সম্পাদকীয়


শাঁটুল গুপ্ত, বসন্ত চৌধুরীদের কালেকশন দেখে বড় হয়েছি। আর এখন ফেসবুকের দৌলতে দেখি এখান ওখান থেকে কিনে এনে, ম্যানেজ করে এনে , প্রায় সবাই ই কালেকটর হয়ে যাচ্ছে। সমাজ মাধ্যমে নিজের নাম খোঁদাই করে ছবি দিচ্ছে সেইসব কালেকশনের। তারা নিজেরাও জানে সেসব নেট দুনিয়ায় খোদাই করা নাম নেট দুনিয়ার সাহায্যেই মুছে ফেলা একটা চুটকির মত বিষয় অনেক মানুষের কাছেই।
শাঁটুল গুপ্তদের প্রজন্মের কালেকশন ঘিরে সেভাবে নিজেদের ধারণা তৈরি করবার সুযোগ ই আজকের প্রজন্ম পায় নি।এজন্য অবশ্য আজকের প্রজন্মকে অবশ্য দায়ী করলে চলবে না। শাঁটুলবাবুদের প্রজন্ম আজকের মত নিজেকে বা নিজেদের বিজ্ঞাপিত করতেন না।ফলে তাঁদের খুব ঘনিষ্ঠ বৃত্তের বাইরের মানুষদের সেসব কথা জানবার তেমন একটা সুযোগ ও থাকতো না।
                          বসন্ত চৌধুরীর শাল আর গণেশ সংগ্রহের কথা আজ কজন জানেন? এই সংগ্রহ কিন্তু তিনি কেবলমাত্র পুরনো জিনিষের দোকান বা অকশন হাউজ গুলো থেকে কিনতেন না।এগুলি সংগ্রহের জন্যে নিজের কেরিয়ার কে পাত্তা না দিয়ে বসন্ত চৌধুরী যে দেশের এবং বাংলাদেশের কত আনাচে কানাচে ঘুরেছেন, সেখান থেকে সেসব সংগ্রহ করেছেন- সেসব কথা বলতে গেলে গোটা একটা বই হয়ে যাবে।
                         আসলে সেকালের সংগ্রাহকদের মধ্যে সংগ্রহের নেশাটাই ছিল প্রবল। সেইসঙ্গে ছিল সংগ্রহ করা জিনিষটার ইতিহাস, সমসাময়িকতা এগুলো খুঁজে বের করবার একটা প্রবল তৃষ্ণা। কোনো রকম চালাকির মধ্যে দিয়ে তাঁরা এসব সংগ্রহ করতেন না ।সংগৃহীত জিনিষপত্রের একটা কাল্পনিক ইতিহাস ও তৈরি করতেন না। একেবারে রসায়নবিদ্যাতে যেমন গবেষণাগারে পরীক্ষিত সত্য কে যাচাই না করে যেমন কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছনো হয় না, ঠিক তেমন ভাবেই সেকালের সংগ্রাহকেরা তাঁদের অমূল্য সংগ্রহ ঘিরে যাচাই করে তথ্য সংগ্রহ করতেন ।
                    পুরান ঢাকায় বেশ কয়েকটি পরিবার পাওয়া যায় , যাঁরা দাবি করেন, তাঁরা নবাব সিরাজদ্দৌলার বংশধর।এক প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সিরাজের বংশধরদের ঘিরে একটা রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজের মত বই লিখেছিলেন।বইটা আবার সেসময়ের শাসকদল কর্তৃক পুরস্কৃত ও হয়েছিল।ফলে এপার বাংলা - ওপার বাংলা , দুই জায়গাতেই ,ব্রিটিশ যেভাবে সিরাজের উপর একটা লাম্পট্যের আস্তরণ ফেলেছিল, তার একটা স্থায়িত্ব তৈরি হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
                      এরফলে এখন পুরান ঢাকার আনাচে কানাচে সিরাজের বংশধর আর সিরাজের ব্যবহৃত , লুৎফুন্নেসার ব্যবহৃত সামগ্রী দেখতে পাওয়া যায়! এই ' ব্যবহৃতে' র প্রকৃত ইতিহাস কি, কেই জানেন না।বিষয়টা অনেকটা সত্যজিৎ রায়ের ' গণশত্রু' ফিল্মের চরণামৃত কে ঘিরে ' বিশ্বাসে' র মত হয়ে যায় আর কী। ' বিশ্বাস' কে কেন্দ্র করে এখন খোদ আদালতের রায় যখন প্রভাবিত হচ্ছে , তখন এই বিশ্বাসবাদীদের যুক্তি হতেই পারে; আমাদের মনগড়া ইতিহাস ই বা কেন বিশ্বাসের পালে ভর করে ডানা মেলতে পারবে না? 
