৩১ আগস্ট, ২০২৪, অপরাহ্ন। তখন চিতাকাঠের আগুন নিভন্ত, নিজেরই রোপন করা বৃক্ষশাখার আগুনের শিখায় বৃক্ষনাথের দেহ তখন প্রায় ভষ্মীভূত। সাড়ে তিন হাত দেহটা ক্রমশ সাড়ে তিন মুঠির, একটা মাটির কলসে কবির ভস্মীভূত নশ্বর দেহের অন্তিম চিহ্ন, তাঁর প্রায় অঙ্গারিভূত নাভি তুলে রাখার প্রস্তুতি চলছে। এরপর পাশের ছোট পুকুর থেকে মাটির কলসে করে হাতে হাতে জল নিয়ে এসে চিতার ছাইচাপা আগুন ঠান্ডা করতে হবে। কৌরব পুরুষের নশ্বর দেহ তখন পঞ্চভূতে লীন। সবুজ ঘাসের উপর সাজানো চিতা ও উপরের নীলাকাশের মাঝে এক ধোঁয়াটে সিঁড়ি উঠে গেছে। হঠাৎ আকাশ ছেয়ে এল মেঘ, দশ পনেরো মিনিটের ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি, প্রকৃতি যেন নিজেই শান্ত শীতল করে দিল চিতার আগুনের তাপ। কমল চক্রবর্তী কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন? পরজন্মে? তাঁর ধর্ম কী? এসব অবান্তর হয়ে যায় লক্ষাধিক গাছের মালি এই সাদা ধুতি ও ফতুয়া পড়া মানুষটা কাছে এলে। বাংলা সাহিত্যের অবিনশ্বর সাহিত্য পত্রিকা ‘কৌরব’ হাতে তুলে নিলে। ‘ব্রহ্মভার্গব পুরাণ’ বা ‘ব্রাহ্মণ নবাব’ বা ‘স্বপ্ন’ বা ‘চার নম্বর ফার্নেশ’ পড়তে শুরু করলে।
যদি কারও বিখ্যাত হওয়ার ইচ্ছে হয় তবে সে কেবল কমল চক্রবর্তীর মতো গদ্য লিখলেই বিখ্যাত হতে পারেন, তাঁর মতো কবিতা লিখতে পারলেও বাংলা কবিতার ইতিহাসে নাম লিখে রাখবেন, লিটল ম্যাগাজিন ‘কৌরব’-এর মতো কয়েকটা সংখ্যা প্রকাশ করলেই তাঁকে নিয়ে হই হই ফেলে দিতে পারতেন। কিন্তু কমল চক্রবর্তীরা থামতে জানেন না। বুকে যে তৃষ্ণা লালন করেন সেই তৃষ্ণায় ছুটে যান কোনও প্রান্তীয় ঊষর জমিতে, গিয়ে তাকে সবুজ প্রাণে ভরিয়ে দিতে নিজেকে উজার করে দেন। কোনও অবহেলিত আদিবাসী জনজীবনের সাথী হয়ে যান, নিজের সন্তানের মতো স্নেহের উষ্ণতায় তুলে নেন তাঁদের সন্তানদের, তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেন, তাদের সুষমপুষ্টির জন্য দুধের জোগান দিতে গাভীর খামার করেন, ধানের অধিক ফলন নিয়ে কাজ করেন, বীজ রোপন করেন, অন্ধকার আঁকড়ে থাকা মানুষদের জীবিকার খোঁজ দেন।
পুরুলিয়ার বান্দোয়ানের ধু-ধু ঊষর জমি আজ সবুজের চাদরে আচ্ছাদিত। ভালোপাহাড়ের ছবিটা গত তিন দশকে আমূল পালটে দিয়েছেন তিনি। মানুষের হাতে গড়া জঙ্গলের মাঝে দুটো পুষ্করণী, ছোট দিঘি আর বড় দিঘি। কমল চক্রবর্তীর ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিয়ে ছোট দিঘির পাশের জমিতে তাঁর নশ্বর দেহের দাহ কাজ করা হল। নিজের স্বপ্নভূমে লীন হতে চেয়েছিলেন তিনি।
