বাইবেল নয় প্রবাদকে হাতিয়ার করে সারা বিশ্বের মানবজীবনকে জানতে চেয়েছিলেন এক খৃস্টান ধর্মযাজক, তাও আবার বিগত শতাব্দীতে নয়, তারও আগের শতাব্দীতে। আসলে তিনি একজন প্রকৃত বিদ্বজ্জন ছিলেন। তাঁর অনন্য জ্ঞানপিপাসা তাঁকে কেবল ধর্মতত্ব নয় হিব্রু, গ্রিক, ল্যাটিন ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষ করে তোলে, পাশাপাশি বীজগণিত ও পাটিগণিতের পাশাপাশি ইতিহাস ও ভূগোল শস্ত্রেও পারঙ্গম করে। তিনি জেমস লঙ (১৮১৪-৮৭)। ২৬ বছর বয়সে কলকাতার উপকণ্ঠে ঠাকুরপুকুরের খৃষ্টান মিশনের দায়িত্ব নিয়ে তিনি কলকাতায় আসেন এবং জীবনের একটি বড় সময় এখানেই কাটান। এখানে থাকাকালীন তাঁর অশেষ পরিশ্রমলব্ধ গ্রন্থ ‘বাংলা প্রবাদ’ (১৮৫১) প্রকাশিত হয়, যা বাংলা সাহিত্যের এক মূল্যবান সম্পদ। পরবর্তী দুই দশক ধরে তিনি বাংলা প্রবাদ বাক্য ও লোকসাহিত্য নিয়ে প্রভূত কাজ করেন। তাঁর অসাধারণ মেধা ও পরিশ্রমের সাক্ষ্য বহন করছে বাংলা প্রবাদের এক অসাধারণ সংগ্রহ, যার সংখ্যা প্রায় সাত হাজার। এই অসামান্য ভারতপথিককে নিয়েই একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন ড. সুরঞ্জন মিদ্দে। দুষ্প্রাপ্য সেই প্রবাদগুলো কেবল দুই মলাটের মধ্যে আনা নয়, সেগুলো নিয়ে মননঋদ্ধ আলোচনাও তিনি করেছেন এতে।
মনীষী জেমস লঙ গভীরভাবে বুঝতে পেরেছিলেন জনপ্রিয় প্রবাদসমূহ থেকেই একটি জাতির মানসলোকের সন্ধান পাওয়া যায়। তিনি বিশ্বাস করতেন ওইসব প্রবাদসমূহের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে হারিয়ে যাওয়া অনেক ইতিহাস। তাই অশেষ পরিশ্রমে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে ঘুরে বাংলার নানারকম প্রবাদ সংগ্রহ করেছেন তিনি। অতি বিস্ময়কর তাঁর সেই সংগ্রহ। এক জীবনে এতটা সংগ্রহ করা যে কোনও মানুষের পক্ষেই দুঃসাধ্য। বলাবাহূল্য সেই অসাধ্যসাধনও করে গেছেন তিনি। তবে শুধু সংগ্রহ করাই নয়, সেগুলো একত্রগ্রথিত করে রেখে গেছেন উত্তরকালের মানুষদের জন্য।
তবে জেমস লঙ বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁর আরেকটি কাজের জন্যে। তিনি তাঁর আমহার্স্ট স্ট্রিটের সিএমএস স্কুলের ছাত্র দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি হাতে পেয়ে অত্যন্ত বিচলিত বোধ করেন। ১৮৬১ সালের সেই নীলকর সাহেবদের চরম অত্যাচার ও এ দেশিয় মানুষদের সঙ্গে দাসসুলভ আচরণের জ্বলন্ত বর্ণনা তাঁকে অত্যন্ত বিক্ষুদ্ধ করে তোলে। তিনি ওই বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে বাংলার গভর্নরের সচিব ও ইন্ডিগো কমিশনের সাবেক সভাপতি হেনরি সেটন করের নজরে আনেন। এমনকি পরবর্তীকালে লেফটেন্যান্ট গভর্নর জন পিটার গ্রান্টের সঙ্গে কথা বলেন। গ্রান্ট নাটকটির অনুবাদের কয়েকটি কপি চান। জেমস লঙ তখন ‘বাই এ নেটিভ’ বেনামে এবং স্বরচিত ভূমিকাসহ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। পরবর্তীকালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ট্রায়াল কোর্টে অনুবাদকের নাম প্রকাশ করতেও অস্বীকার করেন। ফলে এর অনুবাদক হিসেবে মাইকেল মধুসূদন দত্তকে ধরা হলেও বিতর্কটি অমীমাংসীতই থেকে যায়। তবে নিজের উদ্যোগে লঙসাহেব নাটকটির ইংরেজি অনুবাদের