ডিহি কলকাতার দিন নামা

যুধিষ্ঠিরের নৌকা এগোতে থাকে। বড়বাজার পেরিয়ে যাওয়ার পর ঘনবসতি আর নেই। বরং পারে ঘন জঙ্গল। গোবিন্দপুরটা এখন প্রায় গোরা সাহেবদের দখলে। মেলা সাহেবের বাস এই চত্বরে। যেসব সাহেবদের রেঁস্তো আছে তাঁরা বড় বড় বাড়ি বানিয়ে নিচ্ছে। অধিকাংশ গোরা সাহেবের অবশ্য ভাগ্য অতটা সুপ্রসন্ন নয়। তাদের জন্য রয়েছে ভাড়া বাড়ি।


অল্প কিছুদিনের জন্য যদি কেউ আসে তবে সে টাভার্নে থাকতে পারে। গোবিন্দপুরের দিকটায় বেশ কিছু নতুন নতুন সাহেবি ট্যাভার্ন গড়ে উঠেছে। গোবিন্দপুরে আগে শেঠ বসাকদের বাস ছিল। হুগলি থেকে বাস উঠিয়ে এই শেঠ বসাকরা গোবিন্দপুরে তাঁতের কারখানা বানিয়েছিলেন, বসত করেছিলেন। কিন্তু ফোর্ট উইলিয়াম নতুন করে তৈরির সময় এলাকা দখল নিল কোম্পানি। ঠাঁই নড়া হয়ে শেঠবসাকরা আরও উত্তরে সরে গেল।


উত্তরে এখন সব থেকে জমজমাট জায়গা সুতানুটি। একের পর এক বাজার গড়ে উঠছে সেখানে। তার আগে গঙ্গার পশ্চিম পারে সপ্তগ্রামের বন্দর শুকোতে শুরু করার পর থেকেই হাওড়ার ভেতর জমজমাট হয়ে উঠছিল।
বেতরের উল্টোপারেই প্রায় গার্ডেনরিচ। বড় বড় জাহাজ এসে ওখানেই ভিড়ত। গঙ্গার পূর্বপার জুড়ে বর্গির হাঙ্গামা শুরু হওয়ার পর ব্যবসা-বাণিজ্যের কারবার মূলত গঙ্গার পূর্ব পারে সুতানুটিতে সরে এসেছে। আড়ে বহরে আরো বেড়ে উঠেছে বড় বাজার। বড়বাজারে টাকা লগ্নি করছে উত্তরপ্রদেশ রাজস্থানের বহু ব্যবসায়ী। পলাশির যুদ্ধ পর্যন্ত মূলধনী বাজারের বড় কেন্দ্র ছিল মুর্শিদাবাদে জগত শেঠের কুঠি। বাদশাহী টাঁকশালের পুরো নিয়ন্ত্রণ ছিল জগত শেঠের দখলে। কিন্তু পলাশির যুদ্ধের পর অবস্থা দ্রুত বদলাচ্ছে। কোম্পানি গোবিন্দপুরে লালদিঘির পাড়ে নিজেদের টাঁকশাল বসিয়েছে।


এখনও জাহাজ মূলত এসে বেতর গার্ডেনরিচে ভিড়ছে। তারপর তুলনামূলক ছোট নৌকায় মাল ঢুকছে এবং বেরচ্ছে বড়বাজার সুতানুটি বরানগর দক্ষিণেশ্বর থেকে। ডিহি কলকাতা সুতানুটির এই লোকজন বরানগরের লাগোয়া দক্ষিণের এই নতুন জনপদকে 'দক্ষিণের শহর' বলে ডাকত। সংক্ষেপে সেটাই হয়েছে 'দক্ষিণেশ্বর'।
দক্ষিণেশ্বরে ঈশ্বর ভাবনার কোনও ব্যাপার নেই। বরানগর, কামারহাটি, দক্ষিণেশ্বর জুড়ে শেঠ বসাকদের তাঁতের নতুন নতুন কারখানার বিস্তার ঘটছে।


