দাদাটি কথা শুরু করল। বলবে কি বলবে না ভাবটা তখনও মুখ থেকে যায়নি।
-আর কি বলেন তো আমরা সেই সব ভাষা ভালো মতো বুঝিও না। কি সব বলছে সব বুঝিনি। কানে শুনলাম সুইসাইড! ওই বিশ্বাস না গিয়ে উপায় আছে বলেন? আমরা তো আর সেখানে নেই। সুইসাইডই করল নাকি মার্ডার কে জানে! আর এইখানের যে নিয়েগেছিল যে ঠিকাদার সে তো আর ওই সাইটে নেই। ওইখানে অন্য ঠিকাদারের আন্ডারে ওরা কাজ করে। এইখান থেকে পাঠাবে একজন। হাতে থাকবে অন্য লোকের। সেই ঠিকাদারে ঠিকাদারে কথা হবে। মাঝে আবার আরও এজেন্ট ও থাকে। এইসব চেন সিস্টেম। কাজেই সরাসরি কার সঙ্গে কথা বলব? যে যা বলছে তাই শুনছি। আর বাড়িতে গার্জিয়ান বলতে আমরাই। বাবা মরে গেছে অনেক আগে। এক আছে বিধবা মা। বাড়িতে এতোগুলো মেম্বার। এইখানে লেবারি করলে কি সংসার টানা যায়? তাই গেছিল। বিয়ে থা করেনি। খুব অল্প বয়স থেকেই লেবারি করতে যায় ও। এখন কিভাবে মরল সেই সব খোঁজ খবর নিতে কি আর অতোদূর যাওয়া যায়! যাওয়ার খরচ অনেক। কেস চালাবো বললেই তো আর কেস চালানো যায় না! সেইখানে থেকে সেইসব কেস চালাতে হবে। সেই বিদেশে গিয়ে থাকার খরচ কম! সে কি সম্ভব বলেন! মালদার ঠিকাদার যা বলেছিল ওদের থেকে শুনে শুনে। আর যা ওই দু একবার ওইখানের ঠিকাদারের সাথে কথা হল ভিডিও কল, সে তো বলল এরা।
পাশ থেকে সেই আগের পুরুষকন্ঠগুলোতে সম্মতিসূচক ভাবে হ্যাঁ হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি।
আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এই ছেলেগুলো মৃত লেবারটির সঙ্গী সাথী। একই সাথে দাদন খাটতে গিয়েছিল। ফিরে এসেছিল এরাই। দাদাটি বলে চলল, লাশই আনতে যেতে পারলাম না। ওখান থেকে বলল,লাশ ভালো করে পাঠিয়ে দেবে। টাকাগুলোও তো লাশ পাঠানোর নামে কেটে নিল। পাওনা গন্ডা আর কিচ্ছু পাইনি। সাত হাজার টাকা পাড়ার ছেলেগুলোর হাতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। এই এদের হাতে দিয়েই পাঠিয়েছিল। সে মরার আগে নিজেই পাঠিয়েছিল। বাকি আরও অনেক টাকা পাওনা ছিল। অনেক টাকা। আমরা তো আর সব জানিনা। লোকের মুখে শুনেছি অনেক টাকা। সেই টাকা বলে লাশ আনতে ওদের খরচ হয়ে গেছে। যা পাওনা ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা বলে ওদের বডি আনতে খরচ হয়ে হয়েছে। আশি হাজার টাকা বলে খরচ হয়েছে বডি আনতে। বলেছিল তো এম্বুলেন্সে পাঠাবে। কাঠের বাক্সে করে পাঠাবে। কোথায়? পেলাস্টিকে বেঁধে পাঠিয়ে দিল। কিভাবে কিভাবে যে পাঠিয়েছে কে জানে! হাওড়া থেকে আমাদের কাছে ফোন এলো। লাশ আসছে মালদার দিকে। এই খানে তো বডি নিয়ে এলো ছোট একখানা ম্যাটাডোর মতো। কি জানি কিভাবে এসেছিল হাওড়া অবধি! প্রৌড় দাদাটির চোখদুটোতে সন্দেহটা আবার জমাট বেঁধে গেল। চোখগুলো কুঁচকে নিয়ে বলল, সে যে কিভাবে পাঠিয়েছে পচে গলে সে বডির আর কিছু ছিল না!
পাশ থেকে ওই দলের মধ্যে একটি ছেলে বলে উঠল একটুও বরফ দেয়নি জানেন! সে পচে ফুলে উঠেছিল একদম।
বাড়িতে ঢুকিয়েছিল বডি?
