নববর্ষ অর্থাৎ, নতুন বাংলা পঞ্জিকা, দিনপঞ্জি ( ক্যালেন্ডার) মিষ্টিমুখ, নতুন ধুতি পাঞ্জাবি, সুতির শাড়ি, নতুন ব্যঞ্জন। নববর্ষ অর্থাৎ, গুরুজনদের প্রণাম জানান, যাদের সঙ্গে সারা বছর যোগাযোগ নেই তাদের সঙ্গেও অন্তত একটা বার্তা, শুভেচ্ছার আদান প্রদান। নববর্ষে অর্থাৎ, দরজায় আম পল্লব, কদমফুল সাজানো, মঙ্গল ঘট স্থাপন, সিঁদুর টিপের হালখাতা, লক্ষ্মী গনেশ মূর্তি স্থাপন ও পূজা। আরও অনেক ঐতিহ্য বহমানতা এখনও কাশীর বাঙালী ধরে রেখেছে।
এই বাংলা নব বর্ষের আরম্ভ শশাঙ্কের সময়ের। ডক্টর রাজলক্ষী বসুর মতে, আমাদের ঔন্যাসিকতা এইযে আমরা সে ইতিহাস তেমন একটা চর্চাই করি না। পশ্চিমবঙ্গের বুকে কেমন ভাবেই বা চর্চা হবে সে ইতিহাস, যে ইতিহাস বলে, প্রকৃত সত্য প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠিত করে এই নববর্ষ আসলে হিন্দু সম্রাট শশাঙ্কের তৈরি। আকবরের নয়। পশ্চিমবঙ্গে যখন থেকে ঘটা করে সাংস্কৃতিক চর্চার অবকাশ তৈরি হল অর্থাৎ বাম আমলে, তখন থেকেই শুরু হয়েছে অর্ধসত্য ইতিহাসের প্রচার ও পঠন পাঠন। তখন থেকেই বাঙালিদের শেখান হল আক্রমণকারী মুঘলরা গ্রেইট। ইতিহাসে বড়ো প্রশ্ন মানেই শাহাজাহান ও আকবর। শশাঙ্ক? ওটা অপশনাল নোট তৈরি করো। সময় যদি কম থাকে তখন ছোটো করে লিখে পরীক্ষার খাতা জমা দেওয়ার জন্য শশাঙ্কের দরকার হত। ইতিহাসে শশাঙ্কের অধ্যায় ছিল না বাম আমলে। টীকা লেখা হত। তাই শশাঙ্কের কীর্তি-খ্যাতি-বীরত্ব-রাষ্ট্রবোধ ইতিহাসের পাতায় অবমূল্যায়িত হল। আকবর গ্রেইট তাই বঙ্গাব্দের সূচনাটাও আকবরই করল, এমন এক ইতিহাস ন্যারেটিভ বিকৃত দলিল জবরদখল করল। ইংরেজি দিনপঞ্জি অনুসারে শশাঙ্ক হলেন ছয়ের শতকের, সেই সময় কাশী আগমন শশাঙ্কের। আমরা দেখে নেবো এই নব বর্ষ বরণে কাশীর বাঙালিরা কি আয়োজনে ব্যাস্ত।
এই নববর্ষে সকাল হতেই মেয়েরা নতুন বস্ত্র ধারণ করে হাতে পুজোর সরঞ্জাম নিয়ে মন্দির প্রাঙ্গণে উপস্থিত। কেউ শবশিবা মন্দির তো কেউ কেদার মন্দির। এই ভাবেই কাশীর নানা দেবালয় জঙ্গম হয়ে থাকবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের কাশী কবিতায় লিখলেন এক মিঠাই এর কথা -
কাশীর গল্প শুনেছিলুম যোগীনদাদার কাছে,
পষ্ট মনে আছে।
আমরা তখন ছিলাম না কেউ, বয়েস তাঁহার সবে
বছর-আষ্টেক হবে।
সঙ্গে ছিলেন খুড়ি,
মোরব্বা বানাবার কাজে ছিল না তাঁর জুড়ি।
দাদা বলেন, আমলকি বেল পেঁপে সে তো আছেই,
এমন কোনো ফল ছিল না এমন কোনো গাছেই
তাঁর হাতে রস জমলে লোকের গোল না ঠেকত–এটাই
ফল হবে কি মেঠাই।
তাহলে এই নববর্ষে কাশীর কিছু মিঠাই ও মিষ্টান্ন ভান্ডারের কথা বলি, লক্ষির ভান্ডারের কথা এখনও কাশীতে ছড়ায় নি। আমার প্রিয় অধ্যাপকের মধ্যে একজন শ্রী সত্যজিৎ সরকার ( নু টু কা কু )। তাঁর কাছে কিছু ক্ষন থাকা মানে, নতুন ভাবনার আমন্ত্রণ। আজ বললেন কাশীর বঙ্গ সমাজে মিষ্টি বা মিষ্টির প্রতিষ্ঠান গুলির অবদানের কথা কখনো ভেবে দেখেছিস?
