জীবনের মৌলিক সংবেদ, অথবা মায়াবাস্তব পিছুটানের স্বরলিপি

রক্তিম ভট্টাচার্য: বাংলা ছোটগল্পের সাম্প্রতিক ধারায় লেখকসংখ্যা এত বেশি হয়ে উঠেছে, তার মাঝে ভালো গল্পের বই খুঁজে নেওয়া সত্যিই মুশকিলের ব্যাপার। এখন লেখক বেশি না পাঠক বেশি – এই বিতর্ক তুলতে যেহেতু আমরা এখানে আসিনি, তাই সেটা অন্য কোনও পর্বের জন্য তোলা থাক। আজকের আলোচনায় আমরা অপেক্ষাকৃত তরুণতর দুই লেখকের গল্পের বই নিয়ে কথা বলব, বুঝে নিতে চাইব ঠিক কোন স্রোতে তাঁরা তাঁদের লেখা এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন। প্রকৃতার্থে, এই দুই লেখক চয়নের উদ্দেশ্যের তিনটি মূল সূত্র আছে। কিছুটা সাদৃশ্যের, কিছুটা বৈসাদৃশ্যের। প্রথম কারণ হচ্ছে, এঁরা দুজনেই নিজেদের সচেতনভাবে ‘গল্পকার’ বলতে ভালোবাসেন। অন্য ধারার লেখালেখি চর্চা করলেও ‘গল্পকার’ সত্তা যেন অক্ষুণ্ণ থাকে, সেই লক্ষ্যে দুজনেই বদ্ধপরিকর। আর দ্বিতীয় বিষয়টা একটু অন্যরকম। আলোচ্য প্রথমজন, অর্থাৎ, মানস সরকার বাংলার বহু লিটল ও কমার্শিয়াল পত্রপত্রিকায় সমানতালে লিখে চলেছেন বেশ কয়েক বছর, এবং তিনি সুস্পষ্টভাবে দুটি ধারার ভিন্নতা এবং বৈচিত্র্যে বিশ্বাসী। অন্যদিকে, আলোচ্য দ্বিতীয় গল্পকার, দীপশেখর চক্রবর্তী একটি স্বকীয় ধারা এমনভাবেই নির্মাণে মগ্ন, যেখানে তাঁর লেখার মূলগত আঙ্গিক এবং বিষয়বৈশিষ্ট্য প্রতিটি গল্পেই ব্যক্তিগত আমেজের অন্তরালে নিহিত থাকবে। আর শেষ সূত্র, দুজনেই তাঁদের লেখায় নিজেদের সময়কে ধরে রাখতে চান, যদিও ধরে রাখার কায়দা ও ভঙ্গি সম্পূর্ণ পৃথক। তাই আজ বেছে নিয়েছি এই দুই লেখকের এখনও পর্যন্ত শেষ যে গল্পের বইগুলি প্রকাশিত হয়েছে, অর্থাৎ, মানস সরকারের “নোয়ার নৌকা” এবং দীপশেখর চক্রবর্তীর “অনন্ত রাত্রির কিশোরেরা” – তাদের আলোচনা, কিছু কথা, আর সামান্য ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা।

“নোয়ার নৌকা” মানস সরকারের তেইশটি গল্পের সংকলন, এবং গল্পগুলি সচেতনভাবে বেছে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক এবং লিটল ম্যাগাজিনের আঙিনা থেকে, যাতে তাঁর লেখার বৈচিত্র্য পাঠকের হৃদয়ঙ্গম হয়। তাঁর গল্পের একটি বৈশিষ্ট্য মগ্নপাঠে লক্ষিত হবে, যে, লেখকের চেষ্টা থাকে পাঠককে রীতিমতো হাত ধরে একটি গন্তব্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, তারপর আচমকা এক চোরা ধাক্কায় কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাঠককে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া। “সোনার কেল্লা” চলচ্চিত্রে মন্দার বোস ডক্টর হাজরাকে যেভাবে ধাক্কা দিয়েছিলেন, অনেকটা সেরকম। এই ধারা বিশ্বসাহিত্যে বহু ছোটগল্পকার অনুসরণ করেছেন। বিশেষত, বাণিজ্যিক ঘরানার ছোটগল্পে আকছার দেখতে পাওয়া যায়। ফরাসি সাহিত্যে মঁপাসা, আমেরিকান সাহিত্যে ও হেনরি, খোদ আমাদের ভারতবর্ষে রাস্কিন বন্ডের কিছু গল্পে, আর কে নারায়ণের কিছু গল্পেও এই ধারার পরিচয় পাওয়া যায়।

