১.
বৃটিশ ভারতের ‘বাস্তিল’ কালাপানির সেলুলার জেলের কথা অনেকেই জানি না। গল্পের দানবের চাইতেও ভয়ংকর নৃশংস বৃটিশ শাসকদের অকথ্য ও নির্মম অত্যাচারের স্মৃতিচিহ্নটি জানান দিচ্ছে ইতিহাসের সত্যকে। যে সত্যান্বেষণে আমরা অনাগ্রহী, যে আত্ম-অনুসন্ধানে আমাদের চরম অনীহা। পিছু ফিরে তাকালে দেখলে পাবো মুক্তির মন্দির সোপানতলে বলিদানকৃত প্রাণদের উৎসর্গের অনন্য কাহিনি। তেমনই এক অনন্য প্রাণের নাম মোহিতমোহন মৈত্র। ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম ব্যক্তিত্ব এবং অগ্নিযুগের বিপ্লবী। তিনি যুগান্তর দলের সদস্য ছিলেন। ব্রিটিশ রাজবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে অস্ত্র আইনে ১৯৩২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বৃটিশ পুলিশ তাকে কলকাতায় গ্রেপ্তার করে। তার বাড়ি থেকে রিভলভার ও গোলাবারুদ পাওয়ায় তাকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়ে দ্বীপান্তরিত করতে আন্দামান জেলে পাঠানো হয়। অবিভক্ত বাংলার পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার ভারেঙ্গা এলাকার সন্তান এই মহান বিপ্লবীর শহীদ দিবস ২৮ মে। নব্বই বছর আগে ১৯৩৩ সালের এই দিনে প্রাণ দান করেন তিনি। মহান এই বিপ্লবীর অমর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।
২.
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলা ও বাঙালির অবিস্মরণীয় ভূমিকার কথা ও কাহিনি আমরা ক’জনাই বা স্মরণে রাখি ? স্বদেশী আন্দোলন সম্পর্কেই বা কতটুকু ধারণা রাখি আমরা? ইতিহাসে অবহেলিত অনন্য স্বাধীনতা সংগ্রামী মোহিতমোহন মৈত্রকে শ্রদ্ধা জানাতে প্রাণের টানে সম্প্রতি (এপ্রিল ২০২৪) সেলুলার জেল পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। সেলুলার জেলে গিয়ে প্রতিটি ইটের আর্তনাদ শুনতে পেয়েছি আমি। বিস্মিত হয়ে জেনেছি বাঙালি কারাবন্দিদের ভূমিকা সম্পর্কেও। উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না নিশ্চয়, একই গ্রামের সন্তান হিসেবে এবং তার নামে আমার নামকরণের কথা জেনে এই মহান বিপ্লবীর প্রতি আত্মীয়তার টান অনুভব গভীরভাবে অনুভব করেই প্রচণ্ড গরমকালে শারীরিক অসুস্থতাজনিত চিকিৎসার মাঝেও চলে গিয়েছিলাম আন্দামান, কালাপানির দেশে। সেলুলার জেলের সামনে সাভারকার পার্কে স্থাপিত মোহিতমোহন মৈত্রের স্মৃতি ভাস্কর্যের পদমূলে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে পেরে, জেলের সেলে তার স্মারকচিহ্ন খূঁজে স্পর্শ নিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করেছি।
৩.
শুরুতেই শহীদ দিবসে মোহিতমোহন মৈত্রকে জানার চেষ্টা করা যাক।
১৭ মে, ১৯৩৩। পায়রার খোপের সমান জেলখানায় অনশনরত বন্দী মোহিতমোহন মৈত্র চোখ বন্ধ করে শুয়ে। সারা হাতে পায়ে লাল হয়ে আছে মার খেয়ে,কতোদিন স্নান করতে দেয়নি, ঘা হয়ে গেছে ক্ষতগুলো, রক্তজমাট কালশিটের মানচিত্র গোটা পিঠে। পাবনার এই দামাল ছেলে মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে কোন গান ধরেন এই অন্ধকার কুটুরিতে শুয়ে। হয়তো একটা পাখির আওয়াজ এলো বা সমুদ্রের শব্দ মনকে ভিজিয়ে দিলো। ওই গানটাই ২৫ বছর বয়সী ছেলেটার প্রাণ। আর প্রাণ বিপ্লব। স্বাধীন ভারত দেখে যাওয়ার। আজাদী!