কমল চক্রবর্তীকে কোনও ব্যাকরণেই ব্যাখ্যা করা যায় না। মৃত্যুর কয়েক বছর আগেই ‘কমল চক্কোত্তির শাদ্ধের পুন্ন পতিবেদন’ লিখে গেলেন, নিজেরই এক কল্পিত দাহ ও শ্রাদ্ধের বিবরণ, কমল চক্রবর্তীয় গদ্যে। সেখানে হাজির করেছেন তাঁর শেষ সময়ে যাদের আশা করছেন তাঁদের। লিখে গেছেন তাঁদের কল্পিত কথোকথন। কীভাবে তাঁর দেহ দাহ করা হবে তাঁর বিবরণ। অনেকটা সেই মতো আয়োজিত হল কমল চক্রবর্তীর শেষকৃত্য।
“... জঙ্গলে, যেখানে ঘণ্টা চার-পাঁচ, কমলের শবদেহ, এতক্ষণে দেশ-বিদেশ থেকে শ্মশানযাত্রীরা হাজির। ‘জয় বৃক্ষ নাথের জয়’। বডি তুলতে দশ বারোটি নারী পুরুষ! হাত। পারল না। ফেরর জোর লাগিয়ে। পারল না। আরও জোর, না। আরও জোর, না না না। আসলে, চার-পাঁচ ঘন্টা মাটি থেকে, কোটি কোটি সরু মোটা সূক্ষ শিকড়, কেঁচো বেরিয়েছে। শরীরের ভিতরে বাইরে, আচ্ছন্ন। পাশের নিম, বট, অর্জুন, বাঁশ, কাঞ্চন, আম, কৃষ্ণচূড়া, ঝাউ, ঘাস, জাম। কতরকম কত যে শিকড়। কত তাৎপর্য ......”
ভালোপাহাড়ের বৃক্ষনাথের দেহ আসলে সেই মাটি, কীট, কেঁচো ও জলজঙ্গলার আপন সম্পদ হয়ে গিয়েছিল। তাই ঝাড়গ্রামের সেই প্রত্যন্ত এলাকার জনজাতির মানুষের ‘বুড়া’ চিরকাল তাঁদের কাছেই থেকে গেলেন। “খানিক দূরে পশুপাখি। হাজার হাজার। মানুষ ও পশু, পাখি। এবং গাছ ও মৌমাছি, প্রজাপতি। গান ‘জগতের আনন্দ যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ’। সবাই। ঝরঝর পাতা। ফল ফুল। হঠাৎ গাছের মোটা ডালে ডালে ঘর্ষণ। শ্মশান বন্ধুরা একটু উদবিগ্ন দূরে। দ্বিগুণ ডালে ডালে ঘর্ষণ, একটা অর্জুন, অন্যটা আম। আগুন জ্বললো। যেখানে কমলের শব, ঠিক উপরে। হা হা হাসতে হাসতে বড় বড় ডাল, দাউ দাউ, কমলের শরীরে। মানুষজন শ্মশানবন্ধুরা দশ হাত বিশ হাত দূরে ঘাসে। অনেক লেলিহান। আগুন, আগুন, হুতাসন। অগ্নিদেবতার নৃত্য। ধুনোর গন্ধ, জজ্ঞুল। আকাশ অবধি, প্রচুর বনস্থালি, বন্য বিভাগ। অগ্নি ও শবদেহের এই বিপুল ভারতনাট্যম। ...বৃক্ষ কমলকে পোড়াচ্ছে, নিজস্ব, স্বরচিত আগুনে, কাঠে, অপূর্ব শ্রদ্ধায়।”
