গানপাগল এক স্বেচ্ছাব্রতী গবেষকের কথা 



অন্ন বস্ত্র বাসগৃহ তথা শিক্ষার সংস্থান করার পরেও মানুষের মধ্যে নানারকম অবকাশ বিনোদনের ব্যাপার থাকে। কেউ গান শুনতে ভালবাসেন, কেউ বই পড়েন, কেউ বা বোকাবাক্সের দিকে চেয়ে থাকতে পছন্দ করেন। এ সবের বাইরেও নানা মানুষের নানারকম সখ থাকে। কেউ ডাকটিকিট জমায়, কেউবা দেশলাইবাক্স। ট্রামের টিকিট বা বিগত দিনের সিনেমা হলের টিকিটও কেউ কেউ জমান। অনেক খরচ করে অনেকে বইপত্র সংগ্রহ করেন। অনেকে আবার অ্যান্টিক জিনিসপত্র কিনতে কিনতে ফতুর হয়ে যান। এইসব বিচিত্র সখের ভিতর একজন মানুষকে দেখেছি, যাঁকে এককথায় বলা যায় ‘গানপাগল’। কিন্তু এই এক কথাতে তাঁর সবটুকু বলা হল না। তিনি আসলে ভারতবর্ষের নাইটেঙ্গল লতা মঙ্গেশকরের পরমভক্ত। প্রশ্ন উঠবে, তাঁর গানের ভক্ত কে নয়? এই উপ-মহাদেশ ছাড়িয়ে বলা যায় সারা পৃথিবীতে তাঁর অসংখ্য ভক্ত ছড়িয়ে রয়েছে। তবে এই মানুষটার ভক্তির বহরটা একটু অন্যরকম। অন্যরকম অর্থাৎ একেবারেই ব্যতিক্রমী। এঁর নাম স্নেহাশিস চট্টোপাধ্যায়। থাকেন শ্রীরামপুরে। খুব ছোটবেলা থেকেই তিনি লতা মঙ্গেশকরের গানের অনুরাগী শ্রোতা। সেই অনুরাগ এমন এক দুর্মর ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়েছিল যে একসময় তিনি ঠিক করলেন লতাজির সমস্ত গানের রেকর্ড সংগ্রহ করবেন। এই সংগ্রহের নেশা তাঁকে এই কিন্নরকণ্ঠী ভারতরত্ন সম্পর্কে কৌতূহলী করে তুলল। সবিস্ময়ে সংগীতে নিবেদিত এই মানুষটি আবিস্কার করলেন লতাজি ১৯৪২ সাল থেকে শুরু করে আজীবন ৩৮ দেশি ও বিদেশি ভাষায় গান গেয়েছেন। তাঁর নির্ভুল উচ্চারণ ও অসামান্য গায়নভঙ্গি শ্রোতাদের নিরন্তর কেবল মুগ্ধই করেনি, তাঁর সুরেলা কণ্ঠের মধুর স্বর শ্রোতাদের আবিষ্ট করে রেখেছে দিনের পর দিন। সুদর্শন স্নেহাশিসবাবু ইচ্ছে করলেই হতে পারতেন একজন সফল অভিনেতা। বড় চাকরি করে প্রচুর অর্থোপার্জনও করতে পারতেন অধীত বিদ্যার জোরে। নাড়া বেঁধে গান শিখেছেন গুণী শিক্ষকদের কাছে, ইচ্ছে করলে বড় শিল্পীও হতে পারতেন। সে পথে হাঁটেননি তিনি। ছাত্রবৎসল শিক্ষক হিসেবে প্রভূত সুনাম অর্জন করলেও তাতেও বেশি সময় দেননি। জীবিকা একটা ছিল বটে, কিন্তু তা কেবল গ্রাসাচ্ছাদনের এক নিমিত্ত মাত্র। আসলে তাঁর মনপ্রাণ জুড়ে ছিলেন সংগীত সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর । প্রথমত, দ্বিতীয়ত এবং শেষ পর্যন্ত। 

