কান্না জাগানো বৃষ্টির শব্দ

আচ্ছা, বৃষ্টির জলের ছিটে লেগে হ্যারিকেনের কাচ ভেঙে যাওয়ার চড়চড়ে শব্দ এখনও কি শুনতে পাওয়া যায় স্মৃতির আস্তরণ ভেদ করে--

এখন যেন কেমন একটা একটেরে বর্ষা পড়ে। সেই আগের মতো আকাশ ছাওয়া মেঘ, গোটা দিগন্ত জুড়ে মেঘেদের খেলা, মাঝে মাঝে গুরুগুরু ডাক, আর ঝমঝমে বৃষ্টি, এসব যেন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ব্যারাকপুরে মেঘ জমেছে, তো খোদ কলকাতা শহরে মেঘের নাম গন্ধ নেই।

বর্ষাকালে এমনটা কিন্তু আমরা কখনও দেখতে পেতাম না। এমনটা দেখতাম শরৎকালে। আর শরতের মেঘ ছিল পেঁজা তুলোর মতো। বর্ষার মেঘ ঘন গম্ভীর ।

সব কেমন বদলে গেছে। বদলে যাচ্ছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর কথা বলবেন। অবাধে গাছপালা কেটে ফেলার কথা বলবেন। পুকুর বুজিয়ে বহুতল তোলবার কথা বলবেন। বিষয়গুলি নিশ্চয়ই প্রকৃতির নিজস্ব চরিত্র বদলে যাওয়ার পিছনের বৈজ্ঞানিক কারণ। কিন্তু প্রকৃতির বদলে যাওয়া, তার সঙ্গে তো আমাদের মানুষের মনটাও কেমন বদলে যাচ্ছে।

আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগে গ্রীষ্মের যে দাবদাহ ছিল তা আমাদের অসহ্য লাগলেও আজকের মতো সেই দাবদাহে কিন্তু আমরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠতাম না। তখন এত ঘরে ঘরে এসি তো দূরের কথা, সিলিং ফ্যান পর্যন্ত ছিল না। গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল না সেভাবে। আর থাকলেও সেগুলি ছিল ধনীর ঘরে। সাধারণ গরিব মানুষ, তাঁরা ইলেক্ট্রিসিটির সুবিধা সেভাবে পেতেনই না ।

আজকের দিনে ধনী-দরিদ্র -মধ্যবিত্ত নির্বিশেষে নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা কেরোসিন তেলের লাইনে দাঁড়ানোর ভাবনা ভাবতেই পারবে না। তখন যখন শোনা যেত অমুক দিন কেরোসিন তেল দেবে, সেই তমুক দিনটির সকালবেলায় পাড়া ঝেঁটিয়ে  আমরা ছুটলাম কেরোসিন তেলের দোকানের সামনে। কারওর হাতে একটা ভাঙা টিন। কেউ বা নিয়েছে ভাঙা বালতি। কারও হাতে তোবড়ানো মগ।

এগুলো দিয়ে ভাঁজা রাখা হত। সকালবেলা এই কাণ্ড করে এসে, কোনওমতে দৈনন্দিন কাজ সেরে, স্কুল থাকলে স্কুল, স্কুল না থাকলে বাড়িতে যেটুকুনি যা করণীয় ছিল, সেসব সেরে, দৌড় দেওয়া হতো কেরোসিন তেলের দোকানে। তখন থাকতো হাতে নির্দিষ্ট কেরোসিনের টিন। ভাঁজার ওইসব ভাঙাচোরা জিনিসগুলোকে সরিয়ে দিয়ে,  সেখানে টিন বসিয়ে রাখা হতো ।

এই ভাজা সরানো নিয়েও ঝগড়া, মনোমালিন্য কম হতো না। কিন্তু আর যাই হোক, সে সব দিনে, নানা ধরনের সংকটের মধ্যেও, ভাঁজা ঘিরে টুকটাক ঝগড়াঝাঁটি হলেও, মারামারি দূরের কথা, হাতাহাতির পর্যায়ে কিন্তু বিষয়টা কখনও যেত না ।

ছোটরা যদি কখনও কোনও রকম সংঘাতে জড়িয়ে পড়ত, তাহলে সেই কেরোসিনের লাইনে যে দু-চারজন প্রবীণ মানুষ থাকতেন,  তাঁরাই কিন্তু ওসব ঝামেলা ঝঞ্ঝাট আপোসে মিটিয়ে দিতেন। আর এখনকার দিন হলে ,আপোষে মেটাতেই বোধহয় মানুষ ভয় পেয়ে যায়। নাকি তাঁরা মনে করে, ঝগড়া লাগুক। মারামারি হোক। আর আমরা, মোবাইলের ভিডিওতে সেসব ছবি তুলি। তারপরে সেটা সমাজ মাধ্যমে ছেড়ে দিয়ে বাহবা কুড়োই।

