মনস্তত্ত্বের এক অনবদ্য আতস কাঁচ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গোটা জীবনটাতে পরিচালিত করেছিলেন। যে কোনো সৃষ্টির মূলে যে দর্শন থাকে ,সেই দর্শন পরিচালিত হয় কিন্তু মনস্তত্ত্বের নানা চাপান- উতরের উপর নির্ভর করে। সেটা অন্তর থেকে উপলব্ধি করতেন বলেই রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর ,'বিদ্যাপতির রাধিকা 'নিবন্ধে লিখছেন;" অল্প বয়সের ধর্ম এই , সুখ এবং দুঃখ , ভালো এবং মন্দ অত্যন্ত স্বতন্ত্র করিয়া দেখে ।যেন জগতে একদিকে বিশুদ্ধ ভালো-- আর একদিকে বিশুদ্ধ মন্দ, একদিকে একান্ত সুখ আর - এক দিকে একান্ত দুঃখ প্রতিপক্ষতা অবলম্বন করিয়া পরস্পর বিমুখ হইয়া বসিয়া আছে ।সে বয়সে সকল বিষয়ের একটা পরিপূর্ণ আদর্শ হৃদয়ে বিরাজ করিতে থাকে ।গুণ দেখিলে সর্বগুণ কল্পনা করি , দোষ দেখিলে সর্বদোষ একত্র করিয়া পিশাচ মূর্তি ধারণ করে। সুখ দেখা দিলেই ত্রিভুবনে দুঃখের চিহ্ন বিলুপ্ত হইয়া যায়, এবং দুঃখ উপস্থিত হইলে কোথাও সুখের লেজ মাত্র দেখা যায় না( রবীন্দ্র রচনাবলী, ৯, বিশ্বভারতী সংস্করণ পৃষ্ঠা -৪৪২)।"
এই পঙতির ভেতর দিয়ে রবীন্দ্রনাথ মানব জীবনের মনস্তত্ত্বের যে শব ব্যবচ্ছেদ করেছেন, তেমনটা কিন্তু আজও ,এই একুশ শতকের প্রায় মধ্যভাগে এসে ,মানুষের জীবনের দৈনন্দিনীনতা থেকে আলাদা হয়ে যায়নি। আজও আমরা জীবনের শুরুতে সুখ আর দুঃখের যে পরিমাপ করি ,আর সেই পরিমাপের ভেতর দিয়ে নিজেদের জীবনটাকে পরিচালিত করবার চেষ্টা করি- এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ,কিভাবে জীবন প্রবাহকে অনেক সময় ব্যপ্ত না করে ,অব্যপ্তির অকুল সাগরে সবকিছু কে নিমজ্জিত করে, তার হিসাব নিকাশ করতে বসি ,তখন দেখি বড্ড বেশি দেরি হয়ে গেল।
আসলে জীবনের সঙ্গে, সময়ের সঙ্গে গতির সমন্বয় --এই জায়গাটাতে কোথায় একটা দূরত্ব ,যেটাকে রবীন্দ্রনাথ বারবার তাঁর সমস্ত কর্মকাণ্ডের মধ্যে দেখাতে চেষ্টা করেছিলেন ,সেই দূরত্বটাই যে আমাদের জীবনকে অনেক সময় জীবন বিমুখ করে তোলে, এটা আমরা বুঝে উঠতে পারি না ।এই যে রবীন্দ্রনাথ 'একান্ত সুখ 'আর 'একান্ত দুঃখে'র 'প্রতিপক্ষতা'র কথা বলছেন, তার মধ্যে থেকে কিন্তু বিশেষ ভাবে উঠে আসে 'একান্ত' শব্দটা ।
