মিথ্যা যত হৃদয় জুড়ে, এই বেলা সব যাক না পুড়ে

নতুন ভাষার উদয় হলেই শহরে বৃষ্টি নামার আভাস ।সে বৃষ্টিতে ভিজে যাবে সমস্ত ধূলিকণা। সে বৃষ্টিতে ভিজে যাবে সমস্ত না পাওয়ার খতিয়ান। বৃষ্টি যেন আমাদের তৈরি করে দেবে এক অনির্বচনীয় সহ্য শক্তি। যে সহ্য শক্তিকে কবি এখানে অভিহিত করছেন,' বিরুপাক্ষ' বলে ।অর্থাৎ;  তৃতীয় নয়ন। সেই তৃতীয় নয়ন দিয়ে আমরা দেখব আমাদের দেখা বৃত্তের মধ্যেই অনেক না দেখা দৃশ্যাবলী। উপাখ্যান শুনবো। অনেক না শোনা কথা উপলব্ধি করবো ।এমন অনেক অনুভূতির কথা,  যে অনুভূতি আমাদের পঞ্চেন্দ্রীয় কে এতদিন পর্যন্ত নীরব করে রেখেছিল । নীরব করেছিল আগুনের দীপ্তিকে উদ্ভাসিত করবার ক্ষেত্রে ।
আমাদেরকে বলেছিল ,সেই যেন চার্লস ডিকেন্স  নির্মিত ,'সুসময়' আর 'দুঃসময়ে'র দোলাচালের মধ্যে না থেকে , দুঃসময় কে অতিক্রম করবার জন্য ,শহরের ইতিকথা কে বুক ভরে উপলব্ধি করতে।
প্রখ্যাত চিন্তক, অধ্যাপক অভীক মজুমদারের ,'আগুনের রোয়াব'  ছোট্ট একটি বই ।কিন্তু সেই ছোট বইয়ের মধ্যে দিয়ে সত্যিই যেন,' আগুনে হলো আগুনময় ,জয় আগুনের জয়'--রবীন্দ্রনাথের এই উপলব্ধি আমরা প্রতিটি পরতে পরতে স্পর্শ করতে পারি।   
                   অভীক যখন লেখেন, তখন তাঁর লেখার মধ্যে এমন একটা 'বোধ 'কাজ করে। যে বোধ আমাদের সময়ের আবর্তনকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। আবার সেই বোধই আমাদের আগামীর বিচারের  দিকেও চেতনাকে পরিচালিত হতে সাহায্য করে। অভীকের পদ্যই হোক, গদ্যই হোক,  সবের মধ্যে যেন ,'যে অগ্নিতে দীপ্ত গীতে'র  একটা সুরলহরী সব সময় সঞ্চারিত হয়। 
            এই সঞ্চারণমান ভাব গতির ভিতর দিয়ে আমাদের চেতনালোক, মেরুদন্ডের জোর যাকে বলে,  মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা  যাকে বলে --সে সমস্ত উপলব্ধির আরোহনীতে উপনীত হওয়ার একটা শক্তি লাভ করে অভীকের লেখার ভেতর দিয়ে।
              ' সেবার স্বপ্ন ফুলে উঠে ঢেকে দিয়েছিল অমর্ত্যপুর ,অন্ধ অন্ধ আর অন্ধ আগুনে পুড়ে খাক করে দিচ্ছিল আকাশ.....' আগুনে জয়গানে ই যেন  প্রথমেই , ' আগুনের  রোয়াব '  আমাদের পুড়ে যাওয়া একটা আকাশের নীচে ,উদ্ধত অসহায় ভাবে দাঁড় করিয়ে দেয়। আমরা ভাবতে থাকি,  স্বপ্ন কিভাবে ফুলে উঠে ঢেকে দেয় অমর্ত্যপুর। 
            এই পারিপার্শ্বিকতায় আমরা কখনো সমকালকে, সমকালের ঘটনাক্রম কে, সেই স্বপ্নের মধ্যে উপস্থাপিত করে দেখতে চাই কি? সম্পূর্ণ আকাশ আমরা দেখেছিলাম ।আর কেনই বা সেই আকাশ অন্ধ আগুনে পুড়ে খাঁক হয়ে যাচ্ছিল?' অন্ধ 'শব্দটি ব্যবহার করবার ক্ষেত্রে এখানে কবি কিন্তু কোন ও যতি চিহ্ন ব্যবহার করেননি। দুবার ,'অন্ধ'  শব্দটি যতিহীন ভাবে ব্যবহার করে ,কবি বুঝিয়ে দিয়েছেন ,অন্ধত্বের বেড়াজাল আমাদের মনের গহীনকে কিভাবে কুয়াশার  সাথে ছেড়ে দিয়েছে ।
