চিত্ত মন্ডল :বাংলাদেশের ছোটগল্পে হাসান আজিজুল হক বলতে গেলে 'একাকী' এবং 'নিঃসঙ্গ'। তাঁর নিজস্ব ভুবনে তিনি ছিলেন সম্রাটের মতো। 'একা'। তাঁর কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো না। তিনি ' স্বতন্ত্র' এবং 'ব্যতিক্রমী '। ছয়ের দশকে তিনি 'পূর্বমেঘ'কে কেন্দ্র করে তুমুল গল্প লিখে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন। হাসান আজিজুল হক আসলেই নয়া-আধুনিক, গভীর চেতনালোকের মোড়কে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন অনিবার্য নক্ষত্রের মতো জ্বলছেন। তিনি বস্তুবাদী এবং দায়বদ্ধ। তাঁর মন জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আধুনিক সংস্করণ এবং শেখভের অন্তর্চেতনা। তাঁর ভাষা কবিতাক্রান্ত ও গীতাশ্রিত।
হাসান আজিজুল হকের বিষয়বস্তু ও শিল্প - প্রকরণ বরাবরই হাত ধরাধরি করে হেঁটেছে, এ-যেনো অনেকটাই 'এ গুড কন্টেন্ট উইথ এ গুড ফর্ম ইজ গুড' (A good content with a good form is good) । গল্পের বিষয় অনুযায়ী তার শৈলি ----এই যুগলবন্দীই তাঁর রচনার বৈভব। তিনি আধুনিক, কিন্তু জটিলগ্রস্ত নন। গল্প - পাঠককে তিনি কখনো মরীচিকার পেছনে ধাওয়া করেননি। তাঁর ' আত্মজা ও একটি করবী গাছ 'বাংলাদেশের গল্পের ধারাকেই সমূলেই নাড়িয়ে দিয়েছে । তিনি একজন কুশলী চিত্রকর। তিনি গল্প লেখেন না। গল্প আঁকেন। তাই অনায়াসেই পাঠকসমাজ গল্পের অন্দরমহলে লেখকের সঙ্গে সঙ্গে পাশাপাশি নির্বিবাদে ঢুকে পড়তে পারেন। তাঁরা সেখানে গল্প খুঁজে পান। গল্পের কুশীলবদের সঙ্গে শরিকজন হয়ে ওঠেন। কিন্তু হাসান আজিজুল হক এখানে ধ্রুপদী রীতিতে কাহিনী শোনান না। তিনি গল্পের প্রতিবেশে হাঁটতে হাঁটতে চরিত্রগুলোকে দিয়ে নিজেদের গল্প বুলিয়ে নেন। এখানেই তিনি ব্যতিক্রমী। এ কারণেই তাঁর হাত ধরে বাংলাদেশের ন্যারেটিভ গল্পরীতির খোলনলচে বদলে যায়। শেখভের মতোই তাঁর অন্তর্দৃষ্টিও সমাজের মূল কাঠামোয় গিয়ে বিদ্ধ করে। ফলে তিনি দক্ষ শিল্পীর মতো গল্পে হাঁটা - চলা - মুখভঙ্গী এবং জীবনের প্রতিটি অনুভব ও বাঁকের যথার্থ চিত্র ফুটিয়ে তুলতে পারেন ---এখানেই তিনি সবার থেকে আলাদা। বিশেষত, 'আত্মজা ও একটি করবী গাছ' - এর আটটি গল্পেই এই ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
তিনি আসলে গল্প - আঙ্গিকে মূলত এক সংজ্ঞাহীন নির্বেদ সাহিত্য - রীতির আমদানী করে বিদগ্ধ পিঠককুলে মজেছেন। তাঁর এই গল্পসমূহে সমাজীবনের প্রপন্নতা, দেশভাগের যন্ত্রণা, দাঙ্গার যে ভয়ংকর ক্লেদ ও গ্লানি এবং শ্রেণি-স্বার্থের দুর্বার আগুন মনুষ্যত্বকে কিভাবে কূটরক্তের পংকিলতার মধ্যে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, সে-কথা চিত্রকরের মতো বলে যান। এখানে তিনি কথক, কিন্তু নিজেকে রাখেন সযত্ন-দূরত্বে। কুশীলবদের যন্ত্রণার সঙ্গে একজন পাঠক হিসেবে আমাদের মনের মধ্যেও যন্ত্রণা দলা পাকিয়ে ওঠে।