আমরা গুটিকয় নাগরিক মানুষ, কমলদার কাছের, ভালোবাসার, দূরে – ঘাসের উপর কেউ কেউ, কেউ কেউ ছোট দিঘির বাঁধানো ঘাটে। মধ্যখানে আগুনের শিখায় দাউদাউ ‘অগ্নি ও শবদেহের এই বিপুল ভারত নাট্যম’। চিতাকাঠ সাজানো থেকে পোড়া কাঠের গা থেকে অঙ্গার ঝড়িয়ে দহনপ্রক্রিয়াকে সহজ রাখার কাজ করে চলেছেন ভালোপাহাড়ের গুটিকয় আদিবাসী মানুষ। ফুলে ঢাকা শরীরটা যখন ভালোপাহাড়ের ‘আশ্রম’ থেকে বাইরে আনা হল তখন চোখে জল নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে ছিল তাঁর হাতে গড়া স্কুলের কয়েকজন ছাত্রছাত্রী। ঢোলকর্তাল বাদ্যে ও কির্তনের তালে তালে বৃক্ষনাথের প্রাণহীন দেহ বাইরে আনা হল। কমলদা লিখেছিলেন ফুলমালা নয়, তাঁর দেহ অন্তিম যাত্রায় শবদেহ ঢাকা থাকবে ‘কৌরব’ এর ছেড়া পাতায়। অবশেষে মুখাগ্নির পর চিতার উপর ছড়িয়ে দেওয়া হল কৌরবের ছেঁড়া পাতা। কমলদার ধর্ম কী? আদৌ কোনও ধর্ম ছিল কি? মানবতার ধর্মের বাইরে! হিন্দু মতে চিতায় পুরুষের দেহ উপুর করে শোয়ানো হয়, স্ত্রী দেহ চিৎ করে। সজ্জ্বিত চিতাকাঠের উপর কমলদাকে চিৎ করে শোয়ানো হল, ঈর্ষনীয় শুভ্র দাড়ি তখন মুখাগ্নির হিংস্র আগুনে পুড়ে কুঞ্চিত, তামাটে। বুকের উপর থেকে পত পত করে বাতাসে উড়ে যাচ্ছে কবিতা ও কাগজের পৃষ্ঠা। আম্রস্মৃতিতে ভেসে উঠছিল প্রায় দুই দশক আগের এক অপরাহ্নের কথা, কক্সবাজারের সমুদ্রতটে কমলদা, শ্যামলকান্তি দাস, সন্দীপ দত্ত, তপন বন্দ্যোপাধ্যায় ও আমি। কমলদা একগুচ্ছ রঙিন বেলুন নিয়ে আকাশে উড়িয়ে দিলেন, আর শিশুর মতো হাসি তাঁর। সেখানে আমি ও কমলদা একঘরে ছিলাম, প্রায় নিশাচর মানুষটা, ভাবাত কমলদা কি ঘুমোতে জানেন না? পরদিন সেখান থেকে ঢাকায়, বিকালে পাঠক সমাবেশে, ওবায়েদ এল। জড়িয়ে ধরে একটা বই উপহার চাইলেন। বয়স হয় না এমন মানুষের, এই কমলদার মৃত্যু নেই।
আমরা পাঁচ বন্ধু, মারুফ, মোস্তাক, অমর, পলাশ তখন ধোঁয়ার ডানা মেলা দেখছি, সেখানে ভাসতে ভাসতে কমলদা বলছেন – ‘খেয়ে যাবি কিন্তু’। মোস্তাক অসাধারণ যত্নে তাঁর ‘গহণ’-এর কমল চক্রবর্তী সংখ্যার কাজ শেষ করে এনেছে, কিন্তু কমলদা তাঁর প্রকাশে থাকছেন না, ধোঁয়ার ভেতর থেকে হাত নাড়ছেন তিনি। মোস্তাকের চোখে জল। “...মানুষ অবাক হচ্ছেই। অসংখ্য পাখির সহমরণ। অসংখ্য গাছ ও লতার সহমরণ। এই অতিপ্রাকৃত দৃশ্য, মূর্ত। আগুনের ফুলে সসজ্জিত কমলের মরদেহ উঠে, আগুনের তুলোয় বসে, হাত নাড়ছে। হু হু পাখির পালক।”
