বাঙালির লোকপরিচয় (১)

'উৎসব '--এই শব্দটাই যেন কেমন আমাদের মন ভালো করে দেয়।উৎসব শব্দের সঙ্গে যেন মিশে আছে শচীনদেব বর্মনের সেই গান;'  না না না তেমন ঢোল বাজে না, গাজনেতে লাগতো নাচন,  মনতো তেমন নাচে না',  কিংবা; সনৎ  সিংহের সেই গান ;' কৈলাস  হতে বাপের Gramophone Player Original/Working Gramophone Record Player : Amazon.in:  Home & Kitchenবাড়ি এসেছে পার্বতী, সঙ্গে গণেশ কার্তিক আর লক্ষ্মী সরস্বতী।' এইসব গানগুলোকে আজকাল যতই আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে ,নাচন কোদনের মধ্যে দিয়ে উপস্থাপিত করা   হোক না কেন, সেসব গানের আদি রেকর্ড যখন আমরা ইউটিউবের মধ্যে দিয়েও  আবার শুনি ,কেমন যেন মনটা উদাস হয়ে যায়।
                   উৎসব আমাদের জীবনে ডেকে আনে একটা আনন্দের হুল্লোর। ' উৎসব' শব্দের মধ্যে দিয়ে তার যে ভাবার্থের চিত্র উঠে আসে ,তা যেন আমাদের নতুন করে একটা চাওয়া পাওয়ার সমস্ত বিধি-নিষেধের বাইরে মনটাকে এনে দাঁড় করিয়ে দেয় ।আমাদের বাংলা ভাষায় , ডিকশনারিতে উৎসবের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে;  আনন্দজনক অনুষ্ঠান হিসেবে। কিন্তু সেই আনন্দের স্বরূপ টা কি? কেমন হবে তার ব্যাপ্তি  ? বা  অভিলাষ-- ডিকশনারি ঘেঁটে ফেললেও তার কিন্তু কোনো ব্যাখ্যা আমরা পাই না।
                সেই কারণেই আমাদের পারিবারিক আঙিনায়, ব্যক্তিগত যাপনচিত্রের বোধে ,ছোট ছোট আকারের নানা আনন্দ অনুষ্ঠানের যে চিহ্নগুলো ,তাকে আমরা কখনো উৎসব বলে অভিহিত করি। আবার দশ-বিশ জন মানুষ নিয়ে, অর্থাৎ;  সমাজের একটা অংশকে নিয়ে যখন সেটা পালন করা হয়,  সেটাকেও  আমরা উৎসবের মর্যাদা দিয়ে থাকি। আর সেই কারণের জন্যেআ  বিয়ের উৎসব থেকে শুরু করে নববর্ষের উৎসব, আমাদের মনে কেমন যেন একটা নতুন প্রাণের ছোঁয়া এনে দেয়।
                 গোটা বছরের নানা ধরনের জীবন জীবিকার লড়াই,  অর্থনৈতিক পাওয়া না পাওয়ার টানা পড়েন --এই সমস্ত কিছু থেকে সাময়িকভাবে আমাদেল  একটু ভুলে থাকা, একটু  আনন্দ যেন,  কবীর সুমনের ভাষায় ,'হাত পেতে নিয়ে চেটেপুটে'খাওয়ার মত ই আমরা খেতে থাকি এই উৎসব কে ঘারে।
উৎসবের কখনো কোন ধরা বাধা গণ্ডি থাকে না। বাঙালি সমাজেও যেমন এটা থাকে না,  তেমন ই  বাঙালি সমাজের বাইরে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা যেভাবে তাঁদের বিভিন্ন উৎসব পালন করেন, সেখানেও কোনরকম ধরা বাঁধা গন্ডি  থাকে না ।নানা কারণে মানুষ উৎসব পালন করেন ।নানা উপলক্ষকে কেন্দ্র করে মানুষ উৎসব পালন করেন। প্রকৃতির নানা বিষয়বলিকে নিয়ে মানুষ উৎসব পালন করেন। আমরা যেমন ব্যক্তি বা পরিবারের আয়োজনে উৎসব পালন করি ,তেমনি ই  পারিবারিক পরিমণ্ডলের বাইরে, সার্বজনীনভাবে উৎসব পালন করি। আর সার্বজনীনভাবে পালন করা উৎসব যে উপলক্ষে পালিত হয়, সেটা যে কেবলমাত্র একটা জায়গাতেই পালিত হচ্ছে এমনটা নয়। একই উপলক্ষ্য কে কেন্দ্র করে একাধিক জায়গায় ,একাধিক দেশে, উৎসব পালনের রেওয়াজ প্রত্যেকটা সমাজেই আছে। আমাদের বাঙালি সমাজেও আছে। 