 


কীভাবে এটা হলো, কী করেই বা স্নেহাশিসবাবু ‘লতা গীতকোষ’ রচনায় অনুপ্রাণিত হলেন, সেই প্রসঙ্গে তিনি এক অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকারে আমাকে বলেন,“খুব ছোটবেলায় লতাজির ‘ও বাবুল প্যারে’ গানটি শুনে আমি একেবারে যাকে বলে মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম। তখন আমার মাত্র ন’বছর বয়স। তখন থেকেই সুর-সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকরই আমার ধ্যান জ্ঞান হয়ে ওঠে। আমার গানের জগতে হাতেখড়ি হয় মায়ের হাত ধরেই। তখন আমার বয়স মাত্র তিন বছর। এর পরে নলহাটির গৌর দাস, শান্তিনিকেতনের চিত্তরঞ্জন মুখোপাধায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে পণ্ডিত ধ্রুবতারা যোশির কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতের শিক্ষালাভ সম্পন্ন হয়। পরে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ও নীলিমা সেনের কাছেও রবীন্দ্রসংগীত শেখার এক দুর্লভ সুযোগ হয়। 

 


১৯৮০ সালে মহম্মদ রফির মৃত্যুর পরে প্রকাশিত ‘সঙ্গীত’ নামের একটি পত্রিকা দেখে আমি একটু অবাক হয়ে যাই। দেখতে পাই একই পত্রিকায় বিভিন্ন লেখায় মহম্মদ রফির গানের সংখ্যা এক একজন এক একরকম জানিয়েছেন। তখনই ঠিক করি যদি কোনওদিন কাউকে নিয়ে কাজ করি তাহলে যেভাবে আসলে কোষগ্রন্থ তৈরি হয় সেইভাবেই করব।“  এই সংকল্প মাথায় নিয়ে একদিন তিনি সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় কাজে নেমে পড়েন। নিজের ঘর সংসার চাকরি সবকিছুকে সামলে তিনি উঠেপড়ে লতাজি সম্পর্কে তথ্যাদি সংগ্রহ করতে থাকেন। এমনই এক সময়ে তিনি সন্ধান পান বিখ্যাত রেকর্ড সংগ্রাহক সুরাজলাল মুখোপাধ্যায়ের।তিনি হারুবাবু নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। তাঁরই সান্নিধ্যে এসে তিনি তাঁর এই গবেষণার প্রকৃত দিক নির্দেশনা পান। হারুবাবুর নির্দেশিত পথে পা ফেলে হাঁটতে হাঁটতে তিনি নিজের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে একটি সুনির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরি করে ফেলেন। সেই রূপরেখারই সূত্র ধরে তিনি তাঁর নিজস্ব গানঘরে একটু একটু করে লতাজির গাওয়া গানের রেকর্ড, ক্যাসেট, সিডি, ভিসিডি, ডিভিডি ইত্যাদির এক বিপুল সংগ্রহ করে এনে একটা সত্যিকারের আর্কাইভ তৈরি করে ফেলেন।তাঁর ওই সংগ্রহ দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। তাঁর মতো এমন সংগ্রহ ভূ-ভারতে আর কারো আছে কিনা জানা নেই। 
শুধু আর্কাইভ গড়ে তোলা নয়, তিনি একটু একটু করে লতাজির দীর্ঘ আট দশকের সংগীত জীবনের খুঁটিনাটি সম্পর্কে অনুধ্যান করে একটি একটি করে ‘লতা গীতকোষ’ রচনা করতে থাকেন। ১৯৯০ সাল থেকে সেই অভিযাত্রা এখনও অব্যাহত। এখন পর্যন্ত লতাজির গান নিয়ে ১৪টি খন্ডে ‘লতা গীতকোষ’ প্রকাশ করেছেন তিনি। শেষ খণ্ড অর্থাৎ পঞ্চদশ খণ্ডটি অনতিবিলম্বে প্রকাশিত হবে বলে তিনি আশা করছেন।অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে বিপুল এই কর্মযজ্ঞটি তিনি সম্পন্ন করেছেন সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে। এজন্যে কারও সাহায্য বা অনুদান তিনি পাননি বা প্রত্যাশাও করেননি। কারও কাছে হাতও পাতেননি। দুঃখের কথা কেউ স্বতোপ্রণোদিত হয়ে এগিয়েও আসেননি। এই পোড়া দেশে এমনটাই এক কঠিন বাস্তবতা। কেননা আমরা জানি এখানে একজন হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর একক প্রচেষ্টায় সারা জীবনটাই দিয়ে দিয়েছিলেন একটি বাংলা অভিধান নির্মাণের কাজে। 