আর এমন মানসিকতাও হয়তো থাকে, ইনস্ট্যান্ট সাংবাদিক সেজে, সেসব ঘটনার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে, কোনও না কোনও বৈদ্যুতির মাধ্যমে বিক্রি করে দিয়ে, দু'পয়সা উপার্জন করা। বর্ষার রকম ফের বলতে গিয়ে আবার সামাজিক সমস্যার অন্দরে ঢুকে পড়ছি। আসলে সেই ৩০-৪০ বছর আগের বর্ষা ঘন কালো মেঘ আকাশে। সারাদিন বৃষ্টি পড়েই চলেছে, পড়েই চলেছে। দিনের বেলাতেও কেরোসিনের বাতি জ্বালিয়ে ঘর সংসারের দৈনন্দিন কাজ সারছেন মা-বোনেরা -- এ দৃশ্য তো আর আজকের প্রজন্ম কখনও দেখেনি। তাই তাঁদের কল্পনাতেও সে দৃশ্যের কোনো ছবি ভেসে উঠবে না ।

কিন্তু এই কেরোসিনের আলো জ্বালাবার মধ্যেও সে যুগে অর্থনীতির ছবিটা এমন ভাবে ছিল যা ভাবলে আজও কেমন যেন মনটা উদাস হয়ে যায়। গরিব ঘরে ব্যবহার হতো কেরোসিনের কুপি। একটা কাপড়ের সলতে দিয়ে সেটা জ্বলত। বৃষ্টির দমকা হাওয়ায় সেই কূপির আগুন নড়াচড়া করছে। আর কুপির আগুনে যে প্রতিবিম্ব পড়ছে মাটির দেয়ালে বা যাঁদের ইটের দেওয়াল তোলবার সামর্থ্য ছিল, সেই ইটের  দেওয়ালেও যে প্রতিবিম্ব পড়ছে, তাতে রন্ধনরত মা-কে প্রতিবিম্বের মধ্যে হেলতে দুলতে দেখা, সে যে কি আশ্চর্য ভাললাগা অনুভূতি ছিল। আজ মডুলার কিচেনের মধ্যে যখন রন্ধন শিল্পীকে দেখে পরের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা, সেদিনের সেই ছবিটা তাঁরা কল্পনাই করতে পারে না।

রন্ধনশিল্পী কথাটা এই কারণেই উচ্চারণ করলাম এখানে যে,  এ যুগে সাধারণত বাড়ির মায়েরা খুব একটা রোজকার ডালভাত তরকারি রাঁধতে হেঁশেলে ঢোকেন না। না ঢোকবার বিস্তর কারণ আছে। মায়েরা বেশিরভাগই কর্মরত মহিলা। ফলে দিনের শুরুতেই তাঁদের কর্মস্থানে যাওয়ার তাগিদ থাকে। গৃহ সহায়িকারাই রান্নার দায়িত্ব নেন ।

সে কারণে মডুলার কিচেনের যদি আস্তরন ভেদ করেও দেয়ালে কোন প্রতিবিম্ব পড়ে ,  সে প্রতিবিম্বে মা ফুটে ওঠেন না। ফুটে ওঠেন মাসিক মাইনে করা গৃহ সহায়িকা। আজকের ভাষায় যাঁকে এপার বাংলায় বলা হয়, মাসি, পিসি। আর ওপার বাংলায় বলা হয় 'বুয়া।'

একটু যাঁদের ঘরে লক্ষ্মীর কৃপা বর্ষিত হয়েছিল, সেসব ঘরে হ্যারিকেন, তারপরে নানা ধরনের কেরোসিনের টেবিল ল্যাম্পের চলন ছিল। এগুলো ছিল সেকালে ট্যাঁকের ওজনের জানান দেওয়ার নানা ধরনের উপকরণ। সেসব যাই হোক ,বর্ষায় ইলেকট্রিক থাকুক বা না থাকুক, যদি কেরোসিনের বাতি জ্বালানোর দরকার পড়ত, তবে একটু বড়লোক মানুষজনেরাও হ্যারিকেন বা নানা কিসিমের সুন্দর-সুন্দর কেরোসিনের টেবিল ল্যাম্প জ্বালাতেন না। কুপি বা লম্ফো জ্বালিয়ে বেশি কাজ করতেন ।

তার পেছনে কারণ হল, বৃষ্টির জলের যদি কোনভাবে এক ফোঁটা ছিটে এসে সেই হ্যারিকেন বা সুন্দর শৌখিন পোশাকি কেরোসিনের টেবিল ল্যাম্পের চিমনির গায়ে,  তাহলে সেই চিমনি ফেটে যাবে। হ্যারিকেন বা অন্য কোনও কেরোসিনের বাতির  চিমনি ফেটে যাওয়ার সেই শব্দ, আর সেই শব্দকে ঘিরে বাড়ির বড়দের একটা হায় হায় রব-- এসব কোথায় হারিয়ে গেছে। হায় হায় রব এ কারণেই উঠত, ওই চিমটা মফস্বলে বা মফস্বলের আরও গহীনে খুব একটা পাওয়া যেত না ।

