সন্তানের স্মৃতিচারণায় যখন পিতা ভস্বর হয়ে ওঠেন ,তখন প্রাপ্তি টা পাঠকের কাছে চিরকালীন হয়ে যায়। যে পিতার কথা সন্তান লিখছেন, সে পিতা তখন কেবলমাত্র লেখকের পিতাই হয়ে থাকেন না, হয়ে ওঠেন পাঠকেরও পিতা। প্রখ্যাত ফুটবলার পি কে ব্যানার্জির কৃতি কন্যা অধ্যাপিকা পলা ব্যানার্জি যখন পিতার স্মৃতিচারণে কলম ধরেন ,তখন পাঠকের মন লেখিকার সঙ্গেই যেন স্মৃতির চারণভূমিতে বিরাজ করতে থাকে।
পিকে ব্যানার্জি মানে বাঙালির কাছে এক পরম বিস্ময়। ফুটবল প্রিয় বাঙালির কাছে পিকে একটা জীবন্ত কিংবদন্তি ছিলেন ।যতদিন তিনি রক্ত মাংসের শরীরে এই দুনিয়ায় বিরাজ করতেন, সে সময়কালে তো বটেই , তাঁর পার্থিব শরীর চলে যাওয়ার পর আজ অনেকটা সময় কেটে গেছে। তবুও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে যেসব বাঙালির কাছে ফুটবল একটা পরম আদরের ধন, তাঁদের সকলের কাছেই পিকেও হলেন পরম আপনার মানুষ।
যাঁরা সেভাবে ক্রীড়া জগৎ ঘিরে খবরা-খবর রাখেন না বা উৎসাহী নন, তাঁরাও কিন্তু প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় কে চিনতেন এক ডাকে জানতেন। টেলিভিশন যখন থেকে বাঙালির ঘরে ঘরে ঢুকেছে, তখন থেকে বাঙালি ,কোচ হিসেবে পিকের অনবদ্য ভূমিকা ,বিশেষ করে তার অসাধারণ ভোকাল টনিক, এগুলি দেখবার সুযোগ পেয়েছে। পি কে র খেলা টেলিভিশন দুনিয়ার মাধ্যমে খুব একটা দেখবার সুযোগ বাঙালি ঘটেনি বাঙালির।
তবে এখনো অনেক বাঙালি রক্তমাংসের শরীরে আছেন, যাঁরা কলকাতার ময়দান কাঁপানো পিকেকে ময়দানে দেখেছেন। সেই পিকে কে ঘিরে তাঁর কন্যার স্মৃতিচারণে প্রথমে উঠে এসেছে আমাদের প্রায় অজানা পিকের ছোটবেলাকার কথা। উত্তরবঙ্গের ময়নাগুড়ির যে পরিবেশে বড় হয়ে উঠেছিলেন প্রদীপ , সেই পরিবেশের কথা। সেখানকার সার্বিক পরিবেশ তাঁর জীবনে চিরদিন একটা বড় রকমের প্রভাব ফেলেছিল-- এটা তার কন্যার বইটির প্রথম অধ্যায়টি পড়লেই আমাদের সামনে পরিস্কার হয়ে ওঠে ।
এত অপূর্ব লেখনি ,যেখান থেকে আমরা যেন ছুঁতে পারছিলাম, আজ থেকে ৭০-৮০ বছরের আগেকার সময়ের উত্তরবঙ্গকে। ছুঁতে পারছিলাম ময়নাগুড়ি ।সেই শান্ত নিবিড় এক শীতল ছায়াকে। পিকের পারিবারিক বিন্যাসের যে ছবি তাঁর কন্যা পলা দিয়েছেন ,তার মধ্যে থেকে সেকালের বাঙালি জীবনের সামাজিক বৈশিষ্ট্যের এক সুন্দর চালচিত্র উঠে আসে। বাঙালির যে একান্নবর্তী জীবন , তা কেবল তার বাড়ির পরিবেশের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল না ।সেকালে গোটা পাড়াটাই যে হয়ে উঠেছিল তাঁদের বাড়ি, ঘর দুয়ার ।আর সেই পরিবেশের মধ্যে দিয়ে মানুষের মনের গঠন কতটা উদারভাবে বিকাশ লাভ করতে পারে ,এই গোটা ব্যাপারটা তাঁর পিতার শৈশবের নানা ছোট ,ছোট- টুকরো, টুকরো ঘটনার ভেতর দিয়ে পলা তুলে ধরেছেন ।
