শ্যামরায়মঙ্গল- প্রতাপাদিত্যের গুপ্তধন, মানসিংহ ঘুরপথে কেন ?

হসপিটালের বেডে শুয়ে রতনের মনে একেবারেই শান্তি নেই। বাড়িতে খবর দেওয়া গেছে। বউটা দুদিন হসপিটালে ঘুরেও গেছে। ডাক্তারবদ্দির পিছনে খরচে স্যার কিপটেমি করছে না। কিছু টাকাও বউটার হাতে ধরে দিয়েছে স্যারের লোক। কিন্তু মনটার খচখচানি একেবারেই যাচ্ছে না। তার ভুলের জন্যই কি শামসুলের প্রাণটা গেল ? কে মারল শামসুলকে ? একবার যদি হাতের সামনে পেত ব্যাটার বাপের নাম ভুলিয়ে দিত। লছমনই কী করল এমন বেইমানিটা ? স্যারের লোকের মুখে শুনেছে যে লছমনকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। স্যারের লোক অবশ্য এসব নিয়ে ভাবতে বারণ করে গিয়েছে। স্যারের হাত থেকে পালিয়ে লছমন কোথাও যেতে পারবে না। ধরা সে ব্যাটা পড়বেই। কথা হল, তুই মোহর চাস, মোহর নিতিস। শামসুলকে মেরে ফেললি কেন ? দিনরাত মনের ভেতরে এই ভাবনাটাই কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে রতনের। বিহিত তো এর একটা করতেই হবে। শামসুলের বউটার কাছে কী মুখ নিয়ে যাবে সে ?


***


শ্যামরায় নমঃ নমঃ


কেশবায় নমঃ নমঃ


বিষ্ণুবায় নমঃ নারায়ণ।


শ্রীকৃষ্ণ জনার্দন


লক্ষ্মীকান্ত সনাতন


বাসুদেব বৈকুন্ঠ বামন।।


  রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে মনোময় বসলেন পাণ্ডুলিপি নিয়ে। মঙ্গলকাব্যের শুরুতেই যেমন আরাধ্য দেবতাদের উদ্দেশ্যে স্তব থাকে তেমনই রয়েছে। প্রথমেই বাসুদেব কৃষ্ণের স্তব করে কবি হরিদাস লিখেছেন,


হর তাপ হর শোক   হর পাপ হর রোগ


    হর দুঃখ কর সঞ্চালন।


কর ইষ্ট কর সৃষ্ট  করে করি কর নিষ্ট


   কর দেব ভব বৃন্দাবন।।


করশব্দের নানা অর্থে প্রয়োগ মনোময়ের চমৎকার লাগল।


লক্ষ্মীকান্তের পিতা জিয়া গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ত্রী পুত্রের জন্মকালে মৃত হলে সংসারে বৈরাগী হয়ে কালীঘাট ত্যাগ করলেন। কালীঘাট মন্দিরের সেবাইতের কাছে শিশুর প্রতিপালন হতে লাগল। পুত্র লক্ষ্মীকান্ত বড় হয়ে পিতাকে খুঁজে বের করলেন। তিনি তখন কাশীতে কামদেব ব্রহ্মচারী নামে পরিচিত। কালীঘাট অঞ্চল ছিল বসন্তরায়ের অধিকারভুক্ত এলাকা। মায়ের মন্দিরের পূজারি ভূবনেশ্বর ব্রহ্মচারীর নিকটে শুনে গুণী লক্ষ্মীকান্তকে তিনি কানুনগোর দপ্তরে দায়িত্বে বহাল করলেন। যখন বিক্রমাদিত্য পুত্র প্রতাপকে আগ্রায় প্রেরণ করতে চাইলেন তখন বসন্তরায় সঙ্গে লক্ষ্মীকান্তকে দিলেন। বয়সে সামান্য ছোট লক্ষ্মীকান্ত প্রতাপের সঙ্গে দীর্ঘসময় একত্রে থাকায় প্রতাপের স্বভাবের নাড়ীনক্ষত্র জানতেন। 