                 এখানে বাঙালি সমাজ বলতে কিন্তু আমি বৃহত্তর অর্থে বাঙালি সমাজের কথা বলছি ।হিন্দু -মুসলমানের সম্মিলিত বাঙালি সমাজের কথা বলছি  পয়লা জানুয়ারি, এটা হল খ্রিস্টীয় নববর্ষের উৎসব।এই উৎসব  একটা ক্রম বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আজ আর কেবলমাত্র খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এই উৎসব এখন জাতি, ধর্ম, বর্ণ কে অতিক্রম করে, দেশকে পর্যন্ত অতিক্রম করেছে ।খ্রিস্টীয় নববর্ষ উৎসব এখন হলো একটি আন্তর্জাতিক উৎসব।শারদ উৎসবে মেতে ওঠে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার মানুষ - DesheBideshe
                 তবে কোনো কোনো এলাকার, কোনো কোনো আর্থ-সামাজিক পরিমণ্ডলের বহু মানুষের অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে একটা সুনির্দিষ্ট সময়ে ,সুনির্দিষ্ট ঋতুতে ,কোনো একটি জায়গায় বা একাধিক জায়গায় বা একাধিক সামাজিক বৃত্তের মধ্যে ,সম্প্রদায়ের বৃত্তের মধ্যে উৎসব পালনের যে রেওয়াজ, সেটাই সার্বিকভাবে বাঙালি সমাজের উৎসব বলে নিজেকে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে।  এই সামাজিক মিলনের ক্ষেত্রকেই আমরা বাঙালি সমাজে, জাতি- ধর্ম- বর্ণ -লিঙ্গ নির্বিশেষে বাঙালির উৎসব বলে অভিহিত করতে চেষ্টা চেষ্টা করে থাকি ।
            দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এপার বাংলায় শারদ উৎসব কেই কেবলমাত্র বাঙালির উৎসব বলে অভিহিত করবার চেষ্টা দেখতে পাওয়া যায়। শারদ উৎসবের পাশাপাশি পবিত্র ঈদ ও যে বাঙালি একটা উৎসব ,এই বিষয়টিকে ঘিরে আবেগ উচ্ছ্বাস ,এপার বাংলায় প্রায় নেই ই বলা যেতে পারে ।মালদা- মুর্শিদাবাদ- বীরভূম, যে জেলাগুলিতে মুসলমান জনসংখ্যার আধিক্য রয়েছে,  সেখানেও বাঙালি মুসলমান, তাঁদের উৎসব পালনটা ধীরে ধীরে নিজেদের  ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে আবদ্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। 
                   এই বাধ্য হওয়ার পেছনে নানা রাজনৈতিক প্রেক্ষিত কাজ করছে ।আমাদের এই আলোচনা রাজনীতিকে ঘিরে নয় ।সুতরাং রাজনীতির তর্ক-বিতর্ক এখানে আমরা উপস্থাপিত করব না ।কিন্তু যেটা বাস্তব সেটা হচ্ছে এই যে,  প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে  আমরা দেখতে পাই, সেখানে বাঙালি মানে কিন্তু কেবল মুসলমান নয়। বাঙালি মানে কিন্তু কেবল হিন্দু নয়। হিন্দু- মুসলমানের মিলিত লড়াই এর আজ জাতীয় শোক দিবস, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদত বার্ষিকী |  The Business Standardভেতর দিয়েই সেদেশের মানুষ বাংলা ভাষার উপরে পাকিস্তানি হামলা প্রতিহত করেছে। হিন্দু মুসলমানের সম্মিলিত লড়াই পাক হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করেছে ।স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। তার পরেও ধর্মভিত্তিক বাঙালিয়ানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শাহাদাত বরণ করবার ফলে। সেই প্রতিবন্ধকতা ও বাঙালি, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতে আবৃত বাঙালিয়ানা দিয়ে অনেকখানি উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে।