দু-একটা দোকান ওই ধরনের চিমনি রাখত। বিশেষ করে হ্যারিকেনের চিমনি। কারণ, নানা ধরনের বাহারি কেরোসিনের বাতির খুব একটা চল আজ থেকে ৪০-৪৫ বছর আগে মফস্বলে খুব একটা ছিল না। এখনও মনে পড়ে, হেরিকেনের চিমনি ফেটে গেছে জল পড়ে। সযত্নে আমরা বাড়ির ছোটরা, কাগজ দিয়ে, আঠা দিয়ে, সেই ফাটা চিমনির গায়ে পট্টি লাগাচ্ছি ।

আসলে এই যে ঘরে বাইরে যাপন জনিত সম্পর্ক তৈরিতে  মিতব্যয়ী হওয়া, তার একটা ধারণা তৈরি করা-- এগুলো হয়তো পরবর্তীকালে আমাদের জীবনকে একটা অন্যরকম ভাবে পরিচালিত করতে পেরেছে। এই যে সেদিন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জায়া স্বাতী  গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে শুনছিলাম, তিনি কিভাবে এককালে কলকাতা শহরের বেশ কিছু বড়লোক, যাঁরা ব্র্যান্ডেড জামা কাপড়ে অভ্যস্ত, সেইসব লোকজন, ওই ধরনের জামাকাপড় একবার বা দু'বার পরে আর পরেন না। আবার নতুন নতুন জামা কাপড় পরেন ।

স্বাতী  গঙ্গোপাধ্যায় তাঁদের কাছ থেকে একেবারে চেয়ে চিন্তে সেই পোশাকগুলো আনতেন। আর নানা ধরনের দুর্গত মানুষদের হাতে সেগুলো তুলে দিতেন। কারও হয়তো গঙ্গার ভাঙনে বাড়ি তলিয়ে গেছে। কেউ হয়তো বন্যায় গৃহহারা হয়েছে। খুব নীরবে নিভৃতে সেই সমস্ত মানুষদের কাছে ওই বড়লোকদের পরিত্যক্ত কাপড়গুলো পৌঁছে দিতেন স্বাতী।

আসলে এই যে দিনগুলো, বর্ষার সেকালের মতো, কেমন যেন হারিয়ে গেছে। এখন যেমন একদিন দু'দিন জুড়ে আকাশ কালো হয়ে, দিগন্ত কাঁপিয়ে আর বর্ষা নামে না। বৃষ্টির ছাঁট আসে আজও কাঠের জানলার সঙ্গে থাকা স্লাইডিং ডোর দিয়ে ।

সেই বৃষ্টির জল আসাকে আমরা আটকে দিই। এখন আর কারো মনের মধ্যে হয়তো পান্না কায়সারের মতো সেই অনুরণন জাগে না , যেখানে কবিতার ছন্দে ,পান্না বলছেন; 'বৃষ্টির শব্দ না এলে কান্না আসে না।' এখন কাঁদতে গেলেও নানা ধরনের রাসায়নিক লাগে। হয়তো সেকালের গ্লিসারিনের থেকে একালের প্রযুক্তির নিত্য নতুন কৌশলে আরও অনেক নতুন, ভালভাল জিনিস এসে গেছে , যাতে অঝোরে চোখের জল ঝরানো যায়। সেজন্য হয়তো আর ড্রাই আইতে ভোগা মানুষ কখনও ভাবেন না আর্টিফিশিয়াল টিয়ারের প্রলেপ দিয়ে চোখকে শান্ত রাখতে ।

এখন তো আর ঠাকুমা, দিদিমা, পিসিমা, মাসিমা, মায়েদের সেই প্রজন্ম নেই, যাঁরা গায়ের ঘামাচি শুকোতে বৃষ্টির জলের প্রলেপ দিয়ে কিছুটা আরাম পাবেন। এখনও যাঁরা খেটে খান সেই মানুষগুলো ঘামাচির যন্ত্রণায় রাতে ঘুমোতে পারেন না। চিড়বিড় করে গা। হয়তো এখনও কোনও ঘামাচিতে ভরা মায়ের পিঠ, তাঁর মেয়ে নখ দিয়ে টিপে টিপে গেলে দেয় সেই ঘামাচি। আর সেই  হয়তো ছোট্ট ঘরের সামনে এক ফালি ফাঁকা জায়গায়, বৃষ্টি হলে পেতে রাখে কোনও বাটি বা থালা। যেখানে জমতে থাকে বৃষ্টির জল। তার মনে এই প্রত্যাশা-- ওই বৃষ্টির জল গায়ে মেখে আরাম হবে মায়ের ঘামাচির।

  • শ্যামলী ভট্টাচার্য