ভাবপ্রকাশ বনাম রূপপ্রকাশ

ভাবের ভণিতায় রূপের বিসর্জন- এটা যদি সার্বজনীন হতে থাকে তবে কি গান মুক্তির উচ্চ শিখরে ওঠবার এতটুকু অভিপ্রায়ী উঠবে আগামী দিনে--
 
এই সপ্তাহটা দেবব্রত বিশ্বাসের চলে যাওয়ার সপ্তাহ। '৮০ সালের ১৮ ই আগস্ট জর্জমামা চলে যান।দেবব্রত বিশ্বাস।কেন তাঁকে ,' জর্জমামা' বললাম? আমার জ্যেঠু কলিম শরাফির সূত্রে শাঁওলীদি, শাঁওলী মিত্রের ' জর্জমামা' যে সেই কোন ছোটবেলায় আমার ও ,' জর্জমামা' হয়ে গিয়েছিলেন।
আসলে ট্রাঙ্গুলার পার্কের কাছে সেই ছোট্ট আস্তানা।সেখানেই তো আমার জ্যেঠু,কলিম শরাফি, '৪৬ এর ১৭ ই আগস্ট আশ্রয় পেয়েছিলেন তাঁর ' জর্জদা' র কাছে।আলো কুন্ডুর মত , দেবব্রত ভাঙিয়ে , করে কম্মে খাওয়া লোকেরা তখন ও জর্জ মামার থেকে অনেক, অনেকটাই দূরে।
দেবব্রত নিজেকে মন্ত্রহীন , ব্রাত্য বলতে ভালোবাসতেন রবীন্দ্রনাথের গানের প্রেক্ষিতে।যেহেতু তাঁর গানে ব্যবহৃত যন্ত্রানুসঙ্গ ঘিরে এককালে বিশ্বভারতী সঙ্গীত সমিতির কিছু বক্তব্য ছিল, আর সেই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত হতে পারেন নি দেবব্রত।তাইমান অভিমান শেষ পর্যন্ত পরিণত হয়েছিল সংঘাতের আবর্তে।দেবব্রতের এই যে বিশ্বভারতীর সঙ্গে দূরত্ব তৈরির সময়কাল, সেই কালে বিশ্বভারতী এবং দেবব্রত , উভয়ের ই প্রবল আস্থা ছিল জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের প্রতি।কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রের হঠাৎ মৃত্যু সবটা এলোমেলো করে দেয়।
কিন্তু সম্পর্কের মেরামত হওয়ার রাস্তাটা বন্ধ করে দেয় কিছু লোক দেবব্রতের কাছে বিশেষ প্রিয় হয়ে ওঠার প্রত্যাশায়।অভিমানী দেবব্রত তখন বন্ধুর বেশে জড়ো হওয়া শত্রুদের চিনতে ভুল করেন। যেমন দেবব্রতের তাস খেলার সঙ্গী ছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের এক অসামান্য ট্রেনারের স্বামী।কমিউনিস্ট পারটির আদি যুগের কর্মী দেবব্রত , '৪৯ পর্ব, বি টি রণদিভের সাংস্কৃতিক লাইন-- এসব ঘিরে প্রত্যক্ষ ভাবে আর কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন নি।কিন্তু ছয়ের দশকের গোড়াতে কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে যাওয়াটা তাঁকে দুঃখ দিয়েছিল। সেই দুঃখের জায়গা থেকেই পুরনো পার্টির প্রতি দেবব্রতের কিঞ্চিৎ পক্ষপাতিত্ব ছিল।
সেই রবীন্দ্রসঙ্গীত ট্রেনার ছিলেন আদি পার্টির সদস্য। আর তাঁর হাতের খুব সামান্য মশলার রান্নার গুণগ্রাহী কে ছিলেন না? স্বামীর সঙ্গে জর্জদার বন্ধুত্ব, তাসখেলা, পানাহার-- এসবের সুযোগ নিয়ে সেই ট্রেনার বিষ ঢালতে শুরু করলেন দেবব্রতের কানে; সুচিত্রাদি( মিত্র) ই বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডে আটকেছেন আপনার গান। 
হতবাক হয়ে গেলেন দেবব্রত।তাঁর ' দিদিমণি' অমন করতে পারেন? 