                  তাই বাংলাদেশে যেমন সেখানকার সংখ্যাগুরু  মুসলমানদের পবিত্র ঈদ ইত্যাদিকে ঘিরে উৎসব তা ছাড়াও হিন্দু- মুসলমান উভয় সমাজের লোকায়ত  বিষয়কে ঘিরে  মাছের মেলা   থেকে -পীরের মেলা ইত্যাদি কে কেন্দ্র করে উৎসবের আমেজ আছে,  ঠিক তেমনি হিন্দু বাঙালির শারদ উৎসবকে ঘিরেও উৎসবের আমেজ আছে  । 
                আমাদের  ভারতে একটা সময় রাষ্ট্রশক্তি, তার ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান সত্ত্বেও সহ নাগরিক মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব গুলির ক্ষেত্রে সরকার বাহাদুরের পক্ষ থেকে সৌজন্য ইত্যাদির পথে হাঁটতেন ।কিন্তু বিগত ১০ বছরে সেই সৌজন্যের ভারতে ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে ,সেখানে এরশাদ রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম হিসেবে ঘোষণা করে ,মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিপথে পরিচালিত করবার চেষ্টা করলেও, শেখ হাসিনার  নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ, তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ধর্মনিরপেক্ষতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে, শারদ উৎসবের কালে ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশনে গিয়ে সহনাগরিক হিন্দুদের সঙ্গে মিলিত হচ্ছেন ।আনন্দে উৎসবে যোগ দিচ্ছেন ।
                তার মানে কিন্তু এই নয় যে, শেখ হাসিনা গিয়ে দেবী দুর্গার আরাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করছেন। ধর্ম পালন ,ধর্মীয় রীতি নীতির অনুসরণ, আর উৎসব--  এই দুইয়ের মধ্যে কতখানি  আসমান জমিন ফারাক --এই বাস্তবতাটা কিন্তু শেখ হাসিনা বোঝেন ।বোঝেন বলেই পবিত্র ইসলাম যেভাবে পরধর্ম, পরমতের প্রতি সহিষ্ণুতার আদর্শ প্রচার করে থাকে,  ঠিক সেই ভাবেই পবিত্র ইসলামের একজন দ্বীন অনুরাগী হিসেবে ,শেখ হাসিনা, রাষ্ট্রধর্ম পালনের সঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত ধর্মাচরণের জীবনাভূতিকে  কখনো মিলিয়ে দেন না ।
            হিন্দু মুসলমান ভাই ভাই • ShareChat Photos and Videosতাই সেখানে হিন্দুর উৎসবে, মুসলমান যান ।মুসলমানের উৎসবে হিন্দু যান। বিভাজনের চেষ্টা যে সেখানে নেই, এমনটা নয়।কিন্তু বিভাজনের চেষ্টাকে অতিক্রম করে, সংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক প্রবাহের যে শক্তিমান প্রকাশ, সেটি কিন্তু মানুষের মনে, উৎসবকে, ধর্মীয় লেবাসে আকীর্ণ না করে ,উৎসবকে আনন্দের অঙ্গ হিসেবেই যাপন চিত্রের একটি অংশে পরিণত করেছে।