 


লতাজি সম্পর্কে বিশদভাবে অনুসন্ধান করতে গিয়ে স্নেহাশিসবাবু সবিস্ময়ে লক্ষ্য করেন সংগীত জীবনের আশি বছরে এই মানুষটি বিভিন্ন ভাষায় প্রায় সাত হাজারের কাছাকাছি গান রেকর্ড করেছেন। শুধুমাত্র সংখ্যায় নয়, বৈচিত্র্যে এবং তাঁর অপূর্ব কণ্ঠ মাধুর্যে সেইসব গান শ্রোতৃহৃদয়কে স্পর্শ করেছে। নিজের মাতৃভাষা মারাঠি ছাড়া হিন্দি,বাংলা,অহমিয়া, ভোজপুরি, ছত্তিশগড়ি,ডোগরি, গাড়োয়ালি, গুজরাটি, কন্নড়, কোঙ্কনি, মগধি, মৈথিলী, মালয়ালাম, মণিপুরী, নেপালি, পাঞ্জাবি, রাজস্থানি, ওড়িয়া, সংস্কৃত, প্রাকৃত, সিন্ধি, তামিল, তেলেগু, উর্দু, ইত্যাদি দেশিয় ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি, সিংহলি, রাশিয়ান, ডাচ, সোয়াহিলি এবং ল্যাটিনের মতো বিদেশি ভাষাতেও গান রেকর্ড করেছেন। কাজের শুরুতে স্নেহাশিসবাবু ঠিক করেন এইসব অজস্র গানের সংগ্রহ কেবল নয়, এগুলোর প্রকৃত ‘ডেটাবেস’ তৈরি করবেন। উত্তরসূরীদের জন্যে এই তথ্যসমূহ অত্যন্ত জরুরি। নইলে কালের পরিক্রমায় সবই একেবারে বিলুপ্তির পথে চলে যাবে। এমন এক প্রকৃত ‘ডকুমেন্টশনে’র কথা মাথায় রেখে প্রায় তিরিশ বছরেরও অধিক সময় ধরে এই মানুষটি নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। আজ তাই জোর গলায় বলা যায় এই ভূ-ভারতে লতাজি সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্যের সংগ্রাহক হিসেবে শ্রীরামপুরের শ্রী স্নেহাশিস চট্টোপাধ্যায় একমেবাদ্বিতীয়ম।
১৯৮২ সালে মাত্র কুড়ি বছরের তরুণ স্নেহাশিস যখন লতাজি সম্পর্কে কাজ করার কথা ভাবেন, তখন এই কাজের পদ্ধতিগত কোনও ‘গাইডলাইন’ তাঁর জানা ছিল না। পরবর্তীকালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখা থেকে তিনি কিংবদন্তী রেকর্ড সংগ্রাহক সুরাজলালবাবুর কথা জানতে পারেন। বলাবাহুল্য ওই সুরাজলাল অর্থাৎ হারুবাবুর দেয়া অদম্য উৎসাহে তিনি কাজে যে নেমে পড়েন, সে কথা আগেই জানিয়েছি। ওঁর কাছ থেকেই তিনি শিখেছিলেন ‘ডিস্কোগ্রাফি’। ওঁরই সঙ্গে ঘুরে ঘুরে বৈঠকখানার চোরাবাজার,সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারের কাছে লেনিন সরনি এবং মির্জা গালিব স্ট্রিটের পুরনো রেকর্ডের দোকান থেকে সংগ্রহ করেছেন দুস্প্রাপ্য সব রেকর্ড। এছাড়া হারুবাবু প্রকৃত শিক্ষকের মতো তাঁর খেরোর খাতা, বুকলেট, ক্যাটালগ, রেকর্ড লেবেল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখিয়ে কীভাবে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে হয়, সেগুলো হাতে কলমে শিখিয়েছিলেন। এইভাবেই তাঁর সঠিক দিক নির্দেশনায় অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে স্নেহাশিসবাবু কাজ শুরু করে দেন। ক্রমশ তিনি লতাজির গাওয়া গানের তালিকাসহ যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ, তার সুর তালের বিভাজন ইত্যাদি করতে থাকেন। লতাজির গাওয়া গানের খোঁজে তিনি ভারতবর্ষের প্রান্তে প্রান্তে ঘুরেছেন। এইভাবেই দিনে দিনে সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর সংগ্রহ। তবে রেকর্ড সংগ্রহ করেই তিনি ক্ষান্ত দেননি, সেই গানগুলো একটা একটা করে ‘ডিজিডাইজড’ও করে ফেলেছেন।  তাঁর বহু কষ্টের সেই সংগ্রহ থেকে এখন যে কোনও শ্রোতা তাঁর আর্কাইভে বসে অনায়াসে শুনে নিতে পারেন লতাজির বিভিন্ন ভাষায় গাওয়া যে কোনও গান। সেই গান সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যও পেয়ে যাবেন স্নেহাশিসবাবুর সৌজন্যে। এমন পরিশ্রমী, মেধাবী এবং নিবেদিত প্রাণ মানুষকে তাঁর কর্মনিষ্ঠার জন্যে তাই কুর্ণিশ করতেই হয়। যদিও জানি কোনও প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি কিংবা খ্যাতি, যশ বা বিত্তলাভের জন্যে তিনি এই কাজে নামেননি। অবশ্য তাঁর এই অসামান্য কাজের কথা স্থান পেয়েছে ‘লিমকা বুক অফ রেকর্ডস’(২০০১)-এ।

