রাজনীতিসচেতন চলচ্চিত্র পরিচালক বলতে যা বোঝায় সদ্য প্রয়াত উৎপলেন্দু চক্রবর্তী ঠিক তেমনই ছিলেন, এটুকু বললে বোধহয় কিছুই বলা হয় না । যখন প্রথম তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলাম সিনেমা নিয়ে সিরিয়াস আলোচনা করবার জন্য, তখন আমরা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে সবে চলচ্চিত্র চর্চা শুরু করেছি। সে এক ভঙ্গুর সময়। বহু যত্নে লালিত সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার স্বপ্ন বিপর্যস্ত। সোভিয়েত ইউনিয়নসহ গোটা পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙে পড়ার মুখে। ১৯৯০ সালের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব উপলক্ষে অধুনালুপ্ত একটি চলচ্চিত্র পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর সাক্ষাৎকারের কপি পৌঁছাতে গিয়েছিলাম উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে। পত্রিকা হাতে নিয়েই প্রথম প্রশ্ন "পূর্ব ইউরোপে যা ঘটল কি বুঝছো?" আমার থতমত মুখ দেখে সত্তর দশকের রাগী যুবকের কপিবুক সংস্করণ চলচ্চিত্র স্রষ্টার দাড়ি গোঁফের ফাঁকে হাসি দেখলাম! "পলিটিক্স মাইনাস করলে ফিল্ম হয় না ভাই! আপডেট থাকতে হয় ! চোখ কান বন্ধ রেখে ছবি করা যায় না!" সবে ছাত্র রাজনীতির পাট চুকিয়ে আসা বর্তমান নিবন্ধকারের উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর এই কথাগুলো শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, এই তো আমাদের মিছিলের সেই চেনা মুখ! যিনি জাতীয় পুরস্কারের মঞ্চে দু বছর বাংলা ছবিকে গর্বিত করেছেন, চোখ ছবির জন্য নিয়ে এসেছেন বার্লিন থেকে আন্তর্জাতিক পুরস্কার- তাঁর অন্তরে এখনও জেগে দিন বদলের স্বপ্ন!
আটের দশকের প্রথম চার বছর, অর্থাৎ যখন আমরা কলেজ ছাত্র ,তখন দু দুটো জাতীয় পুরস্কার
প্রাপ্ত ছবির ডিরেক্টর উৎপলেন্দু চক্রবর্তী বাংলা ছবির জগতে সর্বাধিক আলোচিত চলচ্চিত্রকারদের অন্যতম । "অন্যতম " শব্দটি ব্যবহার করলেও এই তালিকায় ছিলেন আরও দুজন পরিচালক। একজন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত অন্যজন গৌতম ঘোষ। সত্যজিৎ রায় , ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন তপন সিংহ দের পরে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে একঝাঁক তরুণ প্রজন্মের চলচ্চিত্রকার উঠে এসেছিলেন যাঁরা বাণিজ্যিক বিনোদনমূলক ছবির ধারার বাইরে নিজেদের সামাজিক ও রাজনৈতিক বক্তব্য পৌঁছে দিতে চাইছিলেন বাংলা ছবির দর্শকদের কাছে। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত গৌতম ঘোষ এবং উৎপলেন্দু চক্রবর্তী পর্যায়ক্রমে প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি নিয়ে সাড়া জাগিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে গৌতম ঘোষের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি তেলেগু ভাষায় "মা ভূমি "(১৯৭৮) । কিন্তু বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ১৯৭৮ সালে প্রথম ছবি দূরত্ব নিয়ে আসেন পরের বছর ১৯৭৯ সালে মুক্তি পায় "নিম অন্নপূর্ণা"। উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর "ময়নাতদন্ত " মুক্তি পেয়েছিল,১৯৮০ সালে।
