চশমার কাঁচে শাওয়ার

সকালবেলা সুনীলদার দোকানে গিয়েই মটকাটা গরম হয়ে গেল নীলাভ্রর।কেন যে গোটা দুনিয়ায় এত্তো মিষ্টির দোকান থাকতে এই সুনীলের দোকানের উপর মা ভর করেছে কে জানে।


"আরে বাবা  ,তোমার চিমটে দিয়ে রস চিপে রসগোল্লা কে যে এক্কেবারে দানাদাড় বানিয়ে ছাড়লে"-নীলাভ্রর কথায় কোনো রকম ভ্রুক্ষেপ না করে রসগোল্লার পলিথিন টা পাটের দড়ি দিয়ে বাঁধতে থাকলো বুধো।সুনীলের ছোট ছেলে।মিষ্টির দোকানের লোকজন গুলো কি শালা মিষ্টির গন্ধেই এমন ট্যাপা খোপাটির মতো ফুলে যায়?সুনীলের নাতনি টাকে রাস্তায় দেখলে যেন আর আলাদা করে পরিচয় দেওয়ার দরকার পড়ে।দুলাল ভড়ের  তালমিছরির মতো দেখামাত্রাই  যে একমাত্র সই আর ছবির ই একমাত্র সিম্বল হয়ে হেঁটে বেড়ায়।


 



প্যাকেজিং ব্যাপারটায় বড় শহর তো কোন ছাড়, এই না শহর,না মফস্বলে   অনেক কেই টেক্কা দিয়ে গেলেও ভাটপাড়ার সুনীলের মিষ্টির দোকান কিন্তু পড়ে রয়েছে সেই মান্ধাতার  ঠাকুর্দাদার আমলে।


মাটির ভাঁড় মফস্বল শহর থেকে উধাও হওয়ার আগেই 


সুনীলদা ভ্যানিশ করে দিয়ে ছিল সেসব।পলিটিথের পাতলা পাতলা প্যসাকেট তখন সবে শুরু হয়েছে।চটকলিয়া ভাষায়"চিমকি"।সস্তার পলিথিন পেয়ে গেলে কে ই বা আর বেশি পয়সা খরচ করে মিষ্টি মুড়তে?সুনীলদাও করে নি।


এতো আর কলকাতার শ্যামপুকুর স্ট্রীটের "চিত্তরঞ্জন"বা নিদেন পক্ষে বাগবাজারের বোসপাড়া ঢোকার মুখে গোপালের দোকান নয়,যে প্যাকেজিং নিয়ে মাথা ঘামাতে যাবে।


মনে মনে গজ গজ করতে করতে রাস্তায় পা দিতে না দিতে উল্টোদিকে প্রায় হরপ্পার যুগের বাড়িটার দিকে নজর চলে গেল নীলাভ্রর।


"শালা ,আয় না বড়শি তোর পিছনে গুঁজে দিচ্ছি...."


 আর ও হাজারো মধু বর্ষণের দিকে কর্ণপাত না করে বাড়ির রাস্তায় পা বাড়ালো সে।এক পা এগিয়েছে কী বিপত্তি।"বড়শি"নিয়ে এই বুড়োটার কোথায় যে কি অবসেশন কে জানে!হয়তো বুড়োকে কেউ বড়শির ঘায়ে কাবু করে থাকলেও থাকতে পারে।যদিও পাড়ার বড়শিদাদু,তার আসল নাম "কাবু", এখন দু চারটে ষাটোর্ধোর মনে আছে।তারা তো আর ওর কিমভূতুরের দোকানটার চৌহদ্দিও মাড়ায় না।


তবে অনেক ভেবে নীলাভ্র আবিস্কার করেছে,বড়শি দাদু নোতুন পাজামা আর ফতুয়া পড়বার পর সে গুলো না ছেঁড়বার আগে গায়ের থেকে খোলে না।তাই হয়তো "ইভনিং ইন প্যারী"ভয়ে খদ্দের ঢোকে না ওর দোকানে।