হ্যাঁ হ্যাঁ। ওই তো ওইখানে। বৌদীটি উঠে দাঁড়ালো। গায়ের গামছাটা আবার একটু ঠিকঠাক করে নিয়ে বলল, চলেন দেখাচ্ছি… চলেন দেখাচ্ছি…।
মাটির বারান্দাটার সামনে দিয়ে উঠোন পেরিয়ে বাড়ির আরেকটা অংশ। বৌদীটি সামনে। আমার পেছন পেছন ছেলেদের দলটি চলেছে। এর মধ্যে সংখ্যায় ওরা আরও দু তিন জন বেড়ে গেছে। কেউ হাফপ্যান্ট কেউ লুঙি জিন্সের প্যান্ট স্যান্ডো গেঞ্জি খালি গা গামছা পরা। কুড়ি বাইশ সাতশ আঠাশ এরকম বয়সের। উঠোন পেরিয়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল আরেকটা উঠোনে। আমি ও দাঁড়িয়ে পড়লাম। বাকি ছেলেরা আমার মুখের সামনের দিকে। ওদের পেছনে খড়ের গাদা। আর বাকিটা আটকে আছে পাট কাঠির তৈরি প্রাচীরে। চারপাশে ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে পড়েছে। মাঝে কিছুটা ফাঁকা। বলতে শুরু করেছে ওরা সবাই মিলে।
এইখানে ওকে এনে শুইয়ে রেখেছিল। হাত পা টা শুধু আস্ত ছিল। আর কিছু বোঝা যাচ্ছিল না এমন পচা পচেছিল।
একটা হাফ প্যান্ট পরা ছেলে নিজের আঢাকা হাঁটুটা আমার দিকে তুলে নিয়ে হাঁটুতে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, না না এই পাগুলো কেবল ছিল। হাতগুলোও পচে উঠেছিল। অন্য আরেকটি ছেলে বলে উঠল, হাতগুলো ছিল তাও, পাএর আঙুলগুলোতো কেমন খসে গিয়েছিল। একজন বেশ জোরে বলে উঠল, এই দেখেন এই দেখেন, বলে নিজের বাদামী রঙচটা স্যান্ডো গেঞ্জির উপর দিয়ে নিজের শরীরে হাত বুলিয়ে বলে উঠল, এই এইসব জায়গা পুরো পচে উঠেছিল। নিজের হাড় বার করা বুক থেকে পেট অবধি গোল করে হাতটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়ে বলে যেতে লাগল এইসব জায়গার মাংস চামরা সব গলে পচে গেছিল। আর দু একটা গলা বলে উঠল ঠোঁট চোখ নাক কান সব পচে মাংস খুবলে খুবলে পড়ছিল।
কথকোপথনটা আমার থেকে সরে গিয়ে নিজেদের মধ্যে চলতে লাগল। হাত পা মাথা পায়ের আঙুল কান নাক মাথা কোন অঙ্গ আস্ত কোনটা পচে গলে গিয়েছিল এ নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দলটার মধ্যে ছোটখাটো তর্ক চলছে। আমি হাঁ করে দাঁড়িয়ে শুনছি এক তরুণ যুবকের শরীর পচার বিবরণ। একটু আগের প্রসঙ্গটা বদলে গেছে। ঠিকাদার এজেন্ট লেবার সুইসাইড মার্ডার থেকে পচা গলা গন্ধওয়ালা শরীরের অংশ।
বৌদিটি ওদের মাঝে বলে উঠল যেই কালো প্লাস্টিকটা খুলেছে ভগভগ করে কি পচা গন্ধ… গন্ধ। উঁ…। সে গন্ধে বমি করতে করতে শেষ আমি। খালি গা পাকায়। শুধু এই উঠোনে নাকি! সারা বাড়ি গন্ধ হয়ে গেছিল। সারা পাড়ায় পর্যন্ত গন্ধ ছড়িয়ে গিয়েছিল। সে কিছুতেই যায়না গন্ধ। এই রাস্তা দিয়ে কেউ যেতে পারে না গন্ধে। বডি পোড়াতে নিয়ে গেছে সেইখান অবধি এমন গন্ধের গন্ধ মানুষে ভাত খাবে কি গা পাকিয়ে ওঠে। সাতদিন সেই গন্ধ যায় না। ফিনাইল দিলাম কত ঝ্যাটা দিলাম সে গন্ধ কিছুতে যায় না। পুরো শরীর পচে খাব্লা খাব্লা হয়ে খুলে গেছিল। ঠোঁট মুখ ফুলে মাংস খুলে খুলে পড়ছিল। চেনাই যায়না। আমার দেওরের লাশ না অন্য কারুর লাশ! কিজানি! চিনতেই পারিনি আমরা। সেকি দুর্গন্ধ… দুর্গন্ধ…। কথাটা ভালো ভাবে শেষ করার আগেই নাক ঠোঁটে চাপা দেওয়া গামছাটা সরিয়ে খ্যাক শব্দ করে এক গাদা থুথু বার করে ফেলে দিল উঠোনের ভেতর ডাই করে রাখা খড়গুলোর দিকে। সে কি দূর্গন্ধ কি দূর্গন্ধ…। বৌদীটি গন্ধের কথা বলতে বলতে কখন গলার গামছাটা নাকে চাপা দিয়ে দিয়েছে খেয়াল করিনি। উঠোনের চারপাশে মানুষগুলো গোল হয়ে আরও একটু এগিয়ে এসেছে আমার দিকে। মাঝে গোল মতো ফাঁকা জায়গাটা আরও একটু ছোট হয়ে গেছে। পচা গন্ধের বিবরণ হয়ে চলেছে অনেকগুলো গলার স্বরে। নানা মুখ থেকে থুথু উঠোনের এপাশে ওপাশে পড়ছে। ফাঁকা গোল জায়গাটার দিকে বারবার চোখ চলে যাচ্ছে আমার। একদিন এই গোল মতো ফাঁকটুকুতেই হয়ত এবাড়িরই একটা মানুষ শুয়ে ছিল। পচা গলা একটা মানুষ। বীভৎস গন্ধ শরীর জুড়ে। দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষ শরীরগুলো এভাবেই হয়ত দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখছিল এই ফাঁকের গোল জায়গাটুকুর দিকে। শুয়ে থাকা মরা পচা শরীরটির সাথে দাঁড়িয়ে থাকা শরীরগুলোর কোনও এক সময়ে মিল ছিল। শরীরগুলোর হাত পা ঘাড় পিঠ কোমর মাথা ব্যবহার হয়েছিল ইট টানতে সিমেন্ট তুলতে জল ঢালতে মশলা মাখতে কাঠ পাইপ লোহা লক্কড় বইতে। বাকি শরীরগুলো জ্যান্ত আছে। একখানা তাদেরই মরে পচে গিয়েছিল। সুশান্ত সমীর বাপি কৃষ্ণ সুজয়। সুজয় মরেছে। বাকিরা দাঁড়িয়ে আছে। ওভাবেই দাঁড়িয়ে দেখছিল লাশ। বা নাকে চাপা দিচ্ছিল। খ্যাক খ্যাক শব্দ করে থুথু ফেলছিল। বা পচা গলা লাশ বইছিল। আজ দাঁড়িয়ে আছে।
