কালি প্রসাদের আর টলি সাহেবের গল্প শেষ হতে
কানাই এবার বললো, ভাইটি চলো আমরা বেলাবেলি এগোই। ভাদ্দরে বেলা বেড়ে গেছে ঠিক। তবু বিকেল বিকেল নৌকা ছাড়তে পারলে সুবিধা হবে। রাতের মধ্যে কালীঘাট ঢুকে গিয়ে সকালে মাকে দর্শন করে নেওয়া যাবে।
জটাকেশ বললে, কালীঘাটের মাকে দর্শন করবে,আর শঙ্কর ঘোষের ঠনঠনের সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরে যাবে না? এখান থেকে তো বেশি দূরে নয়।
কানাই বললে, ওখানে শংকর ঘোষের মন্দির কোনটা? কামাক্ষ্যার সাধুর মন্দির যেটা ছিল সেইটা?
জটাকেশ বললে, হ্যাঁ। শঙ্কর ঘোষ তো সাধুর মন্দিরটা সংস্কার করেছে । তাও ৫০-৬০ সন হয়ে গেল।
কালাই বললে, আচ্ছা মন্দিরের নাম ঠনঠনে কালীবাড়ি কেন?
নামটা কিন্তু অদ্ভুত।
জটাকেশ বললে, শহর কলকাতায় চুরি ডাকাতি এখনো এমন কিছু কম নয়। আগে তো আরো বেশি ছিল। এখন লালবাজারের লোক লস্কর তাও একটু বেড়েছে। লাল পাগড়ি হাবিলদার পাঁচজন নতুন বহাল হয়েছে। সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরের পশ্চিম দিকে গঙ্গার উপরে যে শ্মশান ছিল ,
সেখানেই তো সুতানুটির লোকজনের দাহকার্য হত।
চোর বাগানের পশ্চিমের জায়গাটায় মাঝে মাঝেই রাহাজানি লুটপাট হতো। যদি ওই দিক থেকে লুটপাটের খবর আসতো তাহলে সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির থেকে ঠনঠন করে ঘন্টা বাজতো।
লোককে হুঁশিয়ার করে দেওয়ার জন্য। তার থেকেই নাম হয়েছে ঠনঠনে কালী বাড়ি।
ছিদাম বললো, বাপরে! এ কাহিনী তো আমিও জানতাম না।
কানাই বললে, এখন তো বেলা পড়ে এল। কালকে সকাল সকাল ফেরার পথে যদি পারি একবার ঢুকবো। চিৎপুরের রাস্তা থেকে চোর বাগানের দিকে সোজা পূব হাঁটলেই তার মানে পেয়ে যাব মন্দির?
জটাকেশ বললো, একদম।
ছিদাম জটাকেশকে বললো, দাদা বলছিলাম কি, শোভাবাজারের গদি ঘরে একবার মুখ দেখিয়ে আমিও ঘাটে চলে যাব। ওখানে কানাই দারা তো থাকবেই। তুমিও চলে এসো ওখান থেকে না হয়। একবার বাগবাজারের ঘাটে গিয়ে উঠে কৃপে ময়রার দোকানের মিষ্টি খেয়ে আসা যাবে। দাদারা এলো। আদর যত্ন কিছুই করা হলো না।
কানাই বললে, এতো ভালো কথা ভায়া। বৈরাগীকে সঙ্গে নিয়ে নেব। কালু নৌকা দেখবে।
কৃপে তো আমাদের হুগলির
গুপ্তিপাড়ার লোক। কলকাতায় দোকান দিয়েছে শুনেছি। তা কৃপে ময়রার দোকান বাগবাবাজারে নাকি?
জটাকেশ বললে, হ্যাঁ। কৃপে ময়রা বাগবাজারেই এই দোকান দিয়েছে। ঠিক আছে। তোমরা এগোও। আমি পায়রা গুলোর খাঁচা একটু ঠিকঠাক করে যাচ্ছি।
ছিদাম ও কানাই চিৎপুরের রাস্তা ধরে দ্রুত এগোতে থাকে। দুপাশে খোলা নর্দমা। বাড়িতে ঢোকার জন্য গেটের মুখে নর্দমার উপর পাটাতন বসানো। কোন কোন বাড়ির শৌচাগার রাস্তার প্রায় উপরে। হুমনা হুমনা আওয়াজ তুলে মাঝে মাঝে পালকি চলেছে।
কানাই বললে, এখানকার পালকি বেয়ারাদের দেখে মনে হচ্ছে উড়ে হবে। আগে পালকি বাগদী দুলেরাই বাইতো না?