তবে গল্পে তিনিও অংশীদার, গল্পের আঁতের খবর যেনো তারই জীবনের অন্তর্দহন। দেশভাগের এবং দাঙ্গার অভিজ্ঞতা তাঁকে ক্লিন্ন করে, যন্ত্রণায় নীল করে এবং তিনি 'নীলকন্ঠ পাখি' হয়ে ওঠেন। মানুষের ভেতরের অতলান্ত বিকার ও অবক্ষয়িত চৈতন্যকে তিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভঙ্গীতে বাস্তবায়নের ভাষায় খুঁজছেন। তাঁর গল্পে সমকালের বাংলাদেশের ' বিচিত্রতর মানুষের সমাজ জীবনের বিচিত্র বিকার, অসঙ্গ - অবদমিত যৌনানুভূতি, মধ্যবিত্ত জীবনের অনিবার্য অবক্ষয়, দাঙ্গাজনিত উদ্বাস্তু- সমস্যা এবং সর্বোপরি কৃষক - শ্রমিকের প্রতিরোধহীন দুর্দমনীয় শক্তির কথা সহজ অথচ সরলভাবে জীবনকে দেখার চোখ নিয়ে প্রতীকের ব্যঞ্জনার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন।
বাংলাদেশে তখন দুর্বার গণ-আন্দোলন। দেশ এগুচ্ছে গণ-অভ্যুত্থানের দিকে। বামপন্থী-আদর্শে আস্হাশীল বলে অবলীলায় হাসান আজিজুল হকের গল্পে বিনতি মেনেছি। 'সমুদ্রের স্বপ্ন, শীতের অরণ্য' (1964) তেমন আলোড়ন তুলতে পারেনি মনে। তবে তাঁর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ 'আত্মজা ও একটি করবী গাছ' (1967) তুমুলভাবে ওলটপালট করে দেয় এতো দিনের পাঠাভ্যাস । চিন্তার শরীর জুড়ে জ্বলে আগুন। হৃদয়ের দীপ্রতায় প্রদীপ্ত হতে হতে তাঁর গল্পের মায়াজালে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। এ - এক যাদুর মোহজাল। মাদারীপুর নাজিমুদ্দিন কলেজে পড়ি এবং ছাত্র ইউনিয়নের লড়াইয়ে সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।
হাসান আজিজুল হকের এই গ্রন্থের গল্পগুলো এতোই প্রভাববিস্তারী যে, তার অমোঘ নেশায় এবং মোহিনী আকর্ষণে তারই অনুসরনে লিখে ফেলি একটা আস্ত গল্প :আমি, সুপ্তি এবং একটি বিবিক্ত চেতনার উপলব্ধি '। মুগ্ধতার রেশ আকন্ঠ ডুবিয়ে রাখে আমাকে। গল্পটি কলেজ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। পরে শুক্তিযুদ্ধ - শেষে দেশ যখন পুনর্গঠনে ব্যস্ত, তখন দৌলতপুরে বি.এল. কলেজের বাংলার অধ্যাপক সাধন ঘোষ হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন এক বিকেলে। তিনি তখন ঐ কলেজের দর্শনের অধ্যাপক। বৃষ্টিভেজা সেই সন্ধ্যায় আমি মুগ্ধতার জলে ভাসতে ভাসতে ফিরে আসি কলকাতায়। তাঁর মতাদর্শে ও গল্পের সমুদ্রে ডুব সাঁতারে অভ্যস্ত আমি অন্য মানুষ হয়ে উঠি। কিন্তু গল্প আমি আর লিখি না। আমি তাঁর গল্পের একজন গুণমুগ্ধ পাঠক হয়ে উঠি। এবং দেশভাগের ও দাঙ্গার আতংককে আমি উপভোগ করতে শিখি।