টিনের যুজ্ঞিতে আবার ছাপার চাদরে পাতা হবে। দেওয়ালের পেরেকে ঝুলবে ম্যাসোনায়েড বোর্ডে সাঁটা ছোট আয়না চিরুনী। প্লাগ পয়েন্ট থেকে ঝুলবে ফোনের চার্যার আর দড়িতে ঝুলবে প্যান্ট সার্ট স্যান্ডো গামছা গেঞ্জি…
গোল করা ভিড় খড়ের গাদা চার পাশ আটকানো উঠোন পাট কাঠির প্রাচীর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম বাইরে। আবার সেই মিষ্টি মিষ্টি হাওয়াটা ঘাড়ে মাথায় এসে লাগছে পূনর্ণভার দিক থেকে। পিচের রাস্তা। অটোস্ট্যান্ড। পাশ কাটিয়ে পূনর্ণভার পার থেকে পিছোতে লাগলাম। কিছুদূর পিছন দিকে এসে বাঁ এ ঢুকে পড়েছে একখানা রাস্তা। সে রাস্তা ধরে আবার হাঁটতে হাঁটতে এগোতে লাগলাম। এদিকটায় বড় বড় গাছ। মাঝেমাঝেই পুকুর। যেন গুছিয়ে সাজিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এগোচ্ছি এগোচ্ছি। রাস্তা ভোলার ভয়ে ডানে বাঁয়ে কোথাও না ঢুকে রাস্তাটা যেভাবে চলেছে সেভাবেই চলেছি। কোনও এক পাড়ায় রাস্তার ধারে বেশ অনেকখানি জটলা। ভিড়ের ভেতর উঁকি দিলাম। জটলাটা একটা ম্যাটাডোর ঘিরে। কেউ চোখে কাপড় দিয়ে চোখ মুছছে। কেউ ব্যাগ বোচকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। গাড়ির কাচের উপর সাঁটা কাগজের উপর বড় বড় করে লেখাটা দেখে চমকে উঠলাম। কেরালা। এ কি! গাড়িটা যাচ্ছে কোথায়! এই ডেস্টিনেশন আবার সম্ভব নাকি এই ছোট্ট গাড়ির পক্ষে! কৌতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কোথায় যাচ্ছে? উত্তরটা এলো ভিড়ের ভেতর থেকেই। কেরালা পার্টি কেরালা পার্টি…। পরিযায়ী শ্রমিক। চলে যাচ্ছে এখন।
এ ঘটনাটা যখনকার তখন কত নম্বর লকডাউন শেষ যেন হয়েছে। আবার যেন কত নম্বর লকডাউন শুরু হবে। ট্রেন চলা আস্তে আস্তে সুরু হচ্ছে। আমাদের রাজ্যে সরকারি জানানো হচ্ছে বাইরের রাজ্যে যত লেবার ছিল তারা ফিরে এসেছে।
গাড়িটা প্যাকড আপ ভিড় হয়ে গেল। ভিড়ের ভেতর যারা একটু নতুন সার্ট প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পারলাম গাড়িটার যাত্রী তারাই। পনের আঠার কুড়ি বাইশের ছেলে।
দশ পনের মিনিট। ভিড় আরও বেড়ে গেল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি। সবার মনোযোগ আরও বেশি করে এখন গাড়িটার ভেতরের দিকে। যাত্রী দর্শক সবার। সবাই আরও কিছুটা এগিয়ে গেছে গাড়িটার কাছাকাছি। পিঠের বড় বড় ব্যাগগুলো ঠেলে গুঁতিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে মানুষগুলোর ফাঁক ফোঁকর দিয়ে।
ওই ম্যাটাডোর গাড়ি কতদূর যাবে? মালদা স্টেশন? হাওড়া? নাকি সত্যি সত্যিই কেরালা? এ প্রশ্নের উত্তর দর্শকদের থেকে আর পেলামনা। ওই ছোট গাড়ির দিকে চোখগুলো তখন নিবিড় আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। কেউ ছলছলে চোখে। কেউ হাসি হাসি চোখে। অনেক কথা বলতে ব্যস্ত তখন। ভালো করে খেয়ে নিস। পৌঁছে খবর দিবি। ফোন করিস। কেউ চোখ সরিয়ে নিয়ে এই পথচারীটির দিকে আগ্রহ দেখানোর অবস্থায় তখন আর নেই।
ভিড়টা ছেড়ে আবার এগিয়ে চলেছি। দু একজন মানুষ মাঝে মধ্যে দেখা যাচ্ছে। বাকিটা আবার সব ফাঁকা। লকডাউন শব্দটা বেশ আর পাঁচটা শব্দের মতো ঢুকে গেছে মুখে মুখে। লক ডাউন ১…২…৩…৪…৬ কত হয়ে গেছে। খোঁজ নিচ্ছি মানুষ দেখতে পেলে, এ পাড়া থেকে রাজ্যের বাইরে কেউ কাজে গেছে কিনা! গিয়ে লকডাউনে আর ফেরেনি বা এরকমই আর কোনও ঘটনা হয়ে গেছে নাকি কারুর সাথে। পরিযায়ী বলতে এখন আর মানুষ পাখি বোঝেনা। পরিযায়ী বলতে মানুষ বোঝে। মানুষ অথচ আর পাঁচটা মানুষের থেকে আলাদা একটা শ্রেনী এখন পরিযায়ী। তাই আমার বোঝাতে বা আশপাশের পাড়ার মানুষদের বুঝতে খুব একটা সমস্যা হচ্ছিল না আমি কাদের খোঁজ করছি। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ঘরগুলির ধরণ বদলাচ্ছে। একটা জায়গায় সবকটা বাড়ির ধরণই আলাদা। মাটির বাড়ির দেওয়ালে রঙ বোলানো। কোথাও আঁকা পাখি কোথাও দেব দেবতার ছবি। কোনও পথচারী দেখিয়ে দিয়েছিল এই পাড়াটা। বলেছিল, উই পাড়া থেকে একজন মেয়ে মানুষ কাজে গিয়ে মরেছে। মাটির বাড়িগুলোর ফাঁক দিয়ে এ গলি ও গলি হয়ে ধাক্কা খেয়ে যে জায়গাটায় এসে পৌঁছালাম সেখানেই তখন পর্বতরা জটলা করে বসে কোন একখানা বিষয় নিয়ে মশকরা করছিল। হঠাৎ এই বহিরাগত পাড়ার ভেতর ঢুকে পড়ায় অনেকগুলো বিস্মিত চোখ পা থেকে মাথা অবধি দেখে যেতে লাগল। যার কথা জানব বলে পাড়াটায় ঢুকেছিলাম তার মৃত্যুর ঘটনাটা আসলে ঠিক কেমন সেকথা তার ছেলের বৌ গোছের কেউ একটা ঠিক সবটা বুঝে বোঝাতে পারছিল না। আমি প্রশ্ন করছিলাম বাংলায়। ও যা দু একটা উত্তর দিচ্ছিল ওদের মাতৃভাষায়। সব প্রশ্নেই উলটো দিক থেকে কি…? কি…? বলেই একগাল হাসি। শুধু বুঝলাম এই মৃত্যুটা লক ডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যুর মতো হেড লাইন হওয়ার মতো খবর নয়। এটা লকডাউনের আগেই কখনও একটা কোনও অন্য রাজ্যে কাজে যাওয়া লেবারের আর পাঁচটা মৃত্যুর মতো আরও এক লেবারের মৃত্যু। যে মৃত্যু তখনও পরিযায়ীর মৃত্যু বলে ট্যাগ হয়নি।
বাসন হাতে বৌটি তারপরেরটুকু নিজের লোকজনদের দিকে তাকিয়ে কি যেন সব শব্দে বলছে। তার একবিন্দুও বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। বাকিটা বিবরণ শুনেছিলাম পর্বতের মুখেই। পর্বতের শৈশব কৈশোর কেটেছে অন্য ভাষার মানুষের ভেতর। নিজের ভাষায় কথা বলার মতো কেউ ছিল না সেখানে। সেখানে থেকে আধা ভাঙা হিন্দি শিখেছে। পরে কবে যেন বাংলাটা বোঝার মতো বোঝানোর মতো শিখে নিয়েছে। ওর ভাষা সবটা আমি বুঝতে না পারলেও কথকপথনের দুপক্ষই একজন অন্যের কথাগুলো আন্দাজ করে করে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারা যাচ্ছিল।
সেবার এরা চলেছিল দাদনে। এই আদিবাসি পাড়ারই একখানা টিম। চলেছিল হরিয়ানার দিকে। দাদনের অগ্রিম টাকা নিয়েছিল তারা এজেন্টের কাছ থেকে। পর্বত এবং পর্বতের মতো এ পাড়ার আরও অনেকে হতে চলেছিল কন্সট্রাকশান সাইটের লেবার। মানে জোগাড়েগোছের। আর বছর পয়ষট্টির ভদ্রমহিলা হবে তাদের রাঁধুনী। লেবার ক্যাম্পে শ’ দেড়শ লেবারের রান্না করতে হবে তাকে তিনবেলা। একজন রাঁধুনী কাটা বাটা দেওয়া থোয়া সব কাজ মিলে একটা মাত্র হেল্পার পাবে। মরেছিল সেই মেইন রাঁধুনিই। যার সামনের কয়েকটা মাস সেই বিরাট টিমকে রান্না করে দেওয়ার কথা ছিল সে আর পৌঁছোতেই পারেনি সেই লেবার ক্যাম্প অবধি। সে ওই আগের গোল-গাল গোছের বৌটির শ্বাশুড়ি গোছের। বৌটি হাতের মেজে আনা বাসনগুলো দাওয়ায় রেখে মৃত মহিলার নামটা সঠিক ভাবে বোঝানোর জন্য ভেতর থেকে একটু ঘোলাটে একখানা আধার কার্ড এনে হাজির করল আমার সামনে। ছবিতে সাদা শাড়ি পরা এক মহিলা। ছবিটা ঘোলাটে। বোঝা যাচ্ছিল চোয়াল উঁচু মোটা ঠোঁটের কেউ। পাশে লেখা রেবা মান্ডি। বয়সের ঘরে সংখ্যাটা আজ আর স্পষ্ট মনে নেই। ছয়ের ঘরে কোনো একটা সংখ্যা।
জলজলিয়া ইস্টিশন গিয়ে উর মনে পড়েছিল আধার কার্ড তো সুঙ্গে নেয়নি। এই জলজলি নামটা সেদিনই প্রথম আমার শোনা। মালদা জেলার এতোগুলো এলাকায় ঘুরে এই প্রথম শুনলাম জলজলিয়া নামখানা। এমন অদ্ভুত একখানা স্টেশন কোথায় আছে? কিছুতেই বুঝতে পারছিনা জলজলিয়া আবার কোন স্টেশন? পর্বতের কথায় একবার মনে হচ্ছে এই কলাইবাড়ির কাছাকাছি কোনও স্টেশন। পাশে এমন কেউ নেই যে পর্বতের কথাগুলো বুঝিয়ে দেবে। কষ্ট করে অনুমান করার চেষ্টা করে চলেছি।
উ জলজলি আছে না উ জলজলি নাই! উই স্টেশন থেকে আমারা ট্রেনে উঠব তুখন।
