ভারতের ইতিহাস ঔপনিবেশিক ইতিহাস চিন্তা এবং হিন্দু মুসলমান প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ।

ভারতে ঔপনিবেশিক যুগে এবং স্বাধীন ভারতে হিন্দু মুসলমান সম্পর্কের বিতর্কের মূলে হলো ইতিহাস চর্চা।  ইতিহাস রচনায় ঔপনিবেশিক চিন্তায় হিন্দু সমাজ এবং মুসলমান সমাজকে দুটি পৃথক, সার্বিক ভাবে বিচ্ছিন্ন একান্ত ভাবে স্বয়ং সম্পূর্ণ ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসাবে দেখানো হয়েছিল ( হোমোজেনাস এন্ড মনোলিথিক)  ভারতের ইতিহাসের পর্ব বিভাগকে ধর্মীয় বিভাজন হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।  মুসলমান শাসন কে ইংরেজরা চিহ্নিত করেছিলেন এক নিরবিচ্ছিন্ন অন্ধকার ধর্মান্ধ  যুগ হিসাবে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও ইংরেজদের প্রাচ্য তত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন কিন্তু তিনি আবার ঔপনিবেশিক ইতিহাস চিন্তার  থেকে মুক্তি খুঁজছিলেন  কিছুটা পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছিলেন কিন্তু তার ইতিহাস চিন্তার মধ্যে অভিনবত্ব ছিল, আবার নানাধরনের সে যুগের ইতিহাস রচনার সীমাবদ্ধতার ছায়া ছিল। 


ইতিহাস বিষয়ে হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রথম রচনা ছিল ১৮৮৫ সালে শিখ স্বাধীনতা প্রশ্নে।  বলা বাহুল্য অধুনা ভারতের শিখরা তাঁদের  শিখদের জীবনে তিনটে কেয়ামতের যুগ চিহ্নিতও করেন: প্রথম টি আহমেদ শাহ আব্দালির সময় অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দির ভাঙা , দ্বিতীয়টি  ভারত তথা পাঞ্জাব ভাগ এবং তৃতীয়টি ইন্দিরা গান্ধীর অমৃতসরের মন্দির আক্রমণ এবং তাঁর হত্যার পরে  দিল্লিতে কংগ্রেস এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবকদের দ্বারা শিখ নিধন যজ্ঞ।  এর মধ্যে দ্বিতীয় দুটি ঘটনা রবীন্দ্রনাথের জীবনাবসানের পরে ঘটে।  কিন্তু প্রথম ঘটনার বিবরণে রবীন্দ্রনাথ যেমন শিখেদের উপর অত্যাচারের বর্ণনা করেছেন এবং শিখদের দ্বারা আফগান মুসলমানদের উপর অত্যাচারের বর্ণনা দিয়েছেন    এক নৈবক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে।


 


ইতিহাস নিয়ে রবীন্দ্রনাথের একটু রোমান্টিক বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছিল নিখিল রায়ের ফটোগ্রাফের মাধ্যমে মুর্শিদাবাদের ইতিহাস বইয়ের সমালোচনায়। ১৮৯৮ সালে  রবীন্দ্রনাথ লেখেন


 


নিখিল বাবুর মুর্শিদাবাদ কাহিনী পড়িতে পড়িতে মনে হয় , এই নূতন কর্মকোলাহলময় মহিমা মরিচীকাবৎ নিঃশব্দে অন্তর্হিত , তাহাতে পাটের কলের সমস্ত বাঁশি নীরব, কেবল চতুর্দিকে মুসমানদের পরিত্যক্ত পুরীর প্রকান্ড ভগ্নাবশেষ নিস্তব্ধ দাঁড়াইয়া।  নিঃশব্দ নহবতখানা , হস্তীহীন হস্তীশালা , প্রভুশ্যূন্য রাজ্ তক্ত , প্রজশূন্য আম দরবার , নির্বাণদ্বীপ  বেগম মহল একটি পরম বিষাদময় বৈরাগ্যময় মহত্ত্বে বিরাজ করিতেছে।  মুসলমান রাজলক্ষ্মী  যেন শতাধিক বৎসর পরে তাহার সেই অনাথপুরীর মধ্যে গোপনে প্রবেশ করিয়া  একে একে তাহার পূর্বপরিচিত কীর্তিমালার ভগ্ন চিহ্নসকল অনুসরণ করিয়া সনিস্বাসে দূরস্মৃতি আলোচনায় নিরত হইয়াছে।   


