সন্ধ্যে প্রায় সাড়ে ছটা বাজে, গঙ্গার ঘাটে বসে থাকা পাঁচটা মুখ, আরো হাজারো ভিড়ের মধ্য। মা বিসর্জন গেলেন। গোটা বছরের অপেক্ষা, গত তিন মাসের উত্তেজনা ও শেষ দশটা দিনের হাড় ভাঙা খাটুনিও যেন একই সঙ্গে আস্তে আস্তে তলিয়ে গেলো গঙ্গার ভিতরে।
রতনের বাড়ির পুজোয় সেই ছোট বেলার মতন আনন্দ করার প্ল্যান করেছিল এবার পাঁচজন মিলে। প্রতিবারই রতন বাড়ির পুজো একাই নামায়, অবশ্য একেবারে একা বললে ভুল বলা হয়, শিঞ্জিনী কে ছাড়া তো রতন এখন যেন - অচল একটা পয়সার মতো।
প্রতি পদে পদে ঠেকনা দেওয়াই যেন শিঞ্জিনীর আসল কাজ বিয়ের পর থেকে।
হঠাৎ শিবু বলে উঠলো, এই মন খারাপ আর সহ্য হয়না। চল বেড়িয়ে আসি কোথাও একটা।
অবাক দৃষ্টি পড়লো দুটো ।
বাকি দুজন পাত্তাও দিলোনা।
ধাতানি দিলো তুলি, হুজুগ বরদাস্ত করা একদম ধাতে সয়না। এমনিতেই এতগুলো দিন ছুটি নেওয়া হয়ে গিয়েছে।তার উপরে ওয়ার্ক ফ্রম হোম ও আর পাওয়া যাবে না। হায়দরাবাদ, মুম্বাই থেকে বাকিরা এলো বলেই, চেন্নাই থেকে কিছুটা অনিচ্ছা সত্বেও শিবুর কথায় নেচে, রাজি হয়েছিল তুলি।
আলাদা রকম পুজো কাটবে অনেকদিন পর। কিন্তু তা বলে এতো কাজ। অফিসের কাজ ফেলে রেখে আর আনন্দ- ফুর্তির কোনো মানেই হয়না। তুলির সঙ্গে এগ্রি করলো বিশাখাও।
রতন দোনো মনো করলেও, শিঞ্জিনী কিন্তু দিব্বি সায় দিয়ে দিলো। চাকরিটা ছেড়েছিলো বিয়ের পর।হাউসওয়াইফ হয়ে যেন কাজ বেড়েছে আরো দশ গুণ। হাজারেকটা ঝামেলা। সংসার -আত্মীয়স্বজন আর রতনের পেছনে প্যালা দিতে দিতে হাফিয়ে উঠেছে যেন ভিতর থেকে। বিয়ের আগে লিভইন করার সময় এতটাও ডিপেন্ডেন্ট ছিল না রতন, বিয়ের কিছু মাস পর থেকে যেন বাচ্চা বড় করছে শিঞ্জিনী।
যেহেতু শিঞ্জিনীর কথার উপর কথা চলেনা রতনের, আর তুলিও শিবুর মুখ চেয়ে কিছুক্ষন হম্বি-তম্বি করে গোলে যায় শেষটায়, অগত্যা বেড়াতে যাওয়াই ফাইনাল হলো।
বিশাখাকে এক রকম জোর করেই টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হলো। গন্তব্য - লোলেগাঁও। রতনদেরই একটা বাংলো কেনা আছে ওখানে। সুতরাং থাকা -খাওয়ার কোনো ঝামেলাই নেই। ওয়ার্ক ফ্রম হোম করা যাবে কিনা সন্দেহ যদিও । নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়না ওখানে ভালো। আর যাতায়াত না থাকার জন্য ওয়াই-ফাই ও লাগানো নেই স্বাভাবত ই।