  হরিদাস রায় এই লক্ষ্মীকান্ত মজুমদারের বংশেই জন্মেছিলেন। পুঁথিতে যে বংশ পরিচয় দিয়েছেন তাতে দেখা যাচ্ছে লক্ষ্মীকান্তের জ্যেষ্ঠপুত্র রামরায়ের (এই পরিবার পরেরায়এবংচৌধুরীউপাধি পেয়েছিল) তৃতীয় পুত্র জগদীশ রায়ের পৌত্র রামচন্দ্র রায়ের পুত্র হলেন হরিদাস।


  লক্ষ্মীকান্ত মানসিংহের থেকে শুরুতে পাঁচটি পরগনা পেয়েছিলেন। মাগুরা, খাসপুর, কলকাতা, পাইকান, আনোয়ারপুর। কলকাতার অধীনে দমদম, নিমতা, চানক, বরানগর, খড়দহ ইত্যাদি অঞ্চল। খাসপুরের অধীনে বড়িশা, ডায়মন্ড হারবার; মাগুরার অধীনে আলিপুর, গার্ডেনরীচ, খিদিরপুর ইত্যাদি। পাইকান গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে সালকিয়া ইত্যাদি। শুরুতে কয়েকটি অঞ্চলের ভিন্ন নাম হলেও ইংরেজ আমলে বর্তমান নামগুলি হয়েছিল। হরিদাস যখনশ্যামরায়মঙ্গলরচনা করছেন ততদিনে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কলকাতায় ৭০ বছর বসবাস করে ফেলেছে।


  মঙ্গলকাব্যের রস আস্বাদন তেমন করতে পারছেন না মনোময়। কারণ মনের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে গুপ্তধনের কথা। যদিও অনুমান করেছেন যে সে সব ইঙ্গিতপূর্ণ লেখার অংশগুলি সর্দার হাতছাড়া করেন নি এখনও। মনোময় এতোকাল শুনে এসেছেন যে তিন মজুমদারে মিলে বাংলার স্বাধীনতা বিক্রি করে দিয়েছিল দিল্লির হাতে। ভবানন্দ এবং লক্ষ্মীকান্তরা কি সত্যিই মীরজাফরের মতন বিশ্বাসঘাতক ছিলেন ? ভবানন্দের বংশধর রাজা কৃষ্ণচন্দ্র মীরজাফরের দলেই ছিলেন। কিন্তু লক্ষ্মীকান্তের বংশে এমন কিছু জানা যায় নি। তাঁরা ইংরেজদের পক্ষে থাকা দূরস্থান বরাবর বিরোধিতাই করে গিয়েছেন। হরিদাসের পুঁথিতে লক্ষ্মীকান্তের প্রতাপের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার কথা লেখা নেই। থাকার কথাও নয়। যেমন কৃষ্ণচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত অন্নদামঙ্গলে ভারতচন্দ্র ভবানন্দের বিশ্বাসঘাতকতার কথা বলেন নি। এটাই স্বাভাবিক। সকলেই নিজের বংশের বা অনুগ্রহদাতা রাজার গৌরবের কথাই বলেন। কে আর নিজেদের কুকীর্তির কথা লিখে যান ?


