প্রয়াত হয়েছেন দেবজ্যোতি রায়। ১৯৫৪ থেকে ১৮ আগষ্ট ২০২৪।প্রায় ৭১ বছরের আয়ুষ্কাল ছিল তাঁর।কুচবিহার শহরে তাঁর জন্ম।তাঁর যাপন।কিছুদিন ছিলেন কলকাতায়।
জড়িয়ে পড়েছিলেন নকশালবাড়ি আন্দোলনে।তারপর ধরা পড়া।জেলযাত্রা।জেল থেকে ছাড়া পেয়ে একসময় সরে আসেন সক্রিয় রাজনীতি থেকে।কিছুদিন যুক্ত থাকেন মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে। নানান সময় কাজ করেছেন সংবাদ মাধ্যমেও।
একসময় সিদ্ধান্ত নেন সারাজীবন সম্পৃক্ত থাকবেন লেখালেখির সঙ্গেই।আমৃত্যু লেখা আর পড়া নিয়েই তো থেকে গেলেন।
রাজনৈতিক সক্রিয়তা থেকে সরে এলেও দেবজ্যোতি কিন্তু আজীবন তার রাজনৈতিক দর্শনের কাছে,বামপন্থার কাছে সৎ থাকতে পেরেছিলেন।
দেবজ্যোতি রায়ের সঙ্গে কিভাবে পরিচয় হয়েছিল আজ আর মনে নেই।কবি,প্রাবন্ধিক,গদ্যকার,নকশালবাড়ি আন্দোলনের একদা সক্রিয় কর্মী দেবজ্যোতি রায় তখন রাজনীতি থেকে সরে এসেছেন।পুরোপুরি নিমগ্ন রয়েছেন লেখা পড়ায়।দেবজ্যোতি রায় ক্রমে আমার প্রিয় বাবু দা হয়ে উঠলেন।সদ্য লিখতে আসা এক তরুণের পিঠে ভালোবাসার হাত রাখলেন।আমি তখন রোগা প্রেমিকের মত সারা শহরে সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াই।প্রতি মুহূর্তে স্বপ্ন দেখি।রাতের পর রাত জেগে কাটাই।মেদো মাতালদের সঙ্গে ভাটিখানায় আড্ডা জমাই।ওদের জীবনের গল্প শুনি।আর রাত জেগে লেখা চিঠিগুলো ভোরের ডাকবাক্সে ঢুকিয়ে দিই।
সপ্তাহে চারদিন বাবু দার পাটাকুড়ার বাড়িতে যাই।
এক জোড়া জিজ্ঞাসু ও বুদ্ধিদীপ্ত চোখ মেলে বাবু দা আমাকে পরখ করেন।টেবিল জুড়ে অগণন বই।লেখার খাতা।সিগারেটের প্যাকেট।আমি লেখা আর জীবন নিয়ে সবসময় জানতে চাই।বাবু দা তার মতন করে কত কথাই যে বলে চলেন।
একটা দীর্ঘ গদ্য লিখছিলেন।তার অংশ বিশেষ বাবু দা পড়ে শোনান।তোর্সা নদীতে স্নান করতে গিয়ে চোরাবালুতে ডুবতে থাকবার গল্প থেকে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার নানান কথা জানতে পারি।
অনেক পরে সেই সব লেখা বই আকারে বেরোয়।
"নরকের থেকে একটুকরো অনির্বচনীয় মেঘ"_এই শিরোনামে।দুবছর আগে যার নুতন মুদ্রণ প্রকাশ পেয়েছে।
বাবু দা কবিতা শোনান।জীবনের অন্ধকার এক পাতালে প্রবেশ করি।বেঁচে থাকবার লড়াই করা মানুষের আস্ত এক অভিশপ্ত জীবন সেই সব লেখা জুড়ে।দেবজ্যোতি রায় আমাকে শোনান বিশ্ব সাহিত্যের গল্প।ইউরোপ,ল্যাটিন আমেরিকার,আফ্রিকার সাহিত্য।লোকজীবনের কথা।
আমি শিখি।প্রতি মুহূর্তে শিখি।মাঝে মাঝে বাবু দার স্কুটারে চেপে চলে যাই ঘুঘুমারি।কবি অরুনেশ ঘোষের বাড়ি।
এভাবেই আমার জীবনবোধ,আমার স্বপ্নকে উস্কে দিয়েছিলেন বাবু দা।
আমার কবিতা জীবনে,আমার লেখা পড়ার জীবনে দেবজ্যোতি রায় একটা সুতীব্র বাতিস্তম্ভ হয়েই থাকবেন।
দীর্ঘ লেখালেখির জীবনে কবিতা ও গদ্য মিলিয়ে মাত্র ৮ টি বই প্রকাশিত হয়েছে তার।আসলে তিনি তো একেবারেই স্বতন্ত্র পথে হাঁটতে থাকা একজন সৃজনসেনা।তাই মুড়িমুড়কির মতন প্রসব করেননি অগণন গ্রন্থ।
দেশ কাল সময় সমাজ ছিল দেবজ্যোতি রায়ের ভাবনা আর সৃজনের মূল ভরকেন্দ্র।তিনি তার বিশ্বাসের সঙ্গে আমৃত্যু আপোষ করেননি।সংস্কারমুক্ত মুক্তমনা এই মানুষটি চমৎকার গদ্য লিখতেন।প্রবন্ধ লিখতেন।তিনি তার লেখাকে দৃঢ় যুক্তির পটভূমিতে স্থাপন করে লেখাকে বিশ্বস্ত করে তুলতেন।কিন্তু পছন্দ করতেন নিজেকে একজন কবি হিসেবে ভাবতে।
প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৪ সালে।কুচবিহার থেকে প্রকাশিত "রোবট" পত্রিকায়।
কিন্তু তার প্রথম প্রকাশিত বই_"নির্মম বর্শার গান",প্রকাশিত হয়েছিল ২০০২ সালে।এই কবিতার বইটির প্রকাশক ছিল "কবিতীর্থ"।
ভাবা যায় আজকের দিনে দাঁড়িয়ে প্রথম বই প্রকাশের জন্য এত দীর্ঘ অপেক্ষা!