 


অত্যন্ত নীরবে নিভৃতে কাজ করে গেলেও তাঁর এই নিরলস কাজের খোঁজ রাখতেন স্বয়ং সুর-সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর। বহুবার নিজের গানের তথ্যের জন্যে স্নেহাশিসবাবুকে ফোন করেছেন। এই কারণে তিনি অত্যন্ত গর্ব ও আনন্দ অনুভব করেছেন সব সময়। বেশ কয়েকবার সামনাসামনি সাক্ষাৎও হয়েছে দু’জনের। এছাড়া প্রথম খণ্ডের কাজ করার সময়ে চিঠি লিখে উত্তরও পেয়েছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে বহুবার ফোনেও কথা বলেছেন স্নেহাশিসবাবু। একবার এক আঠাশে সেপ্টেম্বর, লতাজির জন্মদিনে, ফোনে শুভেচ্ছা জানাবার সময় স্নেহাশিস জন্মদিনের উপহার হিসেবে তাঁকে একটি গান শোনাতে চান। লতাজি শুনতেও চান। সেদিন ফোনেই একটি দাদরা শুনিয়েছিলেন স্নেহাশিস ভারতরত্ন লতাজিকে। ‘লতা গীতকোষ’ প্রকাশিত হবার আগে প্রতি জন্মদিনে স্নেহাশিসবাবু তার সংগ্রহ থেকে নির্বাচন করে লতাজির গাওয়া গানের একটি সিডি তৈরি করে পাঠাতেন ওঁকে। তাঁর সেই উপহার পরমাদরে গ্রহণ করেছেন লতা মঙ্গেশকর। স্নেহাশিসবাবুর এই মধুর অভিজ্ঞতাগুলো আনন্দের স্মৃতির মতো মনের মণিকোঠায় সঞ্চিত হয়ে আছে।দূর থেকে লতাজি তাঁকে এইভাবে কাজ করার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।