টিমটা চলেছিল দিল্লি। মালদা থেকে ফারাক্কা এক্সপ্রেসের জেনারেল কামরায় প্রতিদিন এরকম বহু পুরুষ মহিলা লেবার চলে যায় দিল্লি হরিয়ানার উদ্দেশে। কখনও সঙ্গে বৌ বাচ্চা। পরে কলাইবাড়ির প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাস্টারমশাই পথিকৃৎবাবু হেসে বলেছিলেন জলজলিয়া মানে মালদা স্টেশন। মালদা স্টেশন চত্তরে ঝলমলে রোদ উঠত। সেই ঝলমলে রোদ দেখেই ঝলমলিইয়া শেষে জলজলিয়া ডাকনামে ডাকে এখানকার লোকজন। সেই দিন দুপুরে মালদা স্টেশন চত্তরে কতটা ঝলমলে রোদ উঠেছিল জানিনা। তবে রেবা মান্ডির মালদা স্টেশনে বসে বসেই শরীরের ভেতরে অস্বস্তি লাগতে শুরু করেছিল। মালদা স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে বড় বড় পিঠের ব্যাগ বালতি কুরণি কোদাল নিয়ে লম্বা লাইনটা বেশ অনেকেরই চেনা। ভোর রাত থেকে লাইন পড়তে পড়তে দুপুর। সেই লাইনে তখন এ পাড়ার রেবা মান্ডি। উপুর হয়ে বসে পড়ছে। দাঁড়াচ্ছে। শোয়ার চেষ্টা করছে ব্যাগে মাথা রেখে। পারছে না। আবার উঠে দাঁড়িয়ে পড়ছে। ঘাড় কপাল পেট পিঠ ভেজা। ঘাম নামছে বুক পেট দিয়ে। ভেতরে ভেতরে নিঃশ্বাসটা বুক থেকে গলা অবধি উঠে আটকে যাচ্ছে। বেরিয়ে পড়েও আবার কি একটা বুকে আটকে থাকছে। ওই রোগা বুকের পাঁজরের ভেতর কার্বন ডাই অক্সাইড ধাক্কা মেরে ঠেলছে। হাঁপরের মতো ফুলছে পাঁজরের হাড়গুলো। পেটের চামড়া কুঁচকে গিয়ে মাংসপিন্ডের উপর লেগে যাচ্ছে। স্বস্তি মিলছে না। অস্বস্তি বাড়ছে। ঘামে ভিজছে ব্লাউজ। পর্বতের বিবরণ শুনে এমনই একটা দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠছে তখন। রেবা মান্ডির ঝুঁকে পড়া শরীর ধরতে ধরতে এনে বসানো হল প্ল্যাটফর্মের বাইরে গাছতলায়।
উ গাছ তলাটা আছে না! উইখানে এনে বসালাম। পর্বতের উ গাছতলাটা বলতে মালদা স্টেশনের বাইরে ঠিক কোন গাছতলা বুঝতে পারিনি। মালদা স্টেশনের বাইরে লাইনকে লাইন ট্যাক্সি অটো রিকশ বাক্স ব্যাগ কুলি ট্রলি বস্তা চা ওয়ালা মাল টানার গাড়ি এসব কিছু চেনা। এ সব কিছুর সাথে সেদিন মালদা প্ল্যাটফর্মের বাইরে রেবা তখন শেষ হাঁফ টান ফেলছে।
উ লাইনটা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। উর জন্যেও সিট রাখব। তাই সব দাঁড়িয়ে আছি। কথাটা শেষ হওয়ার আগেই একটা সাউন্ড বক্সে গোলমালে বিকট শব্দ হয়ে শুরু হল, তোকে নিয়ে যাবো আমি একশ বৃন্দাবন…। রেবার হাঁফটানের কথার মাঝেই সব হেসে উঠল। পর্বত দাঁতগুলো বার করে হেসে নিয়েই হঠাৎ গম্ভীর হয়ে মাঠের দিকে আঙুল তুলে বেশ রাগী রাগী মুখ করে নিজের মাতৃভাষায় কি সব বলে ফেলল। যেদিকে আঙুল তুলে ও কথাগুলো বলছিল মাথাটা ঘুড়িয়ে সেদিকে তাকালাম। এতোক্ষণ খেয়াল করিনি আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার থেকে একশ পা দূরেই একটা দল ঢুকেছে পিকনিক করতে। শীতের বিকেলে খাওয়া দাওয়া সেরে পিকনিক পার্টি নাচ শুরু করেছে। পর্বতের চিৎকারে সাউন্ড বক্সের সাউন্ড একটুও কম হল না। পর্বতের মুখের রাগ আবার কোথায় মিলিয়ে গিয়ে আবার রেবার হাঁফটানের প্রসঙ্গ ফিরে এল। মনে পড়ল ফারাক্কা এক্সপ্রেসের বাইরে কোদাল বড় বড় পিঠ ব্যাগ লাগেজ ব্যাগ বালতি বোঁচকা স্টোভ এর সাথে মানুষগুলোর ধাক্কা ধাক্কি করে ওঠার অপেক্ষা চলছে তখন। কয়েকখানা সিট বা সিট না পেলে মেঝেতে বাঙ্কে বাথরুমের বাইরে গেটের পাশে মালপত্রের সাথে একটু পিঠ ঠেকানোর মতো জায়গা চাই ওদের। এই পূনর্ণভার পারের অটোস্ট্যান্ড থেকে আইহো মোড় আইহো থেকে মোঙ্গলবাড়ি। মোঙ্গলবাড়ি থেকে মালদা স্টেশন। অটোর সিট বদলাতে বদলাতে ছেলেটা চলেছে। ট্রেনের দরজা খুলে দেবে। লাইন দিয়ে উঠে পড়বে সবাই। ট্রেন ছেড়ে যাবে। আগে পৌঁছাতে হবে। তার আগে একখানা সিট দরকার। অটো বদলে বদলে রেবা মান্ডির আধার কার্ড এসে পৌঁছালো ছেলেটির পকেটের ভেতর। ট্যাক্সি ড্রাইভার হেল্পার অটোওয়ালাদের বাস কন্ডাক্টার কুলিদের হাঁকাহাঁকি প্যাসেঞ্জারের দরদামের ভেতর রেবা মান্ডির হাঁপ টান শেষ হল। শক্ত হতে শুরু করল রেবার শক্ত শক্ত হাত দুটো। প্ল্যাটফর্মে এনাউন্স হল ওয়ান থ্রি ওয়ান ডাউন ফারাক্কা এক্সপ্রেস এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাড়বে। ফারাক্কা এক্সপ্রেস ছাড়ল। গাদাগাদি ভিড় হল। একটা সিট বেশি পেল ওই ভিড়ের ভেতর কেউ। এ পাড়ার ঠিক কে কে ট্রেনে উঠেছিল কে ট্রেনে না উঠে রেবার বডি নিয়ে ফিরেছিল জানা হয়নি। রেবার আধার কার্ডটা লেগেছিল তারপর ডেথ সার্টিফিকেট বার করতে।
পর্বত নিজের কথা শুরু করেছিল রেবার মৃত্যুর প্রসঙ্গের মাঝেই। ওই রকম নড়তে নড়তেই হঠাৎ একটু গম্ভীর মুখ করে বলে বসল, আমি সত্যি চ্যাংড়া। সবাই জানে। উ কথা সবাই জানে আমি মিথ্যা চ্যাংড়া না। আমার কথাগুলো শুনবেন?
