সোহানুজ্জামান: ‘বাড়ি’ আর ‘বাসার’ মধ্যে সূক্ষ্ণ পর্থক্য আছে–‘ভিটে’ আর ‘ছোটো একটা ঘরই’ যেন এই পার্থক্যের সারাৎসার। বাড়ি বলতে এখানে বাংলাদেশের সামাজিক স্তরবিন্যাসের এমন একটি অংশ নিয়ে কথা বলছি, যে অংশটি কৃষিভূক্ত গ্রামীণ সমাজ-কাঠামোর সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত ।
আমার এক শিক্ষককে এক ঈদে জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যার, বাড়ি যান নাই?’ তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘বাড়ি যায় ছোটোলোকেরা।’ কথাটা কানে বেশ লেগেছিল। কারণ আমি বাড়ি যাই, নিয়ম করে ছুটি-ছাটা পেলে। ঈদে তো যাই-ই। তাহলে আমি কি ছোটোলোক? এই ‘ছোটোলোক’ যে জনসংস্কৃতির বিবেচনায় আমার শিক্ষক বলেছিলেন, সেটা বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু তারপরও তো কথা থেকে যায়। তাহলে এর বিপরীতে জনসংস্কৃতির বিবেচনায় পশ্চিমের বড়ো বড়ো আলো ঝলমলে উন্নত দেশের লোকেরা বড়োলোক কারণ তারা আমাদের মতো কোনো বড়ো উৎসবে এমন করে বাড়ির জন্য নগর ছাড়তে উঠে পড়ে লাগে না।
পশ্চিমের লোকজনের কাছে বাড়ি ব্যাপারটির অস্তিত্ত্ব একেবারে কমে গেছে, অধিকাংশের বেলায় তা সত্য; তবে দু-একটা ব্যতিক্রম চোখে পড়েবে, তা স্বাভাবিক। এর কারণ সেখানকার দীর্ঘদিনের সামাজিক পরিবর্তনের ঢেউ। এসব আধুনিক নাগরকেন্দ্রিক মানুষের একটাই আশ্রয় এখন নগরের ভিটে বিছিন্ন বাসা। কিন্তু আমাদের এখনো ভিটে আছে, বাড়ি আছে।
আরেকটু খোলসা করি। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যে বয়স, সেই হিসেবে এই রাষ্ট্রে এখনও ভিটে বিচ্ছিন্ন নাগরিক তৈরি হয় নাই। হলেও তা মোট জনসংখ্যার বিচারে সামান্যই। এর পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে।
এখানকার লোকজন দীর্ঘদিনের গ্রামীণ কাঠামোর গোষ্ঠীভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় বসবাস করে এখনও। ফলে তারা সেই গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজে বা পরিবারে ফিরে যেতে চায় যাকে বলে শেকড়ের টান। বড় বড় উৎসবে টেলিভিশনের পর্দায় বিজ্ঞাপনে এই শেকড়ের টানে অথবা নাড়ির টানে বাড়ি ফেরার বিষয়টি বারবার আমাদের চোখে পড়ে।
এই নাড়ি আর শেকড় কী? একজন মানুষের বৃদ্ধি-বিকাশ আরও যা কিছুই বলি না কেন, তা হয় একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত। এরপর যে আর কিছুই হয় না ব্যাপারটি এমন নয়। হয়। তবে তা টিন এজের তুলনায় কম। এই সময়ের হাসি-কান্না আর ভালো-মন্দ লাগার যে সমন্বয়–তার সবই ব্যক্তিকে আজীবন বহন করতে হয়। ফলে যে গ্রামীণ জনপদের কৌম জীবন-যাপনের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে একজন মানুষ বড়ো হয় এবং বেড়ে ওঠে, সেই অভিজ্ঞতার প্রভাব থেকে সে বেরোতে পারে না। বারবার ফিরে যেতে চায় ওই ফেলে আসা জীবনে।