তবু হুজুগে নেচে বেড়িয়ে পড়া হলো পোটলা-পুটলি বেঁধে মাঝ রাতেই। ৭ সিটের গাড়িটা কেনার পর থেকে এই প্রথম ঠিকঠাক ব্যবহার হবে, রতনের এতেই আনন্দ।
ছোট থেকেই আর পাঁচটা ছেলের মতন নয় রতন। বড়লোক বনেদি বাড়ির একমাত্র ছেলে। না চাইতেই মুখের সামনে হাজির হয়েছে প্রায় সব কিছুই । আলালের ঘরের দুলাল বলতে ঠিক যা বোঝায়, তাই ই। দুটো পেট্রল পাম্প, তিনটে কমার্শিয়াল বিল্ডিং আর একটা চা বাগান মিলিয়ে মাস গেলে বাবা ঘরে তোলেন প্রায় ১৭-২০ লক্ষ্য টাকা। এলাহি বাড়ি ।দেখলেই বোঝা যায় টাকার কুমির।
লন্ডন থেকে পাস করে এসে মোটেও তৈরে গদিতে বসার ইচ্ছে হয়নি রতনের। আর ততদিনে শিঞ্জিনীর সঙ্গেও প্রায় দেড় বছর লিভইন হয়েগেছে। সুতরাং বিয়ে সেরে একেবারে মুম্বাইতেই চাকরি নিয়ে ,একরকম সেটেলড বললেই চলে আপাতত। বাবার পয়সায় কেনা ফোর বি এইচ কে কোলাবা তে।
ড্রাইভার সানি প্রায় বারো বছর গাড়ি চালাচ্ছে রতনদের।তার জিম্মায় স্টিয়ারিং ধরিয়ে দিব্যি নাক ডেকে চললো পল্টন উত্তরবঙ্গের উদ্দেশ্য। রাত পেরিয়ে দিন হয়েছে।সেবক পেরিয়ে তিস্তা বাজার পেছনে ফেলে গাড়ি ছুটে চলেছে কালিম্পঙের দিকে।
চা খাওয়া হয়েছে সকাল থেকে প্রায় তিন বার।গন্তব্য আর বেশি দূর নয়। তুলির অধৈর্য মন বিষিয়ে উঠছে মাঝে মাঝেই। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই ই শিউরে উঠছে শিবুর শরীর।
তুলি মেয়েটার মধ্যে কি দেখেছিলো শিবু কি জানি। কেউই খুব বেশি পছন্দ করতোনা তুলিকে,ওর ঠোঁটকাটা আর খ্যাঁক-খ্যাঁক করা স্বভাবের জন্য।
ডিভোর্সের পর তুলি যখন ডিপ্রেশনের রুগী, ঠিক তখনি হঠাৎ করে আবার যোগাযোগ হয় শিবুর সঙ্গে। শিবুও তখন চেন্নাই তেই চাকরি করে ।সেই সুবাদে দিব্বি মেলামেশা শুরু হয় দুজনের। ঘনিষ্ঠতা বাড়ে ধীরে ধীরে।হাড় কিপটে-হুজুগে নাচা এই ছেলেটাকে যেন নতুন করে চিনতে শুরু করে তুলি।
লং ড্রাইভ সেরে, ফ্রেশ হয়ে সারাদিন একরকম ল্যাদ খেয়েই কেটে গেলো সবারই। অপূর্ব পাহাড়ের গা বেয়ে নীচে অবধি নেমে যাওয়া চা বাগানটা রতনদের নিজেদের।আর তারই এক কোণায় এই পেল্লাই বাংলোটা।
পাহাড়ে সন্ধ্যাটা কেমন ঝুপ করে নেমে আসে হঠাৎ করেই। সামনের লাউন্জে সবাই মিলে গোল করে বসে, গরম গরম ড্রাই চিকেন দিয়ে গলা ভিজোতে ভিজোতে, আড্ডা জমে উঠলো। পুরোনো দিনের নস্টালজিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চললো দৈনন্দিন জীবনের নিত্তি ঝামেলার আলোচনাও।