দেশভাগের পরে দাঙ্গায় একটা বড়োগোষ্ঠৌ উদ্বাস্তু হয়। বিশেষত, পশ্চিমবঙ্গ এবং তৎকালীন পূর্ব বাংলার এক বিরাট জনগোষ্ঠীকে ভোগ করতে হয় এই দাঙ্গাজনিত যন্ত্রণা । দাঙ্গাপীড়িত ভয়াবহ জীবনের দুর্দশার চিত্রই এই 'মারী' গল্পের মূল থিম। 'মারী' গল্পটি প্রকাশিত হয় ' সমকাল' - এ (দশম বর্ষ, ষষ্ঠ - অষ্টম সংখ্যা , ঢাকা, মাঘ-চৈত্র, 1373) ।ছয়ের দশকের দ্বিতীয় পর্বে রচিত এই গল্প অচিরেই পাঠকসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গল্পটি উদ্বাস্তু - জীবনভিত্তিক। হাসান আজিজুল হক নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা এবং যন্ত্রণার অনুভবকে স্মৃতিতে লালন করেছেন সারা জীবন। তাই দেশভাগ, দাঙ্গা এবং তার পরিনতিতে যে জীবন - যন্ত্রণা, অসহায়তা সব কিছুই যেনো সাবলীল ও সহজভাবে চলে আসে তাঁর গল্পের ফ্রেমে। ভেতরে তখন টগবগ করে ফুটতে থাকে অন্তর্দহন। দাঙ্গাবিধ্বস্ত জীবন, এলোমেলো সেই জীবনের পুংখানুপুংখ চিত্র তাই পরিস্ফুট হয় তাঁর অভিজ্ঞতার জারকরসে। ফলে গল্পের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে ' আমাদের জীবনেরই ক্ষয় ও ব্যর্থতার যুযধান প্রতিবিম্ব।' (ঘনিষ্ঠ কথকতা, হায়াৎ মামুদ, ছোটগল্প, ছোটগল্পের চতুর্থ সংকলন)। এই গল্পে কোনো রাজনীতি নেই। দক্ষ শিল্পীর মতো নিপুন আঁচড়ে তিনি এঁকেছেন এই রিফিউজী জীবনকথা। এই গল্প উদ্বাস্তুদের নিয়ে। কিন্তু তিনি এখানে উদ্বাস্তুদের জীবনকথা বলতে গিয়ে কোনও নিজস্ব দৃষ্টিকোনকে অবলম্বন করেননি। এখানে নায়ক আসলেই একটি ' অধপতিত অবক্ষয়িত সমাজের রূপচিত্র, যা পাঠকদের অনিবার্যভাবে টেনে নেয় বিষাদ গভীর গহ্বরে।'
হাসান আজিজুল হক যে ধরনের গল্প লিখেছেন, 'উটপাখি' ঠিক সেই মাপ বা মানের নয়। মাপকাঠি বিচারে একে ঠিক গল্প বলা যাবে না। এখানে লেখক সমকালের জীবনের ও মৃত্যুর দর্শনকে প্রতিভাত করেছেন শ্লেষ এবং সুপ্রসন্ন কৌতুক - দৃষ্টিতে। এই গল্পে জাঁপল সার্ত্র - এর 'নসিয়া' বা ' Nausea' নামক এক অস্তিত্ববাদী উপন্যাসের কাহিনীকে সমান্তরালভাবে বিচার করা যায়। এই ' নসিয়া' - ই তাঁকে ' উটপাখি' গল্পটির ফ্রেম ও ভেতরের রক্ত - মাংস নির্মানে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
'সারা দুপুর' গল্পটিও স্বতন্ত্র। তবে তাঁর অন্যান্য গল্পের মতোই দক্ষতার পরিচায়ক । কিশোর মনস্তত্ত্বের এক সহজ - সরল বোধের প্রকাশ ঘটেছে এই গল্পে । এই গল্পে কিশোর মনস্তত্ত্বের আত্মঘাতি দিকটিই পরিস্ফুট হয়েছে।
2.'সুখের সন্ধানে ' শীর্ষক গল্পটির বিষয়-আসয়ও মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের চিত্রভাষ। বাঙলি ঘরের বিবাহিত কম্কুমের সব কিছু পাওয়া হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও যেনো না-পাওয়ার এক দীর্ঘ অসস্তির বাতাবরণ এই গল্পের মূল থিম। এবং বাঙালি মেয়েদের মনের ভেতরের 'চাওয়া' ও ' না-পাওয়ার' দোদুল্যমানতার অসুস্থতাকে নিয়েই এই গল্পের ফ্রেম তৈরি হয়েছে। মনস্তাত্ত্বিক এই গল্পটি বাঙালি নারীদের আঁতের খবর টেনে বের করে আনেন লেখক। এখানেই তিনি গল্প না বলেও নারীর কারুবাসনার স্বপ্নকে প্রকাশ করেন। চাওয়া আর না-পাওয়ার দ্বন্দ্ব কিভাবে একটি জীবনকে অসুস্থতার যন্ত্রণায় দগ্ধ করে, সেই কথাটিই গল্পকার এখানে ফুটিয়ে তুলেছেন।