এইভাবে তুলে ধরার মধ্যে দিয়ে কেবলই যে লেখিকা ,অধ্যাপিকা পলা, তাঁর পিতৃতর্পণ করেছেন, তা নয় ।সামগ্রিকভাবেই সেই সময়ের বাংলা ও বাঙালির জীবনযাপনের যে অনিন্দ্য সুন্দর চিত্রটি উপস্থাপিত করেছেন, এটি আমাদের হারিয়ে যাওয়া পরম যত্নের একটি ধন।
স্কুলের পরিবেশ ,স্কুলে খেলা, সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে বাড়ির মানুষজনদের উৎসাহ দেওয়া, আর তার ভিতর দিয়ে কি করে আগামী দিনের দিকপাল ফুটবলার পি কে তৈরি হচ্ছেন-- তার বর্ণনা দিতে গিয়ে পিতার পিসিমার কথা যেভাবে লেখিকা উল্লেখ করেছেন ,তাতে আজকের দিনে আমাদের বড় আক্ষেপ হয়; এমন পিসিমা -মাসিমা- কাকীমা- জেঠিমা রা আজকের বাঙালি জীবন থেকে কার্যত মুছে গেছেন। আর মুছে গেছেন বলেই হয়তো কৃতি ছাত্র-ছাত্রী ,কৃতি ফুটবলার, কৃতি সাহিত্যিক ,এঁরা তৈরি হচ্ছেন বটে, কিন্তু পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত কিংবদন্তি আর সৃষ্টি হচ্ছে না।
পিকের জীবন সংগ্রামকে যেভাবে তাঁর কন্যা তুলে ধরেছেন ,যে অকপট স্বীকারোক্তির মধ্যে দিয়ে লেখিকা দেখিয়েছেন ,দারিদ্র্যের সঙ্গে, পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে কি প্রবল লড়াই করে তাঁর পিতাকে খেলার দুনিয়ায় একটা স্থায়ী আসন তৈরি করে নিতে হয়েছিল ,সেটি শুধু কেবলমাত্র পি কের জীবন সংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নয় ।আগামী দিনের বাঙালি ,লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে নিজেকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করবার ক্ষেত্রে সব রকমের প্রেরণা পাবে পলা বন্দোপাধ্যায়ের এই পিতৃ তর্পনের ভেতর দিয়ে।
বাবার কৈশোর কাল বর্ণনা করতে গিয়ে সেকালে জামশেদপুরের একটা বড় সুন্দর বিবরণ এই ছোট্ট বইটিতে লেখিকা রেখেছেন। আর সেই বিবরণের যেন একটা পূর্ণতা নিয়ে উঠে আসছে ,পরবর্তী সময়ে ফুটবল জীবনের সাফল্য অর্জনের পর, কিংবদন্তি পিকে যখন সপরিবারে সেই ফেলে আসা জামশেদপুরের আনাচে-কানাচে, শৈশব কৈশোরের স্মৃতিমেদুর দিনগুলো উত্তর পুরুষদের কাছে বর্ণনা করছেন তখন।
এই জায়গায় যেন আমরা একটা অন্য আমেজ খুঁজে পাই। জামশেদপুর শহরকে কেন্দ্র করে ফুটবলার পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন সংগ্রামের যে অধ্যায়টির কথা সংক্ষিপ্ত অথচ সরস ভাবে লেখিকা বর্ণনা করেছেন, সেটি কিন্তু একজন সংগ্রামী মানুষকে বোঝার পক্ষে খুব বড় একটি বিষয়।