বয়সে দেবব্রত, সুচিত্রার থেকে অনেকটাই বড়ো।তবু সুচিত্রা তাঁকে ডাকতেন' জর্জ' ।আর জর্জ , সুচিত্রাকে ডাকতেন, ' দিদিমণি' ।
আসলে আমরা দেবব্রতের আঙ্গিক বলে যেটার প্রচার করি, জর্জমামা নিজে যেটাকে বলতেন ' বুইঝ্যা শুইন্যা গাইও' ,সেটা আসলে জ্যোতিরিন্দ্র মিত্র, জর্জমামার ,' বটুকদা' র আঙ্গিক। নিজস্ব বৃত্তের বাইরে বৃহত্তর জনমানুষে হয়তো জ্যোতিরিন্দ্র নিজেকে খুব একটা মেলতে পছন্দ করতেন না।রাজনৈতিক বৃত্তেল বাইরে খুব একটা বোধহয় তিনি স্বচ্ছন্দ বোধ ও করতেন না।তাই দেবব্রতের যে জনপ্রিয়তা ছিল, সাধারণ মানুষ সেভাবে চেনবার , জানবার সুযোগ পায় নি জ্যোতিরিন্দ্রকে। মাত্র একটি গ্রামাফোন ডিস্কে জ্যোতিরিন্দ্রের গাওয়া দুটি গান, ' জগতে আনন্দযজ্ঞে ' আর ' এ ভারতে রাখো নিত্য' ধারণ করা আছে।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টির পর জ্যোতিরিন্দ্র যখন ঢাকা যান, সেখানকার দূরদর্শনের পক্ষ থেকে তাঁর একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন কলিম শরাফি।সেটি এপার বাংলার খুব কম মানুষের ই শোনবার সুযোগ হয়েছিল।
জ্যোতিরিন্দ্রের হঠাৎ মৃত্যু যেন প্রথাগত ভাবে রবীন্দ্রনাথের গান না গাইবার জন্যে দেবব্রতকে আরো জেদি করে তুললো।আর সেই ট্রেনার আর তাঁর স্বামী দেবব্রতের মানসিক অবস্থা বুঝে নানা ভাবে তাঁর কান ভারী করতে লাগলেন।বিষয়টা তখন এমন ও হয়েছল যে, তাঁর বৌদি , যাঁর সঙ্গে দ্বৈত কন্ঠে ,' হিংসায় উন্মত্ত পৃত্থী ' আর ,' সর্বখর্বতরে দহে ' জীবনে প্রথম রেকর্ড করেছিলেন দেবব্রত, সেই কণক বিশ্বাসের বোঝানোকেও তিনি তখন খুব একটা পরোয়া করলেন না।
দেবব্রতের অভিমানের মাত্রাটিও ছিল বড় তীব্র।একমাত্র বোধহয় অনন্ত, তাঁর দীর্ঘদিনের পরিচারক , সেই কখন ও কখন ও পারতো শিল্পীর সেই অভিমান ভাঙাতে।আসলে ব্যক্তি জীবনের ঝড়ো উত্তাপ ই বোধহয় দেবব্রতকে সময়ে সময়ে অতটা অভিমানী করে তুলতো।সেই অভিমানের সুযোগ নিতে অনেকেই ছাড়ে নি। দেবব্রতের প্রয়াণের পর তাঁকে ঘিরে ব্যবসা করে নিজেদের আখের গুছিয়েছে তারা।বিনময়ে তৈরি করে দিয়েছে তাদের জর্জদাকে ঘিরে অন্তহীন বিতর্ক।সেই বিতর্ককে মুলধন করে ই আলো কুন্ডুর মত লোকেরা দেবব্রত ভাঙিয়ে নিজেদের আর্থিক লাভ ঘটিয়েছে।
ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন;" ....বাংলাদেশে সংগীতের প্রকৃতিগত বিশেষত্ব হচ্ছে গান, অর্থাৎ বাণী ও সুরের অর্ধনারীশ্বর রূপ।কিন্তু, এই রূপকে সর্বদা প্রাণবান করে রাখতে হলে হিন্দুস্থানী উৎসধারার সঙ্গে তার যোগ রাখা চাই।আমাদের দেশে কীর্তন ও বাউল গানের বিশেষ একটা স্বাতন্ত্র্য ছিল, তবুও সে স্বতন্ত্র্য দেহের দিকে; প্রাণের দিকে ভিতরে ভিতরে রাগরাগিনীর সঙ্গে তার যোগ বিচ্ছিন্ন হয় নি।" ( সংগীত চিন্তা,পৃ- ১২৩) 