আগেই বলেছি ' সারা দুপুর' ও 'সুখের সন্ধানে' মনস্তাত্ত্বিক ছোটগল্প। আর 'আমৃত্যু আজীবন' চেতনাপ্রবাহাশ্রয়ী ছোটগল্প। চেতনাপ্রবাহের কিছু কিছু দৃশ্য মানুষের স্নায়ুতন্ত্রকে উদ্দীপিত করে। এবং এর মাধ্যমেই মগজের ভেতরে যে প্রক্রিয়ায় সে চেতনাকে জাগ্রত করে , তাকে গল্পে ব্যবহার করে হাসান আজিজুল হক ' আমৃত্যু আজীবন' গল্পে কিছু কিছু ঘটনাকে উপস্থাপিত করেছেন। এই চিন্তাধারাকে বলা হয় ' thinking action' বা ঘটনা - পরম্পরার মাধ্যমে চিন্তা করা। হাসান আজিজুল হকের এই গল্পের কোথাও কোথাও প্রতিবিম্বমূলক চিন্তা বা ' thinking of memory' লক্ষিত হয় ।এই গল্পের কোনো কোনো স্তরে জয়েসীয় রীতির চেতনাপ্রবাহ - এর সন্ধান মেলে। তবে একথা বললেও তিনি তাঁর গল্পের বিষয়বস্তু ও তাঁর উপস্থাপনা কিংবা উপযোগের দিক থেকে মূলত দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ থেকে একচুলও নড়েননি। তিনি বস্তুবাদী দর্শনে আস্থাশীল ছিলেন বলেই 'জীবনের ইন্দ্রিয়জ উপলব্ধিকে' সর্বত্র বজায় রেখেছেন। এবং এই কারণেই তিনি এখানে অন্তর্দর্শনপুষ্ট বিজ্ঞান তত্ত্বের প্রভাবমুক্ত থেকেছেন।
এই গল্পে হোমিংওয়ের 'দি ওল্ড ম্যান অফ দ্য সী' ( The old man and the sea) গল্পের ভাব - সাদৃশ্য পরিলিক্ষত হয়।
তাঁর গল্পসমূহে তিনি গল্পের বিষয়বস্তুর দিকে তাকিয়েই গল্পের ফ্রেম ও ভাষার ব্যবহার করেছেন। শিল্প - প্রকরণের দক্ষ-শিল্পীর মতো তিনি মানুষের অস্তিত্বের সংকট, জৈবিক দাসত্ব, বেঁচে থাকার নিদারুন গ্লানি, পরাভয় এবং বিনষ্টির বিশ্বস্ত রুপকল্প নির্মানে অসীম ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন। হাসান আজিজুল হকের ' আত্মজা ও একটি করবী গাছ' বাংলা ছোটগল্পের ভুবনে তাকে সম্রাটের আসনে বসিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তিনি প্রভাব বিস্তার করলেও কেউই তাঁকে ছাপিয়ে যেতে পারেন নি। তিনি তাই একাকী, অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং নিঃসঙ্গ।
সহায়কপঞ্জি
1. আত্মজা ও একটি করবী গাছ: হাসান আজিজুল হক, মুক্তধারা, ঢাকা, 1967
2. শ্রেষ্ঠ গল্প :হাসান আজিজুল হক, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা, 2008
3. হাসান আজিজুল হকের কথাসাহিত্য: বিষয়বিন্যাস ও নির্মানকৌশল, চন্দন আনোয়ার, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, 2015
4. বাংলা ছোটগল্পে দেশবিভাগ, সানজিদা আখতার, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, 2002
5. হাসান আজিজুল হকের গল্পের সমাজবাস্তবতা, আবু জাফর, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, 1996
6. বাংলাদেশের ছোটগল্পে বাস্তবতার স্বরূপ, সায়েদা বানু, হাক্কানী পাবলিশার্স, ঢাকা, 2000