বৃষ্টি মাথায় দেবদাস 

 

সুদীপ চক্রবর্তী : কবি বা লেখকের নামে মেল, বিরল হলেও পশ্চিমবঙ্গের একটি বা দুটি স্থানে এরকম মেলার সন্ধান মেলে কিন্তু গোটা একটি উপন‍্যাসের নাম দিয়ে মেলা শুধুমাত্র একটি স্থানেই হয় আর সে উপন‍্যাসের নাম দেবদাস যমুনা পত্রিকার ১৩২০ আষাঢ় সংখ্যায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন- বঙ্গদেশের কুলত‍্যাগিনী বঙ্গরমণীর ইতিহাস সংগ্রহ করেছিলেন তিনি শরৎবাবু সেখানে বিভিন্ন জেলার প্রায় হাজার কিংবা তারও বেশি নারীর নাম-ঠিকানা-বয়স-পরিচয় ঘরছাড়ার কারণ তুলে ধরেছিলেন এবং হিসাব করে দেখিয়েছিলেন-এই হতভাগিনীদের শতকরা সত্তর জন সধবা বাকি তিরিশটি মাত্র বিধবা ইহাদের প্রায় সকলেরই গৃহত‍্যাগের হেতু ছিল, অসহ‍্য দারিদ্র্য এবং স্বামী সংসারের অসহনীয়  অত‍্যাচার-উৎপীড়ন াঁরা বা যেসব সংগঠন নারীদের নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের কাছে উদাহরণ যোগ্য হয়ে থাকতে পারে এই কাজটি ভাবলে বিস্মিত হতে হয়, কোনও যান্ত্রিক সুবিধা না নিয়ে সে যুগে কীভাবে  এত তথ‍্য-সংগ্রহ করলেন শরৎচন্দ্র? কী মারাত্মক পরিমাণ নিষ্ঠা দরকার এই ধরনের কাজের জন‍্য 

       যাইহোক, চন্দ্রমুখী হলেও হতে পারে কিন্তু আমাদের এই নিবন্ধের নায়িকা  পার্বতী কিন্তু এই শ্রেণিভুক্ত নন, বরং পার্বতী- সমস‍্যা কিছু ভিন্ন সাহিত্য সমালোচকদের মতে বঙ্কিমচন্দ্রের রজনী উপন‍্যাসের তীব্র প্রভাব আছে দেবদাস উপন‍্যাসে বাল‍্য প্রেমের অভিসম্পাত যেমন মিশে আছে দেবদাস-, তেমনই মহৎ প্রেম যে শুধু কাছে টানে না, দূরেও ঠেলে দেয় তারও উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে দেবদাস প্রামাণ‍্য না হলেও অনুমান করা হয় সম্ভবত ১৩০৮ সালে রচিত হয় দেবদাস কিন্তু১৩২৩-২৪ সালে ভারতবর্ষ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় এই উপন‍্যাস এই যে এতদিন ফেলে রাখার পর উপন‍্যাসটি প্রকাশ করলেন শরৎচন্দ্র, কোনও দ্বিধা কি কাজ করেছিল তাঁর? যদিও এই নথিটিও প্রামাণ‍্য নয়, তবে জানা যায়; বন্ধু প্রমথনাথ ভট্টাচার্যকে একটি চিঠিতে শরৎচন্দ্র জানিয়েছিলেন নেশা কিংবা একটি গভীর ঘোরের মধ‍্যে তিনি রচনা করেছিলেন দেবদাস রৎচন্দ্রের বাল‍্য যৌবনারম্ভ পর্যন্ত সময় ছিল ছন্নছাড়া সুকুমার সেন তাঁর বাঙ্গালা সাহিত‍্যের ইতিহাস গ্রন্থে জানাচ্ছেন-অতঃপর শরৎচন্দ্রের ক্ষণিক দর্শন পাই ১৯০১ অব্দে কলিকাতায় তিনি এখানে চাকুরি করিতেন কিছুপাল পরে(কতদিন পরে জানি না) তিনি চাকুরি লইয়া ব্রক্ষ্মদেশে চলিয়া যান এরকম ও শোনা যায় এইসময় নাকি একবার শরৎবাবুর নামে পুলিশের হুলিয়া জারি হয় তবে একথা তো সবাই জানেন যে, ব্রক্ষ্মদেশ যাবার আগেই তিনি মামা সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের াম দিয়ে মন্দির নামে একটি গল্প লেখেন,যা ১৩০৯ সালে কুন্তলীন পুরস্কার পায় যদিও খুব একটি প্রাসঙ্গিক নয়, তবু কুন্তলীন পুরস্কার সম্পর্কে বলতে হয় একটু-স্বদেশি গন্ধতেল কুন্তলীন প্রস্তুতকারক ছিলেন হেমেন্দ্রমোহন বসু তাঁর তৈরি দ্রব‍্যের বৃহৎ প্রচারের উদ্দেশ্যে ১৩০৩ সাল থেকে এই পুরস্কার চালু করেন হেমেন্দ্রবাবু সেকালে এই পুরস্কারের যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এই পুরস্কার পেয়েছেন আবার ফিরে আসি দেবদাস প্রসঙ্গে প্রকাশের পর থেকে আজ পর্যন্ত দেবদাস জনপ্রিয়তম একটি উপন‍্যাসের নাম ১৯২৮ সালে নরেশ মিত্র- পরিচালনায় নির্বাক ছবি হিসাবে প্রথম চলচ্চিত্রায়ণ হয় দেবদাস-, সেখানে দেবদাস চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ফণী শর্মা তারপর থেকে এই তালিকা এখনও অবধি শুধু দীর্ঘ নয়; সমৃদ্ধ হয়ে চলেছে দেবদাস হিসাবে আমরা পেয়েছি- প্রমথেশ বড়ুয়া, কুন্দনলাল সায়গল, দিলীপকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, শাহরুখ খান থেকে অভয় দেওলকে তেমনই পার্বতী হিসাবে পেয়েছি- তারকবালা থেকে যমুনা,সুচিত্রা সেন, সুমিত্রা মুখোপাধ‍্যায়, অর্পিতা পাল,ঐশ্বর্য রাই, মাহী গিল থেকে পাওলি দাম-কে আমাদের দেশেই দেবদাস কে নিয়ে উনিশটি ছবি নির্মিত হয়েছে 