             এই কুয়াশাকে উত্তরণের জন্যই তো আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম ।আমাদের আগের কালের মানুষ স্বপ্ন দেখেছিলেন। আগামীকালের মানুষেরা ও স্বপ্ন দেখবেন  কিন্তু সেই সব স্বপ্নগুলো কি অমর্ত্যপুরকে এভাবেই অন্ধ অন্ধ আর অন্ধ আগুনে পুড়ে খাক করে দেবে ? আকাশের সীমা পরিসীমাকে জিজ্ঞাসার  এক অদ্ভুত স্তরে কবি আমাদের এখানে পৌঁছে দেন ।আমরা উত্তর খুঁজতে যাই ।কখনো উত্তর পাই ।কখনো পাইনা ।কখনো পাওয়া উত্তরটা আমাদের মনের মত হয়। কখনো বা হয় না। কিন্তু আমরা উত্তর খুঁজতে প্রয়াসী হই ।আমাদের সত্ত্বাকে, স্বপ্নপুরে ছারখার হয়ে যাওয়ার উত্তর খোঁজার জন্য প্রয়াসই করে তোলা--  এটাই হচ্ছে কবি অভীক মজুমদারের সবথেকে বড় সার্থকতা ।এখানেই অভীকের সবথেকে বড় কালত্তীর্ণতা। এই কালত্তীর্ণতার জন্যই ,এই সময়ে , হাজারো কবিদের ভিড়ে, নিজেকে ব্যতিক্রমী হিসেবে মেলে ধরতে সার্থক হয়েছেন অভীক মজুমদার।
অভীক লিখছেন;'  আজ কী বার কোন মাস বছরের হিসেবে যিশুর জন্ম থেকে কত দূরে এসে দাঁড়িয়েছি, সেসব হাস্যকর মনে হয়।'--  এক প্রকার দার্শনিক উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে আমাদের সকলের মনের গহীনে জমে থাকা বেদনার রাশিকে যেন এই শব্দবন্ধের মধ্যে দিয়ে কবি এখানে সামনে এনে দাঁড় করালেন। এখানে সেই কবি অমিয় চক্রবর্তীর অমঘ উচ্চারণ ; তোমার ও নেই ঘর আছে ঘরের দিকে যাওয়া ।আমারও নেই ঘর আছে ঘরের দিকে যাওয়ার-- মত এক চরম সত্যের প্রতি নিবিড় আত্মসমর্পণ ।
যীশুর জন্ম কে আমরা চলতি কথায় সভ্যতার উষালগ্ন বলে ধরে থাকি। সেই সভ্যতার উষালগ্ন থেকে আলোকে অতিক্রম করে, আরো আলোকময় যাপনের সন্ধানে আমরা ভেসে চলেছি , নাকি আলো থেকে আমরা আকন্ঠ নিমগ্ন হতে চলেছি এক তমসার গহীন সাম্রাজ্যে ?-- এই প্রশ্নই যেন কবি এখানে করছেন ।প্রশ্নটি এমনভাবে তিনি এখানে উপস্থাপিত করছেন যে ,উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে পাঠক, যিনি আলো-আঁধারীর চিত্রকল্পের মাঝে একটা ভালো সন্ধানে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পছন্দ করেন, তিনি ভাববেন, অন্ধকার থেকে আলোই উত্তরণের পথ সামনেই  ।অবশ্যই আমাদের সামনে সমস্ত বাধা বিঘ্নকে অতিক্রম করে, ফুটে উঠবেই ,রাত্রির গভীরতা থেকেই উৎসারিত হবে ভোরের আলোর প্রত্যাশা ।সেই প্রত্যাশাই যেন এই ছোট্ট একটা বইয়ের পরতে  পরতে ছড়িয়ে দিচ্ছেন  কবি অভীক মজুমদার।
'চন্দ্রাতপ' শব্দটিকে কবি এখানে যেভাবে ব্যবহার করছেন তা যেন সামগ্রিকভাবে মানব জীবনের উপরে একটা পরম স্নেহের, ভালোবাসার, ছায়ার আস্তরণ ।এই ছায়ায় অবগাহন করতে করতে আমরা নিঃশ্বাস নিতে পারব। এই ছায়ায় ভাসতে আমরা শুকিয়ে যাওয়া  স্বপ্নকে আবার সবল করে নিতে পারব ।বেগবান করতে পারব। আরো স্বপ্নীল করতে পারব। ছায়ার যে একটা গভীর উপবেশন  মানব জীবনের অভিব্যক্তির মধ্যেই কেবল নয় ,সামগ্রিকভাবে গোটা সৃষ্টির মধ্যে তার পরিব্যক্তি, যা  এক অন্য ধরনের আমেজ তৈরি করে,  এই ব্যাপ্তি  যেন আমাদেরকে অভীক মজুমদার, সমসাময়িকতা এবং অতীত আর ভবিষ্যৎ , এই সমস্ত কিছুর মেলবন্ধনের ভেতর দিয়ে, একটা নিবিড় ছায়ার মত মেলে ধরেছেন। 