কথাটা বুঝতে আমার মিনিট দুএক সময় লেগেছিল। কিছুক্ষণ পর বুঝলাম চ্যাংড়া শব্দটা এক্ষেত্রে আমি ঠিক যেভাবে ভাবছি সেটা নয়। ও বোঝাতে চাইছে ছেলে হিসেবে। পর্বতের কথায় সে একজন সত্যবাদী ছেলে। মিথ্যে সে বলে না। সে আমাকে যা বলছে সবই সত্যি। হঠাৎ এই সততার প্রমাণের কি প্রয়োজন হয়ে পড়ল বুঝলাম না। এর আগে দু চারবার আমার দিকে তাকিয় সন্দেহ করছিল বুঝতে পারছিলাম। এরপর আরও দু তিনবার সত্যি চ্যাংড়া সত্যি চ্যাংড়া শব্দটা আওড়ে নিয়ে বলল, ই পাড়ার সবাই জানে বি এস এফটা আমাকে সেই ছুটো বেলায় নিয়ে চলে গেছিল। আর ফিরায়ে দেয় নাই। আটকাইয়া রেখেছিল হামাকে। উ অনুরাধাপুর ক্যাম্পের বি এস এফ টা। নিয়া গিয়া ছিল হামারে। আটকায়া দিছিল হামারে। কেমন ছিলাম জানো তুখন আমি! উই চ্যাংড়াটার মতোন।
বলেই আবার গর্তে ঢোকা চোখ দুটো খড়ের গাদার দিকে তাকিয়ে বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে খুঁজতে থাকল। অনেকগুলো পাঁচ ছয় সাত আট দশের বাচ্চা খেলছে ওখানে। সেই দলটার মাঝে কোন একটা বাচ্চাকে দেখিয়ে যেন বলল, উই চ্যাংড়াটার মুতো ছিলাম তখন আমি।
বাচ্চাগুলোর মধ্যে থেকে দু একটা ছেলে মেয়ে দৌড়ে পালালো। তাদের দিকে এই বক্তা ও শ্রোতাদের হঠাৎ চোখ পড়ায় লজ্জা পেয়ে তারা ছুট লাগালো মনে হল। বাকিরা এসবে ভ্রক্ষেপ না করে খেলতেই লাগল। কেউ কাঁদছিল যেরকম সেভাবেই কান্না চালিয়ে গেল। বুঝতে পারলামনা ওই এক ঝাঁক বাচ্চার মধ্যে ঠিক কাকে বোঝাতে চাইল।
আমার তখন উই চ্যাংড়াটার মতোই বয়স হবে। তখন নিয়ে চুলে গিছিল।
নিয়ে গিয়েছিল মানে? বাড়ির লোকেরা জানত না আপনাকে নিয়ে যাচ্ছে যে।
হ্যাঁ জানত তো। কাজ করাতে নিয়া গেছিল।
কোথায়?
উই উত্তর পরদেশ।
কাজ করাতে?
হ্যাঁ।
কি কাজে নিয়ে গিয়েছিল?
উদের অনেক জমিন ছিল। সেই জমিতে কাজ করাইতো
ঘরের কাজ করাইতো চাষের কাজ করাইতো।
বিষয়টা আরও একটু স্পষ্ট করে জানার জন্য আর কয়েকটা প্রশ্ন করে যা বোঝা গেল অনুরাধাপুর বি এস এফ ক্যাম্পের কোনও এক উর্দিধারি ওকে ছোটবেলায় কাজ দেওয়ার নাম করে নিয়ে চলে গিয়েছিল।
আপনি বাড়ি ফিরে আসার জন্য কান্নাকাটি করেন নি?
হেসে ফেলল। মোটা কালো ঠোঁটের ভেতর থেকে দাঁতগুলো বেরিয়ে এলো বাইরে। হঠাৎ পর্বতের পিঠে এক ধাক্কা। পর্বৎ হুমড়ি খেয়ে কিছুটা পড়তে নিল। আবার সামলে নিল। আমার সঙ্গে কথা থামিয়ে দিয়ে পেছনের অল্প বয়সী ছেলেটার দিকে ফিরে লাথি দেখিয়ে নিজের ভাষায় কিসব বলতে লাগল। ছেলেটা উলটে থাপ্পড় দেখানোর ভঙ্গী করল। তারপর দু-পক্ষই হেসে গড়িয়ে পড়ল। বুঝলাম এই ধাক্কা মারামারি রসিকতা করে।
ওদের হাসাহাসি চড় থাপ্পড়ের মাঝেই আমি আবার প্রসঙ্গে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলাম। আপনি ফিরে আসার জন্য কান্নাকাটি করেননি?
দাঁতগুলো বার করে আবার হাসতে লাগল। আমি প্রশ্নটা আবার করলাম।
এবার হাসিতে সামান্য রাশ টেনে বলল, কান্নাকাটি করে কি হবে!