ছিদাম বললো, ব্যাপারটা সেরকমই। আসলে শোভাবাজারের রাজা নব কেষ্ট
দুলে বাগদিদের জল অচল মনে করে এই উড়ে বেয়ারাদের নিয়ে এসেছে। আমার অবশ্য মনে হয়
চুয়ার হাঙ্গামায় যেহেতু বাগদী দুলে সবাই জোরে সোরে যোগ দিয়েছিল ,শহরের বড় মানুষদের
সেই থেকে দুলে বাগদি দের ব্যাপারে একটা ভয় ঢুকেছে।
আগে তো বাগদিরাই বাড়িতে বাড়িতে পাহারা দিত । এখন কলকাতার বড় মানুষেরা পশ্চিমা দারোয়ান রাখতে শুরু করেছে।
এও এক নতুন ঢং।
পথে আচমকা এক বড় মানুষের বাড়ির সামনে প্রায় কয়েক হাজার লোকের জমায়েত।
কানাই একটু ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, এখানে এত মানুষের জমায়েত কেন?
কোন হাঙ্গামা বাঁধলো নাকি।
ছিলাম বলল দাঁড়াও দেখে আসি কি ব্যাপার। একটু পরে ফিরে এসেছিদাম বললো, আরে না না
সেনবাবুর মাতৃদায় উদ্ধার হচ্ছে।
আজ শ্রাদ্ধ। কাল কাঙ্গালী বিদায় হবে।
কানাই বললো, কালকে বিদায় দেবে বলে আজকে থেকে লোকজন হচ্ছে?
ছিদাম বলল হ্যাঁ। আজকে এদেরকে ঠেসে ঠুসেএকটা দুটো বাড়িতে পুরে দেবে। তারপর কালকে সকালবেলা বিদায় দেয়া শুরু হবে।
জমায়েতের বহর দেখে কানাই বেবাক অবাক। এমনকি গর্ভবতী মহিলারাও তাদের স্ফীতকায় পেট নিয়ে কাঙালি বিদায় নিতে এসেছে। সামান্য দূরত্ব রক্ষা করে দলে দলে ব্রাহ্মণরাও জড়ো হয়েছে। ব্রাহ্মণরা সকলেই তাদের উর্ধাঙ্গ প্রায় অনাবৃত রেখে যতদূর সম্ভব উপবীত দৃশ্যমান রাখছে। কারণ ব্রাহ্মণ বিদায় একটু বেশি। কপাল ভালো থাকলে ব্রাহ্মণদের জন্য চার আনাও বরাদ্দ হতে পারে।
ছিদাম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর আর পাঁচশালা বন্দোবস্ত বাঙালিকে একদম ভিকারী বানিয়ে দিয়ে গেল গো। যাদের দেখছো সবাই যে কাঙ্গাল এমনটা নয়। গরিব গেরস্থঘরের বহু লোকজনও এই কাঙাল বিদায় নিতে চলে এসেছে। মাঝে মাঝে কাঙাল বিদায়ের ভিড়ের চোটে একজন দুজন কাঙ্গাল অক্বা পায়। তবুও লোকের বিরাম নেই।
ভিড়ে ভিড়াক্বার রাস্তায় কোনক্রমে পথ করে ছিদাম এবং কানাই এগোতে থাকে।
কিছু পথ হাঁটতে মদন মোহন তলা আসতে ডান হাতে মদনমোহনের বিশাল মন্দির।
আসার সময়ই কানাইয়ের চোখে পড়েছিল। তখন তাড়া থাকায় আর থামেনি।
এখন বললো, এটাই গোকুল মিত্রের মন্দির না? বিষ্ণুপুরের রাজা চৈত সিং এর মূর্তি যেখানে আছে?