  কাক কৃষ্ণ কৃতো যেন হংসশ্চ ধবলোধৃতঃ


ময়ূরশ্চিত্রিতো যেন তেন রক্ষা ভবিষ্যতি।।


  এই শ্লোকটি কামদেব ব্রহ্মচারীর নামে প্রচলিত। কাকের বর্ণ কালো, হাঁসের বর্ণ সাদা এবং ময়ূরের বর্ণ নানা রঙের যিনি করেছেন তিনিই সদ্যোজাত পুত্রকে রক্ষা করবেন, একথা লিখে লক্ষ্মীকান্তের বুকের উপরে রেখে জিয়া বা কামদেব ঘর ছেড়েছিলেন। এমন যার বৈরাগ্য তিনি কিন্তু মানসিংহকে বলেছিলেন পুত্রের দিকে খেয়াল রাখতে। এই জায়গাটি মনোময়কে ভাবাচ্ছে। বলা হয়েছে মানসিংহ যশোর আক্রমণের পূর্বে কাশীতে গিয়ে কামদেবের সহিত সাক্ষাৎ করেছিলেন। মানসিংহ একজন হিন্দু হিসেবে হিন্দু সাধুর নিকটে দেখা করতে গিয়েছিলেন এমন কথাই বলা হয়েছে। তখনই জিয়া বা কামদেব ব্রহ্মচারী নিজের পুত্রের কথা বলেছিলেন।কালীক্ষেত্র কলিকাতা’-র সাথেশ্যামরায়মঙ্গল’-এর এই বিষয়ে তথ্যে সাদৃশ্য রয়েছে।


  কিন্তু মনোময় ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। ভারতচন্দ্র যে লিখেছেন,


আগে পাছে দুই পাশে দুসারি লস্কর।


চললেন মানসিংহ যশোর নগর।।


মজুন্দারে সঙ্গে নিলা ঘোড়া চড়াইয়া।


কাছে কাছে অশেষ জিজ্ঞাসিয়া।।


এইমজুন্দারকি কেবল ভবানন্দ মজুমদার ? নাকি লক্ষ্মীকান্ত মজুমদারও ? মনোময় দ্বিধায় পড়ে গেলেন। মাথায় নানান চিন্তা এসে ভিড় করল। মানসিংহ ১৫৯৫ সাল থেকে বাংলা-বিহারের সুবেদার ছিলেন। প্রতাপের সাথে যুদ্ধের আগেই বার ভুইঞার ঈশা খাঁ এবং বিক্রমপুরের কেদার রায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন।  মানসিংহের বাহিনীর সাথেই প্রতাপাদিত্য উড়িষ্যা অভিযানে গিয়েছেন। মানসিংহ প্রতাপ এবং তাঁর দলবল সম্পর্কে অনেক খবরই রাখতেন। লক্ষ্মীকান্ত যে প্রতাপাদিত্যের সরকারের রাজস্ব বিভাগের প্রধান কর্মচারী ছিলেন সেকথা সতীশ চন্দ্র মিত্র তাঁরযশোহর-খুলনার ইতিহাসগ্রন্থে লিখেছেন। মনোময় বইপত্রের র‍্যাক থেকে বইটি বের করে আর একবার দেখে নিলেন। প্রায় দশ বছর বাংলার সুবেদার থাকার কারণে লক্ষ্মীকান্তের পরিচয় মানসিংহের অজানা থাকার কথা নয়। বিশেষত আগ্রায় প্রতাপের সাথে লক্ষ্মীকান্ত গিয়ে থেকেছিলেন বেশ কিছু সময়। মানসিংহের পুত্রদের কথাও বিবেচনায় রাখতে হবে। জগতসিংহকে বিখ্যাত করফেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। বাংলায় ছিলেন এবং নানা যুদ্ধবিগ্রহে অংশ নিয়েছিলেন। পুত্রের থেকেও সংবাদ পেতেন পিতা মানসিংহ।


  ১৫৯৯ সাল নাগাদ মানসিংহ দাক্ষিণাত্য অভিযানে গিয়েছিলেন। এই সময়েই প্রতাপ রাজ্যসীমা বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। ১৬০১ সাল নাগাদ বসন্তরায় প্রতাপের হাতে নিহত হলেন। কচু রায় আগ্রায় অভিযোগ করলেন। মানসিংহ যশোর আক্রমণের প্রস্তুতি নিলেন।


