টুকরো কথায় সময়ের দলিল


স্মৃতি যখন সময়কে ছুঁয়ে হাতছানি দেয় আগামীকে, তখনই হয়ে ওঠে স্মৃতিচারণের সার্থকতা

শব্দের মালায় সময়কে গাঁথতে পারা , খুব একটা মুখের কথা নয়। সাম্প্রতিক অতীতের ফুলগুলো দিয়ে যখন আমরা মালা গাঁথার চেষ্টা করি, তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, 'আমরা' থেকে 'আমি'-এর আধিক্য সেই মালাকে দীর্ণ করে দেয়। ফলে,  ফুলের সুগন্ধ সহজেই হয়ে যায় ম্লান। কিন্তু সময়ের একজন কথকথাকার যখন অতি সহজ কতকগুলো শব্দ দিয়ে পিছন পানে চাইতে চাইতে, অতীত আর বর্তমানের সেতু রচনা করেন এক 'সময়' নামক ফুলের মাধ্যমে, তখন তা কেবলমাত্র সুখপাঠ্যই হয় না, হয়ে ওঠে সামাজিক ইতিহাসের একখন্ড অভ্রান্ত দলিল।

 
প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রচেত গুপ্তের , 'মণিমুক্তোর দিনরাত্রি' তেমনই এক সুগন্ধী মালায় গাঁথা একরাশ 'সময়' নামক ফুলের এক সামাজিক ইতিহাসের টিপছাপ। লেখক কিন্তু ইতিহাস লিখছেন বলে কখনও দাবি করেননি। বরং জ্ঞানগর্ভ নিবন্ধ, সেগুলো ঘিরে একটু 'পালাই,পালাই' ভাবনাই তাঁর মধ্যে বেশি। জ্ঞানের বহর ফলাতে গিয়ে মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, গুটিকয় লোকের পছন্দের লেখক হয়ে থাকতে যে তিনি চান না, তাঁর লেখার আঙ্গিকে তা পরিস্কার। তাইই যখন প্রচেত গুপ্ত লেখেন; 'আমার মনে হয় ছেলেবেলা যে কোনও লেখকের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।'( পৃ-১৩) তখন প্রথমেই আমরা একটা অন্যরকম স্বাদের প্রত্যাশী হয়ে পড়ি।

লেখক বা পাঠক কিংবা যে মানুষটির পড়াশুনার সঙ্গে এখন আর এতটুকু সম্পর্ক নেই, বড়বাজারের একজন মুটে কী সীমান্তের কাছে, কোনও একটা অজ পাড়াগাঁয়ের মোটর ভ্যান চালক, সেও কি কখনও মনের গোচরেই হোক অথবা অগোচরে,  নিজের ছেলেবেলার কথা ভাবে না? সেই ভাবনা কি তাঁকে ক্ষণিকের জন্যে হলেও এক ঝলক আনন্দ দিয়ে যায় না?

 
প্রচেতর আলোচ্য গ্রন্থের প্রথম নিবন্ধ, 'ঘর কম, আকাশ বেশি' - লেখকের চোখ দিয়ে যেন পাঠকের শৈশব ছোঁয়া। আঁকশি দিয়ে যেমন উঁচু গাছের ফল পাড়া হয়, সময় বিশেষে ফুল ভর্তি গাছের ডালকে নামিয়ে আনা হয় ফুল তোলবার তাগিদে, এই নিবন্ধটি যেন ঠিক সেই রকম একটা আঁকশি, এক লহমায় ফেলে আসা শৈশবকে, যা আকাশ থেকে পেড়ে দেয়। বাতাস থেকে ছেনে আমাদের হাতের মুঠোয়। আবার জাবর কাটবার সুযোগ করে দেয়।
শৈশবের গহীনে ডুব দিয়ে লেখক লিখছেন;
'এই বাঙুর অ্যাভিনিউয়ের এখন কি দশা?
গত তিরিশ - পঁত্রিশ বছর ধরে সেই স্নিগ্ধ চেহারা তছনছ হয়ে গেছে।'

