দেশে বিদেশে রেলগাড়ি চড়া

রেলপথে ভ্রমণের স্টেশনগুলো পরপর তীব্র গতিবেগে পিছনে চলে যেতে থাকে। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কোচ নয়, সাধারণ লোকাল ট্রেনে জানালার পাশে বসে দেখার সৌন্দর্য সারা পৃথিবীতে যত সব সুন্দর দৃশ্য দেখেছি তার থেকে কিছু কম নয়। এর মধ্যে আছে নানারকম অনুভূতি, যেমন সামনে, কখনও হয়ত অজানার উদ্দেশ্যে, এগিয়ে চলার আনন্দ, পিছনে কিছু ফেলে আসার বেদনা, রেলপথে অজানা অদেখা অনেক কিছু দেখার অভিজ্ঞতা এমন আরও কত কী। স্টেশনের প্লাটফর্মে অপেক্ষমান নারী, পুরুষ, শিশু, সওদা করা ফেরিওয়ালা, চায়ের স্টল সব দূরত্বের সঙ্গে পাল্টে যেতে থাকে অনেক দূর এগিয়ে গেলে। চলার পথে দেখা যায় শস্যক্ষেত্র, গ্রাম, ছোট শহর, রাস্তাঘাট, সব কিছুর একটা নিজস্বতা আছে। পথের পাশে উদগ্রীব হয়ে এক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট শিশু, মাঠের মধ্য আদুর গায়ে লুঙ্গি পরা কর্মব্যস্ত চাষী, জলভরা এক কলসী কাঁখে নিয়ে  মেঠো পথে হেঁটে চলা এক রমণী সবাইকে অবজ্ঞা করে আমার ট্রেন দ্রুত চলেছে। স্টেশনের  নাম দেখে মনে হয় কোথাও একটা নেমে পড়ি। সেখানে কী আছে জানার দরকার নেই, সেই স্থানটা তো আছে। 

 

 

 

 

ইউরোপে যখনই থেকেছি, তখনই সপ্তাহান্তে কাজ না থাকলে ট্রেনে উঠে পড়তাম লক্ষ্যহীন  কোনো এক শহর বা গ্ৰামের  উদ্দেশ্যে। এক  মোহময় ইউরোপের যে কোনও অংশ যেন পুরো মহাদেশ জুড়ে আছে। ছোট স্টেশনগুলি আছে একটা গ্ৰামের জন্য, সেখানে একটা গীর্জা, একটা ছোট বাজার, একটা প্রাইমারি স্কুল ও একটা ছোটদের খেলার মাঠ  থাকবেই। 

 

 

 

আমাদের দেশেও ট্রেনে চড়ে কোথাও গেলে এমন হয়।  মনে পড়ে হাওড়া-খড়গপুর লাইনে সেই যে স্টেশন নারায়ণ পাকুড়িয়া মুড়াইল, যা ষাটের দশকে আমার চোখের সামনেই সেখানে নতুন হলো ।  নাম দেখেই ইচ্ছে হতো একবার নেমে পড়ে দেখি। এই নামের অনেক ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে পরবর্তীকালে, কিন্তু তার প্রয়োজন নেই, নাম ত শুধুমাত্র নামই। এই নামটি ব্যতিক্রমী এবং সুন্দর। আবার একটা সময় খড়গপুরে আমার হাকিম জ্যাঠার   ( নীলফামারীতে কোন কালে  জজিয়তি করতেন  )  বাড়িতে মাঝে মাঝে যেতাম। পৌঁছবার আগে আসত  বালিচক, শ্যামচক,  জকপুর, মাদপুর, খড়গপুর, কেমন যেন ছন্দোবদ্ধ নাম।  কিছুতেই ভোলা যায় না। 

 

 

 

জার্মানির ফ্রাইবুর্গ  থেকে কনস্টানজ  যাওয়ার পথে রাডোলফজেল ছাড়ালে  এমন ভাবেই আসত  সিঙ্গেন, ইউবারলিঙ্গেন, স্টাহরিঙ্গেন, হাসেলব্রুন, ব্রান্ডবুহল ইত্যাদি। ২০০৫ আর ২০১২ সালে ফ্রাইবুর্গে (Freiburg) কাজ করার সময়ে সেখান থেকে ট্রেনে দুবার কনস্টানজ গিয়েছিলাম। রাডোলফজেল এলেই বুঝতাম দুটো হ্রদ আসছে, এবার এসে গেছি। একটা হলো জার্মানি-সুইজারল্যান্ড সীমান্তে বোডেনসে (Bodensee), আর অন্যটা কনস্টানজসে (Konstanzsee, See অর্থ হ্রদ) ।  এই ট্রেণ ভ্রমণ বর্ণোজ্জ্বল  জার্মানির সব থেকে বর্ণময় রেল ভ্রমণের একটি।  