১৯৩৩ সালের ঐতিহাসিক অনশন ধর্মঘটে প্রায় ৪৫ দিন চলা এবং জোর করে দুধ খাওয়ানোর কারণে তিন জন বিপ্লবী শ্বাসনালীতে দুধ প্রবেশ করায় মৃত্যুবরণ করে শহীদ হন। অনশন ভাঙ্গানোর জন্য তিন সপ্তাহ ধরে অকথ্য মারধর চলেছে তবু এক দানা মুখে দেননি পাবনার মোহিতমোহন মৈত্র, কিশোরগঞ্জের সন্তান মোহনকিশোর নমনদাস আর পাঞ্জাবের মহাবীর সিংহ। তাদের দাবী কি ছিল? ভারতের স্বাধীনতা, আজাদী!
টানা অনশন করে যাওয়ার দাবী কি ছিল তাদের? নৃশংস বৃটিশদের কাছ থেকে জেলখানায় স্রেফ মানুষের মতো ব্যবহার পাওয়া। কীটদেরও এর চেয়ে ভালো ব্যবহার করা হতো আন্দামানের সেলুলার জেলে। রাতের পর রাত না খাইয়ে ফেলে রাখা হতো, বরফের চাইয়ের উপর শুইয়ে রেখে চলতো অকথ্য অত্যাচার। ঠাঠা রোদে দাঁড় করিয়ে অজ্ঞান না হয়ে যাওয়া অবধি চলতো চাবুক মারা,ঘন্টার পর ঘন্টা টানা ঘানি টানতে বাধ্য করা হতো। নারকেল পিষে রোজ ২৫ কেজি তেল বানাতে হতো, নইলে দেওয়ালের হুক থেকে ঝুলিয়ে ডান্ডা দিয়ে পেটানো হতো। এই সব কিছু করা হতো কারণ তাদের অপরাধ ছিল তারা স্বাধীনতা সংগ্রামী আর ব্রিটিশ ভাবতো এসব করে ওদের মনবল ভেঙে দেবে বা মুচলেকা দিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেবে। দেশপ্রেমী, স্বাধীনতা পাগল ছেলেগুলোর কথা ভারতবর্ষ স্মরণ করে না তাই আমরাও মনে রাখিনি এদের জীবনদানের বিনিময়েই পাওয়া ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা, ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম।
৪.
বাংলায় গড়ে ওঠা বিপ্লবী যুগান্তর দলের সক্রিয় কর্মী ছিলেন মোহিতমোহন মৈত্র। বয়স ২৫ এর মতো। বাংলার মোহন কিশোর নমোদাস এবং মোহিত মোহন মৈত্র- এই দুই যুবক ছিলেন অত্যন্ত আমুদে প্রকৃতির, হৈচৈ করে আসর জমিয়ে রাখতেন তাঁরা। স্বাধীনতার সংগ্রামে সামিল হওয়ায় সেলুলার জেলে পাঠানো হয়। সেখানেই শুরু হয় অনশন। ১৯৩৩ সালের ১৭ মে। অনশনরত মোহন মৈত্রের সেলে ঢোকে জেল কর্তৃপক্ষ। জোর করে খাওয়াবেই, মোহনও খাবে না। তাদের বুকে, পেটে ও হাঁটুতে চেপে বসে তিনজন, মাথাটা একজন সেপাইয়ের দু’পায়ের মাঝখানে ঠেসে ধরে, তারপর নাক দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় পুরু নল। মোহন মৈত্র প্রতিরোধের আপ্রাণ চেষ্টা করে কিন্তু সেদিন বর্বরতা ও জবরদস্তি এতোটাই চরমে ওঠে একা শীর্ণ শরীরে আর পেরে ওঠে না। জোরে তারা নল ঢুকিয়ে দেয় নাকে, মুখে। কিন্তু তা গলনালি দিয়ে না ঢুকে শ্বাসনালিতে ঢুকে যায় এবং তা থেকে জ্বর ও পরে নিউমোনিয়া হয়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। দশদিন যমে মানুষে টানাটানি চলে। এটা চলার আরেকটা কারণ মোহন মৈত্রের ওষুধ বা খাবার না খাওয়ার জেদ। সাহেব ডাক্তার হাতজোড় করে বলে অনেক তো হলো এবার ওষুধটা খেয়ে নাও। মোহন মৈত্র মুচকি হেসে বলেছিল, I am still on Hunger Strike. My Comrades are not eating. দশ দিন নিউমোনিয়ার সাথে লড়াই করে মোহিত চির নিদ্রামগ্ন হলেন। মৃত্যুকে আহ্বান করে নিয়ে এলেন মহাবীরের মতো। দিনটা ছিল ১৯৩৩ সালের ২৮ মে। বাঙালির শোকের দিন।
৫.