 
লেখক যখন এই 'তছনছ' শব্দটা লিখছেন, তখন এই শব্দটা যেন কোথায় এসে আমাদের বুকের মধ্যে একটা হাতুড়ির ঘা মারছে। কারন, তার আগেই লেখকের কলমে আমরা দেখেছি,  সেই তিরিশ - পঁয়ত্রিশ বছর আগের বাঙুর অ্যাভিনিউকে। সেই ঘন সবুজে ঢাকা সাইকেল চালানো পথ। ছোট ছোট বাড়ি। একটা স্নিগ্ধ পরিবেশ। একটা বিশেষ রকমের গড়ে ওঠা পাড়া সংস্কৃতি। যে পাড়া গর্ব করত ধনকুবেরদের জন্য নয়। সে পাড়ার গর্ব ছিল;  নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, পূর্ণেন্দু পত্রী, ক্ষেত্র গুপ্ত,  বিষ্ণু বসুদের মতো বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির দিকপালদের ঘিরে ।

আজও হয়তো কোনও সাহিত্য পাগল, কবিতা পাগল মানুষ সে পাড়া দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে কোন বহুতলের মানুষকে জিজ্ঞেস করে বসবে;  আচ্ছা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী কোন বাড়িতে থাকতেন?  কিংবা ক্ষেত্র গুপ্তের বাড়িটা কোথায় ছিল ? পারবে না সেই বহুতলের বাসিন্দা আগন্তুকের ওই প্রশ্নের উত্তর দিতে। কারণ সে তো জানেই না এই পাড়াতে একদিন ইস্কুলের ফাংশান  মাঠে, মেরাপ বেঁধে সেই ফাংশান হচ্ছে, আজকের মতো বাইরে হল ভাড়া করে সেখানে ইস্কুলের ফাংশন, বার্ষিক অনুষ্ঠান এগুলো ভাবাই যেত না। সেই অনুষ্ঠানে এসেছেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। আর সেখানে নীরেন্দ্রনাথ, বাংলা কবিতার দিক চিহ্ন, তার থেকে অনেক বেশি সেই স্কুল এবং পাড়ার মানুষদের কাছে , তিনি 'পাড়ার লোক'।

 
তাই তাঁর পাড়ার স্কুলের নীরেন্দ্রনাথের প্রতি দাবিটা যেমন প্রবল, আবার পাড়ার মানুষদেরও নীরেন্দ্রনাথের প্রতি দাবিটা তেমনিই বড়। এমন একটি পুরস্কার বিতরণী সভায় কিশোর প্রচেত , 'কলকাতা যীশু'  আবৃত্তি করছেন।  আবৃত্তি করতে করতে কবির  সঙ্গে একমঞ্চে থাকবার শিহরণে হঠাৎই তিনি  ভুলে গেছেন কবিতার কোনও একটি পঙতি। আর কবি স্বয়ং উঠে এসে কিশোর প্রচেতর পিঠে হাত রেখে বললেন; ' কোন ও সমস্যা নেই,  আমিও  ভুলে গেছি। তুই লজ্জা পাস না।' ( পৃ-৩৩ ) আর ব্যাস। যেন একটা ম্যাজিকের মতো কাজ করল স্মৃতির আরোহীনিতে। ভুলে যাওয়া কবিতা সুন্দর করে তিনি তুলে ধরলেন কবির সামনে।
এ নিয়ে তাই প্রচেতবাবুর অসাধারণ মূল্যায়ণ,"একেই বলে 'বড় মানুষ'।"

 
মানুষের কাছে এসব স্মৃতির ভেতর দিয়ে যখন সেই ফেলে আসা অতীত খুব বেশি কাল আগের অতীত নয়, সেই সূত্রগুলোকে,  ছোট ছোট ঘটনা, যেগুলো আর দশজন সাধারণ মানুষ, যাঁদের সেভাবে দেখবার চোখ নেই ,তাঁদের কাছে হয়তো মামুলি ঘটনা বলেই মনে হবে,  তেমন ঘটনার মধ্যে দিয়ে প্রচেত আমাদের পৌঁছে দিচ্ছেন সময়ের এক স্মৃতির সরণীতে।