রবীন্দ্রনাথের এই রোমান্টিক উচ্ছাস বাংলার নবাবদের নিয়ে কি শুধু কবি কল্পনার এককালীন বহিঃপ্রকাশ।  আমার তা মনে হয় না।  অক্ষয় চন্দ্র মৈত্রের সিরাজদ্দৌলা গ্রন্থের সমালোচনায় তিনি ইতিহাস নিয়ে আরো প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা করেছেন


মোগল পাঠানের সময় প্রত্যেক সম্রাট স্বতন্ত্র প্রভুরূপে স্বেচ্ছামতে রাজ্যশাসন করিতেন , সুতরাং তাহাদের স্বাধীন ইচ্ছার আন্দোলনে ভারত ইতিবৃত্তে পদে পদে রসবৈচিত্র তরঙ্গিত হইয়া উঠিয়াছিল।  কিন্তু ইংরেজের ভারতবর্ষে ইংল্যান্ডের রাজনতন্ত্রের  শাসন।  তাহার মধ্যে হৃদয়ের লীলা অত্যন্ত গৌণ ব্যাপার।  মানুষ নাই , রাজা নাই , কেবল একটা পলিসি দীর্ঘ পথ ডাক বসাইয়া চলিয়াছে, প্রতি পাঁচ বৎসর অন্তর তাহার বাহক বদল হয় মাত্র। 


 


পুঁজিবাদী ঔপনিবেশিক শাসনের এত সুন্দর সমালোচনা আর নেই।  রবীন্দ্রনাথ ব্যাখ্যা করেছেন এক হৃদয় হীন নৈবক্তিক পুঁজির শাসনের যার মধ্যে সবই একটি পলিসি মাত্র। ভারত কে সভ্য করার    একটি যন্ত্র ঔপনিবেশিক শাসন  যার অস্ত্র আধুনিকীকরণ এবং civilizing mission   রবীন্দ্রনাথ আবার কিন্তু সিরাজের প্রতি সহানুভূতিশীল।  তিনি লিখছেন


 


সিরাজদ্দৌলা যদিচ উন্নত মহৎ চরিত্র ব্যক্তি ছিলেন না , তথাপি এই দ্বন্দ্বের হীনতা-মিথ্যাচার প্রতারণার উপরে তাঁহার সাহস ও সরলতা , বীর্য্য , ও ক্ষমা রাজোচিত মহত্ত্বে উজ্জ্বল হইয়া ফুটিয়াছে। 


 


এযুগের ভারতে সিরাজের চরিত্রের উপর আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের এই বক্তব্য প্রণিধান যোগ্য।  কিন্তু তাঁর মূল বক্তব্য ছিল ঔপনিবেশিক ইতিহাস চিন্তার প্রতি। অক্ষয় মৈত্রর সিরাজদ্দৌলা সমালোচনাতে  তিনি বলেন


 


ঘাতপ্রতিঘাতের একটা স্বাভাবিক নিয়ম আছে।  প্রাচ্য চরিত্র , প্রাচ্য শাসন নীতি সম্বন্ধে ইংরেজি গ্রন্থে ছোট-বড়, স্পষ্ট অস্পষ্ট, সঙ্গত অসঙ্গত অজস্র কটূক্তি পাঠ করিয়া শিক্ষিত সাধারণের মনে যে একটা অবমাননাজনিত ক্ষোভ জন্মাতে পারে এ কথা অল্প ইংরাজই  কল্পনা করেন।


অথচ প্রথম শিক্ষাকালে ইংরাজের গ্রন্থ আমরা বেদবাক্যস্বরূপ গ্রহণ করিতাম।  তাহা আমাদের যতই ব্যথিত করুক তাহার প্রতিবাদ সম্ভবপর , তাহার যে  প্রমান আলোচনা আমাদের আয়ত্তগত এ কথা আমাদের বিশ্বাস হইত না। নীরবে নত শিরে আপনাদের প্রতি ধিক্কার -সহকারে সমস্ত লাঞ্ছনা কে সত্যজ্ঞানে বহন করিতে হইত।


এমত অবস্থায় আমাদের দেশের যে -কোনো কৃতি গুণী ক্ষমতাশালী  লেখক সেই মানসিক বন্ধন ছেদন করিয়াছেন , যিনি আমাদিগকে অন্ধ অনুবৃত্তি হইতে মুক্তিলাভের দৃষ্টান্ত দেখাইতে পারিয়াছেন তিনি আমাদের দেশের লোকের কৃতজ্ঞতাপাত্র। 