আমরা সাধারণ সুখ চাই না। সাধারণ সুখের কথা আমরা বলি না ।সাধারণ সুখের বিষয়টাকে আমরা এড়িয়ে চলতেই ভালোবাসি ।আমরা চাই 'একান্ত সুখ' । সেই 'একান্ত সুখে' র সাগরে নিমজ্জিত হয়ে আমরা ভাবতে চেষ্টা করি, সময়কে ।আর সেই সময়ের উদ্দেশ্যেই রবীন্দ্রনাথের উচ্চারণ,' এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না।'
আমরা কি প্রেমকে উপলব্ধি করতে চাই? কেবলমাত্র সুখের নিগরে ডুবছে কি প্রেম? দুঃখে নিমজ্জিত হয়ে থাকার মধ্যে দিয়ে কি কোন প্রেমানুভূতি আমাদের জাগে না ? তাই রবীন্দ্রনাথ দুঃখের ক্ষেত্রেও এই 'একান্ত 'শব্দটাকে পরস্পরের প্রতিপক্ষতার বিষয় টিকে আরো তীব্র করে তুলতে ব্যবহার করেছেন ।
অল্প বয়সে আদর্শবোধের যে আমেজ, সেই আমেজ অনেকেই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, জীবনের নানা অভিজ্ঞতা নিরিখে, সঠিকভাবে আর ধরে রাখতে পারেন না ।সেই আমেজের রূপান্তর যেন রবীন্দ্রনাথের এই কথার মতই একটা প্রতিপক্ষতার রূপ ধারণ করে। আমরা সুখ আর দুঃখ কে পরস্পর পরস্পরের যুযুধান আঙ্গিকেই দেখতে অভ্যস্থ।
রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই বুঝি একথা লেখা সম্ভব, ' অসত্য কাকে বলে।নিজেকে একান্ত বিচ্ছিন্ন করিয়া জানাই অসত্য।সর্বভূতের সঙ্গে আত্মার মিল জানিয়া পরমাত্মার সঙ্গে আধ্যাত্মিক যোগটিকে জানাই সত্য জানা( কর্তার ইচ্ছায় কর্ম, রবীন্দ্র রচনাবলী, বিশ্বভারতী, পৃষ্ঠা- ৫৫১) ।'
সত্য আর অসত্য এই দুইয়ের আত্ম অনুসন্ধান রবীন্দ্র জীবনের একটি বড় পর্ব। অসত্যকে জানতে পারার জন্যেই সত্যে যে আমরা স্থিত হতে পারি, এটা রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের নানা পর্বের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন। কবির এই উপলব্ধি তাঁর সৃষ্টির মধ্যে সত্যের সন্ধানে যে যাত্রা, তাকে নিষকন্টক করেছিল। সেই যাত্রাকে চিরস্থায়ী করেছিল।
কেবলমাত্র বাঙালি নয় , গোটা মানবজাতি যতদিন পৃথিবীর বুকে জাগরুক থাকবে, ততদিন মহাপুরুষদের যে সত্যানুসন্ধানের দিশা, সেই দিশা মানব সমাজকে, মানব সভ্যতাকে আলোকবর্তিকা দান করবে। আধ্যাত্বিক জগতের মানুষ তাঁর মত করে আলোকবর্তিকা দিয়ে যায় ।সমাজ সভ্যতার দিশারীরা তাঁদের মত করে আলো দিয়ে যায় ।কিন্তু এই যে 'কর্তার ইচ্ছায় কর্ম' রবীন্দ্রনাথের নিবন্ধটি থেকে এখানে উদ্ধৃত করা হলো ,তার সামান্য একটা দুটো শব্দ পড়লেই আমাদের মনে হবে, সমাজ জীবন এবং সমাজ যাপন তার সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার কি অভিনব সম্মিলন রবীন্দ্রনাথ ঘটাতে পেরেছিলেন।সেই সন্মিলনের জেরেই বারবার বলেছিলেন, অশান্তির আঘাতেই বিনা বাজে।