যেকোনো আঙ্গিক থেকেই মানুষ যে উৎসব পালন করছে ,সেই আঙ্গিকে ধর্মীয় দ্যোতনা থাকুক বা সংস্কৃতিক অথবা অন্য কোনো সামাজিক আঙ্গিক ই থাকুক, প্রশ্ন হল; এই উৎসব কেন মানুষ পালন করছে? এক কথায় যদি এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায় ,তাহলে বলতে হয় ; প্রয়োজন থেকে মানুষ পালন করে উৎসব ।এই যে প্রয়োজন থেকে মানুষের উৎসব পালন করার প্রথা বা রীতি বা ইতিহাস,  যে শব্দে ই একে  অভিহিত করা হোক না কেন, তা কিন্তু মানুষ সভ্যতার আদি লগ্ন থেকে পালন করে আসছে। 
            মানুষ যখন একেবারেই প্রকৃতির ইচ্ছের উপর নির্ভরশীল ছিল,  তখন নিজের জীবনকে অতিবাহিত করবার ক্ষেত্রে তার হাতে প্রকৃতির ইচ্ছেই ছিল শেষ কথা। প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করবার কোনো রকম পরিকাঠামো তার ছিল না। ঠিক সেই সময় থেকেই মানুষ কিন্তু তার প্রয়োজনের নিরিখে এই উৎসব পালন বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে। 
           সেই যে সময়কাল ,তখন প্রকৃতির উপর মানুষের নির্ভরতা ছিল একান্তভাবে পেটের ক্ষিদে নিবারণ জনিত। তেমন একটা সময়ও মানুষ ,প্রয়োজনের নিরিখেই উৎসব পালনের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছে। পেট ভরানোর জন্য খাদ্য যেমন তখন আসতো প্রকৃতি থেকে,  ঠিক তেমন ই  মনের ক্ষিদে মেটানোর খাদ্য ,মানুষ তখন সংগৃহীত করতে শুরু করে প্রকৃতি থেকেই ।
              আর সেই মনের খাদ্যের ই উপকরণ হিসেবে আবির্ভাব ঘটে উৎসবের।
খাদ্য উৎপাদনে তখন সাধারণ মানুষের কোনো ভূমিকা ছিল না ।মানুষ জানতোই না কি করে চাষাবাদ করে পেটের খাবার জোগার করতে পারা যায় ।মানুষের তখন ভূমিকা ছিল কেবলমাত্র গাছগাছালি থেকে ফলমূল সংগ্রহ করা ,অর্থাৎ; কেবলমাত্র খাদ্য সংগ্রহের মধ্যেই মানুষ তখন তার নিজের জীবনকে প্রবাহিত করে রাগত  বেঁচে থাকবার তাগিদে।
             ঠিক সেই কারণেই উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রকৃতির ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনো রকম ভূমিকা-ই মোকাবিলা করবার জন্য কোনো আনুষ্ঠানিক রীতিনীতি --এই ব্যাপারটা মানুষ জানতো না। এসব নিয়ে ভাবার মত কোনো অবকাশও মানুষের ছিল না। কিন্তু তবুও সেই নিকৃষ্ট সামাজিক বিধি ব্যবস্থার মধ্যেও মানুষের সমাজে উঠে এলো কিছু কিছু উৎসব। এই উৎসবগুলির উদাহরণ আমরা পাই।ম  আদিম সাম্যবাদী সমাজে ।পশু শিকার থেকে শুরু করে ভোজন কেন্দ্রিক নানা ধরনের আদিম কালের আচার-আচরণের ভেতর দিয়ে। 
             সেইসব আচার-আচরণ নানা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আজও পৃথিবীর কোনো না কোনো প্রান্তে টিকে আছে। এমনকি আমাদের বাঙালি সমাজেও সেই আদিম আচারের ধারাবাহিকতা, বিবর্তিত হতে হতে ও  কোনো না কোনত রকম ভাবে তার রেশ টুকুনি এখনো রেখে চলেছে।

 চলবে...

  • শ্যামলী ভট্টাচার্য