 


২০০৬ সালে এক বিশেষ প্রয়োজনে মুম্বাইয়ে লতাজির পবিত্র গৃহাঙ্গন ‘প্রভুকুঞ্জে’ যাবার সৌভাগ্য হয় স্নেহাশিসবাবুর। সেখানে গিয়ে পরম বিস্ময়ে ঘুরে ঘুরে সমস্ত বাড়িটা দেখেন তিনি। এমনকি তাঁর শোবার ঘরটি দেখারও সৌভাগ্য হয় তাঁর। সব থেকে বিস্ময় ছিল লতাজির গানের ঘরটি। সেই ঘরের বাইরের দরজায় টুপি পরা এক শিশুর ছবি ছিল। উপরে লেখা ‘সাইলেন্স প্লিজ’, নিচে লেখা ‘জিনিয়াস ইনসাইড’। তাঁর শোবার ঘরের ভিতরটা অত্যন্ত সাধারণভাবে সাজানো। একটি সিঙ্গল খাট, একটি ছোট ওয়ার্ড্রোব ও একটি ছোট্ট ড্রেসিং টেবিল। এছাড়া কোথাও কোনও আতিশয্য দেখেননি স্নেহাশিস। একজন জগৎ বিখ্যাত শিল্পীর এমন নিরাভরণ শোবার ঘর দেখে তিনি সত্যি সত্যি বিস্মিত হয়ে যান। সেই অর্থে লতাজি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ একজন শিল্পী। জাগতিক বহু বিষয় আশয় থেকে তিনি সত্যিকারের মোহমুক্ত ছিলেন। তাঁর মতো একজন বিখ্যাত শিল্পীর অতি সাধারণ জীবন যাপন প্রত্যক্ষ করে স্নেহাশিসবাবু সত্যি সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিলেন। সেই মুগ্ধতার রেশ আজও আছে তাঁর মনে। 

 


গান সংগ্রহে স্নেহাশিসবাবুর সন্ধিৎসা সম্পর্কে একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ১৯৯৭ সালে লতাজি দেশিকোত্তম সম্মান গ্রহণ করার জন্যে বিশ্বভারতীতে আসেন। তখন সকলের অনুরোধে তিনি সরস্বতী বন্দনা গেয়ে শোনান। সেই গানটিও একসময় স্নেহাশিসবাবু বিশ্বভারতীর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সংগ্রহ করেন। সুর-সম্রাজ্ঞীর একদা স্নেহাশিসবাবুর  শিক্ষায়তনের নামকরণ করেন ‘স্বরগঙ্গা’। একবার এক চিঠিতে তিনি ‘স্বরগঙ্গা’কে শুভেচ্ছাও জানিয়েছিলেন। এইসব টুকরো টুকরো আনন্দের স্মৃতি নিয়ে বাষট্টি বছরের তরুণ স্নেহাশিসবাবু আজও লতাজির বিপুল কর্মযজ্ঞের অন্বেষণে মগ্ন হয়ে আছেন। তাঁর এই কাজের নিষ্ঠা দেখে মনে পড়ে যায় প্রশান্তকুমার পালের কথা, যিনি ‘রবিজীবনী’ রচনা করার সময়ে এইভাবেই কাজ করে গিয়েছিলেন।
স্নেহাশিসবাবু কাজ শুরু করেছিলেন ভালোবেসে, আর ভালোবাসাই সম্বল করে এতদূর এসেছেন। কোনও সাহায্য বা অনুদান পাননি কারও কাছ থেকে, এ কথা আমি আগেই জানিয়েছি। কাজটা যখন সত্যিকারের চেহারা নিতে চলেছে তখন অবশ্য তিনি হন্যে হয়ে সৎ এবং সংস্কৃতিমনস্ক একজন প্রকাশক খুঁজেছিলেন। চেয়েছিলেন তাঁর কাজ ছড়িয়ে পড়ুক সর্বত্র। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কোনও প্রকাশক পাননি। অগত্যা নিজের পয়সাতেই বইগুলো সীমিত সংখ্যক মুদ্রণ করেছেন তিনি। আর্থিক কারণেই বইগুলোর মুদ্রণ পারিপাট্য হয়তো তেমন করা যায়নি । কিন্তু কী আর করবেন! এ ব্যাপারে তিনি সব সময়েই ‘একলা চলো’ নীতিতেই বিশ্বাস করে এসেছেন। এমন স্বেচ্ছাপ্রণোদিত কাজে ব্রতী হওয়ার দৃষ্টান্ত আজকের দিনে সত্যি বিরল।

