অনাগত


।।১।।


ঠিক সাড়ে সাতটা বাজে। আলোর তেজ অনেকটাই বেড়ে গেছে। সেপ্টেম্বর মাস কে বলবে! বছর দশেক আগেও এই সময়ে একটা হালকা ঠাণ্ডা ভাব থাকত। রোদটা গায়ে পড়লে মন্দ লাগত না; এখন সেটা সহ্য করা যায় না। মর্নিং ওয়াকাররা, আস্তে আস্তে দলবেঁধে কিংবা একা একা ফিরছেন নিজের নিজের ছাদের তলায়। লেকের ধারে বেঞ্চ আর গাছের তলা একটু একটু করে ফাঁকা হচ্ছে। ধীরে ধীরে জায়গাগুলোর দখল নেবে এবার কপোত-কপোতীরা; দুই জোড়া, তিন জোড়া - বসে পড়বে একই বেঞ্চে। তাদের একপাশে ছোট্ট এতটুকু জায়গা নিয়ে নিজেদের ক্ষয়ে যাওয়া অস্তিত্বকে জিইয়ে রাখবেন বৃদ্ধরা। লুকিয়ে আড়চোখে বা ফ্যালফ্যাল করে জলের দিকে তাকিয়ে ভাবতে শুরু করবেন জীবনের প্রাইম টাইম যৌবনকে তাঁরা কতখানি পেছনে ফেলে এসেছেন।

 

শনি মন্দিরের উল্টোদিকে লেকের বুকে ছিটকে বেরিয়ে আসা বাঁধানো মাটির ওপর একটাই বেঞ্চ। এই বেঞ্চটায় কেউ বড় একটা আসে না। ঠিক পেছনের নুয়ে পড়া গাছে কাকেদের বাসা বলে এটার বড় দুর্নাম। মনোরঞ্জন অবশ্য রোজ আসেন। এখানেই বসেন। দুনিয়াভর লোক তাঁকে পাগল বলেই জানে। একজন ছাড়া – সে তাঁর মা-মরা মেয়ে অমৃতা। ও বেটী ঠিক মায়ের মতই হয়েছে। দয়া, নিষ্ঠা, দায়িত্বের জীবন্ত প্রতিমূর্তি। পাড়ার লোকে চুক চুক করে সহানুভূতি জানায় – সুন্দরী, শিক্ষিতা, সর্বগুণসম্পন্না মেয়ের একটাই খুঁতের কথা ভেবে। মোড় ও রকের রাজপুত্তুররা গালের সদ্য ওঠা খোঁচা দাড়িতে হাত বোলায় আর প্ল্যান ছকে – কবে দৈত্যকে মেরে হাতানো যাবে কন্যা। ভয়ে কান দুটো প্রাণপণে চেপে মাথা ঝুলিয়ে বসে থাকেন মনোরঞ্জন, মৃত্যুর প্রতীক্ষা আজকাল অসহ্য মনে হয়! 
“কাকু, একটু জায়গা হবে, এদিকটা বড্ড নোংরা!”
বছর পঁচিশের একটা মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। পেছনে ওর প্রেমিক জাতীয় কোন এক ছাওয়াল। উনি মুখ তুললেন। 
“একটু ওপাশে সরে যাবেন, আমরা দুজনে বসব।”
মনোরঞ্জন একটু তফাতে সরে গেলেন।
“কিরকম ডোজ ধরল দেখলি! তোরা হলি মায়ের জাত, তোদের রিকোয়েস্ট কি কেউ ঠেলতে পারে? 
মনোরঞ্জন পাশ ফিরে ছেলেটাকে দেখলেন। নিজের কপোতীকে আড়াল করে ও বসেছে মনোরঞ্জনের দিকে পেছন ফিরে। খানিকক্ষণ চুপচাপ। 

 