বাণী ও সুরের অর্ধনারীশ্বর রূপের যে কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-- এই সমন্বয়ী চিন্তাকে ব্যক্তি স্তরে অস্বীকার করবার অধিকার একজন মানুষ হিসেবে সকলের আছে।কিন্তু যখন সমষ্টিগত ভাবে রবীন্দ্রনাথের গান পরিবেশন করা হবে, তখন রবীন্দ্রনাথের এই ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়ার অধিকার কার ও নেই।সেকাল- একাল বা ভাবীকাল-- সব কালের শিল্পীদের ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য।যদি সুর ও বাণীর এই অর্ধনারীশ্বর রূপকে কেউ মান্যতা দিতে না চান, অস্বীকার করতে চান, সহজেই তিনি অন্য যেকোনো গান গাইতে পারেন।পারেন না রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে।
সেই কারনেই সন্তোষকুমার ঘোষ লিখেছিলেন; সৃষ্টি বনাম স্রষ্ঠা। না বুঝে অনেকেই সেদিন খড়্গ হস্ত হয়েছিলেন সন্তোষকুমার ঘোষের প্রতি।অনরাগ অন্ধভক্তিতে রূপান্তরিত হলে যুগে যুগে, কালে কালে, দেশে দেশে যা ঘটেছে, যা ঘটবে আগামী দিনে- তেমনটাই ব্যাপার সেদিন ঘটেছিল আর কী।
কেউ অনুধারন করবার চেষ্টাই হয়তো করেন নি ধূর্জটি প্রসাদ কে লেখা রবীন্দ্রনাথের এই পঙতি;" প্রথম বয়সে আমি হৃদয়ভাব প্রকাশ করবার চেষ্টা করেছি গানে, আশাকরি সেটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি পরে।পরিণত বয়সের গান ভাব - বাৎলাবার জন্যে নয়, রূপ দেবার জন্য।তৎসংশ্লিষ্ট কাব্যগুলিও অধিকাংশই রূপের বাহন।' কেন বাজাও কাঁকন কনকন কত ছলভরে'- এতে যা প্রকাশ পাচ্ছে তা কল্পনার রূপলীলা।ভাবপ্রকাশে ব্যথিত হৃদয়ের প্রয়োজন আছে,রূপপ্রকাশ অহৈতুক।মালকোষের চৌতাল যখন শুনি তাতে কান্নাহাসির সম্পর্ক দেখি নে, তাতে দেখিগীতরূপের গম্ভীরতা।যে বিলাসীরা টপ্পা ঠুংরি বা মনোহরসাঞী কীর্তনের অশ্রু- আর্দ্র অতিমিষ্টতায় চিত্ত বিগলিত করতে চায়,এগান তাদের জন্য নয়।আর্টের প্রধান আনন্দ বৈরাগ্যের আনন্দ, তা ব্যক্তিগত রাগদ্বেষ হর্ষলোক থেকে মুক্তি দেবার জন্য।সংগীতে সেই মুক্তির রূপ দেখা গেছে ভৈরোঁতে, তোড়িতে ,কল্যাণে , কানাড়ায়।আমাদের গান মুক্তির সেই উচ্চশিখরে উঠতে পারুক বা  না পারুক , সেই দিকে ওঠবার চেষ্টা যেন ।"এই চিঠিটি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন '৩৫ সালের ১৩ই জুলাই।( ঐ,পৃ- ১৬৬) 
রবীন্দ্রগানে ভাবপ্রকাশ-- এটা কি শিল্পী নিজের ইচ্ছে মত করবেন? নাকি স্রষ্ঠা যেমনটা চেয়েছিলেন ,তাকে মর্যাদা দেবেন? ঋতুপর্ণ ঘোষের ' চোখের বালি' দেখে শান্তিদেব ঘোষ জায়া ইলা ঘোষ বলেছিলেন; পরিচালক নিজের ' চোখের বালি' ফিল্ম করলেই পারতেন।গুরুদেবকে কেন টানতে গেলেন? 
সেই কথাই যেন রবীন্দ্রনাথের গানে ' রূপপ্রকাশ' ঘিরে বার বার মনে হয়।রূপপ্রকাশের গুঁতোয় ভাবপ্রকাশের ব্যথিত হৃদয়ের কথা যে ব্যথায় কোথায় ডুবে যায়, তার খোঁজ শিল্পী রাখেন না বলেই, সে খোঁজের সুলুকসন্ধান মেলে না শ্রোতার ও।তাঁর গানে তানকর্তব ঘিরে স্নেহের মন্টুর ( দিলীপকুমার রায়) সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কথোপকথনের বিস্তারিত আলোচনা করেছেন শঙ্খ ঘোষ।তারপর ও বহু যুগ কেটে গেছে।এই সেদিন নৈহাটির ঐকতান মঞ্চে এক নতুন শিল্পী আর এক প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর কন্ঠে রবীন্দ্রনাথের দুটো একটা গান শুনলাম।রূপপ্রকাশের অহৈতুকতা গানের যে অন্তর্জলীযাত্রা ঘটাচ্ছে-- তা নিয়ে দেখলাম, নবীন- প্রবীণ-- কোন ও প্রজন্মের ই এতটুকু ভাবান্তর নেই।

  • সম্পাদকীয়