স্মৃতির সরণীতে ভাসতে গেলে অনেকেই স্মৃতিকাতর  হয়ে পড়েন। প্রচেত এখানে লিখেছেন, দুঃখবিলাসী হয়ে পড়ার একটা ভাবনা তাঁর মধ্যে কাজ ক'রে, পাছে লোকে তাঁকে ,'দুঃখ বিলাসী'  বলে, হয়তো সেই ব্যাপারে তিনি অনেক বেশি সজাগ থাকেন।

এই বইটিতে বলতে পারা যায় নিজের সেই ভাবনাটির পরিস্ফুটন ঘটাতে লেখক সর্বাংশে সফল হয়েছেন। পুরনো দিনের কথা বলতে গিয়ে, পুরোনোটাই ভাল, আর নতুন খারাপ, এমন মানসিকতা কখনও প্রচেত দেখাননি। আধুনিকতাকে সময়ের নিরিখে গ্রহণ করবার ক্ষেত্রে তাঁর মধ্যে কোনও কার্পণ্য নেই।

তা বলে হারিয়ে যাওয়া সময়টাও খারাপ ছিল,  সেই সময়ের সবকিছু পরিত্যজ্য--  এমন ভাবনাও তিনি ভাবেননি। এমন ভাবনা যখন তিনি ভাবছেন না, তখন কিন্তু অতীত মানেই, 'ভীষণ ভাল',  আর 'বর্তমান'  মানে, 'ভীষণ খারাপ',  এই মানসিকতার ভেতর দিয়েও তিনি যাচ্ছেন না। এই টুকরো টুকরো ছবির মধ্যে দিয়ে তিনি সময়টাকে ধরছেন। যে সময়টাকে আজকের প্রজন্ম কিছুতেই পাবে না।

কিন্তু প্রচেত গুপ্তর এইসব সুন্দর স্মৃতির মধ্যে দিয়ে তাকে ছুঁতে পারবে। জানতে পারবে আজ থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে কেমন ছিল মধ্যবিত্ত বাঙালির সামাজিক জীবনযাত্রা। এই জায়গাতেই বইটির সব থেকে বড় গুরুত্ব। এই দিক থেকে বিচার করে বলতে হয়;  এ বইটি কেবলমাত্র সময়ের স্মৃতিচারণ নয়।

শেষ দিকে লেখাগুলিতে যেমন লেখক আধুনিক প্রযুক্তির নানান বিষয়গুলিকে ঘিরেও রঙ্গ রসিকতার মধ্যে দিয়ে নানা কথা বলছেন, সেটা কিন্তু কখনও পঞ্চাশ  বছর আগের সময়, আর আজকের সময়ের কোনও তুল্যমূল্যের বিচার নয় ।
একটা যেন সময়ের ধারা বিবরণী, যেখান থেকে মানুষ ভাববে, নগর সভ্যতার এই অতিআধুনিকীকরণ আমাদের বাঙালি সমাজের ভাল আর মন্দের তুল্যমুল্যটাকে কোন জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে।

পঞ্চাশ  বছর আগের বিয়ে বাড়ি আর বিয়ে বাড়িতে খাওয়া দাওয়া, বিশেষ করে নিমন্ত্রিতদের ভিড় ঠেলে খাবার পাতে বসে পড়া,  এইসব স্মৃতিচারণগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমাদের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। আমরা ভাবতে থাকি, ওই ঘটনাক্রমের সঙ্গে আমাদের জীবনের নানান আনন্দ-বিষাদের ছবিগুলি-কে।

আজকের দিনে কোনও কিশোর বিয়ে বাড়িতে নেমন্তন্ন খাবার জন্যে একজনের চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে, বসে যিনি খাচ্ছেন, তাঁর  খাওয়া  শেষ হয়ে গেলেই, সঙ্গে সঙ্গে সে বসবে, এমনটা ভাবতেই পারা যায় না।