“কি হল, বল...”
মেয়েটা বলল। ছেলেটা একবার পেছন ফিরে মনোরঞ্জনকে দেখে নিল। 
“তুই যে বললি, বলবি!” এবার মেয়েটার গলা বেশ অস্থির।
“বলছি, দাঁড়া না!” 
এতগুলো বছর ধরে ছাত্রছাত্রী পড়ানোর সুবাদে, মনোরঞ্জন বেশ বুঝতে পারলেন যে ছেলেটা মনে মনে গোছানোর চেষ্টা করছে যা ও বলতে চলেছে।
“বাব্বা, টেনশন; বলিহারি! নাকি লজ্জা?”
কথাগুলো যেন ছেলেটার কানেই গেল না। মেয়েটা বলেই চলল... 
“আচ্ছা ছেলে তো তুই! এতদিন প্রায় কোনও কন্ট্যাক্ট রাখিসনি; আর কাল রাতে হোঅ্যাটস্যাপ করে জরুরি তলব। এত সাতসকালে বাড়ি থেকে টেনে আনলি প্রেমকাহানী শোনাবি বলে। আমার মা যে কি ভাবল!”
“কাকিমা বেশ লিবারাল, কিচ্ছুটি ভাববেন না।” ছেলেটা অনেক কষ্টে সহজ হবার চেষ্টায় হাসল।
“এত মাস পরে বাড়ি এলাম; কোথায় একটু ঘুমোব, তা নয়! তোর জন্যে বেরোতে হল। আচ্ছা, তোর ফিয়ঁসে ভাল আছে তো?”
অনেকক্ষণ ব্যোম মেরে বসে থাকার পর, ছোকরা ভেজা ভেজা গলায় বলল...
“শী ইজ প্রেগন্যান্ট!”
“হোয়াট!”
“অন্তঃসত্ত্বা!”     
ছেলেটা নিচু গলায় তর্জমা করল অযথা। মনোরঞ্জন স্পষ্ট বুঝতে পারলেন ছোকরা মেয়েটার হাতদুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়েছে।
“কি যা তা বলছিস তুই! হাউ ডিড ইট অল হ্যাপেন?”
মেয়েটা ওর হাত থেকে নিজের হাত দুটো ছাড়িয়ে নিল। 
“তুই বিশ্বাস কর নীলা, আমি বা ও কেউই ঠিক...”
নীলা একদৃষ্টে লেকের জলে গাছের ছায়ার দুলুনি দেখতে থাকল। 
“তুই আমার দিকটা একটু বোঝ প্লিজ। আগেও টুকটাক ইয়ে হয়েছে... কিন্তু সেদিন পারিনি নিজেকে আটকাতে!” 
ছোকরা একটু দম জোগাড় করল।     
“সকালবেলায় সেদিন আমার বাড়িতে এসেছিল ও। মা, বাবা আগেরদিন মাসীর বাড়ি গেছে। কিন্তু ডলিদি, মানে আমাদের রান্নার লোক ছিল যখন ও এসেছিল। একটু ঝগড়া করেছিলাম আগেরদিন, তাই আমাকে না জানিয়েই হঠাৎ এসেছিল মিটমাট করার জন্যে। অ্যান্ড দেন ইট হ্যাপেনড। বিলীভ মি, ইট ওয়াজ্ অ্যান অ্যাকসিডেন্ট, শীয়ার অ্যাকসিডেন্ট!”     
ছোকরা একটু ঝুঁকে নিজের মাথার পাশে রগদুটো দুহাত দিয়ে চেপে ধরল। 
“তারপর?”
“দোষটা আমারই, ও অনেক...আমারই উচিত ছিলো নিজেকে আটকানো!”
“ডলিদি?” 
“ও যখন এসেছিল, তখন ডলিদির চলে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। আমি চান করছি। ও বেল বাজানোয় ডলিদি খুলে দেয়। তুই তো আমাদের বাড়ি গেছিস। দোতলায় আমার ঘর থেকে বোঝার উপায়ও নেই কে এল; স্বাভাবিকভাবেই আমি বুঝতে পারিনি। চান করে বেরিয়ে দেখি দোতলার ড্রয়িং স্পেসে বসে আছে। প্রথমে জিজ্ঞেস করল আমি রেগে আছি কিনা। তারপর মিষ্টি হেসে আমাকে বলল যে ডলিদি এইমাত্র চলে গেল। ও তাই মেন গেট বন্ধ করেই এসেছে।”
“ব্যস, তারপর বলিউডের হিরোদের মতন তোয়ালে পরা অবস্থায় হিরোইনকে পাঁজাকোলা করে বেডরুমে ঢুকে গেলি...”
মনোরঞ্জনের মনে হল ছেলেটার মুখে একটা হালকা হাসি এসেও আবার মিলিয়ে গেল। কঠিনস্বরে সে বলল,
“ব্যাপারটা আর ইয়ার্কির স্টেজে নেই নীলা।”
“আই নো, সরি ফর দ্য চিপ কমেন্ট; তারপর কি হল বল।”