মানস সরকার এই ধারায় বেশ কয়েকটি গল্প রচনা করেছেন। “ন্যারেশন চেঞ্জ”, “জল পড়ে পাতা নড়ে”, “হৃদয়হীনের জবানবন্দি” এই ধারার গল্প। একটা আপাত-অচিরাচরিত, কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য ট্যুইস্টের ‘শান্তিপূর্ণ’ সহাবস্থানে নির্মিত হয়েছে গল্পগুলি। উপজীব্য জীবনের সুর থেকে ছাঁকা হলেও তাতে লেগে থাকে অস্তিত্বের প্রলেপ, যা চমকের থেকেও উত্তীর্ণ হয়ে পাঠকের অন্তঃস্থ ভাবনার বৃত্তটিকে জারিত করে। গল্পগুলির ভাষা তড়িৎ, অথচ নিস্পৃহ। গল্পের গতি ভাবনার সমীপে, কিন্তু চমকে ব্যস্ততার ছোঁয়া নেই। স্থিতধী নির্মাণে গড়ে তোলা হয়েছে ক্লাইম্যাক্স।

বইটির নাম-গল্প 'নোয়ার নৌকার নাবিক' এই ধারারই অনুসারী বলা চলে, তবে তাকে থ্রিলার গোত্রে ফেলাই সমীচীন। অল্প পরিসরে চমৎকার বুনন। থ্রিলারের কুশলী নির্মাণ সাধারণত অভিঘাতের জেরের দাবিতে যে স্থান কাঙ্খিত, তার চেয়ে অনেক কম জায়গায় গল্পটিকে পেতেছেন লেখক, অথচ অভিঘাত এতটুকু কুঞ্চিত হয়নি। 'অভিনয়' গল্পটিকে খানিকটা এই পর্যায়েই ফেলা যায়, তবে সে-গল্পে একটি নিহিত গল্প অন্তঃসলিলার মতো বয়ে চলেছে সমান্তর প্রগতিতে। মূল গল্পটির অভিপ্রায় পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয় পাঠশেষে। যা লিখিত- তা গল্প নয়, যা নির্মিত- সেটাই গল্প। 'মুখাগ্নি' ও 'নদী মানে জীবন' গল্পদুটি এই তালিকার নিরীখেই বেশ মুন্সীয়ানার দাবি রাখে, শেষাংশে শিহরিত হতে হয়। অনুচ্চারিত জীবনপ্রবাহের এই সমাপতনে মনে হয়, জীবনের স্বাভাবিক আঁকাবাঁকা ছন্দের মাঝেই যে গোলকধাঁধা লুকিয়ে থাকে, তার অনুসন্ধান-প্রথা আগে থেকে আঁচ করতে পারলে হয়ত মানুষের জন্ম-ই এত নির্বিকার হত না।

 “সিনেমার ভেতরে আমি” গল্পটির কথা আলাদা করে বলতে হয়। চেনা প্রেক্ষাপট পরাবাস্তবিক রদবদলে আচম্বিতে দৃশ্য পরিবর্তন করে, মুছে যায় প্রকৃত আর অবাস্তবতার মেরুকরণ। অনুভূতির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম স্পর্শে পালটে যায় বাহ্যিক চরাচর, আর তার গহীনে ডুব দেন কথক (প্রকারান্তরে, লেখকও)। “অঙ্কের খাতা” গল্পটি নিখাদ বাস্তব পট থেকে উঠে এলেও তার সমাপ্তিতে একইভাবে লেগে থাকে সুপ্ত পরাবাস্তবিক অবগাহনের মেজাজ, যেখানে অঙ্ক হয়ে ওঠে জীবনের সমদস্তুর। “মুক্তিযুদ্ধ” গল্পের পোয়েটিক জাস্টিস ব্যবহার প্রশংসনীয়। এই পর্বেই 'অন্ধকার নামার আগে' গল্পটির নির্মাণ সহজ, ঋজু, তবে গল্পটিতে মেদ-বর্জনের সামান্য সুযোগ ছিল বলে মনে হয়েছে। 'আলোকবর্ষ দূরে' গল্পটির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। 'জন্মদিন' গল্পটি এক্ষেত্রে পরিবেশ ও চিত্রকল্প সৃষ্টিতে চমৎকার হয়েও শেষ দিকে কিছুটা অকারণ বাহল্যের শিকার, মনে হয়েছে।