কপি বিভিন্ন জায়গায় পাঠান। ফলে সেই সময়ে ব্যাপারটি নিয়ে বেশ আলোড়ণ সৃষ্টি হয়। স্বভাবতই অনুবাদকর্মে প্রকাশিত নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের ধরন আর তাতে লঙ সাহেবের প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ প্রশাসনকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। অবশেষে নাটকের ভূমিকায় অপবাদ দেওয়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দুর্নামের কারণে অনুবাদক ও প্রকাশকের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা রুজু করা হয়। ১৮৬১ সালের ১৯শে জুলাই থেকে ২৪শে জুলাই – এইটুকু সময়ের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে চলা শ্বেতাঙ্গদের নিয়ে গঠিত জুরি বোর্ডের বিচারক এম এল ওয়েলস জেমস লঙকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দিয়ে তাঁকে এক হাজার টাকা জরিমানা ও এক মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেন। বাংলার প্রখ্যাত কথাকার কালীপ্রসন্ন সিংহ তাৎক্ষণিকভাবে আদালত কক্ষেই ওই জরিমানার টাকাটা দিয়ে দেন। তবে নিজে একজন শ্বেতাঙ্গ হয়ে এ দেশের অত্যাচারিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তাঁর এই ভূমিকাকে সেই যুগের প্রেক্ষিতে অবিস্মরণীয় বললেও কম বলা হয়।
‘নীলদর্পণ’ কাণ্ডের পর তিনি তিন বছর দেশে কাটিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে আবার কলকাতায় আসেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে কলকাতায় অবস্থানকালে তাঁর প্রধান কর্মস্থল ছিল ঠাকুরপুকুর। ইতোমধ্যে (১৯৬৭) স্ত্রীর মৃত্যু ঘটলে তিনি কলকাতায় তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু ও সহকারি রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে একই বাসায় অবস্থান করতে থাকেন। ওই সময়ে তিনি চেষ্টা করেছিলেন ব্রিটিশ উপনিবেশকারিদের সঙ্গে এ দেশিয় মানুষদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার। ১৮৭২ সালে রেভারেন্ড জেমস লঙ চার্চ মিশনারি থেকে সোসাইটি থেকে অবসর নেন এবং চিরতরে কলকাতা তথা ভারত ত্যাগ করেন। বাকি জীবন তিনি লন্ডনেই বিবিধ গ্রন্থ রচনা করে অতিবাহিত করেন।
তবে পাদরি লঙ চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁর প্রবাদ সংগ্রহের জন্যে। শুধু বাংলার নয়, ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশসহ
বিভিন্ন দেশের প্রবাদের মধ্যে যে এক ধরনের অন্তর্মিল আছে, তাও তিনি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। তবে বাংলা তথা এখানকার জনজাতির মুখে মুখে ছড়ানো প্রবাদমালার মধ্যে যে নৃতাত্বিক পরিচয় ফুটে উঠেছে সত্যি সত্যি তা আমাদের দীর্ঘদিনের যাপনবৃত্তান্তের পরিচয় জ্ঞাপনে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে।