“জানিস্, আমার জন্যই এটা হল! ও বলল আমাকে চেঞ্জ করে আসতে। কিন্তু আমার আর পা নড়ছিল না ওকে দেখে। আকাশি রঙের একটা সালোয়ার পরেছিল...” 
“হুমম, বুঝতে পারছি। আকাশি ওর খুব ফেবারিট, ওকে মানায়ও খুব ভাল। ওর মায়েরও ফেবারিট ছিল।”
মনোরঞ্জনের মনটা কেন জানি একটু ছাঁৎ করে উঠল।
“আমরা কেউই বুঝতে পারিনি ব্যাপারটা এতদুর গড়াবে; বুঝলে...”
“হোতা হ্যায়, হোতা হ্যায়। কোনও প্রোটেকশন নিস নি?”
“যখন কনসিকোয়েন্সটা মাথায় স্ট্রাইক করল ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে।”
“তারপর কি হল বল।” 
“দুদিন আগে ওদের ইউনিভার্সিটিতে ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প ছিল। তখনই শরীর খারাপ করে, পরশু সকালে বাড়িতে চেক করে জানতে পারে...”
“কি অদ্ভুত মেয়ে রে বাবা, পিলস নেয়নি কেন?”
“আমি জানতামও না যে নেয়নি। ওকে আমার বরাবর খুবই ম্যাচিওরড মনে হয়েছে।”
“আমিও তাই অবাক হচ্ছি, ওর মতন মেয়ে কেন এই ভুল করল! তারপর?”
“সারাদিন টুকটাক কথা তো হতেই থাকে, কিন্তু আমাকে কিছু বলেনি পরশু বিকেল অবধি। হঠাৎ সন্ধ্যেবেলা দেখা করতে বলল এই চত্বরেই। আমার বুকে মাথা গুঁজে অনেকক্ষণ কাঁদল; আমি ভাবলাম বাড়িতে কিছু হয়েছে বুঝি, তুই তো জানিসই যে ওর বাবা একটু অন্যরকম...অ্যাবনরমাল!”
শুনে বুকটা এবার ধক করে উঠল মনোরঞ্জনের! আড়চোখে ছোকরাকে এক ঝলক ভাল করে দেখলেন। একটা ইকুয়েশান, দুটো ভ্যারিয়েবল – কি করে সলভ করবেন?
“আঃ, একটু আস্তে বল!” ছেলেটার গলার স্বর ক্রমশ চড়ছিল। নীলা ওকে সাবধান করে দিল।
“হুঁ ...কিছুক্ষণ পরে বলল, বলেই প্রায় ছুটে পালিয়ে গেল। আমিও এতটাই ঘাবড়ে গেছিলাম যে কিছু বলতেই পারলাম না!”
“তারপর? ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছিলিস?”
“না।”
“না মানে! ও গেছিল?”
“জানি না।”
“জানি না মানে?” এবার প্রায় চিৎকার করে উঠল নীলা। 
“কাল কি করলি?
“কাল সকাল থেকে ফোন তুলছে না, মেসেজ করলে উত্তরও দিচ্ছে না!”
“গাধা একখানা, এক্ষুনি ওর বাড়ি চলে যা...”
“বাড়িটা আমি ঠিক চিনিনা রে; জায়গাটা খালি জানি! ওর বাবার সাইকো প্রবলেম বলে কাউকেই বাড়ির ঠিকানা দিতে চায়না ও! আমাকেও দেয়নি।”
মনোরঞ্জন হাতের লাঠিটা বাগিয়ে ধরলেন। 
“ডু ইউ রিয়্যালি লভ হার?”     
বেশ কড়া স্বরে প্রশ্নটা করল নীলা ।
“আই থিঙ্ক সো নীলা; আমি ওকে প্রচণ্ড ভালবাসি, ওকে ছাড়া বাঁচতে পারব না!”
“আমাকে ছাড়া আর কাউকে বলেছিস?”
“না।”
“তোর বাড়িতে কেউ কিছু জানে?”
“বিন্দু বিসর্গও না!”
“তুই কি ওকে ... বিয়ে করতে চাস?”
“হুঁ।”
ইকুয়েশানে দুটোই যে ভ্যারিয়েবল হবে তার তো কোন মানে নেই; একটা হয়তো কনস্ট্যান্ট! মনোরঞ্জন সামনে দেখলেন একটা কাক আরেকটার মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে।
“তাহলে বাড়িতে কনফেস কর।”
ঠাণ্ডা গলায় বলল নীলা। 
“কিন্তু তুই তো জানিস... এই সময়, কিছু ইনকাম নেই, আমার বাড়ির...”
“ব্লাডি কাওয়ার্ড! লজ্জা করে না...আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল নীলা, উঠে পড়ল, ছোকরাকে একা ফেলে রেখেই হাঁটতে শুরু করল, পেছনে আর না তাকিয়ে! 