 একটা গল্প-সংকলন শুধু কিছু ভালো গল্পের একত্রীকরণ নয়, হলে বুঝতে হয়, লেখক নিজের অপারঙ্গমতাকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। এই ক্ষেত্রে কিন্তু তা হয়নি। কয়েকটি গল্পের নির্মাণে পাঠকের সন্দেহের জায়গা থাকে, আর তার প্রকাশ গল্পকারের দিক থেকে অত্যন্ত সৎ। 'ঠ্যালা' গল্পটির নির্মাণ-প্রচেষ্টা প্রশংসনীয় হলেও সমাপ্তি কিছুটা আরোপিত ঠেকে। এখানেই বাকি দুটি গল্পের কথাও চলে আসে- যেগুলির সমাপ্তি নিয়ে কিছুটা ভাবনার অবকাশ থাকে। প্রথম গল্প "মাঝখানে"। গল্পটিতে সময়ের দ্বন্দ্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সচেতনভাবেই, কিন্তু সমাজ-সচেতন গল্পকার ক্লিশে পদ্ধতিতে সেই "আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম"-এর ছকে গল্পটিকে বাঁধেননি। মোচড় না থাকলেও গল্পটির সংবেদ ক্ষণিকে স্রোত পালটায়। এই অংশেই লেখক আরেকটু সচেতন হতে পারতেন- কারণ, ক্লাইম্যাক্স নির্মাণের অংশে যে মূল সূরের সচেতন চ্যুতিটি ঘটেছে, তা যথাযথ সময় পায়নি বলে মনে হয়েছে। আর দ্বিতীয় গল্প 'উত্তরাধিকার'। ভাবনায় বা পরিবেশনায় নতুনত্ব নেই- চিরাচরিত বৈপরীত্য ভাবনার গল্প। শেষের অংশ আবারও আরোপিত- যেন কিছুটা জোর করেই এই মেরুকরণ নির্মিত, মনে হয়েছে। 'সংযোগ' গল্পটিও এই কারণেই সেভাবে অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারেনি।