তাহা ছাড়া প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সংঘর্ষে আমাদের ভাগে যে কেবলি কলঙ্ক সেটা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করা এবং বিরুদ্ধ প্রমান আনয়ন করা আমাদের নতশির ক্ষতহৃদয়ের পক্ষে একান্ত প্রয়োজনীয়।


 


রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক ইতিহাস চিন্তার থেকে একটি মুক্তির পথ খুঁজছেন।  তিনি মনে করছেন ঔপনিবেশিক চিন্তাই ভারতের অভ্যন্তরে হিন্দু মুসলমান বিরোধের কারণ।  সেই প্রসঙ্গে তিনি শ্রী গোপাল চন্দ্র শাস্ত্রীর লেখা 'সহরত -এ আম' প্রবন্ধের বিশেষ প্রশংসা করেছেন।  তিনি লিখছেন যে মুসলমান রাজত্বে পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্ট ছিল তাতে প্রজাদের জন্যে কৃষি কার্য্য এবং জলের সুবিধা , ডাকখানার  বন্দোবস্ত ছিল , ত্বরিৎ গতিতে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ প্রেরণ এবং সমাচারপত্র প্রকাশ। মুসলমান তথা এশিয়া   রাজত্বের সঙ্গে ব্রিটিশ রাজত্বের তুলনা করে  রবীন্দ্রনাথের কাছে মনে হয়েছিল


 


ইংরাজরাজ্যের সুশাসন ও সুব্যবস্থা যে আমাদের কাছে কলের বোধ হয় , তাহা যে অনেক সময় আমাদের কল্পনা এবং হৃদয় আকর্ষণ করিতে পারে না তাহার কারণ ইংরাজ -রাজাকার্য্যে রাজোচিত প্রত্যক্ষ ঔদার্য্য দেখিতে পাওয়া যায় না।  রাজত্ব যেন একটি বৃহৎ দোকান : সওয়াদাগরের 'একচেটে " রাজকার্য নামক মালগুলি প্রজাদের অগত্যা কিনিতে হয়। 


 


রবীন্দ্রনাথ মধ্যে  পুঁজিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে একটি অব্যক্ত  ক্ষোভ ছিল যেটা তিনি প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে নীতিবোধের শাসনের সঙ্গে বাজার অর্থনীতির শাসনের তুলনা করেছেন।  তবে  রবীন্দ্রনাথের ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা কি ছিল ? ১৮৯৮ সালে আব্দুল করিম সাহেবের মুসলমান রাজত্বের ইতিহাস সংক্রান্ত সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যা লিখছেন তাতে এক প্রাচ্যতত্ত্বের ছায়া পাওয়া যায়।  সেখানে তিনি লিখেছেন


ভারতবর্ষের প্রতিবেশে বহুতর খন্ডবিচ্ছিন্ন জাতি মহাপরুষ মোহাম্মদের প্রচন্ড আকর্ষণ বলে একীভূত হইয়া মুসলমান নামক এক বিরাট কলেবর ধারণ করিয়া উত্থিত হইয়াছিল। তাহারা যেন ভিন্ন ভিন্ন দূর্গম মরুময় গিরিশিখরের উপরে খন্ড তুষারের ন্যায় নিজের নিকটে অপ্রবুদ্ধ এবং বাহিরের নিকটে অজ্ঞাত হইয়া বিরাজ করিতেছিল।  কখন প্রসঙ্গ সূর্য্যের উদয় হইলো এবং দেখিতে দেখিতে নানা শিখর ছুটিয়া  আসিয়া  তুষারস্রুত বন্যা একবার একত্র স্ফীত হইয়া তাহার পরে উন্মত্ত সহস্র ধারায় জগৎ কে চারদিকে আক্রমণ করিতে বাহির হইলো। 


 


রবীন্দ্রনাথ এখানে মুসলমান  সাম্রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে তলোয়ারের জোরের যুক্ত করেছেন এবং ভারতকে নিরীহ শান্ত ধ্যানমগ্ন বলে উল্লেখ করেছেন।  তবে কি রবীন্দ্রনাথ মুসলমান শাসন কে বিদেশী বলে মনে করতেন।  তিনি  আবার যেন নিজে কে খণ্ডন করে  নকলের নাকাল প্রসঙ্গে  ১৩০৮ (১৯০১) সালে তাঁর দ্বারা পুনরুজ্জীবিত বঙ্গ দর্শন পত্রিকায় আষাঢ় সংখ্যায় লিখছেন


