নেত্রকোণার এক অজানা বাউল

 

জানা বাউলের ভিড়ে অজানা থেকে গেছে বহু অজানা বাউল। প্রচারের আলো তাঁদের গায়ে না পড়ায়, ধীরে ধীরে চলে গেছেন তাঁরা বিস্মৃতির অন্ধকারে। এমনই এক মরমী সাধকের কথা--

এখন সবাই বাংলাদেশের নেত্রকোনাকে একটা পৃথক জেলা হিসেবেই চেনে। অবিভক্ত বাংলায় নেত্রকোনা ছিল ময়মনসিংহ জেলার একটি অংশ। বাংলার লোকায়ত  সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান ধারা বাউল। আর সেই ধারার প্রচার, প্রসার অবিভক্ত ময়মনসিংহ জুড়ে ছিল ব্যাপক আকারে।

এপার বাংলায় বর্তমানের বাংলাদেশের বাউল ঘিরে আলোচনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখতে পাওয়া যায়, ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ থাকে সাধারণত কুষ্টিয়া জেলাকে ঘিরে। যেহেতু মহাত্মা লালন কুষ্টিয়ার মানুষ ছিলেন , তাই কুষ্টিয়াকেই বাউলচর্চার একটা বড় কেন্দ্রভূমি হিসেবে ধরে নিয়ে, এ ধরনের আলোচনা চলে ।

তবে লালন যে সময়ে এই পৃথিবীর বুকে তাঁর কর্মকাণ্ড রেখেছিলেন, তখন কিন্তু কুষ্টিয়া ছিল বৃহত্তর নদিয়া জেলার অংশ। তাই লালনকে কুষ্টিয়ার মানুষ বলে চিহ্নিত করা ,এটা বোধহয় সব সময় ঠিক বাস্তবসম্মত হয় না।  আসলে লালন সুনির্দিষ্ট ভূখন্ডে আবদ্ধ কোনও মানুষ নন। লালন ছিলেন গোটা পৃথিবীর নিজের মানুষ। সমস্ত দেশের নিজের মানুষ। সমস্ত মানুষের, মনের মানুষ।

অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলাতে হিন্দু ধর্ম এবং ইসলাম ধর্মের ব্যাপক প্রচার সত্ত্বেও জৈনদের একটা প্রভাব কিন্তু ছিল। ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলে জৈনদের নানা মন্দির, উপাসনালয় আজও দেখতে পাওয়া যায়। তার মধ্যে নেত্রকোনাতেই বহু জৈন উপাসনালয়ের সন্ধান পাওয়া যায় ।

এমনই একটি জৈন সাধনক্ষেত্র হচ্ছে দিগযান মন্দির। সেই মন্দিরের সেবায়েত ছিলেন কুটিশ্বর সাধু। কুটিশ্বর সাধু সম্পর্কে বাউল ঘিরে চর্চাকারি মানুষদের মধ্যে খুব বেশি আলোড়ন দেখতে পাওয়া যায় না। কিন্তু মানুষের কথা যেভাবে কুটিশ্বর অল্প কিছু গানের মধ্যে দিয়ে বলে গিয়েছেন, সেগুলির মর্মার্থ আজও আমাদের শিহরিত করে।

আসলে আমাদের দুই বাংলারই জানা-অজানা বহু ক্ষেত্রে এমন বহু লোকায়ত ধর্মের সাধন ভজন করা মানুষজন আছেন, যাঁদের ঘিরে আজও সেভাবে আলোচনা সুধীজনের সামনে উঠে আসেনি। তেমনই একজন হলেন এই কুটিশ্বর সাধু। দিগ যান মন্দিরে প্রায় গোটা সময়টাই তিনি সাধন ভজন আর ধ্যানে নিজেকে ব্যপৃত রাখতেন। কুটিশ্বর সাধু যখন জীবিত ছিলেন, তখন বহু মানুষের ভিড় লেগেই থাকতো ওই দিগ যান মন্দিরকে ঘিরে ।

ভক্তদের কাছে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম নয়, মানব ধর্মের নানা কথা খুব সহজ সরল ভাবে ব্যাখ্যা করতেন। সৃষ্টিকর্তার প্রতি যে মানুষদের আকুল আকর্ষণ ছিল, সেই মানুষদের সৃষ্টিকর্তার পথে পরিচালিত করবার ক্ষেত্রে,  কুটিশ্বর,  নিজেকে আত্মনিবেশিত রাখতে পছন্দ করতেন। কোন পথে সাধন ভজন করলে সৃষ্টিকর্তার কাছে পৌঁছানো সম্ভব,  আধার বিশেষে সেই রকম পরামর্শ তিনি দিতেন। কুটিশ্বরের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য তাঁর ভক্তরা, অনুরাগীরা সব সময় আকুল থাকতেন। কুটিশ্বরের উপদেশ বিতরণের ক্ষেত্রে প্রধান উপকরণ ছিল ,'গান।'