 


আটটি দশক ধরে লতা মঙ্গেশকর এতগুলো ভাষায় যতগুলি গান গেয়েছেন,তার সবগুলো কি সত্যিই পাওয়া যায়? তাঁর স্পষ্ট উত্তর ‘না’। তিনি তো এখনও লতাজির গাওয়া ল্যাটিন এবং রাশিয়ান ভাষায় গাওয়া গানের অনুসন্ধান করেই চলেছেন। বিশ্বস্ত সূত্রে তিনি জানেন যে ওই দুই ভাষায় একটি করে লতাজির গান আছে। এমন অন্যান্য ভাষায় আরও কিছু গান তাঁর অজ্ঞাত থেকে যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন। বলাবাহুল্য সত্যিকারের গবেষকের মতো তাঁর অনুসন্ধান হয়তো এইভাবে সারাজীবন ধরেই চলবে।
এত বড় একটা কাজ তিনি শেষ পর্যন্ত কার হাতে দিয়ে যাবেন? এই প্রশ্নের উত্তরে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় স্নেহাশিসবাবু আমাকে বলেন, “পনেরো খণ্ডে সমাপ্য লতা গীতকোষের কাজে আমি ব্রতী হয়েছিলাম সেই কবে থেকে!  সেটা করতে গিয়ে আমার প্রথমে মনে হয়েছিল গানগুলোর কথাগুলো দিয়েই কাজটা করব। সেই কাজের জন্যে প্রথমেই যেটা প্রয়োজন ছিল সেটা হলো লতাজির গাওয়া সমস্ত গানের অডিও সংগ্রহ করা। কাজ শুরু করেছিলাম ১৯৮৩ সালে। পরে হারুদা অর্থাৎ শ্রদ্ধেয় সুরাজলাল মুখোপাধ্যায়ের তত্বাবধানে নব্বই দশকের গোড়া থেকে কাজটা প্রকৃত অর্থে বিধিসম্মতভাবে শুরু করি। ওঁর পরামর্শে নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন ফরম্যাটে অর্থাৎ রেকর্ড, সিডি, ভিসিডি, ডিভিডি, ক্যাসেট ইত্যাদি সংগ্রহ করতে শুরু করি। এমনকি কিছু ভিএইচএস ক্যাসেটও পাই। এজন্যে কেউ কেউ আমাকে স্বতোপ্রণোদিত হয়ে তাঁদের সংগ্রহ দান করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে প্রচুর অর্থব্যয়ও করতে হয়েছে। তবে এসব ব্যাপারে কোনও পিছুটান আমার ছিল না। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের খ্যাপার মতোই পরশপাথরের সন্ধান করে ফিরেছি। বলতে দ্বিধা নেই আমার সেই ঐকান্তিক প্রচেষ্টা বিফলে যায়নি। সে জন্যেই আমি শেষ পর্যন্ত লতা-গীতকোষের ১৫ খণ্ডের কাজ শেষ করতে পেরেছি। এখন স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে আমার এই বিপুল সংগ্রহের ভবিষ্যৎ কি? বলে রাখা ভালো ভবিষ্যতের ভাবনা ভেবে এই কাজটা করিনি। কেউ বা কোনও প্রতিষ্ঠান যদি উপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে এগুলো সংরক্ষণ করার প্রতিশ্রুতি দেয়, তাহলে নিঃশর্তে এসবই তাঁদের দিয়ে দেব। তবে একটা কথা, এসব নিয়ে কোনও ব্যবসা করা যাবে না। আর আমি যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন এই সংগ্রহের পীঠস্থানে আমার যেন অবাধ প্রবেশাধিকার থাকে। লতাজির মতো একজন বিশ্ববরেণ্য শিল্পীর গানে সবার অধিকার থাকুক, এটাই আমার একমাত্র চাওয়া। প্রকৃত গবেষকেরা যদি আমার কাজে নতুন আরও কিছু সংযোজন করেন, তাহলে অত্যন্ত খুশি হব। আর যদি সেই অর্থে উপযুক্ত কাউকে না পাই তাহলে আমার উত্তরাধিকারদের হাতেই এই সম্ভার দিয়ে যাব এবং আমার এতদিনের এত পরিশ্রমের ফসল উপযুক্ত মর্যাদা পেলে সবচেয়ে খুশি হবো।“