 


দুপুর, বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে হব হব! লেকের ধারের দৃশ্য আমূল বদলে যাবে এখুনি। ভালবাসার এই এক বিড়ম্বনা এ দেশে; আলতো অন্ধকারে আড়ালে চুটিয়ে প্রেম কর। সামনে এস না, এলেই সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশীদের সার্চলাইট তোমার ওপর ফোকাস করবে। কপোত-কপোতীদের হালকা হাসি, অন্তরঙ্গ গুঞ্জন পেরিয়ে মনোরঞ্জনের মনে একটা ভাবনাই ঘুরেফিরে আসছে - শী ইজ্ প্রেগন্যান্ট!
ঝড় উঠবে, আকাশে কাতারে কাতারে জড়ো হয়েছে সিঁদুরে মেঘ। হাওয়া এদিক ওদিক পাক খাচ্ছে, আর ধুলোভরা মাঠে সমানে পা ঠুকছে প্রশিক্ষণরত বুনো ঘোড়ার মতন। একবার লাগাম ছিঁড়ে বেরোতে পারলেই ও আর কাউকে মানবে না। দুর্বার গতিতে ছুটতে থাকবে, সবকিছু ভেঙে, গুঁড়িয়ে তছনছ করে একটা নতুন ধ্বংসস্তুপের সৃষ্টি করবে। এই সৃষ্টির মধ্যেই ওর নির্বাণ লুকিয়ে আছে, তাই কিছুতেই ও ব্যর্থ হতে চায় না!

 