বরানগরে তাঁতিরা এখন ডাচদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে কাজ করছিল। তবে কতদিন টিকতে পারবে বলা মুশকিল। কারণ পলাশির যুদ্ধের পর কোম্পানি এখন অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকদের এলাকায় এলাকায় কোনঠাসা করতে শুরু করেছে। ডাচেদের কুঠির কারণে বরানগরের একটা এলাকার নতুন নাম এখন 'কুঠিঘাট।'
ভাঁটার টানের মুখে যুধিষ্ঠিরের নৌকো দ্রুত এগোচ্ছিল। জটা কেশের কাক কাঁধ থেকে উড়ে গিয়ে গঙ্গার খুব কাছাকাছি নেমে গিয়ে ফের ফেরত আসে। নৌকার ছয়ের উপর বসবার আগে অস্থিরভাবে কিছুটা ডানা ঝাপটায় সে। জটাকেশ একবার তার কাকের দিকে তাকায়। তারপর নদীর স্রোতের দিকে একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অতঃপর ফের আকাশের দিকে তাকায়। যুধিষ্ঠিরের দিকে ফিরে বলে, আজকালের মধ্যে কি ভাদ্রের ষাঁড়াষাঁড়ির বান আসার সম্ভাবনা? যুধিষ্ঠির বলে, গনের হিসাব মত আজ বেশি রাতের দিকে আসতে পারে। তারপর যুধিষ্ঠির কালুর দিকে ফিরে বলে, রাতে তো তুই নৌকায় একা থাকবি। একটু হুঁশিয়ার থাকবি।


যুধিষ্ঠিরদের নৌকা মালবাহী নৌকা। ভারী গরণ। মালবহনের জন্য খোলের মধ্যে নিচের জায়গা অনেকটা প্রশস্ত। ওজনও বেশি। চট করে কোথাও ভেসে যাওয়ার নয়। তাছাড়া ওদের নৌকা রাতে থাকবে আদি গঙ্গার খালের ভেতরের দিকে। খোলা গঙ্গার উপর নয়। তবু কাছি যদি দুর্বল থাকে শক্ত বানের মুখে নৌকাকে ছিঁড়ে নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। হুঁশিয়ার থাকাই ভাল। যুধিষ্ঠির জটাকেশদের নৌকা আরও দক্ষিণের দিকে এগোয়।


গোবিন্দপুরে ইংরেজদের নতুন দুর্গের পর বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে ফাঁকা ময়দান। দুর্গের প্রয়োজনেই তা ফাঁকা রাখা হয়েছে। দুর্গের এলাকা জুড়ে কাটা পরিখা। সেখানে জোয়ার ভাঁটায় গঙ্গার জল ঢোকা বেরোনো করে। সাহেবরা দুর্গের সামনে ফাঁকা জায়গাটাকে বলে 'এসপ্ল্যানেড'। গড়ের এলাকা পার হওয়ার পর পুবের দিকে হেস্টিংস সাহেবের বড় বাংলো আর তার হাতা এলাকা। হেস্টিংস -এর বাংলো আর গঙ্গার মাঝখানজুড়ে ভিন রাজ্য থেকে আসা হাজার হাজার কুলিদের নতুন বসত গড়ে উঠেছে। সেই থেকে জায়গার নাম হয়েছে কুলি বাজার।


কিছুদিন আগে এই কুলি বাজারের মোড়েই মহারাজ নন্দকুমারকে ফাঁসিতে ঝোলালো কোম্পানির বিচার। ব্ল্যাক টাউনের লোকেরা এখনো নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে, হেস্টিংস -এর বিরোধিতা করাই কাল হল নন্দকুমারের। মিথ্যা প্রতারণার মামলায় যদি নন্দকুমারকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয় কুলিবাজারের মোড়ে, শহরের বহু মানুষ ব্রহ্ম হত্যার পাড়ানোর জন্য শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিল। মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর বহু মানুষ ব্রহ্ম হত্যার পাপ যাতে ছুঁতে না পারে তার জন্য ঝাঁপ দিয়েছিল গঙ্গায়। কুলিবাজার অনেকটা টানা ব্যারাকের মতো। ভাড়ায় নেওয়া বস্তি ঘরের স্বাচ্ছন্দ্য সেখানে নেই। প্রতিবেশী রাজ্য থেকে এবং সাঁওতাল পরগনার দিক থেকে বহু মানুষ এসে মাথা গুঁজেছে এই কুলি বাজারে। বহু ক্ষেত্রে দফাদাররা বিভিন্ন ভুজুং ভাজাং দিয়েও সহজ সরল আদিবাসী মানুষকে এখানে নিয়ে এসেছে। শহর আড়ে বহরে ক্রমশ বাড়ছে। নিত্যনতুন নির্মাণ কর্মীর টানাটানি। মাঝে মাঝে কোম্পানিকে ফতোয়া জারি করতে হয় 'আপাতত বেসরকারি কোনও নির্মাণকার্য চলিবে না।' কারণ কোম্পানির নিজের কাজে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না।