পরিবারের কাছে মোহিত মৈত্রের মরদেহটাও পাঠানো হয়নি। পাথরে বেঁধে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলা হয়। আমরা যেভাবে আমাদের বীর যোদ্ধাদের ইতিহাস ছুঁড়ে ফেলেছি আস্তাকুঁড়ে। আমরা ভুলে গেছি এদের। স্বার্থপর হয়ে হয়তো এরা ক্ষমা চেয়ে নিলে, ক্ষমতার লোভ করলে স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক নেতা হিসেবে স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে থাকতেন আমাদের মাঝে। রবি নিয়োগী, বটুকেশ্বর দত্ত, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, উল্লাসকর দত্ত, মোহিতমোহন মৈত্র, ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, বীরেন্দ্র চন্দ্র সেন, সূর্য সেনের সহযোগীদের মনে থাকতো। আমরা ভুলে গেছি হয়তো স্বাধীনতাটা রক্ত দিয়ে এসেছিল। এই দামাল ছেলেগুলোর রক্তে লেখা, ফাঁসিকাঠে হাসিমুখ আঁকা। আমরা মোহিতমোহন মৈত্রদের ভুলে যাবো? বিস্মৃত হবো চিন্তায় ও সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী বাঙালিদের অবিস্মরণীয় সক্রিয় ভূমিকাকেও? সেলুলার জেলের পরিবেশিত তথ্যানুযায়ী পঞ্জাবের মোট ১০১ জন এবং বাংলার মোট ৪০৬ জন বন্দির নাম পাওয়া যায়। অনুপ দাশগুপ্তের লেখা ‘সেলুলার জেলে নির্বাসিত বিপ্লবীদের কথা’ গ্রন্থে এই তালিকা বিস্তারিত দেওয়া আছে। সেলুলার জেলের প্রায় সাত শত বন্দির মধ্যে চার শতাধিকই ছিলেন বাংলার বিপ্লবী। জেলের মধ্যে বন্দিদের প্রদেশভিত্তিক নামের তালিকা এবং জাদুঘরে সংরক্ষিত তথ্যেও এমনটিই পাওয়া যায়। যে রাজবন্দি স্বাধীনতা সংগ্রামীরা সেলুলার জেলে ‘দ্বীপান্তর’ সাজায় বন্দি ছিলেন তার পরিসংখ্যান ও তালিকা ওই জেলেই টাঙানো, ৮০% যে বাঙালি ও প্রায় ১৭% যে পঞ্জাবি এ তো সরকারি তথ্য। আলিপুর বোমা মামলার সাজাপ্রাপ্ত উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নির্বাসিতের আত্মকথা’ বই থেকে সেলুলার জেলের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতায় প্রাদেশিকতা ও সাম্প্রদায়িকতার চেয়ে বাঙালিত্ব পরিচয় বড় হয়ে ওঠার পরিচয় পাই। তিনি লিখেছেন, ‘আমরা হিন্দু মুসলমান সকলকার হাত হইতেই নির্বিচারে রুটি খাই দেখিয়া মুসলমানেরা প্রথম প্রথম আমাদের পরকালের সদগতির আশায় উল্লসিত হইয়া উঠিয়াছিল, হিন্দুরা কিঞ্চিৎ ক্ষুণ্ণ হইয়াছিল; শেষে বেগতিক দেখিয়া উভয় দলই স্থির করিল যে আমরা হিন্দুও নই মুসলমানও নই আমরা বাঙালী। রাজনৈতিক কয়েদী মাত্রেরই শেষে সাধারণ নাম হইয়া উঠিল- বাঙালী।’
৬.