মনের ডাহুক ডাকে কোথায় রবীন্দ্রনাথ নেই? আমাদের ব্যক্তিজীবনের চাওয়া -পাওয়া ,যন্ত্রণা- আনন্দ ,দুঃখ- বিষাদ-- সবকিছুর মধ্যেই কেমন যেন একটা আত্মার আত্মীয় হিসেবে রবীন্দ্রনাথ সম্পৃক্ত হয়ে আছেন। তাই যখন দেখি কৃষ্ণচরিত্র তে রবীন্দ্রনাথ বলছেন; " সকলে জানেন আত্মীয় সম্বন্ধেও আত্মীয়র ভ্রম হয় এবং বন্ধুকেও বন্ধু অনেক বিষয়ে বিপরীতভাবে বুঝিয়া থাকেন।' গোটা মানব সমাজের সমস্ত কিছুই যেন এই কথাগুলির ভেতর দিয়ে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে না ? আত্মীয়- সম্বন্ধে আমার অভিজ্ঞান, সেই অভিজ্ঞানের ভেতরেও কত সময় বুঝে নেওয়ার ক্ষেত্রে একটা ভ্রান্তি থেকে যায়। একটা দূরত্ব থেকে যায়। আর সেই ভ্রান্তি এবং দূরত্ব আমাদের জীবনে অনেক রকমের দুঃখ- বেদনা -হাসি- কান্নার অভিজ্ঞতাকে একটা হৃদয়বিদারক যন্ত্রণায় পর্যবসিত করে ।
আবার সেই অভিজ্ঞতা কখনো আমাদের বিশেষভাবে আনন্দের, তৃপ্তির এক অগম্য সাগরে ভাসিয়ে দেয় ।ঠিক একই কথা প্রযোজ্য আমাদের বন্ধুদের সম্পর্কেও। বন্ধুকে বিপরীতভাবে বোঝা --এটা আমাদের মানব সমাজের একটা স্বাভাবিক উপায় বলেই সব সময় মনে হয়। সেই মনে হওয়াটা কেই যেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে সংজ্ঞায়িত করছেন। তাই তিনি বলছেন; ' অসাধারণ লোককে প্রকৃতভাবে জানা আরও কঠিন; দূর হইতে এবং অতীত বৃত্তান্ত হইতে তাহার যথার্থ প্রতিকৃতি নির্মাণ বহুপরিমানে কাল্পনিক, তাহার সন্দেহ নাই'( কৃষ্ণচরিত্র, রবীন্দ্র রচনাবলী, বিশ্বভারতী, নবম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৫৩) ।
রবীন্দ্রনাথ বলছেন ;' কত বড় বড় কাজের কথা কালের স্রোতে বুদবুদের মত ফেনাইয়া উঠিল এবং ভাসিতে ভাসিতে ফাটিয়া বিলীন হইয়া গেল, আর যত অসম্ভব সম্ব হইল, অভাবনীয় সত্য হইল, বুদ্ধিমানের মন্ত্রণা নহে কিন্তু পাগলের পাগলামিই যুগে যুগে মানুষের অন্তরে বাহিরে , তাহার চিন্তায় কর্মে ,তাহার দর্শনে সাহিত্যে কত নব নব সৃষ্টি বিকাশ করিয়া চলিল তাহার অন্ত নাই( ধর্মের অধিকার, রবীন্দ্র রচনাবলী।বিশ্বভারতী, ১৮ খন্ড।পৃষ্ঠা ৩৯৩)' ।