শহরের বড় মানুষ এবং কোম্পানির বড় কর্তারা অনেক সময় কোম্পানি যে মজুরি দিয়ে কাজ করায় তার থেকে তুলনামূলক বেশি পয়সা দিয়ে সমস্ত নির্মাণ শ্রমিক নিয়ে নিচ্ছে। কোম্পানি বাধ্য হয়ে দফাদার বলে এক ধরনের কর্মচারী নিয়োগ করেছে যাদের মূল কাজ আড়কাঠির ভূমিকা পালন করে বিভিন্ন জায়গা থেকে কুলি এবং নির্মাণ শ্রমিক জোগাড় করে শহরে নিয়ে আসা। অবশ্য গ্রামাঞ্চলে মাঝে মধ্যে দুর্ভিক্ষ হানা দেয়। উৎকলের বড় এলাকা মারাঠা শক্তির পতনের পর টালমাটাল অবস্থায়। সুতরাং বাংলার প্রতিবেশি উড়িষ্যা থেকেও বহু মানুষ এই কুলি বাজারে ভিড় করেছে।


বছর ৩০ আগে বালেশ্বর থেকে প্রায় সাত হাজার উৎকলবাসী যুবক গোপীবল্লভপুরের দিক দিয়ে পায়ে হেঁটে কলকাতায় ঢোকে কাজের সন্ধানে। তারা একজোট হয়ে এই কুলি বাজারে বসত গেড়েছে। তবুও ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে বাংলার প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যাবার পর কলকাতা শ্রমের বাজারে যোগানে ঘাটতি সামলে ওঠা যায়নি। দুর্ভিক্ষের বছরেও কোম্পানি কসাই -এর মত খাজনা আদায় করেছে। এরকম ব্যবস্থা দেশের মানুষ আগে কখনও দেখেনি।


বাদশাহি এবং সুলতানি আমলে অনাবৃষ্টি এবং দুর্ভিক্ষ হলে অন্তত দু'বছর খাজনা মকুব হত। রাজকোষ থেকে কৃষকদের 'তাকভি' ঋণ দেওয়া হত নতুন করে বীজ সংগ্রহের জন্য। কোম্পানির আমলে সেসবের কোনও বালাই নেই। কুলি বাজারের পশ্চিমে বহমান গঙ্গা। কুলি বাজারের আলো, অন্ধকার চিরে মাঝে মাঝেই চোখে পড়ছে। দিনশেষে শ্রমজীবী মানুষের হাল্লা এবং এলোমেলো গানের আওয়াজ ভেসে আসছে। আচমকা কুলি বাজারের দিকে বড় কোলাহল ওঠে। কয়েকশো মশালের আলো দাপাদাপি করতে শুরু করে। সঙ্গে প্রবল চিৎকার সমবেত কন্ঠে।
নৌকায় থেকেও যুধিষ্ঠির জটাকেশরা চমকিত হয়ে ওঠে। আচমকা গম্ভীর এক শার্দুল কন্ঠের হুংকার ভেসে আসে। যুধিষ্ঠির নৌকাটাকে মাঝনদীর দিকে ঠেলতে ঠেলতে ত্রস্ত গলায় বলে, বাবা দক্ষিণরায় বেরিয়েছে গো।
(চলবে)

  • সুমিত চৌধুরী
  • পর্ব ৬