প্রখর রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে টানা ছয় ঘণ্টা ধরে অমানুষিক পরিশ্রম করে মোহিতমোহন মৈত্রের দু’হাত রঞ্জিত হয়ে উঠেছে নিজের রক্তেই। সমান তালে, অবিরামভাবে নারিকেল ভেঙে তার ছোবড়া থেকে আঁশ বের করার কাজটি করতে করতে ঘেমে নেয়ে উঠেছে তার পুরো শরীর। গলা শুকিয়ে একদম কাঠ হয়ে গেছে। এক মুহূর্তের জন্য কাজ থামিয়ে পাহারাদারকে বলেছিলেন এক গ্লাস পানি দিতে। পানি তো মিললই না, বরং পাহারাদারদের মুহুর্মুহু টিপ্পনীর সাথে শুরু হলো নতুন এক পাশবিক খেলা। হাতে-পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরানো মোহিতমোহনকে বলা হলো, হেঁটে গিয়ে পাশের নদী থেকে সবার জন্য পানি আনতে হবে। কাঁটাগাছে ভরা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কিছুদূর হেঁটে যেতেই তার ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত শরীর থেকে নেমে এলো রক্তের ধারা। জ্ঞান হারিয়ে সেখানেই পড়ে রইলেন। অমানবিক সেলুলার জেলের ঘানি টানতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন মোহিতমোহন মৈত্রদের মতো অসংখ্য রাজনৈতিক বন্দী। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে এমন সম্ভাবনাময় তরুণদের শাস্তি হিসেবে পাঠানো হতো বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত আন্দামান সেলুলার জেলে। সাধারণ মানুষের কাছে জেলখানাটি ‘কালাপানি’ নামেই অধিক পরিচিত। ‘কালা’ বলতে এখানে মৃত্যুকেই বোঝানো হয়, আর বঙ্গোপসাগরের উপকূলে অবস্থিত হওয়ায় নামের সাথে যুক্ত হয়েছে ‘পানি’।
৭.
ইংরেজ আমলে ভারতে, বিশেষত বাংলার ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবীদের আটকে রাখার জন্য যে ক’টি কুখ্যাত বন্দিশিবির তৈরি করা হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে কালাপানি অন্যতম। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারীদের, প্রতিবাদী ও আন্দোলনকারী ব্যক্তিবর্গকে বন্দী করে রাখতেই নির্মাণ করা হয়েছিল কালাপানিতে সেলুলার জেল। ভারতের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগরে এর অবস্থান। ৫৭২টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। কলকাতা ও মাদ্রাজ থেকে যথাক্রমে ১,২৫৫ এবং ১,১৫১ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের বুকে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত এই সেলুলার জেলটি। ১৮৫৭ সালে সংঘটিত সিপাহী বিদ্রোহের সময় থেকেই আন্দামান দ্বীপপুঞ্জকে বন্দীশিবির হিসেবে ব্যবহার করে আসছিল ব্রিটিশরা। তবে সে সময় আলাদা করে কোনো কারাগার নির্মাণ করা হয়নি। ১৮৮৯ সালের ১২ জুন ভারতবর্ষের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে এ কয়েদখানাসংবলিত উপনিবেশটি গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অবশেষে ১৮৯৩ সালে সেই উপনিবেশের অংশ হিসেবে সেলুলার জেল নির্মাণের কাজে হাতে দেয়া হয়। মাত্র তিন বছরের মধ্যে ১৮৯৬ সালে, প্রায় ছয়শ কয়েদির দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয় কালাপানির। এ যেন নিজের হাতে নিজের কবর খুঁড়ে বাকিদেরও সেই কবরে শোয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া। ব্রিটিশ বিরোধী প্রথম এই আন্দোলনে ব্রিটিশদের সাথে খুব একটা কুলিয়ে উঠতে পারেননি বিদ্রোহীরা। বেশিরভাগ বিদ্রোহীকে দমন করা হয় হত্যার মাধ্যমে, বাকিদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডস্বরূপ নির্বাসনে পাঠানো হয় আন্দামানে। আন্দামান সেলুলার জেলে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মেয়াদে যেসব বিখ্যাত বিপ্লবী বন্দিজীবন যাপন করেছেন, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৩৭-৩৮ সালের দিকে মহাত্মা গান্ধী এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যস্থতায় মুক্তিকামী কয়েদীদের স্থানান্তরিত করার উদ্যোগ নেয় ব্রিটিশ সরকার। উল্লেখ্য,১৯৪২ সালে জাপান সরকার আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ থেকে বিতাড়িত করে ব্রিটিশদের। সে সময় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তার ‘আজাদ হিন্দু ফৌজ’ নিয়ে ১৯৪৩ সালের ৭ নভেম্বর এ দ্বীপটিকে দখল করে স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেন।
৮.