এই যে কাজের স্রোত কে ,'বুদবুদের মত ফেনাইয়া উঠিল' বলে রবীন্দ্রনাথ বর্ণনা করছেন , তার ভেতরে কিন্তু উঠে আসছে সমাজবিক্ষণের এক বিশেষ অস্তিত্বময় প্রসঙ্গ। কাজের স্রোত তা কিন্তু সময়ের উপর নির্ভরশীল ।আজ যে কাজের স্রোতকে কোনো ব্যক্তি বা সমষ্টি সবথেকে বেশি উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় বলে মনে করে ,সব থেকে বেশি প্রাসঙ্গিক একটি বিষয় বলে মনে করে, সময়ের নিরিখে, সেই স্রোতের প্রাসঙ্গিকতা আগামী দিনে নাও থাকতে পারে। হয়তো সত্যিই আজকের কাজের স্রোতের প্রাসঙ্গিকতা আগামী দিনে এককালে ফেনিয়ে উঠে আবার সেই কালের স্রোতেই সেটা বিলীন হয়ে যেতে পারে ।
এই যে 'সময়ে'র নিজেকে, কাজের ঘন একটা আবর্তনের স্থিত করা, সেই স্থতধি দশার আবার অস্থিত অবস্থা প্রাপ্তি-- রবীন্দ্রবীক্ষণে তা কিন্তু চিরজাগরুক।এখানেই সময়ের থেকে এগিয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ।তিনি এমন ই এক দার্শনিক, যিনি কখনো জঙ্গমতাকে বিশ্বাস করেন না।স্বীকার তো করেন ই না।
আবার সেই সময়কে নির্ভর করেই ওই তৈরি হওয়া আবর্তনের কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া-- এই অস্তিত্ব এবং অস্তিত্বহীনতার এক পারস্পরিক নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্বকে রবীন্দ্রনাথ, তাঁর' ধর্মের অধিকার ' প্রবন্ধে যেভাবে ব্যবহার করেছিলেন, সেটি কিন্তু দেশ -কাল নির্বিশেষে আজও মানব জীবনের ক্ষেত্রে একেবারে ধ্রুব সত্য হয়ে প্রজ্জ্বল্যমান রয়েছে।
বড়ো বড়ো কাজের কথাকে কালের স্রোতে বুদবুদের মত ফেনিয়ে উঠে আবার ভাসতে ভাসতে ফেটে বিলীন হয়ে যাওয়ার এই যে উপমা রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করছেন ,তার ভেতরেই কিন্তু সমাজ সভ্যতার কঠিন সত্য টা লুকিয়ে আছে ।আমরা আজ যে কাজকে বড় কাজ হিসেবে সাব্যস্ত করে, তা নিয়ে নানা ধরনের তর্ক-বিতর্ক তরজাতে নিজেদেরকে ব্যাকৃত রাখছি ,সেই ব্যাপৃতকরণ যে কালকেই তার প্রাসঙ্গিকতা কে একটা অন্য ধারায় পরিচালিত করবে না-- এ কথা কেউ কিন্তু ধ্রুব উপস্থাপন হিসেবে বলে দিতে পারে না। আজকে বুদবুদের মতো উঠেছে ।জলরাশির উপরে যাকে ভাসতে দেখছি আমরা। সেই ভাসমান বুদবুদ আবার এই জলরাশির উপরেই ভাসতে ভাসতে ফেটে যাবে এবং সেই জলের সঙ্গেই বিলীন হয়ে যাবে।
