। বিষাণ বসু একজন চিকিৎসক। ক্যান্সার রোগ বিশেষজ্ঞ। ১৯৭৪ সালে জন্ম, বিষ্ণুপুরে। বাংলা মিডিয়াম।


এই সাতাশ/আঠাশ হাজার শব্দের বইটি একটি ‘ওড্ টু ডেথ’। একটা মৃত্যুকে উদ্দেশ্য করে লেখা একটা ওড, ততটা দার্শনিকতাময় কাব্যও নয়, বরং একটি মৃত্যুর নান্দনিক ধারাবিবরণী। নাকি সেটাও নয়, একথা সেকথায় ‘আর্ট অফ ডাইং’ বিবৃত করা।

আমি লেখক হিসেবে জানি, বিষাণ যখন লিখেছিল, তখন ভারি ভাবনা ভাবেনি। ওর নিজস্ব আবেগ এবং আবেশেই লিখেছিল, আর বলার অপেক্ষা রাখে না, আবেগের উৎস ছিল ভালবাসা। শ্রদ্ধাও। তবে এই শ্রদ্ধায় 'পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম পিতাহি পরমং তপঃ ছিল না'। একটা নির্মোহ দৃষ্টি ছিল। এপাশ থেকে, ওপাশ থেকে, সামনে থেকে পেছন থেকে দেখা।


এই পিতৃবিয়োগের স্মৃতিচিত্র পুরনো নয়। হয়তো দু’হাজার বাইশের ঘটনা, যদিও দু-এক বারের বেশি দিন-তারিখ উল্লেখ করেননি বিষাণ। ইচ্ছে করেই তারিখ দেননি, তা হলে যেন অনেকটা অফিসিয়াল স্টেটমেন্টের চরিত্র পেতে পারত। এই আলেখ্যটি ফরমাল করতে চাননি উনি। তাই এই ক্রম মৃত্যুর ধারাবিবরণীর পরতে পরতে মিশে যায় বিষাণের শৈশবের বাবা, কৈশোর-যৌবনের বাবা। বাবার অসুস্থতার সঙ্গে কলয়ডাল সলিউশনের মতো মিশে রয়েছে একটি বামপন্থী রাজনৈতিক দলের অসুস্থতার বিভিন্ন উপসর্গ। বিবৃত হয়েছে আদর্শ বিচ্যুতির উপসর্গগুলি।


বইটি শুরু হয় ভাস্কর চক্রবর্তীর একটি কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে। ‘কে তোকে বেড়াতে নিয়ে যাবে রোজ বিকেলবেলায়? আমি তো যাব না আর...।’ তারপর আর না ফেরার দেশের দরজা, যেটা ইলেকট্রিক চুল্লি, সেখান থেকে আখ্যানের সূত্রপাত। এরপর ছোট ছোট শব্দ পুঞ্জে গ্রন্থিত। এক একটি অধ্যায় দুশো থেকে তিনশো শব্দের মধ্যেই। ঘটনা, সেই ঘটনাটি ঘিরে অনুভূতি, কখনও বিশ্লেষণ, আবার ফ্ল্যাশব্যাক। পুরনো কাল থেকে আবার হাসপাতালে অসুস্থ পিতার কাছে ফিরে আসা। এরকম একটা আঙ্গিক দিয়েছেন বিষাণ বসু। সে অর্থে কথাসাহিত্যিক নন। এর আগে ওঁর যে বইটা আমি পড়েছিলাম, সেটার নাম ‘কিনে আনা স্বাস্থ্য: বাজার, পুঁজি, মুনাফা আর আপনি’। নামেই বোঝা যাচ্ছে বিষয়বস্তু কী। তবে এ প্রসঙ্গে বলি, এই বইটার আগেই আমাদের চিকিৎসক এবং চিকিৎ‌সা ব্যবস্থা নিয়ে একটি পরিবারের তিন প্রজন্মের তিন চিকিৎসককে কেন্দ্র করে ‘গণমিত্র’ নামে একটি উপন্যাস বেরিয়ে গেছে, যেখানে চিকিৎ‌সার বাণিজ্যিকরণের প্রক্রিয়াটি আখ্যানাকারে বলার চেষ্টা করেছিলাম। তখন মনে হয়েছিল, ইশ্, এই বইটা যদি আগে পেতাম, কাজে লাগত। আর বিষাণের এই আলোচ্য বইটা পড়ে মনে হচ্ছে— এই আঙ্গিকে আমি কেন লিখলাম না আমার মাকে নিয়ে। আমার মাকে হারিয়েছিলাম ১৯৭৭ সালে, মায়ের বয়স ছিল ৪৮, আমার ২৫। প্রায় এক মাস ধরে রোজ লিখে রাখতাম মায়ের শারীরিক অবস্থা, কতবার বমি করলেন, জ্বর কত উঠেছিল, কী কী করতে চাইছেন ইত্যাদি। ভেবেছিলাম ডাক্তারদের কাজে লাগবে। মা কী করে নিকটবর্তী মৃত্যু সংকেতও পেয়েছিলেন, এবং কী বলেছিলেন, এসবও লিখে রেখেছিলাম। সেই খাতাটা অনেক দিন আমার কাছেই ছিল। বিষাণের এই বইটা পড়ে আফশোস হচ্ছে কেন আমিও লিখলাম না।