সেলুলার জেলের বিল্ডিংটিতে সাতটি উইং ছিল, বাইসাইকেলের চাকার মতো সবগুলো উইং গিয়ে মিলিত হয়েছে একটি বিন্দুতে। তিনতলা উইংগুলোতে মোট সেলের সংখ্যা ছিল ৬৯৩টি। প্রতিটি সেলে মাত্র একজন করে কয়েদী থাকতো, কেউ কারো মুখ দেখবে এমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সারাক্ষণ সেখানে প্রহরায় থাকতো অসংখ্য প্রহরী। জরুরী অবস্থার জন্য ছিল বিশালাকৃতির অ্যালার্ম। ১৯৬৯ সালে বিল্ডিংটিকে জাতীয় স্মৃতিসৌধ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। বর্তমানে এটি ভারত ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষের কাছে দর্শনীয় স্থান হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করেছে। এখানে বিভিন্ন গ্যালারিতে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছবি এবং স্মারকচিহ্ন সংরক্ষিত আছে। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে ভারত ভূখণ্ডের অংশ বলেই মনে করা হতো না। রাজবন্দীদের আন্দামানে পাঠিয়ে তাদের মনোবল ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়াই ছিল ব্রিটিশদের মূল উদ্দেশ্য। তারপরও মুক্তিকামী মানুষকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি ব্রিটিশরা। কোনো অপশক্তি পারেনি তাদের রুখতে। সেজন্যই স্বাধীন হতে পেরেছে ভারত, কালক্রমে স্বাধীনতা পেয়েছে বাংলাদেশ।
৯.
আগেও জেনেছি মোহিতমোহন মৈত্রের জন্ম পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার ভারেঙ্গা গ্রামে। তার পিতার নাম হেমচন্দ্র মৈত্র। তার জন্ম তারিখ কিংবা সাল সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা সম্ভব হয়নি। তার জন্মস্থান পাবনায় তাকে নিয়ে কোন স্মারকস্মৃতি স্থাপিত না হলেও মোহিতমোহন মৈত্রের নামে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার পাইকপাড়ায় একটি নাট্যমঞ্চ স্থাপিত হয়েছে ‘মোহিত মৈত্র মঞ্চ’ নামে। এছাড়াও মোহিতমোহন মৈত্রকে স্মরণ রেখে জলপাইগুড়িতে একটা মফস্বল এলাকার নাম রাখা হয়েছে মোহিত নগর বলে। সেখানকার মোহিত নগর রেল স্টেশনও তারই স্মরণে নামকরণকৃত। মোহিতমোহন মৈত্রের আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেই কলকাতায় বিশেষ করে নৈহাটিতে বসবাস করছেন বলে জানতে পেরেছি। আবারো শহীদ দিবসে মহান এই বিপ্লবীর অমর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।
(তথ্যসূত্র: আন্দামানের সেলুলার জেল : রতন চন্দ্র কর, এপ্রিল ২০১৮ এবং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ইন্টারনেট)