  মনোময় ভাবছিলেন। আকবরের রাজনীতিতে শক্তির সাথে বুদ্ধিমত্তার মিশেল ছিল। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে হিন্দুদের তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন। চিতোরের রানা প্রতাপের সাথে সন্ধির জন্য মানসিংহকেই পাঠিয়েছিলেন। রানা প্রতাপ রাজি না হওয়ায় যুদ্ধে যান মানসিংহ। বাংলায় টোডরমল এবং মানসিংহকে দিয়ে হিন্দু রাজাদের অনেককেই আনুগত্য স্বীকার করিয়েছিলেন। আকবরের অনুগত মানসিংহ প্রতাপের বিরুদ্ধে অভিযানের সময়ে একই পলিসি নিয়েছিলেন। ভবানন্দ, জয়ানন্দ এবং লক্ষ্মীকান্ত মজুমদারদের স্বপক্ষে আনয়ন এই পলিসিরই সফল প্রয়োগ ছিল।


  মানসিংহ রাজমহলে থাকতেন। রাজমহল থেকে ভাগিরথী পার হয়ে আজকের মুর্শিদাবাদ ও নদীয়া হয়ে যশোরে যাওয়াই ছিল সোজা পথ। কিন্তু ভারতচন্দ্র বর্ণনা করেছেন যে তিনি বর্দ্ধমানে এসেছিলেন। মনোময় একবার গুগল ম্যাপ খুলে দেখে নিলেন।


 


         মানসিংহ কেন সোজা যশোরের দিকে না গিয়ে বর্দ্ধমান হয়ে এলেন একথা ভাবতে ভাবতেই মনোময়ের মনে পড়ল বাঁশবেড়িয়ার জয়ানন্দের পরিবারের আদতে জমিদারী বা রাজত্ব ছিল বর্দ্ধমানের পাটুলিতে। জয়ানন্দের পুত্র রাঘবেন্দ্র বাঁশবেড়িয়ার বাঁশবন কেটে প্রাসাদ বানিয়েছিলেন। ভবানন্দও বর্দ্ধমানের কাছেই থাকতেন। নদীয়ার বাগুয়ানে আদি বাড়ি হলেও ভবানন্দ মুহুরীগিরি করার জন্য সাতগাঁও পরগনায় থাকতেন। নিজে বাড়ি করেছিলেন বল্লভপুর গ্রামে। ভবানন্দের বল্লভপুরের গ্রামে মানসিংহ এসেওছিলেন।


  এখন কথা হল দুজন সাধারণ কর্মচারীর সাথে দেখা করার জন্য মানসিংহ এমন ব্যস্ত হয়ে উঠলেন কেন ? বাংলা-বিহারের সুবেদার মানে হল প্রায় সুলতানের মতন ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। তিনি সামন্ত রাজাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারেন। তাবলে সামন্ত রাজাদের অধীনস্ত কর্মচারীদের সাথে ? মনোময়ের মনে হল এক গভীর পরিকল্পনা ছিল মানসিংহের। পাটুলির রাজা জয়ানন্দকে হাতে নিলেন। তাকে দিয়ে লক্ষ্মীকান্তকে খুঁজে বের করলেন। ভবানন্দ এবং লক্ষ্মীকান্তের সাহায্য নিয়ে প্রতাপের সমস্ত শক্তি এবং দুর্বলতা জেনে নিয়ে তাঁদের সাহায্যেই প্রতাপকে পরাস্ত করলেন।


এই পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবেই মানসিংহ কাশীতে গিয়ে কামদেব ব্রহ্মচারীর সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। মনোময় প্রায় নিশ্চিত হলেন এই বিষয়ে। লক্ষ্মীকান্ত বিশ্বস্ত কর্মচারী ছিলেন। পিতার আদেশ ছাড়া তিনি প্রতাপের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে রাজি হবেন না। আর যাই হোন লক্ষ্মীকান্ত ভবানন্দের মতন উচ্চাকাঙ্ক্ষী নন। ভবানন্দ নিজেই এসে মানসিংহের সাথে দেখা করেছিলেন। লক্ষ্মীকান্তকে খুঁজে বের করতে হয়েছিল।