      তথ‍্য থেকে এবার যদি আমরা বাস্তব চিত্রের দিকে নজর ফেরাই, কী পাই সেখানে? নিজের মনের ইচ্ছের উপর পাথর চাপিয়ে দেবদাসকে ছেড়ে পার্বতীকে হাতিপোতা গ্রামের জমিদার ভুবনমোহন চৌধুরীকে বিবাহ করতে হয় উপন‍্যাসে আছে- 

  • ্রায় ুড়ি-ঁচিশ ্রোশ দূরে বর্ধমান জেলায় হাতীপোতা গ্রামের জমিদারই পাত্র তাঁহার অবস্থা ভাল, বয়স চল্লিশের নীচেই-গত বৎসর স্ত্রী বিয়োগ হইয়াছেভুবন চৌধুরীর নিকট হইতে সর্বরকমে প্রায় দু-তিন হাজার টাকা ঘরে আসিবে 

আর কেমন অবস্থা ছিল হাতিপোতা- জমিদার ভুবন চৌধুরীর? উপন‍্যাসে আছে- 

  • ার্বতী আসিয়া দেখিল, তাহার স্বামীর মস্ত বাড়ি নূতন সাহেবী ফ‍্যাশনের নহে,পুরতন সেকেলে ধরনের সদর মহল,অন্দর মহল, পূজার দালান, নাটমন্দির, অতিথিশালা, কাছারি-বাড়ি, তোশাখানা, কত দাসদাসী- পার্বতী অবাক হইয়া গেল সে শুনিয়াছিল তাহার স্বামী বড়লোক, জমিদার কিন্তু এতটা ভাবে নাই 

স্থানীয় গ্রামবাসীরা বিশ্বাস করেন শরৎচন্দ্র নিজে এই গ্রামে এসেছিলেন পার্বতীকে দেওয়া শেষ কথা রাখতে; এসেছিল দেবদাস- যখন দেবদাস নষ্ট লিভার নিয়ে বুঝল মৃত্যু নিশ্চিত, দেশে ফেরার আগে ট্রেনে ঘুমন্ত ধর্মদাসকে রেখে একা-একা নেমে পড়ল দেবদাস, তারপর- 

  • াঁপিতে কাঁপিতে দেবদাস স্টেশনের বাহিরে আসিল(াণ্ডুয়া) একজন ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ানকে ডাকিয়া বলিল, বাপু, হাতীপোতায় নিয়ে যেতে পারবে? 