"এই শান্তদার ছেলে,দেখো তুমি পড়াশুনা করে কেমন ভদ্র সভ্য হয়ে রাস্তায় যাচ্ছো।আর এই বাপে তাড়ানো,মায়ে ক্ষেদানো গুলো কে দেখো তো।"



বড়শি দাদুর এহেন সম্ভাষণে এগিয়ে গিয়ে তার মন রাখা দুটো কথা বলবে কি না ভাবতে গিয়ে নীলাভ্র দেখতে পেল সেই হরপ্পা যুগের বাড়ির মেহেরগড়ের আমলের দোকানের সামনের রোয়াক থেকে দাঁত ক্যালাচ্ছে দেবু আর বাদলা।


দেবুরা নীলাভ্রর ছোটবেলাকার বন্ধু।একটা সময় ছিল ,মাধ্যমিকের পর ওদের সঙ্গে সে চুটিয়ে আড্ডা মেরেছে।রেল রাস্তার পাশে বাঁকানো দুটো সিমেন্টের শ্ল্যাব ছিল ওদের 'ঠেক'সাইকেল নিয়ে গোটা শহর টো টো করার যুগ সেটা।একবার তো বড় রাস্তা দিয়ে সাইকেল রেস করে যাওয়ার সময়ে এক উৎকল নন্দনের এক্কেবারে পশ্চাৎ দেশে প্রপাত চ,মমাত চ।তারপর সাইকেল নিয়ে দৌঁড়,দৌঁড় আর দৌঁড়।


      দেবুটা অবশ্য বড়াবড় ই বেড়ে পাকা।ওদের বাড়িটাকে কেন যে 'আঠারো ভাজার বাড়ি'বলে কে জানে!কেউ কেউ বলে ওদের বাড়ির কেউ নাকি রাস মেলার মাঠে "আঠারো ভাজা "বেচতো।তাই থেকে ই বাড়ির অমন হাড়ের গরম জানান দেওয়া নাম।


বন্ধুদের বাঁচাবে না কি বড়শি দাদুকে একটু তোল্লা দেওয়ার নাম করে দেবু,বাদলাদের ই আর একটু উসকে দিয়ে কেটে পড়বে তা ঠিক করবার আগেই মোবাইলটা বেজে উঠলো। 


থ্রিকোয়ার্টারের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখলো স্ক্রীনে লেখা"তোর্ষা"।এই গঙ্গার দেশে জন্মানো মেয়ের নাম কেন যে ওর বাবা ,মা "তোর্ষা"রাখলো কে জানে!


"কতোক্ষণ ধরে ফোন টা বাজছে।কি রে ঝারি করতে এতো বিজি মহারাজ?"


"বড়শি দাদুর বাওয়ালি।"


"কাজ নেই কোনো না?সাত সকালে পাগল নিয়ে পড়েছিস।শালা ভাটপাড়ার 'ভাট'কি আর গাছে ফলে?খুব ভালো লাগে না একটা মানসিক ভাবে অসুস্থ লোককে ক্ষেপাতে?একদিন ও জানবার চেষ্টা করেছিস লোকটার মনে কোথায় কান্না লুকিয়ে আছে?"


"আরে বে,এত্তো টেম্পার নিচ্ছিস কেন? সক্কাল সক্কাল জ্ঞান না ফলিয়ে কি বলতে চাইছিস বলে ফেল"-রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই জবাব দিল নীলাভ্র।


"শোন, আজ দশটা চল্লিশের নৈহাটি টা না ধরে সুপারটা ধরবি?"


"কল্যাণী সুপার?"


"তা ছাড়া আর কটা সুপার আছে রে গাধা?"


"এই শোন সাত সকালে 'গাধা'বলবি না তো।শালা,সকাল হতে না হতেই মা টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললো ,মিষ্টি নিয়ে আয়।বাড়িতে বিপত্তারাণী।কোন বিপদ তাড়াবেন তিনি কে জানে!