 


মুসলমান রাজত্ব ভারতবর্ষেই প্রতিষ্ঠিত ছিল।  বাহিরে তাহার মূল ছিল না।  এইজন্য মুসলমান ও হিন্দু সভ্যতা পরস্পর জড়িত ছিল হইয়াছিল।  পরস্পরের মধ্যে স্বাভাবিক আদান প্রদানের সহস্র পথ ছিল।  এই জন্যে মুসলমানের সংশ্রবে আমাদের সংগীত সাহিত্য শিল্পকলা, বেশভূষা, আচার ব্যবহার , দুই পক্ষের যোগে নির্মিত হইয়া উঠিতেছিল।  উর্দু ভাষার ব্যাকরণ গত ভিত্তি ভারতবর্ষীয় , তাহার অভিধান বহুলপরিমানে পারসিক এবং আরবি।  আধুনিক হিন্দুসংগীতও এইরূপ।  অন্য সমস্ত শিল্পকলা হিন্দু ও মুসলমান কারিগরের রুচি ও নৈপুণ্যে রচিত।  চাপকান জাতীয় সাজ যে মুসলমানের অনুকরণ তাহা নহে , তাহা উর্দুভাষার ন্যায় হিন্দু মুসলমানের মিশ্রিত সাজ; তাহা ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন আকারে গড়িয়া উঠিয়াছিল।


 


আস্তে আস্তে বিংশশতাব্দীর গোড়ায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভারতের ইতিহাস সম্পর্কিত নিজস্ব ধারায় ভারতকে এক অভিনব রসায়ানাগার হিসাবে উল্লেখ করেছেন।  ধীরে ধীরে তিনি ভারতের ইতিহাস প্রসঙ্গে একটি ধারণাই উপনীত হচ্ছেন।  সেই কথাই তিনি  পূর্ব পশ্চিম প্রবন্ধে বলেছেন যা প্রথমে প্রকাশিত হয়েছিল প্রবাসী পত্রিকাতে ভাদ্র সংখ্যা ১৩১৫ সালে (১৯০৮ )  সেই কথা দিয়ে আমি এই পর্ব শেষ করি।  রবীন্দ্রনাথ লিখছেন


ভারতবর্ষেও যে ইতিহাস গঠিত হইয়া উঠিতেছে এ ইতিহাসের শেষ তাৎপর্য্য এ নয় যে , এ দেশে হিন্দুই বড় হইবে বা আর কেহ বড় হইবে। ভারতবর্ষে মানবের ইতিহাস একটি বিশেষ সার্থকতার মূর্তি পরিগ্রহ করিবে , পরিপূর্ণতাকে একটি অপূর্ব আকার দান করিয়া তাহাকে সমস্ত মানবের সামগ্রী করিয়া তুলিবে - ইহা অপেক্ষা কোনো ক্ষুদ্র অভিপ্রায় ভারতবর্ষের ইতিহাসে নাই।  এই পরিপূর্ণতার প্রতিমা গঠনে হিন্দু, মুসলমান বা ইংরেজ যদি নিজের বর্তমান বিশেষ আকারটিকে বিলুপ্ত করিয়া দেয় , তাহাতে স্বজাতিক অভিমানের অপমৃত্যু ঘটিতে পারে , কিন্তু সত্যের বা মঙ্গলের অপচয় হয় না। 


 


রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস চিন্তার মানবিক দিক এই সময়ের পর থেকে ক্রমাগত বেড়ে গেছে।  তিনি ভারতবষের রূপ কে ক্ষুদ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের থেকে উর্ধে একটি সামগ্রিক মানবিক রূপে দেখতে চেয়েছিলেন।  তাঁর  মনে হয়েছিল উপনিবেশিক চিন্তার থেকে, সাম্প্রদায়িক বিভাজন থেকে মুক্তির উপায় এটাই। কোনো খণ্ডিত সামাজিক স্বত্ত্ব নয় পূর্ণ মানবিক সত্ত্বার অনুসন্ধান ছিল তাঁর ইতিহাস চিন্তার ধারক।

  • শুভ বসু
  • দ্বিতীয় পর্ব