এই যে রূপক অর্থে ব্যবহৃত শব্দপঞ্জি রবীন্দ্রনাথকৃত, তার মধ্যে থেকেই কিন্তু এই চরম সত্যিটা উঠে আসে যে ,কালের মহাসিন্ধুর কাছে কেবলমাত্র অক্ষয় অমর হলো, সত্যের থেকে অসত্যের পথে যে কাল স্রোত পরিচালিত হচ্ছে তার বিরুদ্ধতা করা। তার বিরোধিতা করা। আর তার মোকাবিলা করা।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি গানে বলেছেন ,'যে তোরে পাগল বলে তাহলে তারে তুই বলিস নে কিছু'। নিজের যাবতীয় সৃষ্টিকর্মের মধ্যে, নিজের সৃষ্ট গানের প্রতি রবীন্দ্রনাথের দুর্বলতা ছিল সম্ভবত সব থেকে বেশি। তাঁর গানের ভাষা ,বলবার ভঙ্গিমা এবং সুর -- এগুলিকে সযত্নে রক্ষিত করবার জন্য তিনি বারবার তাঁর অনুরাগীদের কাছে অনুরোধ করে গেছেন। বারবার বলেছেন ,তাঁর গান কে যেন তাঁরই গান বলে চেনা যায়।
তাই রবীন্দ্রনাথ যখন বলছেন; বুদ্ধিমানের মন্ত্রনাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার থেকে পাগলের পাগলামি যুগে যুগে মানুষের অন্তরে বাহিরে ,চিন্তায় কর্মে, দর্শনে ,সাহিত্যে কত নব নব সৃষ্টি বিকাশ করে চলবে, সেই বিকাশের কোনো মাপ পরিমাপ করতে রবীন্দ্রনাথ রাজি ছিলেন না ।সেই বিকাশকে তিনি অন্তহীন বলে অভিহিত করেছেন ।অর্থাৎ; বুদ্ধিমান নয় ।যে বুদ্ধিমান তার মধ্যে অনেক চালাকি থাকবে। অনেক রাজনীতি থাকবে ।অনেক সততা এবং তীব্রতা থাকবে।শঠতাও ।আবার ক্ষিপ্রতা থাকবে।
এই সমস্ত কিছুর থেকে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিস্তার পেতে চেয়েছেন। তাঁর কামনা, তাঁর প্রার্থনা ছিল ,পাগলের পাগলামির প্রতি ।তাই আজকে যে অঙ্গে কালি দিতে আসবে, কালকেই সে ধন্য বলে সেই কালি দেওয়া অঙ্গে ফুল চন্দন দেবে--এটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের ভাবনার জগত ।রবীন্দ্রনাথের দূরদর্শী কার্যবোধ। কল্পনার জগত নয়।
' ধর্মের অধিকার ' নামক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন ; ' যাঁহারা মানুষকে অসাধ্য সাধনের উপদেশ দিয়াছেন , যাহাদের কথা শুনলেই হঠাৎ মনে হয় ইহা কোনোমতেই বিশ্বাস করিবার মতো নহে, মানুষ তাঁহাদিগকে শ্রদ্ধা করে অর্থাৎ বিশ্বাস করে ।তার কারণ মহত্বই মানুষের আত্মার ধর্ম ; সে মুখে যাহাই বলুক শেষকালে দেখা যায় সে বড়োকেই যথার্থ বিশ্বাস করে। সহজের উপরেই তাহার বস্তুত শ্রদ্ধা নাই ,অসাধ্যসাধনকেই সে সত্য সাধনা বলিয়া জানে ।সেই পথের পথিক কেই সে সর্বোচ্চ সম্মান না দিয়া কোনোমতেই থাকিতে পারে না।'
সাধারণ মানুষ কাকে বিশ্বাস করে এই প্রশ্নের এক অনন্য সাধারণ উত্তর রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই ,' ধর্মের অধিকার ' প্রবন্ধে উপস্থাপিত করছেন ।এই উপস্থাপনের মধ্যে কোন নাটকীয়তা নেই ।মেকি প্রণালী নেই।আছে এক আত্ম উপলব্ধির বর্ণিল প্রকাশ ।কেমন সেই প্রকাশ?