হাসি মুখে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। যেন অবান্তর একটা কথা আমি বলে ফেলেছি।
উরা আসতে চাইলে বলত, তুর বাবা ভালো আছে মা ভালো আছে, সবাই ভালো আছে। তুই গিয়া কি করবি? বলে আবার হাসি।
আপনাকে যে নিয়ে গেল তারপর সেই অফিসার আর ক্যাম্পে ফিরে আসেনি?
হ্যাঁ। এখানেই তো কাজ করত।
আপনার বাড়ি থেকে আপনার কেউ খোঁজ নিত না?
হ্যাঁ। উরা তো গিয়েছিল উই অনুরাধাপুর ক্যাম্প অফিস।
সি বলেছিল তোর চ্যাংড়াটা ভালো আছে। বলে পাঁচশ টাকা আমার বাপের হাতে ধরায়েছিল।
আপনার হাতে টাকা পয়সা দিত না?
আমার বাপটাকে সি একবার পাঁচশ টাকা দিয়েছিল। ব্যাস! আর দেয় নাই। তারপর তো উ এইখান থেকে চুলে গেল। টারান্সফার হুয়ে চুলে গেল। উর বাবাটা ভালো ছিল। কোলে বসায়ে ফোটো তুলেছিল হামার। সেই ফটোটা দেওয়ালে বড় করে বাঁধায়ে রাখছিল। বলত, তুই তো হামার আরেকটা বেটা।
একথাটা বলতে বলতে মুখটা আবার হাসিতে ভরে উঠল। ডাল ভাঙা শিমুল গাছটার দিকে তাকিয়ে বলল, দাদুটা ভালো ছিল। দাদুটা ভালো ছিল।
ওই বয়সে অতো কাজ করতে পারতেন?
হ্যাঁ, মাথাটা হেলিয়ে ফেলল ডান কাঁধে। তারপর ঘাড় মাথা নিচু করে বলল, যা বলত তাই করতাম। জমির ফসল কাটতাম। বীজ রুইতাম।
কী কাটতেন ধান?
না ধান হত না। গোম হত। ভুট্টা হত। ওই সব দেশে ধান হয় নাতো। সেই সব কাটা। আনা নেওয়া সব করতাম।
বাড়ির কাজ করাতো?
হ্যাঁ বাড়ির কাজটাও করতাম। ঘর পুছতাম। কাচড়া ফেলাতাম। সব করতাম। যা বলত সব করতাম।
ঘাড় রইল সেরকমই নীচু। জংলা ছাপার টুপির নিচ দিয়ে মুখখানা আর দেখা যাচ্ছে না। কথাগুলো বলে চলেছে নীচু স্বরে। যেন সেই উত্তর প্রদেশের মালিকেরা এই সামনেই কোথাও দাঁড়িয়ে আছে। সে যেন আজও তাদের অধীনে কাজ করা এক লেবার। মাঝে অনেক বছর কেটে গেছে। বিয়ে করেছে। তিন ছেলে মেয়ের বাবা এখন পর্বত। আদিবাসি পাড়ার কোনও এক মাটির বাড়ির গৃহ কর্তা সে এখন। উত্তর প্রদেশের মালিকের বাড়ির সেই দেওয়ালে টাঙানো ফ্রেমে বাঁধানো ফটো আর বাধ্য হয়ে সমস্ত আজ্ঞা পালন করার কথা বলতে বলতে সেই শীতের বিকেলে কাঁচা পাকা চুলের চল্লিশ বেয়াল্লিশের হাফ প্যান্ট পরা পর্বত যেন হয়ে উঠল অন্যের বাড়িতে ফাই ফরমাশ খাটা এক কিশোর।
ন্যাড়া ন্যাড়া ধরণের খেজুড় গাছটার থেকে শেষ বেলার চিলতে রোদটা ততক্ষণে সরে গেছে। কাঁটা কাঁটা গাছটা আরও যেন কালো হয়ে এসেছে। চারপাশের বাচ্চাদের চিৎকার কমে এসেছে। মশার ভনভন বাড়ছে। পিকনিক পার্টির ঢাউস ঢাউশ বাসনগুলোর ঠোকাঠুকির শব্দ বেশি বেশি করে কানে আসছে। এঁটো খাবারের গন্ধ আসছে ভুর করে রাখা থার্মোকলের প্লেটগুলো থেকে।
ফিরে এলেন কিভাবে? পরে ফিরিয়ে দিয়ে গেল?
না…না!
না শব্দটা বলল জোর দিয়ে। বি এস এফের টুপিসমেত মাথাটা ডানে বাঁয়ে নড়তে থাকল এবার। চোখদুটো আমার থেকে সরিয়ে নিয়ে ভিড়টার দিকে তাকিয়ে বলল, এদের জিজ্ঞাস করেন। এরা সুবাই জানে। বিশ্বাস না যান এরা বুলবে। আর দিয়া যায়নি। এই এত্তোটুকু থেকে এই এত্তো লম্বা হয়ে গেলাম। তাও দিয়া গেল না ফিরত।
তাহলে !
তাহলে ফিরলেন কিভাবে?
পালিয়ে… আবার সেই দাঁত বার করা হাসি।
শুধু ই নামটা মুনে ছিল, শিরশি কলাইবাড়ি। আর কিচ্ছু মনে ছিল না। ঠিকানা বিকানা কিচ্ছুনা। একটা চ্যাংড়ারে পেলাম। সে চ্যাংড়া উ সমস্তিপুরের। উ সমস্তিপুর থেকে গিছিল উই উখানে কাজে। তারে ধুরলাম। উই বাড়ি থেকে পলাইলাম ওই চ্যাংড়াটার সুঙ্গে। কিভাবে যেন টেরেনে করে উ জলজলিয়া উবদি এলাম। মনে নাই। তারপর লোকেরে জিজ্ঞাস করতে করতে চলে এলাম।
শেষে পর্বত আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল একটা ধুলোয় মাখা বাচ্চাকে। নাকের জলে চোখের জলে ধুলো কাদায় মাখামাখি হয়ে সে এতোক্ষণ পর্বতের চোখের সামনেই ছিল। বলল, উ আমার ছুট চ্যাংড়াটা। আর দুটো আছে উই উখানে। বলেই আবার সেই দলের দিকে দেখিয়ে দিল।
বিয়ে করলেন কবে?