কিন্তু ব্যক্তিজীবনের বেঁচে থাকার তাগিদে তাকে বেরিয়ে পড়তে হয় এই গ্রামীণ কৌম জীবন থেকে। আশ্রয় নিতে হয় নাগরিক জীবনের অপরিসর ফ্ল্যাটে বা বস্তিতে। মেনে নিতে হয় নতুন বাস্তবতাকে। মেনে নিয়ে এক ধূসর আর লিনিয়ার-বর্ডার-লাইন পরিস্থিতির ভেতরে পতিত হয়।
এই বিষয়টি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি জীবনানন্দ দাশের বেলায়ও প্রযোজ্য হয়েছে। ফলে এই ‘ছটফটানি ধাঁচের জীবন’ থেকে সে মুক্তি চায়। কিন্তু মুক্তি তো সম্ভব নয়। বিপরীতে নস্টালজিয়া তাকে ক্রমশই কাবু করতে থাকে। বাড়তে থাকে ফেলে আসা জীবনে ফিরে যাওয়ার ব্যাকূলতা।
যে ব্যক্তি বাড়ি যাচ্ছে, তার কোনো না কোনো প্রজন্ম গ্রামে কিংবা প্রায় গ্রামের মতো মফস্বলে রয়ে গেছে। তার ফিরে না গিয়ে উপায় কী! যদিও কেউ কেউ ব্যাপারটিকে খুব যান্ত্রিক উপায়ে খারিজ করে দিতে চান। কিন্তু খারিজ করলেই কি আর খারিজ করা সম্ভব হয়! আমি বলবো, না। সম্ভব হয় না।
বর্তমান বাংলাদেশে যে প্রজন্ম নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত হিসেবে বিবেচিত, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, তারা তাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মকে কোনো না কোনোভাবে গ্রাম ও মফস্বলে ফেলে রেখেছে। আসলে ফেলে রাখতে তারা একরকম বাধ্যই হয়েছে বলা চলে। আর কেউ কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে না রাখলেও পূর্ব প্রজন্ম হয়তোবা শেষ জীবনে আর নগরে আস্তানা গাড়তে চায় নাই। কারণ এখনকার মধ্যবিত্তের পূর্বপুরুষদের একটি কৃষিভিত্তি তো ছিলই।
এখন তার নানারূপ বিকৃতি সাধন হয়ে নতুন ধরনের আর্থ-উৎপাদন কাঠামো হয়তো তৈরি হয়েছে, কিন্তু পুরোনো সামন্ত সমাজের বিষয় একেবারেই উবে তো যায় নাই। তাই এই দুটো আর্থ-উৎপাদন কাঠামোর লোকজনের মধ্যে অবস্থানগত ফারাক আছে। এই ফারাক কমাতে যে সমন্বয় দরকার তা ঠিকঠাকভাবে করে উঠা যাচ্ছে না। এও এক বড়ো কারণ। বাড়ি যাওয়ার, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের অবস্থানগত দূরত্ব মোচনের।
ঢাকার যে আবহাওয়া এবং পরিবেশ দূষণের পরিমাণ–তাও যদি বিবেচনা করা হয়, সেক্ষেত্রে বলতে হয় যে, এই সূচক পৃথিবীর সব দেশের হিসেবে যে খারাপের সীমনা আছে, তাও ছাড়িয়ে তলানিতে ঠেকেছে। এমন একটা শহরে মানুষ বাস করে। দেশের মানুষকে বাস করতে হয়। বাস না করে আদতে আর কোনো উপায় নাই, থাকে না। কিন্তু সবদিক বিবেচনায় মানুষ কি সত্যিই এমন শহরে বাস করতে চায়?