রবীন্দ্রনাথ বলছেন;' যাঁহারা মানুষকে অসাধ্য সাধনের উপদেশ দিয়াছেন' । অর্থাৎ ; মানুষকে ,তার জীবনের কর্মপন্থার উপরে স্থাপনের জন্য যে প্রাকৃত অতীত, আর প্রকৃত অপ্রাকৃত কার্যাবলীর সমন্বয় সম্পৃক্ত ভাবনা উপস্থাপিত করা হয় হঠাৎ করে ,সেইসব মানুষদের কথা শুনলে যখন আমাদের অবিশ্বাস্য মনে হয়, সেই রকম মানুষদের প্রতি মানুষের বিশ্বাস জন্মানোর, শ্রদ্ধা করবার যে একটা প্রচলিত ধারা সেই ধারার কথা রবীন্দ্রনাথ এখানে তাঁর নিজের রচনার ভেতর দিয়ে উপস্থাপিত করছেন।
সেই উপস্থাপনার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ বারবার যেটা বলছেন , মহত্বই হলো মানুষের আত্মার ধর্ম ।এই যে মানুষের আত্মার ধর্ম, তার নির্ণায়ক একটা দিকরেখা রবীন্দ্রনাথ নির্দিষ্ট করছেন ,সেই নির্দেশনার ভেতর দিয়ে আমরা যেন কালের এক অমঘ গতিকে বুঝে নেবার চেষ্টা করি ।ভেবে নেবার চেষ্টা করি। অন্তস্থ করবার চেষ্টা করি ।
সেই ভেবে নেওয়ার মধ্যে দিয়েই যেন আমরা আমাদের যথার্থ বিশ্বাস কে পরিচালিত করি। সেই পরিচালন পদ্ধতির মধ্যে খাদ থাকতে পারে।ভুল থাকতে পারে। কিন্তু আন্তরিকতার যেকোনো অভাব নেই, সেটা যেন রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে আমাদের মধ্যে বারবার জাগরুক হতে থাকে। অসাধ্য সাধনকে সত্য সাধনা বলে জানা-- এই যে রবীন্দ্র উপলব্ধি, সেই উপলব্ধির মধ্যে দিয়েও আমরা যেন আগামী সংকেতকে একটা অন্যভাবে বোঝবার চেষ্টা করি। চেষ্টা করি আমাদের হৃদয় আত্মা আর মানবতার ভিতরে অনবদ্য সম্মিলন ঘটাতে ।সেই সম্মিলনের মেলানোর যে ঝড়ো হাওয়া আর পোড়ো বাড়ির ভাঙা দরজা, তার ভেতর দিয়েই খুঁজে পাবার চেষ্টা করি ,কাল থেকে কালান্তরের পথে আমাদের যাত্রা কে ।
তাই রবীন্দ্রনাথ লিখছেন;' যারা মানুষকে দুর্গম পথে ডাকেন ,মানুষ তাঁহাদিকে শ্রদ্ধা করে, কেননা মানুষকে তাঁহারা শ্রদ্ধা করেন। তাঁহারা মানুষকে দীনাত্মা বলিয়া অবজ্ঞা করেন না ।বাহিরে তাহারা মানুষের যত দুর্বলতা যত মুঢ়তাই দেখুন না কেন তবুও তাঁহারা নিশ্চয় জানেন যথার্থত মানুষ হীনশক্তি নহে-- তাহারা শক্তিহীনতা নিতান্তই একটা বাহিরের জিনিস ;সেটাকে মায়া বলিলেই হয় ।এইজন্য তাঁহারা যখন শ্রদ্ধা করিয়া মানুষকে বড় পথে ডাকেন তখন মানুষ আপনার মায়া কে ত্যাগ করিয়া সত্যকে চিনতে পারে, মানুষ নিজের মাহাত্ম্য দেখিতে পায় এবং নিজের সেই সত্যস্বরূপে বিশ্বাস করিবামাত্র সে অসাধ্য সাধন করিতে পারে। তখন সে বিস্মিত হইয়া দেখে ভয় তাহাকে দেখাইতেছে না, দুঃখ তাহাকে দুঃখ দিতেছে না ,বাধা তাহাকে পরাহভূত করিতেছে না, এমনকি নিষ্ফলতা তাহাকে নিরন্তর নিরস্ত করিতেছে না। তখন সে হঠাৎ দেখিতে পায় ত্যাগ তাহার পক্ষে সহজ ,ক্লেশ তাহার পক্ষে আনন্দময়, এবং মৃত্যু তাহার পক্ষে অমৃতের সোপান( ঐ- পৃষ্ঠা- ৩৯৬) ।'