দুটো ডায়াগোনাল স্কোয়ারের চারটে সাইডে চারটে হেমিস্ফিয়ার একটানে আঁকা; কিরকম একটা ধাঁধা লেগে যাচ্ছে মনে। ক্লাশ ফোরে অঙ্কের মাস্টার সুধীনবাবু প্রায়ই বলতেন – ‘তুই, তুই একদিন বিশাল কিছু হবি রে’। অথচ মনোরঞ্জন আজকে এই সহজ ইকুয়েশানটাই সামলাতে পারছেন না। বাড়ির দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন। এখানে মনে হয় ইলেকট্রিকের ফেজ বিগড়েছে। সন্ধ্যের কলকাতা অন্ধকারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে। ভিজে চুপচুপ কাকের মতন অসহায় দেখাচ্ছে শহরটাকে!
অমৃতা নিজের ঘরে খাটের ওপর বসে আছে। দু হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে ও ফোঁপাচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে কান্নার জের অনেকক্ষণ চলছে। টেবিলে রাখা ওর মোবাইলটা থরথর করে কাঁপছে বারবার; ভাইব্রেশন মোডে আছে নিশ্চয়, কিছুক্ষণ আলো ছড়িয়ে আবার থেমে যাচ্ছে। মনোরঞ্জন দাঁড়িয়ে রইলেন। উনি জানেন ও কেন কাঁদছে, স্পষ্ট জানেন; তবু এক্সের দুটো ভ্যালুর কোনটা বাদ দেবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না।
“বাপি!”         
তাড়াতাড়ি একরাশ কালো চুল সরিয়ে ওঁর মা-মরা সুন্দরী মেয়ে চোখের জল মুছল।
“এতক্ষণ কোথায় ছিলে? দুপুরবেলা এসে খেয়ে গিয়েছিলে? তারকের মা বলতে পারল না, কিন্তু আমার মনে হল থালা, বাটি খালি থাকলেও তুমি খাওনি!”


মনোরঞ্জন একদৃষ্টে ওর জলে ভেজা বড় বড় চোখ দুটোর দিকে নিশ্চুপে তাকিয়ে রইলেন। 
“এ-বাবা, তুমি তো ভিজে একশা হয়ে গেছ!”
ওর মা চেয়েছিল নাম হোক এণাক্ষী। ওর চোখে একটা আশ্চর্য চাঞ্চল্য; এ জিনিস আগে কোনদিন দেখেনি তার পাগলা বাপ! দেখলে নামটার যৌক্তিকতা স্বীকার করতেই হত। আগেভাগে চুক্তি ছিল যে মেয়ে হলে নাম রাখার অধিকার মনোরঞ্জনের। ‘অমৃতা’ – যার মৃত্যু নেই, অনন্ত, অন্তহীন। মনোরঞ্জনের চিরকালই ইনফিনিটির প্রতি একটা তীব্র আকর্ষণ বোধ করেছেন।
অমৃতা এগিয়ে এল। অমৃতা – তাঁর সাহসী অথচ সতর্ক সচেতন মেয়ে। ও কি কিছু বলতে চায়?
“হাতদুটো তোল, সব ভিজে গেছে!”
মনোরঞ্জন হাত ওপরে করলেন। অমৃতার মুখটা অদ্ভুত কঠিন হয়ে গেছে। 
“কি হল? বাঁহাতটা ওপরে কর। অন্য একটা পাঞ্জাবী আনছি, পাজামাটাও পাল্টে নাও।” 
নিঃশব্দে সব আদেশ মানলেন উনি। তারপর মুখ ঝুলিয়ে সোফায় বসে রইলেন। আজকাল ইলেকট্রিসিটি গেলে চারপাশ কিরকম যেন থম মেরে যায়! ওনার ভালো লাগে এরকম সময়গুলো; আগে তাও লোডশেডিং হত মাঝে মাঝে। এখন প্রায় সবসময় আলো ঝলমলে; অন্ধকার বড় কম। কোনও রহস্যও তাই দানা বাঁধতে পারে না। 
হঠাৎ পাশের বাড়ি থেকে একটা গান বাজতে শুরু করল; বোধহয় মোবাইলে! 
“উঃ, উঃ...” অস্ফুটে মুখ থেকে বিরক্তি ছিটকে বেরোল।
অসহ্য! ইকুয়েশানটা যে কিছুতেই মেলানো যাচ্ছে না। কানদুটো প্রচণ্ড জোরে দুহাতে চেপে ধরলেন মনোরঞ্জন!
অমৃতার ঘরে ডোর লকের ফুটোটায় চোখ রাখলেন উনি। কিছুক্ষণ আঁধারে অস্পষ্ট থেকে ঘরের ভেতরের ছবিটা আস্তে আস্তে ফুটে উঠল। পশ্চিমের জানালার ঘষা কাঁচে এসে ধাক্কা খাচ্ছে রাস্তার নিওন আলো, চুঁইয়ে চুঁইয়ে এসে ছড়িয়ে পড়ছে ঘরে। আবছা আলো আঁধারিতে ওয়ার্ডরোবের সামনে আয়নাতে নিজের নগ্নতাকে মেলে ধরেছে অমৃতা। শুধু দুটো হাত উঠে এসে কান্নাভরা মুখটাকে রেখেছে আড়ালে।
দরজায় বারকয়েক নক করতেই খুলে দিল ও – ওঁর মা-মরা অসভ্য মেয়ে অমৃতা! একটা নাইটি গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে। আকাশি রঙটা ওর মা খুব পছন্দ করত। 
“বাপি, কিছু বলবে?”