রতন যে এখনো মন থেকে কতটা সরল, কতটা নিষ্পাপ; তুলির জ্বালায়ে কিভাবে শিবুর প্রাণ ওষ্ঠাগত; শিবুর কিপ্টেমির ঠেলায় তুলি কতটা অতিষ্ঠ; শিঞ্জিনীর যে কত ঝক্কি পোহাতে হয় রতনের অতি ভালোমানুষির জন্য - গলা বেয়ে তরল নামতেই বেড়িয়ে এলো সব।
কিন্তু এতেই শেষ নয়। আস্তে আস্তে বেরোতে থাকলো আরো গোপন পরিচয় গুলোও। আরো না জানা অজানা কত কথা।
তুলির ঠোঁটকাটা স্বভাবের দোষেই নাকি আর সহ্য না করতে পেরে এক রকম বাধ্য হয়েই আগের স্বামী ওকে ডিভোর্স দিয়েছিলো। সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়ে ওষুধ খেয়ে ডিপ্রেশন মুক্ত হয়ে এখন কিছুটা হলেও সামাল দেওয়া গেছে।
শিবুর যদিও অভ্যেস হয়ে গিয়েছে ঠিকই ,কিন্তু তবুও লোক সমাজে এখনো যথেষ্টই লজ্জায় পড়তে হয় হামেশাই। এদিকে তুলির কম্প্লেইন হলো ,শিবু এতটাই কিপটে যে ,বাড়ি থেকে শুরু করে আসবাবপত্র-- সবেতেই তার ছাপ পরিস্কার। ভালো কোনো বন্ধু কে বাড়িতে ডাকতে লজ্জা পায় তুলি। আর এই নিয়েই সারাদিন ঝগড়া -ঝামেলা, কথা -কাটাকাটি লেগেই রয়েছে।
একমাত্র শিঞ্জিনী এই গ্রুপে নতুন। রতনের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পরেই সিঞ্জিনীর এই গ্রুপে যোগ দেওয়া। বাকিরা সকলেই স্কুল ফ্রেন্ড। কেবল শিঞ্জিনীর সঙ্গে রতনের আলাপ লন্ডনে পড়তে গিয়ে।
রতনটা যে কিরম ক্যাবলা টাইপের একটা ছেলে-- সেই নিয়েও চললো শিঞ্জিনীর মস্করা কিছুক্ষণ। বড়লোক বাড়ির ছেলে হয়েও একফোঁটাও দম্ভ নেই ঠিকই , তবে সেই সঙ্গে নেই কোনো প্র্যাক্টিকাল স্ট্রাগলের অভিজ্ঞতাও।
আর বাপ মরা, মায়ের কাছে মানুষ হওয়া শিঞ্জিনী জানে প্রতি পদে পদে স্ট্রাগল কাকে বলে। কলেজে শিঞ্জিনীর এই বেপরোয়া ইমেজই মন কাড়তো সকলের। রতনও বাদ পড়েনি। কিন্তু রতন বাকিদের তুলনায় বড্ডো ছাপোসা। শুধু বাড়ির পয়সা আর সুন্দর একটা মন ছাড়া প্রায় কিছুই ছিলোনা কম্পিটিশনের বাজারে।
তথাকথিত হ্যান্ডসম, গুড লুকিং, ম্যানলি-- কোনো তকমাই লাগানো যায়না। তার উপর পড়াশোনাতেও খুবই অ্যাভারেজ। শিঞ্জিনী যেখানে স্কলারশিপ পেয়ে লন্ডনে পড়তে এসেছে, আদ্দেক কলেজ যার পেছনে লাট্টু হয়ে ঘুরছে। ভারতীয়রা তো বটেই , বিদেশিরাও বাদ যাচ্ছে না।সেখানে ক্যাবলা রতনের সম্বল বলতে ছিল দূর থেকে হাঁ করে শিঞ্জিনীকে দেখা আর চোখা-চোখি হলেই লজ্জা পেয়ে পালানো।