দোকানদারের ছেলেটা একটা ময়ে আকার ল।রসগোল্লাকে দানাদাড় বানিয়ে দেয়।তারপর বড়শি দাদুর কিচাইন।"


"নীল,শোন,মুখের ভাষাটা ঠিক কর।ভুলিস না ,প্রেসিতে এবার হিস্ট্রিতে তুই টপার।"


"তুই বল তোর্ষা,কাল রাত তিনটে পর্যন্ত ফরাসী বিপ্লবে ষোড়শ লুইয়ের অর্থমন্ত্রী নেকারের রোল নিয়ে কার্লাইল থেকে নোট নিয়েছি।আর আজ সকাল আট টা বাজতে না বাজতেই মা কি না ঘুম থেকে টেনে তুলে দিল?"


"নীল,তুই বুঝবি না ,মায়ের এই ডেকে দেওয়াটা কতো মন ভালো করে দেওয়া ব্যাপার।"


নীলাভ্র বুঝতে পেরেছে তোর্ষার গলাটা ভারি হয়ে এসেছে।


"শোন ,আমি রাখছি।সাড়ে দশটার মধ্যে ওভার ব্রিজের ওপর দাঁড়াচ্ছি।আননেসেসারি দেরি করিস না।"


"দেরি যেন যতো আমি ই করি ,আর উনি পাংচুয়াল টু দি ইনফিনিটি।"বলেই মোবাইলটা কট করে কেটে দিল তোর্ষা।


বাড়িতে ঢুকে মিষ্টির পলিথিনটা ঠাকুর ঘরের জানলার শ্লাবের ওপর রেখেই সোজা চান করতে ঢুকে গেল নীলাভ্র।চা,কফি কিছু খাওয়ার জন্যে মা ডাকলেও সেদিকে ওর নজর নেই।এখন নটা পঁচিশ বাজে।ঠিক সময়ে ওভারব্রিজের মাথায় দাঁড়াতেই হবে।



ভাবতে ভাবতেই শাওয়ারটা চালিয়ে দিল ।চোখে তখনো চশমা রয়েছে।জন্মদিনের পোষাকে চশমা আঁটা চোখে উঁচু হয়ে শাওয়ারের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ঝিরঝিরে জল পড়া দেখা ওর প্রিয় বিনোদন।যতোই কাজের তাড়া থাক,ট্রেন মিস হয়ে যাওয়ায আশঙ্কা থাক-চশমায় চোখের আড়াল রেখে জলেদের এই বিন্দু বিন্দু জীবন যাপন নীলাভ্র দেখবেই।


যখন একা একা থাকে ভাবে,কিছু আড়াল করতে চেয়েই কি এভাবে চোখে চশমা দিয়ে জল পড়া দেখে সে?কই পাতা নড়া তো আর এ ভাবে দেখে না।


     শাওয়ারের জলে চশমার কাঁচ টা ক্রমে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।মাথা ঝাকিয়ে সেই জল ঝরানোর বৃথা চেষ্টা করছে সে।ওদিকে ঘড়ির কাঁটা যে এগিয়েই চলেছে সেদিকে কোনো খেয়াল নেই।যতোই তাড়াহুড়ো থাকুক না কেন সেলফ ইনভেনটেড এই জল যাপন ছাড়তে পারে না নীলাভ্র।


"কি রে?আর কতোক্ষণ?ট্রেন তো শেয়ালদা পৌঁছে যাবে।"দরজায় মায়ের ঝাক্কা আর বাজখাঁই চিৎকারে শাওয়ারধারায় ছেদ টানতে বাধ্য হলো নীলাভ্র।মাধ্যমিকের পর ও যখন হুগলী কলেজিয়েটে এইচ এসের জন্যে ভর্তি হয় তখন নেশা নিয়ে খবরের কাগজের সামপ্লিতে একটা আর্টিকেল মার মাথাটা ঘেঁটে রেখেছে।সেই ভূত যেন আর ছাড়ছেই না।


   বাথরুমে বেশিক্ষণ থাকা মানে নাকি ছেলে নেশা করছে--পাঁচ বছর আগের সেই কাগুজে টিপস্ মায়ের মাথায় এখনো গিজ গিজ করছে।আরে প্রেসির ছেলে বা মেয়ে যদি নেশা করতে চায়,তাহলে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে তাকে তা করতে হবে না।বেকার হোস্টেল থেকে কলেজ মাঠের বিকেল কি নিদেন পক্ষে নিশুত রাতে "ওটেন সিঁড়ি"আছে না?এটি মা জননী কে কে বোঝাবে?