কেউ যেন মনোরঞ্জনের কাঁধ ধরে খুব জোরে ঝাঁকিয়ে দিল। 
“বিনয়ের অবতার একেবারে! তখন থেকে… তখন থেকেই দেখছি তোমাকে! আই, আই, আই শুড হ্যাভ … তুমি পেয়েছটা কি! আমি পাগল বলে যা ইচ্ছে তাই করবে…” 
প্রচণ্ড আক্রোশে আকাশি নাইটির বুকের কাছে ফ্রিলের গোছাটা চেপে ধরলেন উনি।
“শালা, আমাকে পাগল পেয়েছ না? আই ওয়ান্ট টু সি; রাইট নাও। এতটুক সংযম শিখতে পারোনি! এই তোমার শিক্ষা! ইউ শ্যুড বি অ্যাশেমড অফ…”
“বাপি, স্টপ ইট! কি করছ, কি করছ বাপি!” 
অমৃতাকে জোর করে ঠেলতে ঠেলতে বিছানার কাছে নিয়ে এলেন মনোরঞ্জন।
“সব ছিঁড়ে ফেলব, শয়তান! কতদিন আর পাপ ঢেকে রাখবি?”
নাইটিটাকে মুহূর্তে ছিঁড়ে ফালা ফালা করে ফেললেন। ঘটনার আকস্মিকতায় অমৃতা মুখও ঢাকল না, লজ্জা নিবারণ করারও কোনো চেষ্টাই করল না! ঐ তো নাভিবৃন্ত! ঠিক তার নিচে, হ্যাঁ, সঠিক ঐ জায়গাতেই নির্ভুল এক দুর্যোধনী পদাঘাত করলেন।
বিশ্রী একটা আর্তনাদ করে অমৃতা ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে। ঘরের এক কোণে। বমির টকটক গন্ধটা একদম সহ্য করতে পারেন না মনোরঞ্জন – এক ছুটে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।