  মনোময় ঘড়ি দেখলেন। প্রায় বারোটা বেজে গিয়েছে। পুঁথির যতটুকু পেয়েছেন তার মধ্যে গুপ্তধনের কিছুই পান নি। পাওয়ার বিশেষ আশাও করেন নি তেমন। গুপ্তধনের রহস্যের কথা মাথায় ঘোরায় নতুন মঙ্গলকাব্যটিকে একপ্রকার অবহেলাই করা হয়ে যাচ্ছে। মনোময় ঠিক করলেন ফেললেন কয়েকটি কথা। এক, সর্দারের প্রস্তাবে তিনি রাজি হয়ে যাবেন। কারণ না হলে পুঁথির বাকি অংশটি তিনি হাতে পাবেন না। পুঁথিটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। দুএকটি বাক্যের দিকে আগেই নজর পড়েছিল। পাতা উল্টে মনোময় খুঁজে বের করলেন।


প্রথমটি হল,


গ্রামে নাহি মানে সেহ আপুনি মণ্ডল।


কোন শক্তি নাহি রুদ্র বাক্যই সম্বল।।


  বসন্তরায়ের জ্যেষ্ঠপুত্র গোবিন্দরায়ের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। তিনি নিজ এলাকায় চোটপাট করলেও আসলে তাকে কেউই তেমন মানত না। প্রতাপ তাঁর এই খুড়াতো ভাইটিকে একেবারে দেখতে পারতেন না। প্রতাপের নানা কাজে বাগড়া দেওয়া তার স্বভাবে দাঁড়িয়েছিল। পকশ্রীতে একটি নদীবন্দর এবং দুর্গ তৈরির পরিকল্পনা ছিল প্রতাপের। প্রতাপের রাজত্বকালে পর্তুগিজ জলদস্যুদের অত্যাচার বেড়ে গিয়েছিল। তাদের দমন করার আবশ্যকতা ছিল। অথচ নিজ এলাকাভুক্ত হওয়া সত্বেও গোবিন্দের জন্য প্রতাপ এলাকাটি হাতে পাচ্ছিলেন না। নিজে কিছু করবেনও না, আবার প্রতাপকে দেবেনও না করতে। গোবিন্দের এই আচরণের কথা বলতে গিয়ে কবি হরিদাস উপরের দুটি লাইন লিখেছিলেন। মনোময় বিছানায় শুয়ে ভাবছিলেনগাঁয়ে মানে না আপনি মোড়লনামের প্রবাদের কথাটি। কোনটির জন্ম আগে ? প্রবাদটির, নাকি হরিদাসের এই পঙক্তিটির ? মনোময় সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেন না।


  এরকমই দ্বিতীয় আর একটি উদাহরণ তিনি পেয়েছেন।


পিপীলিকা পক্ষ ধরে মরণ লাগিয়া।


দুর্বুদ্ধি প্রতাপে হৈল বিদ্রোহ করিয়া।।


  কবি হরিদাস বেশ কিছু প্রবাদ বাক্যের জন্ম দিয়েছিলেন আজ থেকে আড়াইশো বছর আগে। আর আগেও দেখেছেন, ‘সুখের প্রবাহে হয় প্রেতের উৎপাত আর এবারে পেলেন মরণের সময়ে পিঁপড়ের পাখা গজানোর কথাটি। তিন তিনটি প্রবাদের উৎসের সন্ধান পেয়ে মনোময়ের মুখে বেশ তৃপ্তির হাসি চলে এল। ঘুম আসতে আসতে ভাবলেন, কবি হরিদাস কী লোকমুখে প্রচলিত প্রবাদগুলি কাব্যিকভাবে ব্যবহার করেছিলেন ? নাকি এই কাব্যের পরেই এগুলির ব্যবহার বেড়েছিল ?