 কিন্তু আমাদের সে যুগে, মানে প্রচেত যে যুগের কথা বলেছেন, সে সময়, এগুলো কোন আত্মসম্মান হানিকর বিষয় ছিল না। বরঞ্চ এগুলোর মধ্যে ছিল একটা অনাবিল আনন্দ। আজকের নিত্যনতুন পদ সমাহারে বিয়ে বাড়িতে বুফে সিস্টেমে খেতে খেতে হঠাৎ কেমন যেন মনে হয়, সেদিনের সেই শাকভাজা বা লম্বা করে কাটা বোঁটা সমেত  বেগুনভাজা, অথবা নড়বড়ে মাটির গেলাসে জল। কখনও কখনও চুইয়ে পড়ে যাচ্ছে সে জল পাতেই। ডেকোরেটরের সেই কাঠের ভাঁজ করা চেয়ার। যে চেয়ারে বসতে গেলে ছোটরা প্রায় উল্টে পড়ে যেত! বড়দের ও পড়ে যাওয়ার ঘটনা যে একেবারে ঘটেনি, তেমনটা নয়!

আসলে সেই অনাবিল আনন্দগুলো হারিয়ে গিয়ে তার জায়গায় ভীষণ শৌখিন মজদুরি সম্পন্ন ভদ্রতা।  মাপা হাসি। মাপা কান্না। এসব যেন সময় বদলের একটা দিক চিহ্ন। সময় তো বদলাবেই। বদলই জীবনের গতি। সেই গতির কথাই তো প্রচেত বলেছেন বারবার ।
যেমন,  হাওয়াইন গিটারের কথা বলেছেন। আজকের দিনের ছেলেমেয়েরা হয়তো চেনেই না হওয়াইন গিটার। নেল, স্টিলবার এসব তারা জানেই না। গিটার বাদক সুনীল গাঙ্গুলী, যিনি প্রচেতবাবুদের  নিকটতম প্রতিবেশী ছিলেন, সেই সুনীলের কথা আজকের কারও সামনে তুলে ধরলে, হয়তো তাঁকে সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে দেখতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়বে নতুন প্রজন্ম।  

একরাশ মাথায় চুল নিয়ে কাঁধে স্ট্রিপ দিয়ে বাঁধা গিটার বাজানো নতুন প্রজন্মের বাদক গায়কেরা এমনটাই দেখতে অভ্যস্থ।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের যে অসাধারণ স্মৃতিকথা প্রচেত লিখেছেন, তা যেন  আমাদের কেমন উদাস করে দেয়। সেই দিনগুলি বারবার আমাদের স্মৃতিভারে হর্ষ বিষাদের মধ্যে দিয়ে এক অনুপম অনুভূতির মধ্যে নিয়ে আসে। অংশুমান রায়ের সেই গান  সেই ইপি রেকর্ডের শুরুতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের এক টুকরো উচ্চারণ, 'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ,এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম'।

এইসব অনুভূতি কেবল আমাদের স্মৃতিকেই উসকে দেওয়ার কাজ করেনি। প্রচেতর এই বইটি আগামী প্রজন্মকেও নতুন ভাবে অতীতকে চেনবার একটা 'সিঁড়ি' তৈরি করে দিয়েছে। প্রচেতর এই স্মৃতিচারণায় ,' সিড়ি' এবং' বারান্দা ' - এ দু,টির বিশেষ গুরুত্ব আছে।
প্রচলিত অর্থে সিঁড়ি আর জীবন অতিক্রমের সিঁড়ি এই দুইয়ের মধ্যে এক অদ্ভুত দার্শনিক সাযুজ্য রচনা করেছেন এখানে লেখক। আর সেই মেলবন্ধনে এসে যুক্ত হয়েছে 'বারান্দা'। তবে নানা ধরনের বারান্দার উল্লেখের মধ্যে একটি অনুল্লেখ থেকে গিয়েছে, সেটি হল;  আশাপূর্ণা দেবীর সত্যবতী সিরিজের সুবর্ণতার সেই বহুকাঙ্খিত এক টুকরো বারান্দা।

মণিমুক্তোর দিনরাত্রি
প্রচেত গুপ্ত
আজকাল
২৫০ টাকা

  • শঙ্খদীপ্ত ভট্টাচার্য