আগেই বলেছি, এই গল্পগ্রন্থের বাছাইপর্ব অত্যন্ত যত্ন-সহকারে হয়েছে। তাই, বাণিজ্যিক মেজাজের পাশাপাশি এবার আসি বেশ কয়েকটি নিরীক্ষামূলক গল্পের আলোচনায়। 'শকুন' এবং 'কোটর' গল্পদুটি এই বইয়ের মূল্যবান সম্পদ। ভাষা এবং শব্দ-ব্যবহারে মুন্সীয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। লেখক এই ধারার গল্পগুলিতে নিজেকে ভেঙেছেন অনেকখানি, চিরাচরিত আঙ্গিকের স্বরকে রুদ্ধ করেছেন দ্যোতনার অবিমিশ্র পরাকাষ্ঠায়। গল্পের কাহিনি-নির্মাণের চেয়েও অন্তর্ঘাত নির্মাণে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে অনেক বেশি। কাহিনির তুলনায় ক্ষরিত অভীপ্সা বাঙময় হয়েছে বারবার। 'বাস্তুতন্ত্র'ও এও ধারাতেই রচিত একটি অনবদ্য গল্প। তবে, ব্যক্তিগতভাবে ভীষণ প্রিয় হয়ে থাকবে 'মৎস্যপুরাণ'। চমক না থেকেও চমক, গল্প হয়েও না-গল্প! তার থেকেও বড় কথা, এই গল্পে অনুভূতিকে এতখানিই প্রশ্রয় দেওয়া যায় যে, শেষের অংশকে আরোপিত মনে করার চেষ্টা করলেও তা খানিকটা কষ্ট-কল্পনা বলে বিশ্বাস করতেই মন চায়। মনে পড়ে যায়, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের “দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী” উপন্যাসের সেই অসম সংঘাতের কাহন। 'ঋতুদের গল্প'-এ লেখক ঝুঁকি নিয়েছেন প্রবল, নিজেদের বিদেশি সাহিত্যের পড়াশোনা এবং কাব্যবোধকে জাগরুক করে তুলে গল্পটিকে অন্যমাত্রায় উন্নীত করার চেষ্টা করেছেন। তবে, লেখাটির মধ্যে চকিত উপন্যাসধর্মিতা বিরাজমান। 'রুটিজীবন' এ-প্রসঙ্গে আরেকটি চমকপ্রদ গল্প- যা শিহরণের হিল্লোল তুলে অনুকম্পার বাহুমূলে আঘাত হানে উত্তর-পাঠে। গল্পটি শেষ করে স্বাভাবিকভাবেই থমকে থাকতে হয় বহুক্ষণ। শেষ বাক্যাংশটির, "নরম, তুলতুলে রুটি...", অন্তর্ঘাত যে রক্তাক্ত অনুনাদ সৃষ্টি করে, তা এড়ানো অসম্ভব।

মানস সরকারের গল্পে সাধারণভাবে একটি সচেতন বৈপরীত্য নির্মাণের প্রকট চেষ্টা আছে। কখনও তা বাহুল্য, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গল্পের সুরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। আয়রনির যে সংযমী ও মার্জিত ব্যবহার লেখক প্রায়শই করে থাকেন, তা যথাযথ। আলাদা করে বলতে হয়, গল্পগুলির প্রাঞ্জল ভাষা এবং স্থানিক তাৎপর্যমূলক সেপিয়া টোনের কথা। গভীর পড়াশোনা ও পারিপার্শ্বিক বিষয়ে পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োজনমাফিক গবেষণার ছাপ পাওয়া যায়- তবে তা কখনোই ইনফো-ডাম্পিং-এর পর্যায়ে পর্যবসিত হয় না।

 এবার আসি, দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ “অনন্ত রাত্রির কিশোরেরা” আলোচনায়। এর আগে আমরা যারা লেখকের “তৃতীয় পৃথিবীর নিঃসঙ্গতা” এবং “হাওয়ার দুর্গ” পড়েছি, তারা জানি, দীপশেখর লেখককেই প্রথম পুরুষের স্থানে রেখে এক নৈঃশব্দ্যের জগত সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন। তাঁর স্বনির্মিত দুনিয়ায় কাহিনি ব্রাত্য, শুধু জেগে থাকে অনুভূতির সংবেদী অঞ্চল, আর ব্যক্তিগত যাপনের সূক্ষ্মানুভূতি। দেবর্ষি সারগীর গল্পের যে স্বপ্ন-বাস্তবতায় জারিত বিকপ্ল জগত, তার সঙ্গে কখনও কখনও মিলে যায় কম্পাঙ্ক, তবে, এখানে জগত শুধু বিকল্প নয়, বরং বিপন্ন ও বিষণ্ণ। জাগতিক অনুনাদ এখানে সভ্যতার আদিম চিৎকারে স্থগিত, বরং, নৈঃশব্দ্যের নির্নিমেষ আর্তনাদে পাঠককে খুঁজে নিতে হয় শূন্যতার স্বরলিপি, যেখানে স্বর ও সুর বরাবরই তীব্রভাবে অনুপস্থিত।