এমনভাবে মেলে ধরতে গেলে জীবন বোধ সম্পর্কে যে গভীর অনুধ্যান প্রয়োজন ,সে কথা তো আলাদা করে বলবার কোন ও  প্রয়োজন নেই ।কিন্তু সেই অনুধ্যানটিকে কবি কিভাবে উপলব্ধি করেছেন এবং সেই উপলব্ধিকে সঞ্চারিত করছেন সমকালে আর  ভাবী কালের জন্য, সেটাই হল প্রশ্ন। 
           এই প্রশ্নের সমাধানে একটা ছোট্ট কয়েক পাতার বইয়ের মধ্যে দিয়ে অভীক যেভাবে উত্তরের সন্ধান দিচ্ছেন ,কিন্তু নিজে সরাসরি কোন ও উত্তর দিচ্ছেন না, উত্তরে  উত্তরণের দায়িত্বটা রেখে যাচ্ছেন পাঠক সমাজের কাছে , ভাবী কালের কাছে-- এই গোটা বিষয়টাই একটা বিশেষ রকমের বৌদ্ধিক দীপ্তির আভাস সূচক।
শ্মশানের একমাত্রিক স্পেস  ঘিরে পথিকদার মন্তব্য আর সেই মন্তব্য নিয়ে গত পরশু রাত দুটোর সময় ১৮৫৭ সালের ফৈয়াজ  আর মনাব্বর শেখ কে, বুকে গুলির ছ্যাঁদা নিয়ে পরদেশীর দোকানে চা খেতে দেখা-- এক অতীত  আর বর্তমানের  চিরায়ত কথোপকথন ,এই ছোট্ট কাব্যগ্রন্থের ১১ নম্বর গদ্য কবিতার মধ্যে দিয়ে অভীক যা বলছেন, তা যেন সহজেই হয়ে উঠছে ইতিহাস দর্শনের স্বর্ণময় ব্যক্তিত্ব ই এইচ কারের ইতিহাসের সংজ্ঞা নিরূপণকারী মন্তব্যের একেবারে সার্থক অনুরণন।
                কী অদ্ভুত গাম্ভীর্যপূর্ণ অথচ মরমী মানসিকতা থাকলে দেশের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেওয়া দুই জানা বা অজানা সংগ্রামী ,তাঁদের বুকের গুলির ছ্যাঁদা, চায়ের দোকান ,আর ১৯৮৯ সাল, যে সময় কালে এই চায়ের দোকানের মালিক পরদেশী আত্মহত্যা করে , সে সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় , আর তখনই যেন এক দিকদ্রষ্টা  কবির কলম থেকে উঠে আসে এই শব্দগুলি; ' দিনকাল ভালো নয়।গাজনপুরের মাঠে এত রাতে আগুন জ্বালাচ্ছে কারা? ময়নানদীতে নৌকায় হট্টগোল শোনা যাচ্ছে। এবছর ধানের বদলে নাকি মৃতদেহ পাওয়া যাবে মাঠে। অন্ধ সেই গণৎকার ,গিরিশ, একথা বলেছিল। আমাদের ওপর নজর রাখছে পাগড়িপরা কয়েকটা মুখ।'( পৃ-১৭) 
 এ যেন আমাদের সময়ের, আমাদের কালের এক অভ্যর্থ্য টিপছাপ ।এমন এক একটা সময়কাল কবি এখানে উল্লেখ করছেন,  যে সময়কালটা মানবজাতির একটা দিক চিহ্নবাহী সময়।
 ১৮৫৭, যে সময়ে  শুরু হয়েছিল ভারতের স্বাধীনতার জন্য প্রথম সংগ্রাম। ১৯৮৯। যার  ঠিক দুশো বছর আগে শুরু হয়েছিল , অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার সেই মহান সংগ্রাম ,ফরাসি বিপ্লব। এ সমস্ত কিছুই যেন একটা সঙ্গতির বিনি সুতো অসংগতির ঢেউ কে আগামীর প্রত্যাশায়, শান্ত সমাহিত করবার সেকালের টোটকা ।সেই হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর 'বেনে বউয়ে' বর্ণিত গ্যালন গ্যালন গর্জন তেল ঢেলে দেওয়া অশান্ত সমুদ্র কে শান্ত করতে।
 
আগুনের রোয়াব--
অভীক মজুমদার 
প্রকাশক-- জয়- কাবেরী
দাম-২৫ টাকা

  • শঙ্খদীপ্ত ভট্টাচার্য