মা নিজে বাথরুমে চানেই হোক আর হাত ধুতেই হোক একবার ঢুকলে যে সহজে বেরোতেই চায় না--এটা যে সম্পুর্ণ "ও সি ডি" যাকে বলে "অফসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার"- এটা মাকে কে বোঝাবে?


       স্টেশনে ঢোকার মুখে চন্দনদার কাগজের স্টলটার দিকে একবার উঁকি মারতে গিয়ে ডিসপ্লে বোর্ডে নীলাভ্র দেখলো কল্যাণী সীমান্ত তিন নম্বরে আসছে।অগত্যা দিনের কয়েকটা কাগজে এক ঝলক চোখ বোলাবার হাতছানি এড়িয়ে ওভারব্রিজের দিকে পা বাড়াল।


"ও বাবা,একটু আমার দিকে দেখো"-ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো বাদকুল্লার সেই ফর্সা থপথপে বুড়িটা বসে রয়েছে বঙ্কিমচন্দ্রের তারের জালের মূর্তিটার সামনে।বুড়ির সংসার চলে ভিক্ষের টাকায়।বাড়িতে পঙ্গু ছেলে।ছেলের বউ ও আছে।সে কুটোটা নাড়ে না।বুড়ির এক নাতনি রয়েছে।ক্লাস এইটে পড়ে।চেয়ে চিন্তে বুড়ি সেই নাতনীর জন্যে বই জোগার করে।নীলাভ্র হাত খরচ বাঁচিয়ে মাঝে মধ্যে দুটো টারটে টাকা আগে বুড়িকে দিতো।


তারপর লক্ষ করেছে বুড়ি সেই টাকা তিল তিল করে জমিয়ে এক দু হপ্তা পর বাড়িতে দিয়ে আসতো।নিজে প্রায় না খেয়ে দিন কাটাতো।এটা বোঝার পর নীলাভ্র আর বুড়ির হাতে টাকা দেয় না।সময় থাকলে বুড়িকে নিয়ে যায় স্টেশনের পাশের 'ক্ষণিকের শান্তি'হোটেলে।পেট ভরে ভাত,ডাল খাইয়ে দেয়।নিজের পকেটে টাকা থাকলে মাছ ভাত খাওয়াতেও ভোলে না।তবে বুড়ির নাতনীর জন্যে চেয়ে চিন্ত বই জোগাড়ে নীলাভ্র লজ্জা শরম নেই।সেদিন খোদ ভি সি ম্যামের কাছে দরবার করে ওঁর হাজব্যান্ডের একটা স্কুল সিলেবাসের বই ও এনে দিয়েঠিল বাচ্চাটার জন্যে।



         "এখন না মাসি।ট্রেন পাব না।"বলে উর্দ্ধশ্বাসে এগিয়ে গিয়েই দেখলো তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে নামার মুখের সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তোর্সা রিস্ট ওয়াচে র দিকে তাকিয়ে।এই মোবাইলের যুগেও ও হাত ঘড়ি পড়ে।কারণ জিগ্যেস করায় বলেছিল,মাধ্যমিকের আগে ওর মা কিনে দিয়েছিলেন। আর কিছু জানতে চায় নি নীলাভ্র।


তোর্সার ঘড়ি দেখাটা একটা কায়দা।কারণ,কিছু না বলেও সে বুঝিয়ে দাতে চায়,চেষ্টা করেও "লেট লতিফ"নামটা ঘোচাতে নীলাভ্র পারবে না।