 


এমন অকপট বয়ান শোনার পরে স্বভাবতই যে প্রশ্নটা আসে সেটাই তাঁকে করলাম, “আপনার বয়েস সবে মাত্র বাষট্টি। চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন কিছুদিন হলো। আপানাদের ছেলেও সুপ্রতিষ্ঠিত। আপনার স্ত্রী এক নামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা। ‘লতা-গীতকোষ’-এর কাজ তো প্রায় শেষ। আপনি তো একজন কাজের মানুষ। এই কাজটা শেষ করে আপনি এর পরে কী করবেন? নতুন কোনও পরিকল্পনা আছে আপনার? আপনার মতো কাজের লোক তো আর চুপচাপ বসে থাকতে পারেন না !
উত্তরে মৃদু হেসে তিনি বললেন, “সেইভাবে কিছুই ভাবিনি। অনেক দিন তো হলো! আপাতত আমার সব কাজগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে ছোট খাটো ভুলভ্রান্তিগুলো দূর করব। নতুন কিছু সংযোজন করার থাকলে করব। তারপর সত্যি সত্যি কিছুদিন বিশ্রাম নেব। এরমধ্যে যদি নতুন কোনও পরিকল্পনা মাথায় আসে, ভেবে দেখব।


স্নেহাশিসবাবুর এই কথাগুলো শুনে ভাবলাম, তাঁর মতো একজন কাজপাগল নতুন কিছু একটা কাজ অবশ্যই করবেন। কাজের মানুষের জন্যে বাষট্টি বছরটা সেই অর্থে কিছুই না। নিশ্চয়ই আরও বৃহত্তর নতুন কোনও কাজ তাঁর জন্যে অপেক্ষা করে আছে। কেননা তাঁর মতো নিঃস্বার্থ, পরিশ্রমী, একাগ্র মানুষই তো পারেন এই সমাজের জন্যে সত্যিকারের কিছু অবদান রেখে যেতে।এমন কাজপাগল মানুষদের কথা ভেবেই হয়তো রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
“বিশ্ববিদ্যাতীর্থপ্রাঙ্গণ কর’ মহোজ্জ্বল আজ হে।                                                                                                                                     বরপুত্রসংঘ বিরাজ’ হে। ঘন তিমিররাত্রির চিরপ্রতীক্ষা পূর্ণকর’, লহ’ জ্যোতিদীক্ষা।“

  • সুশীল সাহা
img
আগের পাতা
অনাগত