পূর্ববঙ্গের মানুষেরা এককালে ' আজাইরা' শব্দটাকে অহেতুক শব্দের স্থানীয় কথ্যরূপ হিশেবে ব্যবহার করতেন। আজকের বাংলাদেশের আনাচে কানাচে গেলে এখন ও এমন শব্দ শুনতে পাওয়া যাবে। গানের রেশের মত ই সেই আজাইরা কথা হিশেবেই যদি আমরা ধরি , যুক্তিহীনতাই হলো যুক্তি, সেটাই আজ অনেকে ' যুক্তি' র পরাকাষ্ঠা বলে ঠাওর করে নেবে।সেভাবে সংগ্রহ আর সংগ্রাহক এবং তার পিছনের গপ্পো কে ইতিহাস বলে চালাতে চাইবে। 
                  প্রায় বছর পঁচিশ আগের ঘটনা।নৈহাটি স্টেশনের সামনে সেখানটায় ছিল ' বসন্ত কেবিন' , সমরেশ বসুদের রোজকার আড্ডার জায়গা।যেখান থেকেই তৈরি হয়েছিল সমরেশের কালজয়ী উপন্যাস,' শ্রীমতী কাফে' র উপাদান,সেখানে সময়ের নিরিখে তখন ছিল একটা পুরনো খবরের কাগজ, বইখাতার দোকান। পুরনো বইয়ের দোকানে হানা দেওয়া অনেকের ই অভ্যাস।আমার ও।পুরনো বই, পুরনো রেকর্ড -- এসব দোকানে সস্তায় কিছু ভালো বই  পাওয়া যায় কি সেদিকে নজর দেওয়াটা তো আর নজরদারি নয়।
দোকানের ছেলেটি হঠাৎ একদিন বললে, পুরনো একটা বাড়িতে নন্দলাল বসুর কিছু অরিজিনাল ছবি আছে। ওঁরা বাড়ি বিক্রি করে চলে যাচ্ছেন। দেখবেন নাকি দাদা একবার ছবিগুলো? 
মাষ্টারমশাইয়ের আঁকা অরিজিনাল ছবি! যে কোনো বাঙালির কাছেই তো স্বর্গ।ছেলেটিকে বললাম, নিয়ে চলো সে বাড়িতে। ছেলেটি তার সেই দোকানেই এনে ছবি গুলো দেখালো।ছবির নীচে মাষ্টারমশাইয়ের সই আছে। প্রথমটায় আনন্দে ডগমগ হয়ে উঠলাম।দাম? ছেলেটা যা দাম বললো, তা সেই পঁচিশ বছর আগেও নন্দলাল বসুর আঁকা অরিজিনাল ছবির নিরিখে অভাবনীয়।এত সস্তা হতে পারে মাষ্টারমশাইয়ের আঁকা অরিজিনাল ছবি? কিনব বলে মনস্থির করেও একটু সংশয়ী হয়ে পড়লাম।
পুলিশের নৈহাটিস্থ সেকালে সি আই , দুঁদে পুলিশ অফিসার সুবীর চট্টোপাধ্যায়কে বিষয়টা বললাম। দুদিনেই সুবীরবাবু , নন্দলাল বসুর অরিজিনাল ছবির রহস্য ভেদ করলেন। জানা গেল , মাষ্টারমশাইয়ের কোনো ছবির প্রিন্টের রেপ্লিকা দোকানদারটি মুগা বা তসরের কাপড়ের উপরে কাউকে দিয়ে আঁকিয়েছে।তারপর সেটাকে ভাতের ফ্যানে চুবিয়ে শুকিয়েছে।সেই শুকনো কাপড় ইস্ত্রি করে ছবিতে পুরনো আমেজ , অর্থাৎ; একটা কোঁচকানো  ,বাসটে আমেজ এনছে।তারপর মুরগি ধরতে বেরিয়েছে। আমাকে হালাল করে  জবাই করতে চেয়েছিল। বদলে দোকানদারটির ই মামাবাড়ি র থেকে ঘুরে আসা হয়ে গেল।
শিল্প সামগ্রী পেলে যাচাই টা যে সব থেকে বড় বিষয়, সেই বোধটাই এখন হারিয়ে যেতে বসেছে ।সংগ্রাহক বিষয়টির মধ্যে যে একক তৃপ্তির মানসিকতা ছিল, সেটা এখন অস্তমিত।শরৎচন্দ্র, জীবনানন্দ ঘনিষ্ঠ গোপালচন্দ্র রায় বা বাংলদেশের কুষ্টিয়াতে বসবাসকারী কিংবদন্তীতুল্য লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ ডঃ আবুল আহসান চৌধুরীর মত সংগ্রাহকদের কাজ দেখবার সুযোগ যাঁদের হয়েছে, তাঁরা সকলেই উপলব্ধি করবেন, সংগ্রহ বিষয়টা নিজের ঢাক নিজে পেটানোর মত কোনো বিষয় আদৌ নয়।
একান্ত ভাবেই নিজের মধ্যে তৃপ্তি পাওয়ার বিষয়কে এখন নিজকে নিয়ন আলোর নীচে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার মত বিষয় হিশেবে ক্রমান্বয়ে উঠে আসতে শুরু করেছে। ব্যাপ্তি ভালো।ব্যাপ্তি অবশ্য ই জীবনের গতিময়তার একটা নিদর্শন।ব্যাপ্তির মধ্যেই রয়েছে,' নাচে জন্ম - নাচে মৃত্যু- তালে তালে' ।সেই তালে তাল দিলে তবেই তো তাতাথৈথৈ বোল ফুটবে।কিন্তু তাল যদি কেটে যায় ? 