 আমরা যদি বইটির কয়েকটি গল্পের নাম একবার দেখে নিই, তাহলে কেমন হয়? “হারানো সময়ের খোঁজে”, “শহরটি গায়েব হয়ে যায়”, “নির্বাসিত স্মৃতির মিনার”, “একটি প্রত্যাখ্যান”, “চিলেকোঠার বিষণ্ণ প্রেতেরা”, “ভাষাটিকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি”। কয়েকটি মাত্র গল্পের শিরোনাম (শিরোনাম কথাটি লক্ষ্যণীয়, বিষয়বস্তুর কথা বলা হয়নি) বাদ দিলে প্রতিটির নামের মধ্যেই এক অদ্ভুত নৈরাশ্য বিরাজ করছে। হারিয়ে যাওয়া সময় হোক বা ভাষা, গায়েব হয়ে যাওয়া শহর হোক বা নির্বাসিত হয়ে যাওয়া স্মৃতি, অথবা চিলেকোঠার বিষণ্ণ প্রেত। বস্তুত, এই ক্রম-নৈঃশব্দ্যের দিকে যে যাত্রা, তাই দীপশেখরের গল্পের অন্যতম উপজীব্য। স্বাভাবিক জগতের যে মূর্ত অবয়ব, তা থেকেই গল্পের শরীর বোনা শুরু করেন লেখক, ধীরে ধীরে সেই শরীরে জন্ম নিতে থাকে এক পরাবাস্তব আত্মার ধ্রুপদ। লেখক নাকি কথক গুলিয়ে যায়- এবং তিনি অবগাহন করতে থাকেন সেই শূন্যের আদি পথে, আর খুঁড়ে আনতে থাকেন অবচেতনের অলীক স্বীকারোক্তি।

 দীপশেখরের এই বইয়ের প্রতিটি গল্পেই তাঁর কৈশোর, যৌবনের রূপকথা, যৌনতার মন্থন খোদাই করে রেখেছেন। অনন্ত একাকীত্বের সেই গভীর স্বর পাঠককে স্তব্ধ করে নৈর্ব্যক্তিক মাদকতায়। তাঁর গল্পে উদ্বেগ আছে, উদ্বেগের জারণ আছে, এবং বহু আপাত-অবান্তর প্রশ্ন আছে। স্বভাবসুলভ বৈপরীত্যে তিনি প্রশ্ন করেন কবিতার মতো, উত্তরে কথক নিজেই কবিতা হয়ে ওঠেন। আর, সমস্ত চরিত্ররা আবর্তিত হয়ে চলে নিজেদের কেন্দ্র করেই, ঠিক একটা প্রেতের মতো। যেমন, “হারানো সময়ের খোঁজে” গল্পে কথকের বন্ধুরা নির্লিপ্তির কুয়াশাকে কাটতে থাকে ক্রমশ। স্কুল পালানোর মতো এক স্বাভাবিক উন্মত্ত কৈশোরের চেতনাকে পাশ কাটিয়ে তারা মিলিয়ে যেতে থাকে স্মৃতির অতলান্ত গহীনে। “শহরটি গায়েব হয়ে যায়” গল্পে তেমনই আমরা দেখি, রচিত হয় এক মায়াবাস্তবিক পট, যেখানে অস্তিত্বের যাবতীয় উত্তেজনাকে হারিয়ে ফেলতে থাকেন কথক এবং তাঁর বন্ধুরা। এই দুই গল্পের একটি কমন ফ্যাক্টর চোখে পড়ে। নৈমিত্তিক রাজনীতির ব্যবহার্য যুদ্ধক্ষেত্র কীভাবে মনস্তত্ত্বের বাসভূমিটিকে ধ্বংস করে ফেলতে সদা-তৎপর, তা লক্ষিত। এখানে বলা দরকার, লেখক এখানে কথকের নাম বরাবর নিজের নামেই রেখেছেন, এবং তাঁকে প্রথম পুরুষেই সম্বোধিত করেছেন। আসলে, এও এক উত্তরাধুনিক দ্যোতনা, যেখানে নিজেকে ক্রমাগত এক ‘আনরিল্যায়েবল ন্যারেটর’-এর ভূমিকায় প্রশ্নের মুখে ফেলে অবিরাম আত্মনিগ্রহের ক্ষেত্রে তৈরি করা, যাতে তিনি নিজেও অধিবৃত্তীয় মর্ষকামের সঙ্গোপন থেকে উত্তোরিত হতে না পারেন।