এবং সেই প্রথম কোনও বাংলা ছবির শেষ সংলাপ আমাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। গ্রামের প্রান্তিক পরিবারের মা তাঁর মৃত ছেলের ময়নাতদন্তের পর প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন, "পেটে পা লি একমুঠো ভাত?" জাতীয় পুরস্কার জিতে নেওয়ার জন্য নয় ,বরং স্পষ্টভাবে রাষ্ট্র ও সমাজের দিকে অসাম্য এবং বৈষম্যের কারণ বঞ্চিত মানুষের ভাষায় জানতে চাওয়ার জন্য ময়নাতদন্ত ছবির পরিচালক উৎপলেন্দু চক্রবর্তী আমাদের প্রিয় হয়ে উঠলেন। তার পরের ছবি ১৯৮৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত"চোখ "- প্রায় পড়িমড়ি করে মুক্তির প্রথম সপ্তাহেই দেখেছিলাম ,কারণ উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর পরিচালক জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি তথ্যচিত্র "দেবব্রত বিশ্বাস " দেখানো হচ্ছিল এক
ই শো তে "চোখ "ছবি শুরু হওয়ার আগেই। এই ছবি মুক্তির মাত্র আড়াই বছর আগে চিরবিদায় নেওয়া আমাদের জর্জ বিশ্বাসের উপস্থিতি স্মৃতিতে তখনও টাটকা ।
"চোখ" ছবির প্রধান স্তম্ভ অবশ্যই প্রতিবাদী শ্রমিক নেতার চরিত্রে ওমপুরী এবং একজন শিল্পপতির চরিত্রে কলকাতার নাট্যজগতের গর্ব শ্যামানন্দ জালানের অসামান্য অভিনয়। কিন্তু মালিকের সঙ্গে হাত মেলানো উঁচুতলার শ্রমিক নেতাদের মুখোশ খুলে দেন উৎপলেন্দু চক্রবর্তী যখন ওম পুরী অভিনীত যদুনাথ একটি বৈঠকে ঢুকে পড়ে বাইরে থেকে আসা পদস্থ শ্রমিক নেতাকে চাবুকের মতো প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন ,"মিউচুয়াল হো গিয়া না?" এই ছবির আরও একটা দৃশ্য মনে গেঁথে যায়, যখন দেখা যায় মালিকের পাঠানো ভাড়াটে খুনি খুন করে লাশের গায়ে হাতে লেখা লাল অক্ষরের পোস্টার ফেলে যায়," কমরেড যদুনাথের নেতৃত্বে শ্রেণী শত্রু খতম চলছে, চলবে!" এই ছবিতে পরিচালক কোনও ইচ্ছাপূরণের গল্প লেখেন নি বলেই চলচ্চিত্রের আগ্রহী ছাত্র হিসাবে আমরা তাঁর সততা ও ইতিহাস চেতনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই। এই ছবির শেষে টাকার জোরেই শ্রমিক যদুনাথের শেষ ইচ্ছা অগ্রাহ্য করে তাঁর চোখ এক ধনী ব্যবসায়ী নিজের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী পুত্রের জন্য কিনে নেন। ঘটনাচক্রে হয়ত কিছুটা নাটকীয়ভাবেই সেই ধনী ব্যবসায়ী ফাঁসি হয়ে যাওয়া শ্রমিকনেতা যদুনাথের কারখানার মালিক এবং একটি চিটফাণ্ড কোম্পানির কর্ণধার। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়ত অন্যায় হবে না যে, এই ছবিটি তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরের নিবেদিত।
১৯৮৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত "দেবশিশু" ছবিতে যেভাবে গ্রামীণ ভারতবর্ষে প্রচলিত অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কার নির্ভরতার উৎস হিসাবে সীমাহীন দারিদ্র্য ও অশিক্ষাকে চিহ্নিত করেছিলেন উৎপলেন্দু চক্রবর্তী ,তা আজও সমাজ সচেতন চলচ্চিত্র পরিচালকদের কাছে উদাহরণযোগ্য। ওম পুরী ও স্মিতা পাতিলের দুর্দান্ত অভিনয়ের তুলনায় এতটুক বেমানান ছিলেন না তখনও পর্যন্ত তেমন পরিচিতি না পাওয়া সাধু মেহের। এক দরিদ্র গ্রাম্য দম্পতির শারীরিক প্রতিবন্ধী পুত্রকে দৈবী ক্ষমতাসম্পন্ন সাজিয়ে ব্যবসা করার আয়োজনকে যেমন বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপনা করেছিলেন উৎপলেন্দু চক্রবর্তী তেমনই গ্রাম্য দম্পতির টিকে থাকার লড়াইয়ের মধ্যে বুজরুকির কারবারে যুক্ত থেকে চটজলদি রোজগারের প্রলোভনের ফলে তৈরি হওয়া তাঁদের মানসিক টানাপোড়েন দেখিয়েছেন । এখনও ছবিটি বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনার নিরিখে প্রবল প্রাসঙ্গিক বলে মনে হবে। বিশেষত সাধু মেহের অভিনীত রঘুবীর চরিত্রের সংলাপ " ইস সময় বাচ্চা কো রাক্ষস হোনা চাহিয়ে!" আজও বুকের ভেতরে ধাক্কা দেয়।