কমলদা লিখেছিলেন – “দূর দূর গ্রামের, বুড়িগড়া, মাকপালি, বকডুবা, রাজগ্রাম, সানবাবা, শালবনি, খরকবন, মকরদেহ। জঙ্গল, রাস্তায় গাছের নীচে নীচে হাজার হাজার মানুষ। কমলদার শেষ যাত্রা হে। শেষবারের কমল। কান্নার বেদায়...।” কমল চক্রবর্তী চিতায় জ্বলছেন, খোলা আকাশের নীচে একটা পূর্ণবয়স্ক দেহ ভস্ম হতে অন্তত তিন ঘণ্টা। আমরা দেশি নেশায় নিজেকে ভুলাতে পাশের হাটে। না, সেই হাটের জনা পঞ্চাশেক আদিবাসী মানুষের কেউ জানেন না – ভালোপাহাড়ের বুঢহা মারা গিয়েছেন। গুটিকয় নিজস্ব পরিচিতির বাইরের কেউ নেই কমল চক্রবর্তীর দাহের সময়। একজন স্রষ্টার কল্পনাকে হারিয়ে দিয়েছে সময়, সময়ের গতিতে একক হয়ে যাওয়া মানুষ। ‘...শাদ্ধের পুন্নপতি বেদন’ -এ কমল চক্রবর্তী তাঁর সক্রিয় যাপিত জীবনের কাছে থাকা স্বজনদের, সাহিত্যের সাথীদের অনেকের উল্লেখ করেছেন, যারা তাঁর শেষ সময়ে শবদেহ ঘিরে এসে দাঁড়িয়ে, তাঁরা কাঁদছেন, স্মৃতিচারণ করছেন। কিন্তু বাস্তব খুব নিষ্ঠুর কমলদা। আট দিন তিনি অজ্ঞান অবস্থায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়েছেন। এরপর শেষ বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু সেই তালিকার প্রায় কোনও কবি সাহিত্যিক অন্তিম যাত্রায় সাথী হতে আসেননি। না, কেউ না। কমল চক্রবর্তীর মৃত্যুর পর সঙ্গে ছবি সহ সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টের বন্যা বয়ে যায়, এঁদের কেউ সাহিত্য ও আশ্রম অন্ত প্রাণ মানুষটার অন্তিম যাত্রায় থাকলেন না। অথচ কমলদার কল্পনা ছিল, দু’পাতা জুড়ে লিখেছিলেন তার সেই স্বজনদের কথা- কমলদার মৃতদেহ ঘিরে তাঁদের কথোপকথন। লেখক তো দ্রষ্টা, কালতীর্ণ - “...আকাশের আগুন নিভে গেলে, কিছু দগ্ধ নক্ষত্র। কিছু, অবশিষ্ট বা অরুন্ধতী প্রতিম জ্বলজ্বল নক্ষত্রে, ফোস্কা। কারণ লেলিহান। সব মুছে, পূর্ণিমার নীলিমা। আসলে দুর্গতি অব্যাহত হয় না। বেদনার কার্ভ ক্রমে নীচু...।”
২০১২ -এ পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অ্যাকাডেমি তাঁকে বঙ্কিম পুরস্কার দিয়েছিল। কমল চক্রবর্তীর অন্যতম প্রধান গদ্য সাহিত্য ‘ব্রহ্মভার্গব পুরাণ’ -এর জন্য। বাংলা একাডেমির বা কবিতা অ্যাকাডেমির কোনও প্রতিনিধি একটা শুকনো ফুল বা শ্রদ্ধা জানাতে হাজির হননি কমল চক্রবর্তীর মরদেহের পাশে, তাঁর অন্তিম যাত্রায়। আসলে হয়ত এটাই প্রকৃতি নির্ধারিত ছিল, প্রাকৃতিক আয়োজনে দাহকর্মের পর আকাশ থেকে নেমে আসা ঝরঝর জলধারায় স্নাত হয়ে ধোঁয়ার ধূসর আলোতে লীন হলেন বাংলা সাহিত্যের – আদি ও অকৃত্রিম রিংমাস্টার।