গঙ্গ যমুনার তাহজীব

আমার রাতের অন্ধকার খুবই পছন্দ।  সেই সময় নিজের মুখোমুখি বসা যায়। মনের  গভীরে  সত্ত্বা রয়েছে তার সঙ্গে কথোপকথন করা যায়।  বহুদিন আগে এরম এক গভীর রাতে বেড়াতে গিয়ে প্যারিসে  সেইন  নদীর তীরে বসে আছি।  সামনে মহানগরের  নিওন বাতি জ্বলছে। শহরে আলোর মালা,  সাঁ মিচেলের    সামনে নটরডেমের গির্জার ছায়া সেইন নদীর জলে পড়েছে।  চারিদিকে জীবনের উল্লাস।  নদীর বুকে প্রমোদ  তরণী  বয়ে চেলেছে।  আমি শুধু তন্ময় হয়ে স্বার্থপরের মতো ভাবছি জীবনের পথ চলার কথা।   প্যারিসের সন্ধ্যায় জীবনের  উদ্দামতা ল্যাটিন কোয়ার্টারের গানের উল্লাস সামনে নটরদামের  সেই কল্পিত নায়ক কোয়াসিমোদোর  দীর্ঘ্যশ্বাস আর নদীর জলের সামান্য আকুতি শুনতে পাচ্ছি।  প্যারিস রোমান্টিক নিশ্চই কিন্তু তখন মনে পড়ে গেলো আর এক রোমান্টিক শহরের কথা।  প্যারিসের ইতিহাসের সঙ্গে আমার অন্বয় নেই কিন্তু সেই শহরের ইতিহাসের সঙ্গে আমার গভীর যোগাযোগ রয়েছে।



আমাদের দিল্লিতে মাসির বাড়ি ছিল দরিয়া গঞ্জে।  নামেই ভূগোলের পরিচিতি।  একসময় যমুনা নাকি আমাদের ২৪ নম্বরের  গলির কাছেই প্রবাহমান ছিল।  সেখানে বাজার বসত প্রতি জুম্মাবারে।  নদীর ওপার থেকে নৌকা বেয়ে এপারে শহরের রইস ওমরাহদের জন্যে চাষিরা নিয়ে আসতেন তাঁদের আনাজ পত্র। যমুনা ছিল দিল্লির প্রেমিকা।লাল কেল্লায় ছিল যমুনার জন্যে দরওয়াজা যার নাম ছিল খিজরী  দরওয়াজা । খিজরী দরওয়াজা ছিল  খয়াজা  খিজর  বলে এক সিন্ধি সন্তের নাম তিনি ছিলেন নদীর প্রাণ।  দিল্লিবাসী তাঁকে ডাকতো  ঝুলেলাল বলে।  হিন্দুদের কাছে তিনি ছিলেন অসংখ্য দেবদেবীর একজন আর মুসলমানদের কাছে তিনি ছিলেন  দরিয়া শাহ  'জিন্দা  পীর ।  কে জানে তাঁর নামের থেকেই ছিল দরিয়াগঞ্জ।



তবে শাহাজানাবাদের আসল বাজার ছিল চাঁদনী চকে।   চাঁদনী চকের মধ্যে দিয়ে নহর বয়ে যেত।  শাহ্জাদীরা তাদের নৌকায় বিনের সমধুর ধ্বনি শুনতে শুনতে খালের জলে বাজারের দোকানের রোশনাই আর চাঁদের আলোর ছায়া দেখতেন।  কোনো শাহজাদা তাদের প্রেমাস্পদ কে ফুলের তোরা  উপহার দিতেন আর মৃদু সুরে আওড়াতে শুরু করতেন রুমির কবিতা।  পাশে বাজারে কিন্তু চলতো পসরা কেনার বেচার কাজ।  বেনারসের শেঠজিরা নিয়ে আসতেন মসলিনের কাপড়, রাজস্থানের বাঞ্জারারা বিছিয়ে দিতেন রং বেরঙের কিংখাব , বুখারা সমরখনদ থেকে উজবেগ বণিকরা নিয়ে আসতেন গরম পশমের পোশাক।  চলতো বিকিকিনি। শাজাহানের সময় থেকেই চাঁদনী চকে ছিল শ্রী দিগম্বর জৈনলাল মন্দির। মুঘল আমলে আবার দূর থেকে বুলন্দ আওয়াজের আজান ভেসে আসত দিল্লির জামা মসজিদ থেকে ।  শ্রী দিগম্বর মন্দিরের আরাধনার সুর মিলে যেত আজানের ধ্বনি সঙ্গে। এই চাঁদনী চকে  ছিল মীর ত্বকী মীরের বাড়ি , অষ্টাদশ শতাব্দীর দিল্লির মশহুর কবি। ১৭৩৩ সল্ থেকে তিনি ১৭৮২ সল্ পর্যন্ত দিল্লিতে ছিলেন কুচা চেলান, চাঁদনী  মহল  এবং মাতিয়া  মহল। তিনি যখন   ১৭৮২ সালে তিনি দিল্লি ছেড়ে চলে যান লাখনৌ তখনি দিল্লির সংস্কৃতির সূর্য্য অস্তমিত।  সংস্কৃতির  ইতিহাসে প্যারিস হলো প্রতীচ্যের দিল্লি যদিও মুঘল শাহেনশাহর দের ঐশ্বর্যর কাছে বুৰ্ব রাজারা ছিলেন শিশু ।     শাহজানাবাদের গলিতে গলিতে ইতিহাস নীরবে থমকে দাঁড়িয়ে আছ। তখন মনে হলো যেখানেই থাকি প্যারিসে , লন্ডনে মন্ট্রিয়ালে  সেই ইতিহাসে আমার নিজস্ব অধিকার আছে। হিন্দুস্তানের গঙ্গা যমুনার তাহজীব আমার অস্তিত্বের অঙ্গ।

  • শুভ বসু