কবি পরিচিতি: আলোকধন্বার জন্ম ১৯৪৮ সালে বিহারের মুঙ্গের জেলায়। সত্তরের দশক থেকেই হিন্দি কবিতার জগতে এক পরিচিত নাম। বামপন্থী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ দুনিয়া রোজ বনতি হ্যয় (১৯৯৮) এবং মুলাকাতেঁ (২০২৩)। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল অব্দি ‘বিহার সঙ্গীত নাটক একাডেমি’-র অধ্যক্ষ ছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেছেন। পহল সম্মান, নাগার্জুন সম্মান-সহ অনেক সাহিত্য সম্মান পেয়েছেন। ইংরাজি ও অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে। আমেরিকার ক্রিটিকাল এনকোয়ারি পত্রিকায় ইংরাজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্য অকাদেমি প্রকাশিত হিন্দি কবিতার ইংরাজি অনুবাদের সংকলন সারভাইভাল-এ তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে।
ঘুম
রাতের ভবঘুরেরা
আমার আত্মার কাছেও একটু থামো
আমাকে দাও এমন ঘুম
যার উপর থাকবে না এক বিন্দু চাপ
এমন ঘুম
যেন চাঁদের উপর জলের ঘাস।
এক যুগের কবিতা
ওখানে ডালে ডালে ফল পেকে উঠত
আর তাদের থেকে ঠিকরে পড়ত আলো
আমরা খুব জোরে দৌড়োতাম
ময়দান থেকে ঘরের দিকে
কখনও কখনও আগে আগে আমরা
আর পিছু পিছু বৃষ্টি
উঁচু ঘাসের শিকড়ের মধ্যে
ছোট ছোট ফুল ফুটত
অন্য কোন গাছ থেকে
ঘাসের ভিতর উঁকি দিলে
তবেই দেখা যেত
কোন দিন হঠাৎ মেঘ ঘিরে ধরলে
সন্ধ্যার আগেই সন্ধ্যা নেমে আসত
মা আমাদের ডাকতে ডাকতে
গ্রামের বাইরে অব্দি চলে আসত
আমরা বেশিক্ষণ জেগে থাকলে
অন্ধকারে অনেক ধরনের শব্দ শুনতে পেতাম
যেসব শব্দ দিনে কখনও শোনা যেত না
কুয়োতে বালতি ডোবানোর শব্দ
জন্তুদের ভারি শ্বাস
উপরে তারাদের মধ্যে কোন একলা পাখির
ডেকে ডেকে চলে যাওয়া
ফসল কাটার সময়
ক্লান্ত হয়ে ফিরত বাবা
তখন মা
কত মিষ্টি স্বরে কথা বলত
কালো রাত খুব কালো হত
সাদা রাত খুব সাদা
বোনের বান্ধবী ছিল সুজাতা
পুকুরঘাটে গান গাইত
কোঁকড়া চুলওয়ালা এক ছেলে ছিল দিবাকর
লুকিয়ে ওর গান শুনত
একদিন সুজাতা চলে গেল বাংলায়
ওর পরিবারসহ
আর দিবাকর রয়ে গেল বিহারে
কত লোক গ্রাম ছেড়ে চলে গেল
আর কোন দিন ফিরে এল না
বর্ষাকালে পুবালি বাতাস বয়
বোনের সাথে আমরা
বাগানে ঘুরে বেড়াই
বোন দেখাত কীভাবে একটা গাছ ভেজে
উপরের পাতা থেকে চুঁইয়ে পড়ে জল
অথচ ভিতরের শাখাগুলি
কত কম ভিজে
আর নীচের মোটা কাণ্ডটা তো
প্রায় কখনই পুরোপুরি ভিজত না
ওখানে বাকলের উপর আঠা ছুঁয়ে দেখতাম আমরা
বাগানের চারিদিকে একটা সুগন্ধ থাকত
খুব ভালো লাগত
মা যখনই নতুন শাড়ি পড়ত
গুনগুন করত
আমরা মাকে জ্বালাতাম
মাকে দুলহন বলতাম
মা বিরক্ত হত না
বরং নতুন পাটালি দিত
পাটালিতে বাদামের দানাও থাকত
যখন মা একটু ফুরসত পেত
তখন আমাদের সেই সব দিনের কথা বলত
যখন মা নিজেও ছোট্ট ছিল
আমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হত
যে মাও কোন দিন ছোট্ট ছিল
সন্ধ্যা আরতির সময় মা গান গাইত
সন্ধ্যায় বাতি জ্বালাতে জ্বালাতে গান গাওয়া
সব সময় ভালো লাগত ওর
মা ছিল নিরক্ষর
কিন্তু ওর গানের অভাব ছিল না
কত নতুন নতুন গানও শোনাত
অনামা কত গ্রাম্য কবির
সন্ধ্যাবাতির সামনে সে গাইত
আমরা সব ভাইবোনেরা তার গায়ে গা ঘেঁষে
চুপ করে শুনতাম
সে এত ভালো গাইত যে মনে হত
সে যেন আর অন্য কোন কাজ না করে
কিন্তু তখনই তাকে চলে যেতে হত রান্নাঘরে
আঁচলের আড়ালে প্রদীপের শিখাকে
হাওয়া থেকে বাঁচিয়ে
উঠোন পার করত সে
গোধূলির সময় নিমগাছের নীচ থেকে
আমরা তাকে রান্নাঘরে যেতে দেখতাম
রাত যত বাড়তে থাকত
আমরা মায়ের থেকে দূরে থাকতে পারতাম না
আজ এত বছর পরেও আমি ভুলিনি
সন্ধ্যাবেলায় মায়ের সেই গান
চাঁদের আলোয়
নদীর ধারে বুনো কুল ঝরে পড়া
এই সবকিছুকে আমি বাঁচিয়ে রেখেছি বেদনার ঝড় থেকে।