  তাই বা কিকরে হয় ? এই কাব্যগ্রন্থটি তো প্রচলিতই হয় নি। তাহলে জনগণ এর মধ্যে লেখা প্রবাদগুলির কথা জানবেন কী করে ? আচ্ছা, তাই বা কেন ? হরিদাস এটি রচনার পরে নিশ্চয়ই অনেককেই পড়িয়েছিলেন। ১৭৬০ সাল নাগাদ সাবর্ণ চৌধুরীদের জমিদারীর সেই তেজ আর নেই। কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকা ব্রিটিশদের দখলে। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের মাধ্যমে ভারতচন্দ্র যে সম্মান ও খ্যাতি পেয়েছিলেন সেটি হরিদাসের কপালে জোটেনি। ফলে তিনি বিখ্যাত হতে পারেন নি। তাঁর রচিতশ্যামরায়মঙ্গলবিস্মৃতির অতলে চলে যায় একসময়। কিন্তু তাই বলে এই গ্রন্থটি কেউই পড়েন নি, তা তো নয়। সাবর্ণ চৌধুরীদের লোকজন, তাঁদের বন্ধুবান্ধবেরা পড়েছিলেন হয়তো। তাদের মুখেমুখেই প্রবাদের মতন করে লেখা বাক্যগুলি জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে যায়। বাক্যগুলির গঠনও লোকেদের চলতি ভাষায় তৈরি হয়ে যায়।সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়জাতীয় বাক্যের এভাবেই হয়তো জন্ম হয়েছিল। এসব ভাবতে ভাবতে মনোময় কখন জানি ঘুমিয়ে পড়লেন।


***


 


   বরানগর থেকে বাসে অল্প সময়েই বালিতে এসে ট্রেন ধরে হাওড়ায় আসতে ত্রিশ/চল্লিশ মিনিট লাগে। সজলের বাসা বাড়িতে আসতে ঘন্টাখানেকের সামান্য বেশি। পথে আসতে আসতে সজল রত্নদীপের কথা ভাবছিল। বর্দ্ধমানের রাজকলেজের বন্ধু নিত্যর সাথেই রত্নদীপ বোলপুরে এসেছিল বছর সাতেক আগে। সে সময়ে মনোময় স্যার বোলপুরে এস ডি আই সি ও। সেই সময়ে একটি পুরানো পুঁথিতে কিছু চর্যাপদের সন্ধান পেয়ে সেসব উদ্ধারের আশায় তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের অফিসে মনোময় স্যারের দ্বারস্থ হয়েছিল সজলেরা তিনবন্ধু। বীরভূমের নানা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সেইবজ্ররহস্যউদ্ধারের জন্য ছোটাছুটি বেশ করতে হয়েছিল। মূর্তি পাচারচক্রের সাথে সংঘাতও হয়েছিল। এরপরেই তিনবন্ধুর জীবন তিনদিকে ছড়িয়ে গিয়েছিল। মনোময় স্যারের গাইডেন্সে পরীক্ষা দিয়ে সজল একই দপ্তরে চাকরি পেয়েছে। সজলের খুড়তুতো বোন বর্ণার সাথে রত্নদীপের কিছু মন দেওয়া নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত নিত্যের সাথেই তার সম্পর্ক হয়েছিল। নিত্য বর্দ্ধমানের এক নামকরা পরিবারের সন্তান। পিতা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং ধনী ব্যবসায়ী। কিন্তু নিত্য নিজের উদ্যোগে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে পুলিশ সার্ভিসে যোগ দিয়েছে। বর্তমানে ডিএসপি পদমর্যাদায় কর্মরত। কেবল রত্নদীপের সাথেই যোগাযোগ ছিল না। থাকার কথাও ছিল না। কারণ শেষদিকে সম্পর্কটা স্বাভাবিক ছিল না।  এতো বছর বাদে আর এক পুঁথিকে কেন্দ্র করে আবার দেখা হয়ে গেল রত্নদীপের সাথে। না জানি আবার কী রহস্য অপেক্ষা করে রয়েছে সজলদের জন্য কে জানে!