এই ট্রেনটা গ্যালোপিং বলে অফিস টাইমের পড়ন্ত বেলা তে তেমন একটা ভিড় হয় না।তিন জনের সিটে চারজন বসা এখন লোকাল ট্রেনের দস্তুর।ট্রেনে উঠেই তোর্ষা কেবল নিজের জায়গা ম্যানেজ করে ফেললো না।ব্যাগ দিয়ে নীলাভ্রর জায়গাটাও রেখেছে।


   বাবু তো আমাদের 'জিরো বন্ গ্যায়া হিরো।'সে সিটে বসে যাবে কেন?প্রেসটিস প্যাঙচার হয়ে যাবে না?দরজার সামনে হাওয়া খেতে খেতে না গেলে তার কি চলে?তোর্ষার ভাষায় দুনিয়ার মেয়েদের ঝারি মারতে না পারলে যে 'বাবু'র অন্নপ্রাসনের ভাত হজম হবে না।


       দমদম স্টেশনের আগে বঙ্গীয় উন্মাদ আশ্রমের সামনে ট্রেন  দাঁড়াতেই দরজায় আধঝোলা নীলাভ্রর চোখ চলে গেল উল্টোদিকের সিটে বেশ কায়দা করে জায়গা করে নেওয়া তোর্ষা র দিকে।


ওর চোখে দুষ্টুমির হাসি।ব্যাপারটা বুঝেও গায়ে মাখলো না নীলাভ্র। ভাটপাড়ার লোক আর "বঙ্গীয় উন্মাদ আশ্রমে"র একটা লিঙ্ক টানবার ধান্দায় আছে।না,পাত্তা দিলে চলবে না।উদাস চোখে সামনের গভর্নমেন্ট কোয়ার্টারের দিকে চেয়ে রইলো।ইশ্,আগে কোয়ার্টারের পাঁচিলের গলতাটা দিয়ে পাশের সরু খালের ক্যালভার্ট টা ডিঙিয়ে রেল লাইনের পাশের রাস্তায় চলে আসা যেত।


যাঃ শালা,পাঁচিল টা আটকে দিয়ে শান্তিনিকেতনের পাঁচিল কাকুর দশা করেছে যে মাইরি।


"এই শোন,তোর কি ফোর্থ পিরিয়ডটা আছে?"


"ন্যাকা চৈতন্য,জানেন না,জিওগ্রাফির টি সি মালের এফেক্টে টি সি নিতে চলেছে!"-ঝাঝালো উত্তর দিলো তোর্ষা।


"ভাব,টি সি র শ্বশুর ছিল আন্দামান ফেরত বিপ্লবী।"


"তা আর ভেবে কি হবে?সেই বিপ্লবের জেরেই স্কোর না করেও টি সির দুটো মেয়েই জে এন ইউ দাপিয়েছে"-তোর্ষার জবাবে কিছু না বলে পুঁটিরামের সামনে রাস্তা পেরিয়ে সূর্ষ সেন স্ট্রীট থেকে কলেজ স্ট্রীটের পথে পা দিল নীলাভ্র।খেয়াল করে নি তোর্ষা একটু পিছিয়ে পড়েছে।একটু ছুটেই যেন নীলাভ্র কে ধরে ফেললো ও।


ফোর্থ পিরিয়ডের শেষে কলেজের পিছনের মাঠে বসে ওরা লাঞ্চ বক্স খোলার তোড়জোড়ে ব্যস্ত।


"জানিস ,ধোকার এই মাখা মাখা তরকারি টা মা কী দারুণ রাঁধতো।"


"তোর্ষা,আবার?"-প্রেসিডেন্সির পিছনের দিকের মাঠে লাঞ্চ বক্স খুলে খাবারটা ভাগ করতে গিয়ে তোর্ষাকে ধমক দিয়ে উঠলো নীলাভ্র।


"কি রে নিজেরা বেশ ঘাপটি মেরে সাঁটাচ্ছিস তো?"নীলাভ্রর পীঠে একটা গদাম করে কিল কষিয়ে বলে উঠলো সঈফ।


"তোকে ভাগ দেবো কেন রে বে?"-তোর্ষাও কম যায় না।


"শালা দিলকুশায় দই চিকেন খাওয়াবি শ্রীপর্ণাকে আর টিফিনের ভাগ খাবি আমাদের থেকে?যা ফোট।"


তোর্ষার কথাটা যেন লুফে নিল সঈফ।


"পিশিমা!'আমাদের টিফিনের ভাগ?'জিও কাকা!"