প্রথমটা নাকি শিঞ্জিনীই অ্যাপ্রোচ করেছিল। থতমত খেয়ে সে কি একশা কান্ড রতনের সেদিন। আমতা আমতা করে কিসব বলেছিলো, শিঞ্জিনী বুঝতেও পারেনি ঠিক করে।
আর ব্যাস পর মুহূর্তেই বাদের খাতেই নাম উঠে গিয়েছিলো রতনের। দুই ক্লাসমেট সঞ্জয় আর জেসিকা না থাকলে এই জন্মে শিঞ্জিনীকে পেতে হতোনা রতনের।
এখনো রতন স্বীকার করে, ওদের ঘটকালির উপকার সে সাত জন্ম তপস্যা করেও ফিরিয়ে দিতে পারবেনা।
আমোদ প্রমোদের পালা শেষ করে লাউন্জের ঘাসের উপরেই শুয়ে রইলো বেশ অনেক্ষন সবাই মিলে। দূরে জোনাকির মতো টিমটিম করছে পাহাড়ের গায়ে আলো গুলো। এখনো সেই হাড় হিম করা ঠান্ডা না পড়লেও, বেশ একটা ফুরফুরে হাওয়া আর সুন্দর হালকা হালকা ঠান্ডার আমেজ। আকাশের দিকে তাকালে মনেহয় যেন চুমকি বিছিয়ে রেখেছে কেউ। বুক ভোরে অক্সিজেন নিচ্ছে সবাই মিলে, চুপটি করে। অযথা আর একথা ওকথা না বলে, সবাই যেন কেমন হিম্পোটাইজড হয়ে রয়েছে।
রতন তেমন কোনো কথা না বললেও দিব্বি এনজয় করছিলো সবার আড্ডা। ওকে নিয়েই মজা করা হচ্ছে ঠিকই, তবে এই আরেকটা মস্ত গুন ওর, স্পোর্টিংলি নিতে জানে মজা গুলো। রতনের শুয়ে শুয়ে মনে এলো সেই দিনগুলোর কথা, সত্যি কেমন যেন স্বপ্নের মতন লাগে আজও।
শিঞ্জিনীর সঙ্গে প্রথম যেদিন ডেটিংয়ে বেরোলো রতন কিরম যেন কুঁকড়ে ছিল ভয় ভয়ে। শিঞ্জিনীর পাশে কিছুটা জায়গা ছেড়ে প্রথম বসা, পারফিউম মেশানো একটা মেয়েলি গন্ধ, আলাদা সেনসেশন। সেই সুবাস তো রতন এখনো পায়, প্রতিদিন পায়। কিন্তু এখন তো সেই গন্ধটাও একটা অভ্যেসের মতন হয়ে গেছে। এখন এই গন্ধটাই ওর বাকি জীবন কাটানোর টোটকা, অক্সিজেন।
ছোট খাটো চেহারার ইন্ট্রোভার্ট, চুপচাপ বিশাখাকে নিয়ে কেউই তেমন আলোচনা করেনা। বিশাখা তাই অনেকটা কাবাব মে হাড্ডি টাইপ ফিল করে হামেশাই। পিএইচডি করে হায়দ্রাবাদে চাকরি নিয়ে আজ প্রায় সাত- আট বছর রয়েছে । খুব হৈহুল্লোড় পছন্দ না করলেও, এই গ্রুপে বেশ তেলে-ঝোলে মিশে থাকার মত গুছিয়ে নিয়েছে নিজেকে বিশাখা।
আট বছরের ইমোশনাল ইনভেস্টমেন্টের পর, রণর কাছে লেঙ্গি খেয়ে একরকম জড়ো বস্তু হয়ে গিয়েছে । এনগেজমেন্টের পর, বিয়ের কেনাকাটা অবধি সব কমপ্লিট হয়ে গিয়েছিল। শেষ মুহূর্তে রণর কেমন যেন মনেহলো ওদের রিলেশনশিপটা বড্ডো সাফোকেটিং!বাকি জীবন এই রকম দম বন্ধ অবস্থায় কাটানো ওর পক্ষ্যে সম্ভব না। শেষমেশ গান্ধর্ব মতে, মিউচুয়াল ডিভোর্স।