১৮৫১ সালে লঙ সাহেবের প্রবাদমালার প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হলে বিদ্বজ্জন মহলে সাড়া পড়ে যায়।প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে বাংলা গদ্যের উন্মেষপর্বে বাংলা প্রবাদ নানাভাবে লেখকদের প্রভাবিত করে। ‘আলালের ঘরের দুলাল’, ‘বুড় শালিকের ঘারে রোঁ’, ‘কুড়ে গরুর ভিন্ন গোঠ’, ‘ জাত থাকাত কী উপায়’, ‘সধবার একাদশী’, ‘কৃপণের ধন’, ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’, ‘যেমন রোগ তেমনি বোঝা’ ইত্যাদি উদাহরণ তো হাতের কাছেই আছে। কে না জানে জন-সংযোগ তথা জন-শিক্ষার অন্যতম বাহন এই প্রবাদ। এই আপ্তবাক্যটিকে সম্বল করে লঙ সাহেব বিপুল উদ্যোগে সমগ্র দেশের প্রবাদ সংগ্রহে মেতে উঠেছিলেন। দেশিয় প্রবাদের পাশাপাশি তিনি বেশ কিছু বিদেশি প্রবাদও সংগ্রহ করেছিলেন। সেই প্রবাদ্গুলোর মধ্যে নানারকম অন্তর্মিলও তিনি আবিষ্কার করেন। তাঁর এই সংগ্রহের অনুবাদকর্মে এ দেশের দু’জন বাঙ্গালি কবির অবদান অনস্বীকার্য। একজন হলেন নবীনচন্দ্র বন্দ্যোপাধায়, অপরজন রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। এঁরা দু’জন ওইসব প্রবাদগুলোকে বাংলা ভাষাতে রূপান্তর করে দিয়েছেন অত্যন্ত সরস ভঙ্গিতে। তাই লঙ সাহেবকে কুর্নিশ জানাবার সময়ে এই দু’জনকেও মনে রাখতে হবে। কেননা এঁদের সাহায্য ছাড়া ওই প্রবাদ্গুলো সেইভাবে প্রাণবন্ত হয়ে উঠত না।
১৮৭২ সালে ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে লঙ সাহেব প্রবাদচর্চায় পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ১৮৭৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘ওরিএন্টাল প্রোভার্বস’ নামের একটি মূল্যবান গ্রন্থ। এখানেই শেষ নয়, আরও পাঁচ বছর পরে (১৮৮১) তাঁর সর্ব শেষ গ্রন্থ ‘ইস্টার্ন প্রোভার্বস আন্ড এমব্লেমস’ প্রকাশিত হলে সকলেই অনুভব করেন তাঁর গভীর প্রাচ্যপ্রেম। ওই গ্রন্থ প্রকাশের কিছুকাল পরে ১৯৮৭ সালে এই মহান ভারতপথিকের জীবনাবসান হয়। বলাবাহুল্য বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে দিয়ে যাবার জন্যে আমরা তাঁর কাছে চিরঋণী। অত্যন্ত আনন্দের কথা এই যে তাঁর মৃত্যুর এত বছর পরেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আলোচনায় তাঁর ঋণ কৃতজ্ঞচিত্তে আমরা স্মরণ করি।
ঠাকুরপুকুরের মানুষেরা তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্যে ওই এলাকার একটি রাস্তার নামকরণ করেছেন জেমস লঙ সরণি। ইদানিং দাবি উঠেছে ওখানকার প্রস্তাবিত মেট্রো স্টেশন তাঁর নামেই নামাঙ্কিত করার জন্যে। বিষয়টির বাস্তবায়নের জন্যে কেবল সময়ের অপেক্ষা। তবে ২১০ বছর আগে জন্ম নেওয়া একজন ধর্মযাজকের জন্যে কলাকাতার মানুষ তথা গবেষক তথা জ্ঞানপিপাসুদের তৃষ্ণা মেটাবার জন্যে ড. সুরঞ্জন মিদ্দের এই অসাধারণ উদ্যোগ অবশ্যই ধন্যবাদার্হ।এই গ্রন্থে জেমস লঙ সংগৃহীত প্রবাদ্গুলো পর্বে পর্বে বিভাগ করে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। অশেষ পরিশ্রম করে সম্পাদক একটি অসাধারণ ভূমিকা গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছেন। সে যুগে ফটোগ্রাফি না থাকায় লঙ সাহেবের একটিমাত্র প্রতিকৃতি যা পাওয়া গেছে সেটি অবলম্বন করেই অসামান্য প্রচ্ছদশোভিত এই গ্রন্থ নিশ্চয়ই পাঠকনন্দিত হবে। সম্পাদক ড. সুরঞ্জন মিদ্দেকে পুনর্বার ধন্যবাদ জানাই।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------- পাদরি লঙ-এর প্রবাদমালা * সম্পাদনা – সুরঞ্জন মিদ্দে * নান্দনিক * ২০২৪ * প্রচ্ছদ –চঞ্চল গুইন * মূল্য ৪৫০ টাকা