"এই শালা ভাগবি?"-


"দেখো নিলুচন্দর ,তোমার লাঞ্চ বক্সে কাকীমার হাতের কোনো গ্রান্ড রান্না নির্ঘাত আছে।না খেয়ে এক পাও নড়ছি না।যদি না খাওয়াস শালা 'মালু মাসী'কে গিয়ে 'সেই বৃন্দাবনের লীলা অভিরাম' সব ই বলছি।"


হাসতে হাসতে সঈফের হাতে পরোটা আর ধোকার ডালনা দিতে দিতে নীলাভ্র বললো,"শালা,শকুনের চোখ ;না,নাক কে জানে!"


সঈফ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে নীলাভ্রর খিস্তির জুতসই প্রেসিডেন্সিয়ান খিস্তি হাতড়াতে।তার ফাকেই ওর হাত থেকে ওর আধ খাওয়া ধোকার টুকরোটা ছো মেরে তুলে এক্কেবারে মুখে চালান করে দিয়েছে তোর্ষা।


 "দেখ শালা কে শকুন"-কপট রাগে নীলাভ্রকে সঈফের  বলার সাথে সাথেই নীলাভ্রর স্মার্ট উত্তর," ইকনমিক্সের স্টুডেন্ট,জেন্ডারটা জানবি কি করে?ওটা শকুন নয় রে গাধা।শকুনি হবে।"


"কাকা,মহাভারতের শকুনি কি গুরু ট্রান্সজেন্ডার ছিল?"


"কথার যেন খই ফোটে"-তোর্ষা র কথা শুনে নীলাভ্র আর সঈফের প্রায় একসাথেই উত্তর;"সাধে কি আমরা প্রেসিডেন্সিয়ান?"


সঈফদের গ্যাঞ্জাম দেখে ধোকার গন্ধ যেন শুকতে শুকতে চলে এসেছে ডিউক।


"এসো কাকা,এতোক্ষণে ষোলকলা পূর্ণ হলো।"


"কেন?"যেন কিচ্ছু বুঝতে পারছে না এমন ভঙ্গী করে তোর্ষার কাছে জানতে চাইলো ডিউক।


"না,মানে নাইকের কচি কলাপাতা রঙের টি শার্ট আর 'লেভি ট্রেস'জিন্স পড়ে ক্লাইভের ঠাকুর্দার আমলের একটা দশ টাকার নোট নিয়ে আবার 'কেন'জানতে চাওয়া হচ্ছে?"


তোর্ষা বোঝে ডিউক কে বেশি পাত্তা দিলে মনে মনে চটে যায় নীলাভ্র। ওকে কিন্তু কিছুতেই তোর্সা বোঝাতে পারে না যে,ডিউক যতোই নেতা হোক আর হাতা হোক, ওর স্টেডি গার্ল ফ্রেন্ড আছে।তবে মেয়েটা জন্মসূত্রে খ্রিষ্টান।স্কটিশে পড়ে।


ডিউকের গোটা পরিবারটা বামপন্থী রাজনীতি করে।বেশ আধুনিক। এই ধর্ম টর্ম ওদের স্টেডিনেসে কোনো ম্যাটার করবে না।ম্যাটার করবে স্বয়ং ডিউকের বেড়ে পাকামো।