বিষাণের বাবার নাম শক্তিরঞ্জন বসু। যদিও নামের উল্লেখ তেমন নেই। বাবার ছবিতে বাবাই থাকেন। সার্টিফিকেটের নাম থাকে না। বাঁকুড়া জেলার পুরনো কমিউনিস্টরা ‘শক্তি বোস’ বলেই চিনতেন। সাইকেল সম্বল কর্মী। সেই সাইকেলেই বিষাণ পাঠককে ঘুরিয়েছেন বাঁকুড়ার গ্রাম, ছোট নদী, আটাত্তরের বানভাসি, পাড়াপড়শিদের ঘরবাড়ি...।


বাবার পার্টি কমরেডদের কথাও বলেছেন। একজন পার্টি কমরেড, যার নাম করেননি বিষাণ, শক্তিবাবুকে দিয়ে একটা মার্কসবাদী বই অনুবাদ করিয়ে প্রকাশের পর শক্তিবাবুর নামটাই চেপে দেওয়া এরকম দু-চারটে উদাহরণ পাই। পার্টির রমরমার সময় কিছু লোকের ক্ষমতার মোহ, কর্ত্তাগিরি এসবও দেখেছি এক কিশোর এবং সদ্য যুবকের চোখে। বাবা যে কষ্ট পাচ্ছেন বুঝেছিল সেই ছেলেটি। তাই ক্রমমৃত্যুর ধারাবিবরণীতে বিষাণ লেখেন, ‘অনেক দিনের ডায়াবেটিক, সেখান থেকে কিডনির সমস্যা, দীর্ঘদিনের ধূমপানে ফুসফুস দুর্বল, হৃৎ‌পিণ্ডের বেহাল দশা, মানসিক অবসাদের কারণ কিছুই ভালো না লাগা। সব মিলিয়ে আস্তে আস্তে শরীর ভেঙে যাওয়া— কিন্তু বাবা তো মারা যাচ্ছিল অনেক দিন ধরেই। এই অনেক দিন ধরে মারা যাওয়ার গূঢ় অর্থ হল ভিতরে ভিতরে ক্ষয় হয়ে যাওয়া। শারীরিক ক্ষয় যত, মানসিক ক্ষয় তার চেয়ে বেশি। সব চেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছিলেন ‘বিশ্বাস’ শব্দটাই যখন দলিত হল। মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানোটা মানসিক হেমারেজের মতো'।


বিষাণ অন্যান্য বন্ধুদের কথা লিখেছে যারা ওর বাবাকে সুস্থ করে তোলার যুদ্ধে সঙ্গী ছিল। আবার বাবাকে যখন বাইরের যন্ত্রপাতির সাহায্য নিয়ে প্রায় জোর করে শুধু বেড নম্বর হয়ে যাওয়া একটা দেহকে নিয়ে বাঁচানো-বাঁচানো খেলা হচ্ছে, সে সময় একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়াটা কেন্দ্র করে এমন লাইন লিখেছে বিষাণ, যা অন্তরাত্মায় ঢুকে যায়।


এরপর জীবন, মৃত্যু, মৃত্যুকে স্বীকার-অস্বীকার করা, স্বাভাবিক থাকা এই সব কিছু, যার মাঝে ভাস্কর চক্রবর্তী এবং আরও কয়েক জনের কবিতা, দার্শনিকদের বক্তব্য মিলিয়ে একেবারে মনের কথা লেখাটার জন্য একটা বিশেষ ক্ষমতা অর্জন করতে হয়। বিষাণের শিল্প এবং চিত্রকলা বিষয়ক কিছু লেখা আমি ফেসবুকে পড়েছি। যে মানসিক গঠন চিত্রকলার নন্দন বোঝে, এবং জনবোধ্য ভাষায় লিখতে পারে, সেই মনই এই বইটি লিখতে পারে। সব শেষে মনে হয়, এই সব শক্তি বসুদের কথা, যাঁরা আদর্শের জন্য, মানুষের জন্য, একদলা স্বপ্নকাদা নিয়ে স্বপনপুরী গড়তে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হয়েও কাদা মাখা হাতটা ধুয়ে ফেললেন না, তাঁদের বুকটা টনটন করে ওঠে। এরকম অনেক শক্তিবাবুকে ইতিহাস ততটা মনে রাখবে না, কিন্তু সময়ের ইতিহাস্টা থাকবে। লেখায়। স্মৃতিকথায়।


বিষাণের এই ছোট বইটা একটা আরতি করার প্রদীপ।


টুকরো স্মৃতি
বিষাণ বসু  
কেতাব-ই
২০০ টাকা

  • স্বপ্নময় চক্রবর্তী