আটের দশকের শেষ থেকেই বাংলা ছবির বাজারে সমান্তরাল ধারার ছবির প্রযোজক পাওয়ার সমস্যা বাড়ছিল। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের পক্ষেও ভরতুকি দিয়ে ছবি করার প্রযোজনা ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহ তেমনভাবে দেখা যাচ্ছিল না। উত্তমকুমারের অকাল প্রয়াণের পরে আসা জোরালো ধাক্কা সামলে মূলধারার বাংলা ছবি প্রভাত রায়, বীরেশ চট্টোপাধ্যায় অঞ্জন চৌধুরী, সুজিত গুহ ,স্বপন সাহা প্রমুখ পরিচালকদের হাত ধরে ঘুরে দাঁড়ায়। শুধু তাই নয়, কম টাকায় আবেগপূর্ণ পারিবারিক ছবি ভালো ব্যবসা করায় এবং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আঙ্গিনায় বাংলা ছবির সাফল্য প্রার্থিত উচ্চতায় না আসার ফলে "প্রাইজ পাওয়া "ছবির আগ্রহী প্রযোজক কমছিল। এর পাশাপাশি ছিল মিডিয়ার তৈরি আর্ট ফিল্ম বনাম.কমার্শিয়াল ফিল্ম এর দ্বন্দ্ব। যাতে বাংলা ছবির ছোট বাজার দ্বিধা বিভক্ত হওয়া ছাড়া আর কোনও লাভ হয়নি। এই আবহে উৎপলেন্দু চক্রবর্তী তাঁর ছবির বিষয়বস্তু বদলাতে শুরু করলেন। যার ফলশ্রুতি১৯৮৯ সালের "ছন্দনীড় " । সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর সাফল্য নেপথ্য কন্ঠশিল্পী হিসাবে এই ছবির জন্য পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী এবং সেরা গীতিকার হিসাবে শিরোপা সান্যাল জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তি । কিন্ত বিপুল অর্থে নির্মিত এই ছবির বাণিজ্যিক সাফল্য আসেনি । অথচ এক ভরতনাট্যম নৃত্য শিল্পীর শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন যথেষ্ট নিষ্ঠার সঙ্গে রূপায়ণ করার চেষ্টা করেছিলেন পরিচালক।
আসলে তাঁর পরিচালিত শেষ উল্লেখযোগ্য কাহিনীচিত্র "প্রসব" আবার প্রমাণ করেছিল উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর নিজস্ব বিচরণভূমি হল রাজনৈতিক ছবি। এই ছবি নকশাল আন্দোলনের পটভূমিকায় সশস্ত্র বাম আন্দোলনের কর্মীদের আদর্শগত দায়বদ্ধতা সত্ত্বেও ভারতের সামাজিক পরিস্থিতিতে তাঁদের বিভ্রান্তি ও পারস্পরিক বিরোধের উৎপত্তির প্রাথমিক কারণ যে বিপ্লব করার ইচ্ছা নিয়ে সর্বস্ব পণ করে ঝাঁপিয়ে পড়া কর্মীদের জনবিচ্ছিন্নতা,সেই সত্য কে তুলে ধরেছিল। কিন্তু একইসঙ্গে সহযোদ্ধার প্রতি মমত্ববোধের মানবিক দলিল "প্রসব " ! শ্রীলা মজুমদার ও শুভাশিস মুখোপাধ্যায়ের অসাধারণ অভিনয় এই ছবির সম্পদ।
যদি এভাবে এই নিবন্ধ অথবা আংশিক স্মৃতিচারণ শেষ করা যায় যে, কিংবদন্তি মৃণাল সেনের শতবর্ষপূর্তির বছরে তাঁর আদর্শগত উত্তরসূরী উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর প্রয়াণ বাংলা ছবির কাহিনী ও চিত্রনাট্যে পঞ্চাশ বছর আগেকার বামপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার প্রতিফলন তুলে আনার শেষ স্রষ্টার বিদায় ,তাহলে বিন্দুমাত্র অত্যুক্তি হবে না। সেইসঙ্গে এই সত্যও স্বীকার করা জরুরি ১৯৯৪ সালে পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির বিপর্যয়ের তিন বছর পরে উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর ছবির বাঙালি মধ্যবিত্ত দর্শকেকে বামপন্থীদের জনবিচ্ছিন্নতার বাস্তবতা খুব বেশী আকৃষ্ট করতে পারেনি বলে "প্রসব" ছবির ঐতিহাসিক গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না।