কুটিশ্বরের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য মানুষের যে ব্যাকুলতা সেটা ছিল দেখবার মতো। একটা বিষয়, জাতি ধর্মের নানা বেড়াজালকে অতিক্রম করে, কী ভাবে লোকায়ত সাধনার ভেতর দিয়ে মানুষের কথা, মানুষকে বলে, মানুষকে আপনার করে নিতে পারা যায়, এই যে শিক্ষা কুটিশ্বর দিয়ে গিয়েছেন, তার প্রবাহমানতা আজও বিদ্যমান রয়েছে।

সেখানে  হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালি সমাজের জন্যে তাঁর সাধনার প্রথম এবং প্রধান উপকরণ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন গানকে। কুটিশ্বর নিজে অসামান্য দর্শন সমৃদ্ধ গান রচনা করতেন। আর সেই গানই ছিল তাঁর ঈশ্বর উপাসনার একমাত্র উপকরণ। গানের ভেতর দিয়েই মানুষের মনের সমস্ত রকমের সংশয় দূর করা, এটাই ছিল তাঁর সাধনার একটা অঙ্গ ।

 মানুষ রতনের সন্ধানে গানকে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে সিদ্ধি লাভের যে পথ কুটিস্বর সাধু দেখিয়ে গিয়েছিলেন, সে পথ ধরে অনেককাল বহু মানুষ নিজেদের পরিচালিত করেছিলেন। বাংলাদেশের নানা ধরনের আর্থ -সামাজিক -সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক উত্থান পতনের মধ্যে দিয়ে কুটিশ্বরের সাধনার যে ধারা সেই ধারাটি কিন্তু মানুষের মনের গহীনে একটা বড় জায়গা করে নিয়েছিল।

গানের ভেতর দিয়ে কুটিশ্বর নিজেকে সৃষ্টিকর্তার প্রতি নিবেদিত করেছিলেন ।আর তাঁর অনুরাগী, অনুগামীদেরও সেই গানের মধ্যে দিয়েই সৃষ্টিকর্তার প্রতি নিজেকে নিবেদনের উপদেশ তিনি দিয়ে গিয়েছেন। কুটিশ্বরের গান শুনলে বোঝা যায়,  দর্শনের কি গভীর অনুরণনের মধ্যে দিয়ে তিনি নিজেকে ব্যপৃত  রেখেছিলেন।

কুটিশ্বরকে যাঁরা দেখেছিলেন, তাঁদের কাছে খুব বিস্ময়ের বিষয় ছিল যে ,গভীর আত্মনিবেদনের মধ্যে দিয়ে, দিগজান মন্দিরে তিনি সংগীত পরিবেশন করতেন, সেই পর্যায়টি। বহু মানুষ সেই অবস্থাতে কুটিশ্বরকে দেখে যে বিস্ময়াপন্ন হয়েছিলেন, তাঁদের সেই বিস্ময় অনেকাল কাটেনি।

কুটিশ্বরের অনুরাগী, অনুগামীদের মধ্যে তাঁর সেই গান গাইতে গাইতে দেবতার প্রতি একাত্ম হয়ে যাওয়ার দিকটি বিশেষভাবে রোমাঞ্চকর এক অভিজ্ঞতা। কুটিশ্বর নিজের সাধনলব্ধ অভিজ্ঞতা তাঁর ভক্ত, শিষ্য, অনুরাগীদের মধ্যে অকাতরে বিলিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে ছিলেন অক্লান্ত।

এখানে প্রচলিত বাউলদের সঙ্গে তাঁর অবস্থানের কিছুটা ফারাক দেখতে পাওয়া যায়। বাউলরা যেমন তাঁদের সাধনার গুহ্য তত্ত্বকে বিশেষ গুরুত্ব দেন। কুটিশ্বর কিন্তু খুব তেমনটা ছিলেন না। যে কেউ তাঁর কাছে আধ্যাত্মিক উপদেশ চাইতে এলে, তাঁকে পথ দেখানোর ক্ষেত্রে কুটিশ্বর  ছিলেন অকৃপণ। কেবলমাত্র তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিন সঙ্গ করেছে, এমন কোনও মানুষকেই তিনি তাঁর সাধনার গুপ্ত কথা বলবেন, তেমনটা তিনি কখনও ছিলেন না। ফলে তাঁর তরিকায় যাঁরা পরিপূর্ণভাবে আস্থাশীল নন, এমন বহু মানুষের কাছেও কুটিশ্বর  অকাতরে তাঁর সাধনলব্ধ অভিজ্ঞতা এবং সাধন তত্ত্বের কথা বলেছেন ।

আসলে কুটিশ্বরের দৃষ্টিভঙ্গিটা ছিল, মানুষ যেন মানুষ রতনের প্রতি আত্মনিবেদনকারী এক সেবকে পরিণত হয়। সেই উদ্দেশ্যেই তিনি তাঁর সাধনলব্ধ অভিজ্ঞতা অকাতরে মানুষদের কাছে বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সে কারণে তাঁর অনুরাগীদের মধ্যে ধারণা,  যাঁরা কুটিশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করেছেন ,তাঁরা প্রত্যেকেই মানুষ রতনের সন্ধানে সত্যিকারের পথ পেয়েছেন।