বিশাখার দিকটা খুব বেশি ভেবে দেখলোনা রণ। অনেকবার ঘ্যান ঘ্যান করে, হাথে পায়ে ধরে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে, হাজার গালি অপমান সহ্য করেও যখন তেমন লাভের লাভ হলোনা, তখন বিশাখা ,একরকম ধরেই নিলো জীবনের যেন এখানেই ইতি।
জীবনে' ইতি' টানার একটা সূক্ষ্য চেষ্টাও করেছিল একবার। কিন্তু সফল না হতে পারায় টের পেয়েছিলো কত বড় অন্যায় করতে গেছিলো । বাপ-মা-দাদার বুক ফাটা কান্না দেখে নিজেই অনেকটা শক্ত হয়ে উঠেছিল এরপর।
বিশাখা বড্ডো সেকেলে আর ভালো মানুষ গোছের। ওর বয়েসী বাকিরা যখন নিজেকে মেইনটেইন রাখতে ব্যস্ত, বিশাখা তখন দিব্বি ছিমছাম এট্রাক্টিভ-হীন জীবনেই সাবলীল। কোনো কিছুই খুব বড় করে আর আঘাত দিতে পারেনা ওকে। তেমনি ভীষণ রকম খুশি হওয়ার মুহূর্তও প্রায় হারিয়ে গিয়েছে জীবন থেকে।
নিজের কাজকর্ম ছাড়া আর তেমন বিশেষ কিছুতেই ইনভল্ভ থাকেনা এখন আর। ইদানিং নতুন করে স্পিরিচুয়াল ব্যাপার ট্যাপারের দিকে ঝোঁক হয়েছে। আর্ট অফ লিভিং এবং ঈশা ফাউন্ডেশন দুটোতেই দিব্বি যাতায়াত, দৈনন্দিন ভিড়-ভাট্টা এড়িয়ে ইনার-পিসের খোঁজে।
শিবু এসব বোঝেনা, ওর কাছে এসব অযথা পয়সা নষ্ট। বিশাখার ডোনেশন গুলোকেও টিটকিরি মারতে আর তাচ্ছিল্য করতে ছাড়েনা। শিবু দিব্বি কোথাও শুনিয়ে দেয় সুযোগ পেলেই - এই তোদের মতন দুর্বল মনের মানুষের মাথায় টুপি পড়িয়েই আজ এই বকধার্মিক ,সাধু সাজা লোকগুলো কোটিপতি। বিশাখা যদিও পাত্তা দেয়না, ওর কিছুই যায়-আসেনা তার ব্যাপারে কে কি বললো, কি ভাবলো সেসব নিয়ে।
তিনটে দিন বেশ দিব্বি কাটলো। চতুর্থ দিন ভোর ভোর কলকাতা ফেরার উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া হলো। চারিদিক কি সুন্দর লাগছে।এখনো পুরোপুরি ভোর হয়নি। আস্তে আস্তে হচ্ছে। জলের মধ্যে পাউডার গুলে যেমন শরবত তৈরী হয়, অনেকটা সেভাবেই রং পাল্টাচ্ছে চারিদিকের প্রকৃতির । নিঝুম নিস্তব্ধতা ভেঙে চুরমার করছে অজস্র পাখির কিচির-মিচির। চা বাগান আর পাইন বনের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলেছে গাড়ি, হুড়মুড়িয়ে যেন নেমে আসছে একটা মাত্র ঝর্ণার স্রোত। মন মেজাজ সবারই বড্ডো ফুরফুরে, সামনে বসেছে বিশাখা, বাকিরা পেছনে জোড়ায় জোড়ায়।