তারপরের ঘটনাতো আমরা সবাই জানি অসহ‍্য লিভার পেন, জ্বর রক্তপাতকে উপেক্ষা করে দু-তিন দিন অবিশ্রান্ত গরুর গাড়ির খানা-খন্দ পার হয়ে রাত্রি বারোটা নাগাদ জমিদার বাড়ির সামনে অশ্বত্থতলায় উপস্থিত হল দেবদাস সারারাত গাছতলায় পড়ে থেকে, সকালে মারা গেল দেবদাস হায়! অন্তপুরে পার্বতী জানতেও পারল না, তার বাড়ির সামনেই গাছতলায় মারা গেল- ওর দেবদাদা পন‍্যাসের েষে রৎচন্দ্র িখলেন-দি কখনও দেবদাসের তো মন তভাগ‍্য, সংযামী াপিষ্ঠের হিত পরিচয় ঘটে, তাহার জন‍্য কটু ্রার্থনা করিও প্রার্থনা করিও, আর যাহাই হোক, যেন তাহার মতো এমন করিয়া কাহারও মৃত্যু না ঘটে লেখকের কথা মনপ্রাণ দিয়ে শুনেছেন সমস্ত পাঠক, শুনেছেন হাতিপোতা গ্রাম সংলগ্ন অঞ্চলের মানুষ তাই, পূর্ব বর্ধমানের কালনার নান্দাই পঞ্চায়েতের অন্তর্ভুক্ত হাতিপোতা গ্রামে পয়লা মাঘ যে মেলা বসে; তার নাম দেবদাস মেলা

গঙ্গা গর্ভে চৌধুরি জমিদারদের সমস্ত কিছু বিলীন  হলেও, আজও অল্প কিছু স্মৃতিচিহ্ন রয়ে গেছে এই গ্রামের নদী, প্রকৃতি, সবুজের মাঝে েঁচে আছে থাকবে দেবদাস পার্বতীর প্রেম- এই গ্রাম তার সবকিছু  দেবদাস-ময় স্কুলের মঞ্চ, ক্লাব, অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের মূর্তি, সব নিয়ে হাতিপোতা আজও সেই অমর প্রেমের সাক্ষ‍্য বহন করে চলেছে এই গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা দেবদাস মেলা কমিটির সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত নাসের আলি সেখ জানালেন- আজ চব্বিশ বছর সফল ভাবে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে প্রতিবছর পয়লা মাঘ সূচনা হয় দেবদাস মেলার আশেপাশের সমস্ত গ্রাম থেকে প্রচুর মানুষ এই মেলাতে আসেন তবে এই মেলার শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ হল রসোগোল্লা পাঁচ-দশ টাকা থেকে হাজার-দুহাজার টাকা দামের মিষ্টি পাওয়া যায় এই মেলাতে যা নিয়ে সবাই আগ্রহী নাসের বাবু আরও জানালেন- আমারা যখন ছোট ছিলাম ভুবন চৌধুরীর কাছারি বাড়ি দেখেছি এখন কিছু নেই জমিদার ভুবনবাবুর নায়েব ছিলেন আমাদের আত্মীয় শুনেছি, বেলকুলি গ‍্রামে শরৎচন্দ্রের কেউ একজন আত্মীয় ছিলেন লোকমুখে এই কাহিনি শুনে জলপথে শরৎচন্দ্র এখানে এসেছিলেন তখন এই গ্রামে গঙ্গা থাকলেও, এখন আর নেই গঙ্গা অনেকটা সরে গেছে, সেই জায়গায় এখন খোরে নদী প্রবাহিত হচ্ছে অনেক বছর আগে এখানে রাস্তার কাজ হওয়ার সময়, মাটির নীচ থেকে হাতির দাঁত উদ্ধার হয় গ্রামের মানুষ সেটি সংরক্ষণ করে রেখেছেন 

মালতীপুর, মির্জাপুর আশেপাশের গ্রামগুলির মনোরম পরিবেশ আপনাকে এক অন‍্য অনুভূতির জগতে পৌঁছে দেবেই একটি উপন‍্যাসের জীবন্ত অনুভব আপনাকে মুগ্ধ করতে বাধ‍্য 

 

(কীভাবে যাবেন: হাওড়া থেকে কাটোয়াগামী যে কোনও ট্রেন ধরে ধাত্রীগ্রাম স্টেশনে নামতে হবে ধাত্রীগ্রাম থেকে অটো বা টোটো ধরে হাতিপোতা গ্রাম) 

তথ‍্যঋণ: বাঙ্গালা সাহিত‍্যের ইতিহাস : সুকুমার সেন 

  • সুদীপ চক্রবর্তী