আমাদের জীবন এখন তাল কেটে আলকানা হয়ে কেবল ই ঘুরছে।যেন, ' এমন ই করে ঘুরিব দূরে বাহিরে' ।তাই কি আমরা গতি হারাচ্ছি? অগতির গতি তো দূরের কথা , গতির গতিময়তায় নিজেকে নিমজ্জিত করতে শুরু করেছি? 
শুরু যখন একবার হয়েছে, তবে আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু শেষ তো কোনো একদিন হবেই হবে।শুরু যেমন সব নয়।ঠিক শেষ ও ' শেষ' নয়।রবীন্দ্রনাথের ই ভাষায়, অন্ত যারে মনেহয় , সেতো অন্তহীন।
তাই সংগ্রহ আর সংগ্রাহকের এই হাল হকিকৎ দেখে  মনটা একটু বিষন্ন হয়ে গেলেও রোদ্দুরের প্রত্যাশা তো থেকেই যায়।মেঘ ও যেমন শেষ কথা নয়।ঠিক তেমন ই রোদ্দুরের চাঁদিফাটা অবস্থাটাও নয় শেষ পরিণতি।
                  সঙ্কট যখন সামাজিক জীবনের প্রায় সব কয়টা  জায়গাকেই আকীর্ণ করে তোলে, তখন মনোজগতের ও অনেক তর্কাকীর্ণ  সংকট উঠে আসবে , তাতে আশ্চর্য হওয়ার কি আছে? সংকট কখন, কোথায়, কিভাবে আসে ,সে কথা কেউ বলতে পারে না।
               এই যে ধরা যাক না , গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের জীবনাবসানের পর নিমতলা ঘাটে তাঁর মরদেহ ভষ্মীভূত হওয়ার পর, বহু মানুষ সেই অস্থি সংগ্রহ করেছিল। আবার সেই অস্থি একটি কলসে ভরে শান্তিনিকেতনে  নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ।উদয়ন গৃহের সামনের চাতালে সেই অস্থি স্থাপিত ছিল-- সেটির কথা শুনেছি আমরা শান্তিদেব ঘোষের কাছে। আবার তাঁর আত্মকথনমূলক রচনা,' জীবনের ধ্রুবতারাতে'ও সে কথা লেখা আছে ।
                   শান্তিদেব এটাও লিখে গিয়েছেন যে ,রবীন্দ্রভবনের সংগ্রহশালায় সেই অস্থিকলসের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। শান্তিদেবের ব্যক্তিগত সংগ্রহে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি অস্থি ছিল ।আমাদের সৌভাগ্য ঘটেছিল সেগুলি স্পর্শ করে প্রণাম করবার। আজও শান্তিদেব বিহীন তাঁর গৃহে সেই অস্থি অত্যন্ত সযত্নে সুরক্ষিত অবস্থায় আছে ।কিন্তু কোথায় গেল রবীন্দ্র ভবনে সংরক্ষিত সেই অস্থি? 
              কারো না কারোর কাছে তো তা অবশ্যই আছে। সেই অস্থি নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে এমন কোনো খবর তো  নেই। তাহলে ?বা নিমতলা শ্মশান ঘাটে সেদিন যারা রবীন্দ্রনাথের অস্থি  সংগ্রহ করেছিলেন, তাদের কারোর না কারোর কাছে তো তা আছে ।কিন্তু কোথায় আছে ?কিভাবে আছে? এ খবর আমরা কেউ জানি না ।
               রবীন্দ্রনাথের অস্থি নিয়ে আবার হয়তো দেখা যাবে আজকের এই আলোচনার পর ,কোনো কোনো সংগ্রাহক তাদের ঝুলি থেকে রবীন্দ্রনাথের অস্থি বের করে সেগুলি নিয়ে প্রদর্শনী করবেন। ফেসবুক ভরে যাবে রবীন্দ্রনাথের অস্থির ছবিতে। ঠিক যেমনটা এককালে মোরারজি দেশাইয়ের  প্রধানমন্ত্রীত্ব কালে সেইসময়ের জনতা পার্টির সাংসদ, তথা বিশিষ্ট পদার্থবিদ্যাবিদ ,অধ্যাপক সমর গুহ , ডাঃ শিশির কুমার বসু এবং শরৎচন্দ্র বসুর দুটি ছবি মিশিয়ে আজকের ভাষায় যাকে বলে ফটোশপ, এমন করে ,খবরের কাগজে ,তাইহোকু উত্তর সুভাষ চন্দ্রের ছবি বলে প্রকাশ করে সস্তায় বাজিমাত করতে চেয়েছিলেন। 
             এমন কিছু হয়তো আবার রবীন্দ্রনাথের অস্থির ঘিরে নতুন করে শুরু হলেও শুরু হয়ে যেতে পারে।

  • কালেকশন