কাহিনীটা কলকাতায় লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে গিয়ে সবাই জানে। মূলত লবণের কারবার করে গোকুল মিত্তির লালে লাল হয়ে যায়। বিষ্ণুপুরের রাজা চৈত সিং এই সময় একবার খুবই দরকারে পড়ে তাদের কুলো বিগ্রহ মদনমোহন বন্ধক রেখে গোকুল মিত্রের কাছ থেকে বেশ কিছু টাকা কর্জ নেন।
পরে টাকা যোগাড় করে কর্জ শোধ দিয়ে যখন বিগ্রহ ছাড়াতে আসেন চৈত সিং, তখন
গোকুল মিত্তির হুবহু একই রকমের দেখতে আরেকটি মূর্তি তৈরি করে বলেন, আপনার মূর্তি কোনটি আপনি চিনে নিয়ে যান।
রাজা চৈত সিং নাকি ভুল করে নকল মূর্তিটি নিয়ে ফিরে যান।
তারপরেই গোকুল মিত্র বিশাল করে এই মন্দির ফেঁদেছে মদনমোহনের জন্য।
গত বছর হঠাৎই লটারিতে গোকুল মিত্র চাঁদনী চকের গোটা বাজারের মালিকানা পেয়ে গেল।
এখন লোকে বলে,
"মদনমোহনের কৃপায় পেল বাজার চাঁদনী।"
এই বাজার চাঁদনীর কিছু দূরে
চীনাদের বাস। তার কিছু দূরে লালবাজার। তারপাশে রাইটার্স।
খুব সরেশ জায়গা সন্দেহ নেই।
মূলত কানাই এর আগ্রহে ই
ছিদাম কানাইকে নিয়ে একবার মন্দিরের ভিতরে ঢোকে। বিশাল থামওয়ালা মন্দির। বিরাট তার নাট মঞ্চ।
ছিদাম বলে, মদনমোহনের সত্যিই অদ্ভুত লীলা। কোম্পানির দাপটে লবণ এত আক্রা যে বাংলার মানুষ লবণ কিনতে না পেরে দুর্বল হয়ে পড়লো। আর সেই লবনের ব্যবসায় দু হাতে পয়সা লুটে
মদনমোহনের এত বড় মন্দির!
ছিদাম সুতানুটির মোড়ে এসে ডান দিকে ঘুরে কানাই কে বলল তুমি ঘাটে যাও। আমি এক্ষুনি আসছি।
সিদাম ঘাটে ফিরে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই, জটাকেশ এসে হাজির হয়। দেখা গেল ঘাটের মাঝি মাল্লারা অনেকেই জটাকেশ কে চেনে। জটাকেশ বললো, নৌকা তো এখন খালি।
শুধু নৌকার পাহারার জন্য কারুর থাকবার দরকার নেই।
কালু ও আমাদের সঙ্গে চলুক।
আমি ঘাটে অন্য মাঝিমাল্লাদের বলে দিচ্ছি। তোমরা এগিয়ে চলো।
অগত্যা পাঁজনে মিলেই বাগবাজারের কৃপে ময়রার দোকানের দিকে চলে। মন্ডা মিঠাইয়ের ভোজ হবে।
বিকেলের দিকেও কৃপে ময়রার দোকানে মেলা ভিড়। দোকানে পৌঁছে দেখা গেল একটি বছর পনেরোর ছেলে কৃপে ময়রার সঙ্গে হাতে হাতে কাজ করছে।
জটাকেশ কৃপে ময়রাকে বিলক্ষণ চেনে।
জটাকেশ জিজ্ঞাসা করলো, ছেলেটি কে গো? দেখে তো তোমার ছেলে মনে হচ্ছে।
কৃপে বললো, হ্যাঁ দাদা। গ্রাম ঘরে পড়াশোনা করছিল। পাঠশালার পালা শেষ করেছে। তারপর আমার দোকানে নিয়ে এলাম।
হাতে হাতে কাজটাজ শিখুক এবার। একদিন না একদিন কারবার তো ধরতেই হবে।
জটাকেশ কিশোর ছেলেটির মাথার চুল আলতো করে কেটে দিয়ে জিজ্ঞাসা করে, বেশ বেশ।
তা নাম কি তোর?
সম্প্রতিভ ভঙ্গিতে ছেলেটি বলে,
আমার নাম ভোলা। ভোলা ময়রা।আপনার নিবাস?
আপনার ব্যবসাই বা কি?
জটাকেশ কিশোরের সপ্রতিভতায় একটু থতমতো খেয়ে যায়।
তারপর সামলে নিয়ে বলে,
আমি কলকেতাতেই থাকি।
কাজের মধ্যে পায়রা ওড়াই।
কিশোর এবার চিত্তাকর্ষক মুদ্রায় বাতাসে হাত আন্দোলিত করে বলে,
বেশ বেশ বেশ
চার ইয়ার কে নিয়ে বাবু
ওড়াতে থাকুন পায়রা
মিষ্টান্নে মন ভরাবো
আমি ভোলা ময়রা।
কিশোরের ভাবভঙ্গি দেখে সবাই হো হো করে হেসে উঠলে।
জটাকেশ বললে,
"কৃপে, তোমার ছেলে বড় হলে নব কেষ্টর হরু ঠাকুরের ঘাড়ে হাগবে।"
(চলবে)