 পরের গল্প, “অবগাহনকারী”তে আমরা দেখি, কথক আবারও স্কুল পালানো ও একটি মেয়ের সংস্রবকে মুখ্য সংবেদে স্পষ্ট করেছেন, যা গত দুটি গল্পের থেকে একদিকে একই, আবার আলাদাও। এক এই ক্ষেত্রে, কারণ, পূর্বোক্ত দুটি গল্পেও adolescent fantasy এবং উন্মত্ত কৈশোরের মুহূর্ত অর্বাচীনভাবে উপস্থিত, যা কি না নিষিদ্ধ এবং উত্তেজনাময়, অযাচিত নারীসঙ্গের অধিগ্রহণে বাঙময়। কিন্তু সেখানে কথক একা নন প্রাথমিকভাবে, বন্ধুরা তার জগতকে পরিপূর্ণ করে। এই গল্পে কথক একা পালান, পালাতে চান তার বাস্তব দুনিয়া থেকে, যেখানে সভ্যতার উৎপীড়ন গ্রাস করে ফেলছে সত্যের অধীত অস্তরাগ। সময় নিয়ে খেলা করেছেন লেখক, অথবা সময় তাঁকে নিয়ে খেলা করেছে নিঃশব্দে, ঠিক যেমন বইয়ের উৎসর্গপত্রে সঞ্চিত তারকোভস্কি করতেন তাঁর চলচ্চিত্রে (প্রসঙ্গত, “মিরর”)। “নির্বাসিত স্মৃতির মিনার” গল্পে একটা পরাবাস্তবিক স্তর থেকেই গল্পের শুরুয়াত, তা ধীরে ধীরে প্রাসঙ্গিকতা-অপ্রাসঙ্গিকতার দোলাচল পেরিয়ে পৌঁছে যায় এক আশ্চর্য শিখরে, যেখান থেকে কথক আবার বাস্তবে ফিরে আসার প্রচেষ্টা করতে থাকেন। আসলে, কথক দিনের শেষে ফিরতে চান কোথাও একটা, কিন্তু পৌঁছতে না পারার ব্যর্থতায় অপ্রস্তুত মায়াবকাশ রচনা করেন নির্দ্বিধায়।

 এরপর, “চড়াই পাখিদের গান” গল্পে সময় লেখককে নিয়ে লুকোচুরি খেলে আবারও। কোনো এক অপাপবিদ্ধ যন্ত্রণার কুহক থেকে উঠে আসে মন্দ্রতার প্রতিধ্বনি, কথক বুঝতে পারেন না তাঁর আদৌ কোথাও যাবার আছে কি না। একই অনুভূতি প্রস্তুত হয় পরবর্তী গল্প, “একটি প্রত্যাখ্যান”-এ। প্রেম এবং প্রত্যাখ্যান – এই দুইয়ের আপাত সরল তাৎপর্যের ভেতরে অস্তিত্বের সাঁকো খুঁজে চলে গল্পটি। কথক তার ভালোবাসার (অথবা, অপ্রেমের) নারীকে খুঁজে চলেন, সে-নারীও কথককে খোঁজে অস্পষ্ট চেতনার স্তরে। স্নায়বিক অবচেতনের অন্দরমহল থেকে বারবার উঁকি দেয় সময়ের সঙ্কেত, যাকে সঠিকভাবে কখনোই উপভোগ করে ওঠা সম্ভব হয়  না। কিছু দুষ্প্রাপ্য দৃশ্যকল্প রচিত হয়, যা ক্লান্ত অথচ গভীর কণ্ঠে বুঝিয়ে দিতে চায়, জীবনের সখেদ অভিব্যক্তি আসলে একেকটি রোদ-পড়া জলবিন্দু ছাড়া আর কিছুই নয়।