 

এই অঞ্চলের সব থেকে উপভোগ্য শহর হলো লিন্ডাউ (Lindau) এবং আকর্ষণীয় ট্রেণ ভ্রমণ কনস্টানজ থেকে লিন্ডাউ, বোডেনসের উত্তরে এই হ্রদের এবং জার্মানির শেষ শহর এটি । ট্রেণ বোডেনসের পার দিয়ে হ্রদের পশ্চিম প্রান্ত হয়ে আবার পূবে এই হ্রদের উত্তর তীর দিয়ে যাত্রা করল। এই পথে স্টেশন ছিল Meersburg (সামুদ্রিক দূর্গ), Hagnau am Bodensee, Immenstaad (বিশাল শহর), Freidrichshafen (hafen অর্থ বন্দর, Friedrich একটি জার্মান খ্রীষ্টান নাম),   Kressbronn am Bodensee., সব নামের অর্থ জানা নেই। 

 

 

 

 

একদিন শেষ বিকেলে লিন্ডাউ পৌঁছলাম। শহরটা হ্রদের মধ্যে একটা দ্বীপ। এর পরেই অস্ট্রিয়ার ব্রিগেঞ্জ (Bregenz), তার পর সুইজারল্যান্ড।  শহর থেকে পশ্চিমে তাকালে দিগন্তবিস্তৃত জল। কিছু সময়ের পরে লাল সূর্য অস্তাচলে যেতে শুরু করেছে। এই শহরের কেমন একটা মোহনীয় রূপ আছে, এখানে গেলে মনে হয়, সত্যি স্বর্গকে স্পর্শ করা যায়। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে ফেরার ট্রেণ ধরলাম। হ্রদ ঘেঁসে ট্রেন চলল।

 

 

 

জুরিখে বাড়ির কাছে রেল স্টেশন ছিল ভোলিশোফেন, তার পর থালভিল, ভাদেন্সভিল, রাপার্সভিল। ভিল হল গ্ৰাম। আমাদের দেশে যেমন স্থানের নাম শেষ হয় গ্ৰাম, পুর, বাদ বা এমন কিছু শব্দ দিয়ে, ও দেশে নামের শেষে দেখা যায় ভিল, ইঙ্গেন, কোন ইত্যাদি ।

 

 

 

 

জার্মানির ফ্রাইবুর্গ থেকে ব্ল্যাক ফরেস্টে টিটিসে যাওয়ার পথে রেল স্টেশনের  নাম হল  Littenweiller (সহনশীল গ্ৰাম), Kirchzarten (সংবেদনশীল গির্জা), Himmelreich (স্বর্গরাজ্য), Hinterzarten (কমনীয় গ্ৰাম)। হিমেলরাইখ স্টেশন পৌঁছে মনে হবে সত্যিই স্বর্গরাজ্যে এসেছি। নামার সুযোগ হয়নি। ট্রেন থেকে দেখা যায় কয়েকটি সুন্দর সাজানো ছোট বাড়ি, ফুল ফলে ভরা বাগান, শিশুরা পার্কে খেলছে। গ্রামের রাস্তায় গাড়ি চলছে। Himmel শব্দের অর্থ আকাশ বা স্বর্গ, Reich হল রাজ্য, Kirche হল গির্জা। পাহাড়ের উপর এত উঁচুতে থাকা ছোট শহরে সব সুবিধা আছে। 

 

 

 

প্রকৃতির সৌন্দর্য জার্মানি বা সুইজারল্যান্ডে যা আছে বাংলার গ্ৰামে, গঞ্জে, পাহাড়ে তার থেকে কিছু কম নেই। দার্জিলিঙ জেলা বা সিকিমের পাহাড়ে ট্রেণ লাইন প্রায় নেই। সুইজারল্যান্ডের মত এখানেও টানেল তৈরি করে রেল লাইন পাতা যেত। এই পরিকল্পনার কথা কখনও চিন্তা করা হয়নি। যদিও সিকিমের রংপো পর্যন্ত একটা টানেল তৈরি  হচ্ছে বলে শোনা যায়। অবশ্য এদেশে  অন্য অনেক সমস্যার গুরুত্ব বেশি। 

  • 2024-06-09