মিচকি হাসিতে ভরে গেল টুপির নিচটা, বাড়ি এসে বিয়া করেছি। তিনটে চ্যাংড়া হল। এখুনও লেবার খাটতে যাই বিদেশে। আমার বৌও যায়। ই পাড়া থেকে ইখন একসাথে যাই সব।
উত্তরপ্রদেশের নাম ভুলে যাওয়া কোন এক গ্রাম থেকে মালদার এই সীমান্ত লাগোয়া আদিবাসি গ্রাম। অজানা এই জার্নির বিবরণ মাঝে কিছু কিছু পর্বত বলেছিল তার নিজের ভাষায়। যতটুকু বোঝা গেল ততটুকু লেখা গেল। পর্বতের মুখের যতটুকু উচ্চারণ বোধগম্য হল তারসাথে খানিকটা অনুমান মিশিয়ে লিখলাম। কোথাও কোথাও জায়গা বদল করে গেল পর্বতের মুখের আ-কার ই-কার উ-কার। বোঝার বাইরে অনেকটাই থেকে গেল অস্পষ্ট।
ফেরার পথ ধরেছি। হাল্কা অন্ধকারে গাছগুলোর ভেতর পার্থক্যগুলো কিরকম হারিয়ে ফেলেছে। পাতার বিশেষ বিশেষ সবুজগুলো সব মিলে মিশে গিয়ে কিরকম কালো কালো একই রকম লাগছে। ডানে বাঁয়ের রাস্তায় দেখা মুখগুলো কিরকম একই রকম লাগছে অন্ধকারে। পর্বতের মতোন রেবা মান্ডির মতোন। হাঁটছি… হাঁটছি…। দুপুরের আলোয় রাস্তাটা যেমন দেখতে লাগছিল এখন অন্যরকম। সন্ধের জমাট বাঁধা কুয়াশা ফাঁক ফোঁকরে ঢুকে পড়ে আবছা করে দিচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে আবছা হয়ে যাচ্ছে মনের ভেতর আরও অনেক জানা জানা সংজ্ঞা। কাকে বলে শিশু! কাকে বলে পূর্ণ বয়স্ক! কাকে বলে শিশু শ্রমিক! কাকে বলে শুধু কাজের লোক! কাকে বলে মাঠের লেবার! কাকে বলে রক্ষক! কাকে বলে চোর! কোনটা সুইসাইড! মার্ডার! কোনটা রুগির বিছানা! কোনটা স্টেশন! কোনটা প্রাইভেট প্লেস! কোনটা পাবলিক প্লেস!
অটো স্ট্যান্ড চলে আসতে আরও মিনিট খানেক। স্ট্রিট লাইটের আলো দেখা যাচ্ছে দূর থেকে। পুকুর ধারে সেই ম্যাটাডোর ভিড়টা আর নেই। কেউ নেই এখন আর। কেরালা লেখা গাড়িটা বোধহয় শ্রীরামপুর ছাড়িয়ে মোঙ্গলবাড়ি ছাড়িয়ে জাতীয় সড়ক ধরে নিয়েছে। অটোতে লোক বসে পড়েছে। অটোতে পিছনের সিটে গিয়ে বসতে হবে। এদিনের মতো শেষ অটো আইহো যাওয়ার। হঠাৎ মনে পড়ল সেই উত্তর প্রদেশের পর্বতের পাতানো দাদুর সাথে পাতানো নাতির দেওয়ালে টাঙানো ছবিটার কথা। সে ছবিটা আজও কি ওভাবেই টাঙানো? সেই গ্রুপ ছবির বাকিদের হদিশ হয়ত সব ঠিকঠাক আছে। কেউ বেঁচে আছে। কেউ মরে গেছে। শুধু একটা মানুষ গায়েব হয়ে গেছে। ছবিটা কোথায় এখন? সেভাবেই সামনের বারান্দার দেওয়ালে টাঙানো! নাকি কোনও ভাঁড়ার ঘরে! নাকি ডাস্টবিনে! পর্বতের তিন ছেলে। ছোটটিকে দেখেছিলাম ধূলো মাখা গায়ে। বড় মেজ ছিল ভিড়ের ভেতর কোথাও! ছেলেগুলোর আগামী মাসগুলোতে আস্তানা হবে কোথায়? লেবার বাবা মায়ের সাথে জেনারেল ডিব্বার বগি চেপে অন্য কোনও এক রাজ্যের লেবার ক্যাম্পে? নাকি তিন পাশে খোলা মাঠের মাঝের পাড়ার অন্য কোনও ঘরে! নাকি আরও অন্য অন্য কোনও ঘরে! অটো স্ট্যান্ডের পাশে মৃত সুজয়ের বাড়ির উঠোনে টিমটিমে আলো জ্বলছে চোখে পড়ল। সেই গন্ধওয়ালা উঠোন বাড়িটা অন্ধকারে অন্যরকম দেখাচ্ছে। মানুষগুলোর উঠোনের মাঝে ছিটিয়ে দেওয়া থুথুগুলো এতক্ষণে শুকিয়ে কাঠ হয়ে নিশ্চয়ই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কিছুটা জমাট বাঁধা কুয়াশা ঢুকে পড়েছে নিশ্চয়ই সেই ভেতরের উঠোনের গোল ফাঁকা জায়গাটাতেও। দূর থেকে একটা গান কানে ভেসে আসছে। হ্যাঁ এগিয়ে আসছে শব্দটা। ম্যাটাডোরের উপর বক্সে বাজতে বাজতে এগিয়ে আসছে পর্বতদের বাড়ির রাস্তার দিক থেকে।
তোকে নিয়ে ঘুরতে যাবো একশ বৃন্দাবন।
আমি আর অন্য কিছুর মুডে নেই এখন…