শিলিগুড়ি ছাড়িয়ে, একটু বেলা করেই, এক জায়গায় বেশ পেট পুড়ে হেভি ব্রেকফাস্ট করা হয়ে গিয়েছিলো ।আর তাই দুপুর পেরিয়ে যেতেও কারোরই ঠিক খিদেটা পায়নি সেভাবে। এখুনি ইঞ্জিনে কয়লা না দিলেও চলবে ঠিকই, তবে আরেক রাউন্ড চা-সিগরেট খাওয়া যেতেই পারে।
গাড়ি যখন আবার রওনা দেবে, শিবু কে সামনে পাঠিয়ে বিশাখাকে পেছনে ডেকে নিলো তুলি, নিজের পাশে। আমতা আমতা করে বললো, দেখ তোকে একটা কথা বলবো বলবো করেও বলা হয়নি; তুই তো দেবুদা কে চিনিস সেই ছোট থেকেই। শিবুর বাড়িতে যাতায়াত তো আমাদের সেই ছোট থেকেই। জানিসই তো দেবুদা একবার কিরম ক্রাশ খেয়েছিলো তোর উপর।আমরা তখন সবে কলেজে ঢুকেছি, আমার ভাসুর বলে বলছিনা, জানিসই তো মানুষটা কিরম ভালো। শিবু ওর নখের যোগ্য নয়। আজ প্রায় তিন বছর হলো ওর বৌ বৌ মারা গিয়েছে।তার পর থেকে একা।
আমি কথায় কথায় একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম তোকে এখনো পছন্দ কিনা, উত্তর না দিলেও যেভাবে ব্লাশ করেছিল, দেখেই বুঝেছি আপত্তি নেই। এবার লক্ষ্মীটি তুইও রাজি হয়ে যা না বোনটি আমার, তাহলেই দুইয়ে দুইয়ে চার হাত এক করে দিই আমরা।
এক টানা বলে যেন ভিতরের জমে থাকা ভয়টা উগরে দিলো তুলি। গাড়ির মধ্যে পিন ড্রপ সাইলেন্স। সবার চোখ বিশাখার দিকে। বিশাখা বড্ডো অপ্রস্তুত হয়ে উঠলো হঠাৎ করেই। ব্যাপারটা এতটাই সাডেন যে সব টুকু বুঝে উঠতেও যেন সময় লাগছে ওর। রতন ঘুরে বসে হাথে হাত রাখলো বিশাখার হাতে।--
কিছু একটা বল রে।চাপ নিসনা। তুই যা বলবি তাই হবে। শিবু তুলির মুখ দেখে না। আমার দিকে তাকিয়ে বল।
কিছুই তেমন বলে উঠতে পারলোনা বিশাখা। এরকম করে ভাবা তো সে একরকম ছেড়েই দিয়েছে প্রায়। বিড়বিড় করে শুধু বললো,ম;
এখনই কিছু কথা দিতে পারছিনা ভেবে দেখবো। আর তাছাড়া কথা বলেও দেখতে হবে তো, দেবুদার সাথে মতের মিল - মনের মিল হয় কিনা।
ব্যাস এইটুকুতেই চলবে, বলে জাপ্টে ধরতে গেলো রতন ওকে। তুলি তো চুমুই খেয়ে ফেললো আনন্দে। শিঞ্জিনীও ঘুরে বসে আরেকটা গালে ছেপে দিলো নিজের ঠোঁটের লিপস্টিক।
শিবু কিছু করতে পারছিলো না সামনে বসে। মনে মনে ভারী খুশি ও। এক তো নিজের দাদা, তার উপর নাকি ছোট বেলার বিশাখার সঙ্গে ..... ।ভেবেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছে ও।আর বারেবারে ফিরে তাকাচ্ছে তুলির দিকে।এই ঠোঁটকাটা মেয়েটাকে এইজন্যই সে এতো ভালোবাসে।
কাবুলিওয়ালার ঢঙে চিৎকার করে বলে উঠলো, খোঁকি , তুই শাঁশুড় বাড়ি জাবি ?'