  ওদিকে তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের মহকুমা আধিকারিক থেকে প্রমোশন পেয়ে মনোময় জেলার দায়িত্বে চলে যান বছর চারেক আগে। পোস্টিং ছিল দক্ষিণ দিনাজপুরে। প্রধান অফিস বালুরঘাটে। সেখানে থাকাকালীনই বাংলাদেশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সেমিনারে যোগ দিতে গিয়ে মনোময় স্যার জড়িয়ে পড়েছিলেন এক রহস্যের সাথে। তখনই সর্দারের সাথে পরিচয়। পরিচয় বলতে নামেই পরিচয়। কখনও মুখোমুখি হন নি কেউই। সজল ততদিনে চাকরি পেয়ে গিয়েছে। মনোময় স্যারকে রহস্য উদ্ধারে যথাসাধ্য সাহায্যও করেছিল। রহস্যের সমাধান হলেও বাংলাদেশের ইন্টেলিজেন্স সর্দারকে ধরতে পারে নি।



  সেই সর্দার বর্তমানে রয়েছেন কলকাতায়। একেবারে সজলদের নাকের ডগায় ! ভাবতেই সজলের ভেতরে অদ্ভুত এক উত্তেজনা হচ্ছে। সেই সর্দার আবার মনোময় স্যারকে আহ্বান করছেন এক রহস্য সমাধানে। সজল ভেবে পাচ্ছে না লোকটার এতো সাহস কিকরে হয়। নিজের উপর কনফিডেন্স এতোদূর হতে পারে ? যার জন্য নিজের জন্মভূমি থেকে পালিয়ে আসতে হল সেই প্রধান প্রতিপক্ষকে নিজে ডেকে কাজ করতে বলছেন সঙ্গে। এ কোন ট্র্যাপ নয় তো ? সর্দার আসলে এসবের মাধ্যমে মনোময় স্যারকে কোনো কিছুর মধ্যে ফাঁসিয়ে দিতে চাইছেন না তো ? এর সাথে আবার যোগ দিয়েছে রত্নদীপ।


  যদিও মনোময় স্যারের উপরে যথেষ্ট আস্থা রয়েছে সজলের, তবুও স্যারের জন্য কিছুটা টেনশন হচ্ছে এখন। বাসাবাড়ির প্রায় কাছাকাছি আসতে আসতে সজল ঠিক করল কাল সকালেই স্যারকে একবার সতর্ক করে দেবে। এমনিতেই স্যারের রহস্য সমাধানের কাজকর্মের জন্য সুনাম বৃদ্ধির সাথে সাথে ডিপার্টমেন্টে একদল শত্রুর জন্ম হয়েছে। একই দপ্তরে চাকরি করে বলে সজল ভালই টের পায়। ঈর্ষাকাতর কেউ কেউ দপ্তরের সেক্রেটারির কান ভারী করছে। মনোময় স্যার নাকি এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে নানান কাজকর্ম করছেন। সরকারী আধিকারিকদের নানান নিয়মের বেড়াজালে থেকে কাজ করতে হয়। বাংলাদেশে গিয়ে মাফিয়াদের সাথে লড়াইতে জড়িয়ে পরার কোনো অধিকারই নাকি ছিল না স্যারের। হালকা সতর্ক করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আবার একটা ভুল পদক্ষেপ হলে ডিপার্টমেন্ট একশন নিতে পারে। যদিও সজল জানে এসবকে তোয়াক্কা করেন না স্যার। আইনের মধ্যে থেকে ন্যায়ের জন্য, সত্যকে উদ্ঘাটনের জন্য মনোময় স্যার ঝুঁকি নিতে রাজি থাকেন। যতক্ষণ নিজে ঠিক মনে করছেন কোনো কাজ থেকে পিছিয়ে যাওয়ার মানুষ তিনি নন। ফলস্বরূপ বিপদের সম্মুখীন হতে হয় মাঝেমধ্যেই। বাংলাদেশে যেমন ফিজিক্যালি আক্রান্ত হয়েছিলেন। স্যারের জন্য সজলের চিন্তা হয়। স্যারকে সে সতর্ক করতে পারে, কিন্তু ঝুঁকি নেওয়া থেকে আটকাতে পারে না। স্যারকে থামাতে না পারলেও স্যারের মতন মানুষকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে সে সবকিছু করতে পারে।

  • রজত পাল
  • পঞ্চম পর্ব