একটা সময় সম্পাদনা করেছিলেন চিন্তা ও চেতনা চর্চার পত্রিকা "ব্যতিক্রম"।
দেবজ্যোতি রায়ের ব্যক্তিজীবন নানান ঘাত প্রতিঘাত লড়াই দিয়ে সাজানো।এতরকমভাবে এতরকমের জীবন দেখেছেন তিনি যা পুষ্ট করেছে তার সৃজনভূমিকে।তিনি ছিলেন তীব্র ভাবে সচেতন।প্রতিটি শব্দ লিখবার ক্ষেত্রে।প্রতিটি বাক্যপ্রয়োগের ক্ষেত্রে।
তার আত্মজৈবনিক গদ্যের বই_"নরকের থেকে একটুকরো অনির্বচনীয় মেঘ" পাঠ করে চমকে উঠেছিলাম।পাঠক হিসেবে আমাকে পরিপুষ্ট করেছিল এই বইটি।বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে বইটি পড়তে হয়েছে আমাকে।
এই বই তাকে নিশ্চিতভাবে কিছু দীক্ষিত পাঠক দিয়েছিল।
নিজের জীবনের গল্প,নিজের রাজনীতি,বিশ্বাস,দর্শন তিনি তুলে ধরেছিলেন এই বইটির মধ্য দিয়ে।
পরবর্তীতে "বলদের যোনি ও অন্যান্য গল্প","মাস্তান রাশির জাতক" বই দুটিতে তিনি লেখক হিসেবে তার জাত চিনিয়ে দিয়েছিলেন।
অরুণেশ ঘোষ,নিত্য মালাকার,সত্বিক নন্দী,অজিত রায় এবং আরো কয়েকজন মেধাবী মানুষের সঙ্গ সান্নিধ্য বিনিময় দেবজ্যোতি রায়ের চিন্তা বিশ্বকে আলো দিয়েছিল।তার মেধা মননকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করেছিল।
দেবজ্যোতি রায় তার লেখায় সমাজের জীবনের অন্ধকার নিয়েই আগ্রহী ছিলেন।প্যানপ্যানে সুখী আলোকিত বিষয় নিয়ে তিনি তেমন আগ্রহী ছিলেন না।
এসব তো প্রায় সকলেই লেখে।
কিন্তু নরকজীবন লিখতে পারে বা লিখতে জানে কয়জন!পাশাপাশি খুব সাধারণ অথচ বিচিত্র মানুষেরা উঠে এসেছে তার লেখায়।
তার গদ্যে কিন্তু কোন কাঠিন্য ছিল না।তার লেখা পড়তে গিয়ে কিন্তু কোথায় থেমে যেতে হয় না।আমার তো মনে হয় দেবজ্যোতির গদ্যভাষা কবিতার কাছাকাছি।তার ভাষায় রয়েছে তেজস্ক্রিয় আকর্ষণ।
তিনি ছিলেন নিরন্তর নিরীক্ষায় বিশ্বাসী।কি কবিতায় কি গদ্যে।
কবিতার বই_"একটি আত্মস্থ হল্লাবোল" পাঠ করতে গিয়ে দেখি কি বিষ্ময়করভাবে তিনি নিজেকে সরিয়ে এনেছেন "নির্মম বর্শার গান" থেকে।এবং খুব সচেতনভাবেই।
আবার গদ্যের বই_"নরকের থেকে একটুকরো অনির্বচনীয় মেঘ" থেকে হাজার মাইল দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকে তার "বলদের যোনি" বইটি।
কিন্তু খুব বেশি লেখেননি তিনি।নিজেকে প্রস্তুত করতেন খুব ধীর স্থির ভাবে,সময় নিয়ে।
তরুণ লেখক,নতুন লেখা বরাবর তার আদর পেয়েছে।
ছিলেন তুমুল আড্ডাবাজ।ভ্রমণপ্রিয়।
আপাত কাঠিন্যের আড়ালে দেবজ্যোতি ছিলেন একজন শিশুর সারল্যে ভরা মানুষ।
অজস্র স্মৃতি,ডুয়ার্সের জঙ্গলে রাতের পর রাত কত কত বিষয় নিয়ে আড্ডা।
খুব নিবিড় হয়েই থাকবেন তিনি আমাদের অন্দরে।
দেবজ্যোতি রায় আর নেই। মানে শারীরিক অস্তিত্ব নিয়ে নেই।কিন্তু তার লেখা থাকবে।তার কথা তার লেখা নিয়ে তিনি তার স্বজনবৃত্তে পাঠকবৃত্তে থেকেই যাবেন;মেধাচর্চার অগ্রণী এক ব্যক্তিত্ব হয়ে।