কুটিশ্বরের অন্যতম প্রিয় শিষ্য ছিলেন দিন মাঝি। এই দিন মাঝির মধ্যে সাধক কুটিশ্বর সাধু খুঁজে পেয়েছিলেন প্রবল সম্ভাবনা। মানুষ রতনের সার্বিক বিকাশের ক্ষেত্রে দিন মাঝি যে একদিন বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করবে, সেই বিশ্বাস কুটিশ্বর দেখছিলেন। আর সেই বিশ্বাস থেকেই নিজের সাধনলব্ধ সমস্ত চেতনাকে, অনেকটা শ্রী রামকৃষ্ণ যেভাবে তার প্রিয় শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যে সঞ্চারিত করেছিলেন, ঠিক সেভাবেই কুটিশ্বর সাধু সঞ্চারিত করেছিলেন ।

এ ভাবেই হয়ে উঠেছিলেন দিন মাঝি এক সার্থক বাউল। কুটিশ্বর সাধুর জীবনকালে তাঁর গান গোটা পূর্ববঙ্গে বিশেষ জনপ্রিয় ছিল। কালের প্রবাহে কুটিশ্বরের সাধনধারা এবং তাঁর গান অনেকখানি হারিয়ে গিয়েছে বাঙালির জীবন থেকে। যেহেতু কুটিশ্বর  তাঁর জীবৎকালে বা প্রয়াণের অব্যবহিত পরে সেভাবে প্রচার মাধ্যমের  খুব একটা ঝলক পাননি বা লোকসংস্কৃতি ঘিরে যাঁরা সুধী সমাজের কাছে বিভিন্ন সন্দর্ভ তুলে ধরেন, সেই সমস্ত মানুষদের বিশেষ একটা সাহচর্য পাননি ,সে কারণে তাঁর নামটিও সেভাবে প্রচার লাভ করে নি।

তাঁর অন্যতম প্রিয় শিষ্য দিন মাঝি জীবৎকালে যেভাবে কুটিশ্বরের গান এবং দর্শনের প্রসার লাভ ঘটেছিল, সেই ধারাবাহিকতা খুব একটা পরবর্তীতে প্রসার লাভ ঘটেনি। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই তাঁর সান্নিধ্যে আসা মানুষজনেরা যখন ধীরে ধীরে পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চ থেকে অবসৃত হয়েছেন, সেই পরম্পরাটা তারপরের প্রজন্মে সঞ্চারিত হওয়ার কাজটা খুব একটা ঘটেনি।

সে কারণে আজ বাংলা বা বাঙালির মনলোকে নেত্রকোনার দিগ যান  মন্দিরের সেবাইত কুটিশ্বর সাধুর গান বা সাধনার ধারা বা দর্শন আর তেমনভাবে চর্চার মধ্যে আসে না। হারামণি গ্রন্থের কিংবদন্তি তুল্য স্রষ্টা মহাম্মদ মনসুর উদ্দিন তাঁর একটি গান সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু তিনিও আক্ষেপ করতেন কুটিশ্বরের সাধনার বিভিন্ন আঙ্গিক কেন্দ্রিক সমস্ত গানগুলি সংগ্রহ না করতে পারার জন্য। মনসুরউদ্দীন অত্যন্ত আক্ষেপ করে বলতেন;  নেত্রকোনার কুটিশ্বর  সাধু প্রায় তিন লাখ পীরের পাঁচালী রচনা করেছিলেন। বহু চেষ্টা করেও সেই পীরের পাঁচালীগুলি মহাত্মা মনসুর উদ্দিন সংগ্রহ করতে পারেননি।   

পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের নানা ধরনের রাজনৈতিক উত্থান পতন , বিশেষ করে পাক হানাদাদের ভয়াবহ অত্যাচার ইত্যাদির ফলে কুটিশ্বরের গানগুলি আর সেভাবে সংগ্রহ করা সম্ভবপর হয়নি। কুটিশ্বরের একটি গান এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে;

মাগো

দেখলাম না তোর রূপটি কেমন

আমি জন্ম অন্ধ নাই মা আমার দুটি নয়ন। বাহিরে দেখিলে যে রূপ অন্তরে রূপহয়না স্মরণ

আমার অন্তরে বাহিরে আঁধার কি রূপে করি দর্শন ।

কারিগরে তোমায় গরে ভক্তজনের মনের মতন

তোমায় যে সাজে  সে সে  সাজায়

সে সাজ ধারণ কর তখন।

কেউ বলে না চতুর্ভোজ

দশভোজা  বলে কয়জন ।

কেহ বলে দিল বোঝা মা

যার মনে যা জাগে যেমন ।

কেহ বলে কালা কালি

কেহ বলে সাদা বরণ

কেউ বলে গৌরী রূপে

আলো করে কৈলাস ভূবন

  • শুভ্রদীপ্ত ভট্টাচার্য