কলকাতার ময়দানে পিকে কে কিভাবে লড়াই করতে হয়েছে তার অনবদ্য লিথোগ্রাফ যেন কাগজের উপরে খোদাই করেছেন লেখিকা ।পিকের জীবনের কলকাতা শহরে ভবানীপুর অঞ্চলের সেই টাঙ্গাওয়ালা, আমাদের সকলের কাছে এক প্রণাম্য ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন পলা বন্দোপাধ্যায়ের লেখনীর গুনে। সফল কিংবদন্তিদের জীবন গড়ে তুলবার ক্ষেত্রে এমন অনেক অজানা অচেনা মানুষদের খুব বড় একটা ভূমিকা থাকে। কিন্তু সেই ভূমিকা ইতিহাসে কখনো লেখা হয় না। পরের প্রজন্ম কখনো জানতেও পারে না, কোনো একটি সাধারন মানুষ, এক কিংবদন্তির জীবনকে গড়ে তুলবার ক্ষেত্রে কতখানি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন।
এদিক থেকে বলতে হয় সমাজ মনস্কতার এক অনুপম স্বাক্ষর পিকে কন্যা রেখেছেন ভবানীপুরের সেই টাঙ্গাওয়ালার তাঁর পিতার জীবনে ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা উল্লেখের মধ্যে দিয়ে ।
প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের খেলোয়াড় জীবন তৈরিতে ,ফুটবলের আরেক কিংবদন্তে বাঘা সোমের ভূমিকার কথা যেভাবে লেখিকা উল্লেখ করেছেন, তা এক কথায় অনবদ্য। আজকের ফুটবল চর্চার ইতিহাসে বাঘা সোম বিস্তৃত ব্যক্তিত্ব। নতুন প্রজন্মের মানুষরা প্রায় বাঘা সোমের নামই শোনেনি ।ফুটবলের ইতিহাসে বাঘা সোমের কৃতিত্বের পাশাপাশি, পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো এক কিংবদন্তির, পেশাজীবনে বাঘা সোম যে ঐতিহাসিক অবদান রেখেছিলেন, সে কথা আমাদের জানার সুযোগ করে দিয়ে পলা বন্দ্যোপাধ্যায় ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন।
নিজের পরিবারের মানুষজনদের প্রতি, ভাই-বোনদের প্রতি, সন্তান-সন্ততিদের প্রতি, স্ত্রীর প্রতি, পি কে বন্দ্যোপাধ্যায় কতখানি দায়িত্বশীল একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন, তার অনবদ্য স্মৃতিচারণের মধ্যে দিয়ে সেটা দেখিয়েছেন পলা বন্দোপাধ্যায় ।পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনের সঙ্গে যে সংগীত জগতের আরেক দিকপাল কুমার শচীনদেব বর্মনের একটা গভীর সংযোগ ছিল, এটা আমরা জানতেই পারতাম না যদি না পিকে কন্যা কলম না ধরতেন।
পলা লিখছেন ; " বাবা বিশ্বাস করতেন ,যে যার সময়ে তার নিজের সময়ের সমস্যা ,চাপ ,সুবিধা অসুবিধা সব নিয়ে বড় হয়েছে ।বাবাকে কেউ যদি জিগ্যেস করত, শচীন তেন্ডুলকার বড়, না সুনীল গাভাসকার .... বাবা সে প্রশ্নের উত্তরই দিতেন না।"
পলা লিখছেন;" বাবা ক্রিটিক্যালি খেলা নিয়ে আলোচনা করতেন, যাকে বলে বিশ্লেষণ, কিন্তু কারো ক্রিটিসিজিম করতেন না ।" এখানে ই লুকিয়ে রয়েছে ব্যক্তি পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন এবং যাপনচিত্রের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য এবং তাকে তুলে ধরবার ক্ষেত্রে তার কন্যা অধ্যাপিকা পলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসামান্য কৃতিত্ব।
বাবাকে যেমন দেখেছি
পলা ব্যানার্জী
অনুলিখন - শ্যামলী আচার্য
আজকাল
১৮০ টাকা