“এখানে কি মিস অমৃতা রায় থাকে?”
প্রায় চার বছর পর মেয়ে ছাড়া অন্য কাউকে গেট খুলে দিলেন মনোরঞ্জন। ভয় হয়; ওই বুঝি মৃত্যু এসে কড়া নাড়ল। ঠিক যেমন সেদিন ভোরবেলা পুলিশ এসে খবর দিয়েছিল অমৃতার মায়ের রোড অ্যাক্সিডেন্টের। তার আগের রাতে ভীষণ তর্কাতর্কি হয়েছিল দুজনার; ওর মায়ের অভিযোগ ছিল মনোরঞ্জনের সংসার করা উচিত হয়নি। অঙ্কের প্রফেসর হিসাবে মনোরঞ্জনের এত খ্যাতি, অথচ রোজগার একদম সাদামাটা! অমৃতাকে ঠিক ভাবে মানুষ করার জন্যে যে অনেক টাকার দরকার… 
ওর মা যে কতটা ভুল ছিল, বেঁচে থাকলে বুঝত। জীবনের ইকুয়েশানে টাকাটা কখনই ভ্যারিয়েবেল হতে পারে না! মনোরঞ্জন তারপর আর কোনওদিন ইউনিভার্সিটির ছায়াও মাড়াননি। অথচ চলে তো যাচ্ছে সংসার। মেয়েটা কি মানুষ হয়নি?  
মনোরঞ্জন প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়ে একটু পিছিয়ে এসে ড্রয়িং রুমে ঢুকলেন। আগন্তুক এক মুহূর্ত কি যেন ভেবে নিজেই মেন গেটটা বন্ধ করে দিলেন।
“যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে আজ, এত বৃষ্টি এই সময়ে ভাবা যায় না। সবকিছুই কিরকম বদলে যাচ্ছে! জুলাই, আগস্টে বৃষ্টি নেই, আর সব বৃষ্টি এইসময়!” 
মনোরঞ্জন দেখলেন ওনার জামা, প্যান্ট, সবই বেশ ভিজে গেছে। সমবয়স্ক ভদ্রলোকটি এবার ছাতাটা বন্ধ করে এক কোণে রেখে স্বচ্ছন্দে ভেতরে ঢুকে এসে সোফাতে বসে পড়লেন। 
“আপনি তাহলে ওর বাবা, ডক্টর মনোরঞ্জন রায়। আপনার নাম অনেক শুনেছি; আমাদের ইউনিভার্সিটির ম্যাথস ডিপার্টমেন্ট বলতে তো লোকে একবাক্যে আপনাকেই জানত!”
মনোরঞ্জনের মনে ‘জানত’ শব্দটা জোরে একটা ধাক্কা দিল…দ্য ডিকে অফ ভ্যালু ওভার টাইম।         
পকেট থেকে সিগারেট কেস বার করে একটা গোল্ড ফ্লেক ধরালেন ভদ্রলোক। মনোরঞ্জন ওঁর দিকে বাড়িয়ে ধরা সিগারেটের দিকে না তাকিয়েই বললেন, 
“অনেকদিন ছেড়ে দিয়েছি।”    
বহু বছর পর কারোর সাথে কথা বলতে এখন আর ভয় করছে না তাঁর।
“আমার নাম রথীন ঘোষ। আমি একটা প্রোপোজাল নিয়ে এসেছি আপনার কাছে!”
রথীনবাবু একটু থামলেন। 
“আমার ছেলে একটা রাস্কেল! আগে ভয়ে বলেনি আমাদের… অমৃতা মায়ের গর্ভে যে আসতে চলেছে সে যে আমাদের কত আপন, সেটা একবার ভেবেও দেখেনি! চাবকানো উচিত এরকম ইরেস্পন্সিবল ছেলেকে! যাইহোক...”
মনোরঞ্জনের ভাবলেশহীন মুখের দিকে একবার দেখলেন ভদ্রলোক। মনে হল কিছু প্রতিক্রিয়া আশা করছিলেন।  
“আমরা চাই যত তাড়াতাড়ি বউমাকে ঘরে তোলা যায়!”
কথাগুলো ওঁর কানে গেলেও, মনের অব্যক্ত বেদনা যেন সেসব চাপা দিয়ে দিল। মনোরঞ্জনের ষষ্ঠেন্দ্রিয় টের পেল অন্তরালে কারোর উপস্থিতি। কেউ একজন, তাঁর একান্ত আপন একজন; নিশ্চুপে ওঁদের কথোপকথন শুনছে। 


প্রলয়ঝড়টা থেমে গেছে। ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে অনাগত নির্বাণ লাভ করেছে!
ট্রেনের আলোটা ঝড়ের গতিতে এগিয়ে আসছে! লাইন ধরে, মনোরঞ্জন – অমৃতার পাগল বাপ… অকুতোভয়ে সুস্থ মস্তিষ্কে এগিয়ে চলেছেন অমৃতলোকে, চিরমুক্তির খোঁজে…

  • প্রান্তিক বিশ্বাস