বাবু কিনা পড়াশুনা করে চাকরি বাকরি করবেন না।পার্টির হোলটাইমার হয়ে দেশোদ্ধার করবেন।বেকার বর কটা মেয়ে মানবে?নারীবাদের ঠাকুমা,দিদিমারাও তো এক একটা মান্ধাতার ঠাকুমা,দিদিমার ষোড়শী পিসী।


ধ্যুৎ,ডিউককে নিয়ে এতো ভেবে মরছে কেন?নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো তোর্ষা।কলেজ মাঠে সে চুপচাপ বসে রয়েছে।নীলাভ্র,সঈফ,ডিউক-যে যার ক্লাসে চলে গিয়েছে।


সন্ধ্যের কলেজ স্ট্রীট সারা দিনের ব্যস্ততা সেরে যেন রাতে শুতে  যাওয়ার আগে খানিকটা গড়িয়ে নেয় এই সাতটা ,আটটা নাগাদ।বইয়ের দোকানের ঝাপ গুলো বন্ধ।ছোট ছোট ঠেলা গুলো বইয়ের বান্ডিল নিয়ে ইতি উতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।সুতানুটি যেন উকি ঝুকি মারছে শাকিন কোলকাতার রূপকথায়।


নীলাভ্র আর তোর্ষা আলাদা আলাদা কোচিং এ যায়।ফেরে এক ট্রেনে।


শিয়ালদা স্টেশনে এসে অ্যাপেল জুসের কাউন্টারটার সামনে রোজকার মতো দাঁড়িয়ে আছে নীলাভ্র।যে আগে আসে সে এখানটাতেই অপেক্ষা করে।পকেটে টাকা থাকলে দু গ্লাস অ্যাপেল জুস দুজনে খায়।জুসে এখন আপেলের বদলে জুসারের জলের কেরামতি দিন দিন ই বাড়ছে।তা হোক,টাকায় টান থাকলে এক গ্লাস ই ভাগাভাগি করে খায়।


"কি রে সকালের লেট লতিফ অপবাদ ঘোচাতে আগে এসেছিস?না , কোচিং বাঙ্ক করে কোথাও কেটেছিলি?"


"হ্যা বে।বিপাশা বোস কে নিয়ে আইনক্সে গেছিলাম রে"-হাসতে হাসতে বললো নীলাভ্র।


"শেষে মালটার এই দশা বিপাশা পিসী কে নিয়ে পি এন পি সি করতে হলো?হায় রে।দেখছি তোর মতো দাদুর সঙ্গে আর ডেটিং করা যাবে না।"


"অনেক হয়েছে,চল আট নম্বরে' হাটে বাজারে  ' ঢুকছে।পরে গেলে আর জায়গা পাবি না।"নীলাভ্রর কথা থামিয়ে দিয়ে অ্যাপেল জুসের গেলাসটা আধ খালি করে ওর দিকে এগিয়ে দিল তোর্ষা।কথা না বাড়িয়ে চুমুক দিল নীলাভ্র।


দাম দেওয়ার জন্যে জিন্সের ব্যাক পকেটে সবে হাত ঢুকিয়েছে নীলাভ্র,তোর্ষার হাতটা নরম আবেশে শক্ত ভঙ্গিমায় চেপে ধরলো সেই হাত।


"নীল ,'যুগের ডাকে'যে আর্টিকেল টা লিখেছিলাম,তার জন্যে আজ দুশো টাকা পেয়েছি।ওই টাকাটা আনতে গিয়েছিলাম রে।তাই দেরি হলো।সত্যিই আজ কোচিং এ যাই নি।আজ দামটা আমি দিই?"


না,বলার মতো শক্তি জোগালো না নীলাভ্রর মুখে।


"জীবনের প্রথম উপার্জন।মাকে তো একটা আইসক্রিম ও খাওয়াতে পারলাম না।তোকেই খাওয়ালাম।"গলার স্বরটা ভারি হয়ে এসেছে তোর্ষার ।ওর হাতটা জোরে চেপে ধরে নীলাভ্র উঠে পড়লো হাটে বাজারের এস ফোরে।

  • গৌতম রায়