আপনি ঢাকায় যে কোনো একটি সার্ভে করলে এর সত্যতা খুঁজে পাবেন। কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চল আর কিছু নির্দিষ্ট মানুষজন বাদে ঢাকায় আরাম-আয়েশ দূরে থাক, স্বস্তিতে কে বাস করে? বসবাসের জন্য শ্যামলিমা ব্যাপারটাও তো গুরুত্বপূর্ণ। সেইটাও ঢাকায় নেই বললেই চলে। কেবল সবুজের কথা বাদ দিলাম, পুরো ঢাকায় এমন কিছু অঞ্চল আছে যেখানে শতভাগ কংক্রিটে মোড়ানো! মানে মাটি আপনি চোখ থাকলেও দেখতে পাবেন না। এই বছর হিটওয়েভের কালে পত্রিকার রিপোর্ট এমনটাই জানিয়েছিল! ভাবুন তো, মানুষ মাটি দেখতে পায় না! এও কারণ বাড়ি ফেরার। ঈদে।
বেশ ভালো মতোই কর্পোরেট বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের চাকরিতে উপস্থিত হয়ে পড়েছে এখন। পুঁজির বিকাশের নানা পর্ব থাকে। আমরা বোধহয় এক লাফে পুঁজির শেকড় বাদেই টবের কর্পোরেট হয়ে গেছি। মানে যেভাবে পুঁজির বিকাশ ঘটে, সেইটা হয় নাই আরকি এইখানে। এই সিস্টেমের মধ্যে পড়েছে নিম্ন-মধ্যবিত্ত আর মধ্যবিত্ত। কৃষিভিত্তিক জীবন ছেড়ে চাকরি করতে হচ্ছে স্বস্তির বিপরীতে।
কৃষিকাজে পরিশ্রম আছে, কিন্তু আছে অবসরও। কিন্তু তা দিয়ে আধুনিক মানুষের জীবন–যাপনের চাহিদা মেটে না। তাই তাকে বেছে নিতে হয় অবসরবিহীন চাকরির জীবন। আর ঈদের মতো উৎসবে তারা পায় ক’দিনের অবসর। এই বিষয় আর যে সমস্ত বিষয় নিয়ে পূর্বে আলাপ করেছি, তা থেকে অল্প পানিতে নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম মানুষের ক’দিনের স্বস্তির জন্যই ঈদ উৎসবে লোকজন বাড়ির দিকে ফিরে।
জেমস রেনেল, যিনি ছিলেন ঔপনিবেশিক ভারতের একজন সেনা কর্মকর্তা এবং একইসাথে তিনি বাংলা অঞ্চলের প্রথম মানচিত্র তৈরি করেছিলেন। ১৭৬৪ সনের মে মাসে তিনি যে জরিপ শুরু করেছিলেন, সেই জরিপকালে জুনের ৪ ও ৫ তারিখে কুষ্টিয়া ও পাবনায় পৌঁছেছিলেন, এবং এই দুটি অঞ্চলকে নিছকই দুটি গ্রাম হিসেবে বিবেচনা করেছেন; এবং জরিপ শেষে ঢাকায় প্রবেশের যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, তাতে ঢাকা অনেকাংশেই একটি ধূসর গ্রামীণ জনপদসম এক মলিন শহর।
এছাড়া উনিশ শতকের প্রথমদিকে চার্লস ডি অয়লিসের আঁকা ঢাকার ছবিও প্রমাণ করে দেয়, তাঁর ছবি আঁকার কালে ঢাকায় কেবল ‘মুঘলাই’ ব্যাপারটাই ভেঙে পড়েনি, আরও যা কিছু ছিল তাও ভেঙে পড়েছে। অর্থাৎ জাহাঙ্গীরনগর ভেঙে মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থানান্তর কিংবা ১৯১১ সনের বঙ্গভঙ্গ রদের বিষয় ঢাকাকে একেবারেই শিরে সংক্রান্তি অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল।
ঢাকা মূলত জেগে উঠেছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর, নতুন রাজনৈতিক আন্দোলনের ভেতর দিয়ে। তাই এমন ঢাকা নিয়ে গর্ব করার অনেক কিছু থাকলেও এই ঢাকা ছেড়ে |ীে যে সমস্ত লোকজন গ্রামে ফিরে যায়, কয়দিন থাকে, আনন্দ উৎসব করে, আবার কালো মুখ করে ঝুলতে ঝুলতে ভাত-কাপড়ের ঢাকায় ফিরে আসে, তাদের ছোটোলোক বলার আগে ভাবা উচিৎ, ঢাকায় থাকা মানে এলিট হয়ে যাওয়া নয়, পা কিন্তু এখনো একটা কাদায় ডুবে আছে