 বইটির শেষ লগ্নে চলে আসতে থাকি আমরা। আসলে বইটি যেন একটাই লেখা, সে যেন বিভিন্ন পথ ঘুরে কোথাও একটা পৌঁছতে চেয়ে আবারও সূচনার শীর্ষবিন্দুতে এসে উপনীত হয়েছে। তাই, গল্পদের পথ-চলা খুব একটা আলাদা, বা বৈচিত্র্যপূর্ণ নয়। অথচ, চেতনার অন্তঃস্থল থেকে তারা উঠে আসে, এবং তাতে সন্দেহাবকাশ নেই। “অনন্ত রাত্রির নক্ষত্ররা” খুব গভীর রাজনৈতিক চেতনার গল্প। সেখানে আশা আছে, নৈরাশ্য আছে, শূন্যতাবোধ আছে। এক অদ্ভুত, ‘কাল্পনিক বাঁচার ‘ কথা আছে। ডিসটোপিয়াকে জোরালো অভিব্যক্তির মধ্যে দিয়ে নগ্নভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে এই গল্প- তবে, বোধ হয়, সামান্য মেদ-বিবর্জিত হলে আরও প্রতীকী হয়ে উঠতে পারত। “কিছুই ব্যক্তিগত নয়” গল্পে সভ্যতার অন্তরালে প্রোথিত থাকা ধ্বংসের বীজটির সন্ধান পাওয়ার চেষ্টা করা যায়। মার্ক্সবাদী মননের ফলাফল হোক, বা নিরবচ্ছিন্ন ইতিহাসের স্নায়বিক অববাহিকা বেয়ে হেঁটে-চলা – ব্যক্তিগত সমস্ত ক্ষয়ের ভেতর জেগে থাকা নৈঃশব্দ্যকে হাতিয়ার করে এগিয়ে চলে গল্পটি। শেষ দুটি গল্প, “চিলেকোঠার বিষণ্ণ প্রেতেরা” এবং “ভাষাটিকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি” গল্পে এক আশ্চর্য পথের কথা আছে। যেখানে আবার রচিত হয় সেই ‘আনরিল্যায়েবল ন্যারেটর’-এর কল্প। গল্পেরা পথ খোঁজে নিজেরাই, পাঠকও খুঁজে নেয় নিজের পড়ার পথ। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল ছাড়িয়ে গল্প হয়ে ওঠে বাস্তব, আর বাস্তব বোধ হয় খুব মেদুর স্বপ্নের মতোই হারিয়ে যায় এক অন্ধকার শূন্যের দিকে।

 দীপশেখরের গল্পে প্রতীক আছে, চেতনা আছে, মনস্তত্ত্বের স্বীয় চরাচর আছে। পুরো বইটিই যেন একটা নির্দিষ্ট অক্ষের মতো ঘুরে চলে অবিরাম। মানুষ আর মানুষের মতো কোনও অস্তিত্বকে ক্রমাগত সন্দেহ করতে করতে সময়ের করাঘাতে স্বপ্নের জাদু রচনা করেন দীপ; অবিন্যস্ত যাপনের দুর্বার রুক্ষতাতেও লেগে থাকে এক অকল্পনীয় সিম্ফনির সমমেল রোদ, যেখানে কাটা-ছেঁড়ার পর যেটুকু অনুভব রয়ে যায় বিমূর্ত, সেটিকেই সত্য বলে গণ্য করা যেতে পারে।

 দুটি গল্পগ্রন্থ স্বীয় মেজাজে সঞ্জাত। মানস সরকারের গল্পগ্রন্থে সময়ের এক্তিয়ারকে ক্রম-প্রতিষ্ঠিত করে চলার পথটিকে মজবুত করে তোলার চেষ্টা রয়েছে, বেভুল পথের সতর্কতাও রয়েছে বস্তুগতভাবেই। আর, দীপশেখর-রচিত গ্রন্থে সময়কেই ক্রমাগত প্রশ্নের মুখে ফেকে পথের প্রকৃত তাৎপর্যকে হারিয়ে ফেলা হয়েছে সচেতনভাবেই। আশাবাদ ও বিষণ্ণতার এই চোরা অন্তর্ঘাত পাঠককে যে স্বস্তি দেবে না- তা নিশ্চিত।

 

  • 2024-06-16