বাঙালির খাওয়া-দাওয়ায় মিষ্টি অতি জনপ্রিয়। যে-কোনও উৎসব-অনুষ্ঠানে শেষ পাতে মিষ্টি ছাড়া ভাবতেই পারে না বাঙালি। সত্যি ত এই দিকটা ভেবেই দেখা হয়নি।
আজ কাশীতে অনেক মিষ্টির দোকান। সেই ভিড়ের মধ্যে দু এক নাম লোকেদের মুখে লেগে থাকে। যেমন রসগোল্লা খাবার ইচ্ছে হলে। কেদার ঘাটের ‘হরগৌরী ভান্ডার’ আজ সেই দীর্ঘ দিনের দোকান যদিও বন্ধ।চম চমের জন্য বিখ্যাত, কলিতলার কাছেই সুধীর মিষ্ঠান। অবশ্য নাগ মিষ্ঠান্ন নিজের এক পরিচিতি গড়ে তুলেছে গজার জন্য। গুড়ের সন্দেশ - এর জন্য, গির্জা ঘরের পাশে পাণ্ডে ধর্মশালার গায়ে লাগা ছোট্ট দোকান মৌচাক। জলযোগের নাম লোকে আজো মনে রেখেছে। কেকের জন্য সোনার পুরা - ভেলু পুরা রোডের মাঝেই রয়েছে সম্রাট বেকারী। বাঙালী খাবার চাইলে - দশাশ্বমেধ বোর্ডিং, নিল রতন ব্যানার্জি স্কয়ার ( গীর্যাঘর ) এর কাছেই ক্যালকাটা হোটেল। চৌসোট্টি মন্দিরের অনতি দূরেই গোল্ডেন স্পোর্টিং ক্লাব ঘরের পাশেই অমর বোস মহাশয়ের রেস্টুরেন্ট লজিজ বাইট। সোনার পুরা অঞ্চলে গণেশ মন্দিরের কাছেই অভয় ঘোষ মহাশয়ের খাবার হোটেল ঘোষ রেস্টুরেন্ট। রোডের ওপর সুশান্ত ভট্টাচার্য্য পরিচালিত বর্ণালী হোটেল, হরিশচন্দ্র রোডের ওপর দাদাস কিচেন আর শিবালয় রয়েছে অঙ্কালস কিচেন।
এবার কিছু অলঙ্কার আর বস্ত্র প্রতিষ্ঠান গুলোর কোথায় আসি। বাংলার বস্ত্রের জন্য রয়েছে, বকুল বস্ত্রালয় ( রানা মহল ঘাটের কাছে), রানী ভবানী পোস্ট অফিসের কাছে খান্না, ঋষভ বস্ত্রালয়, ঋষিকা সিল্ক হাউস, পান্ডে ঘাটের ওপর রিংকু সিল্ক হাউস, এই প্রতিষ্ঠানের কর্নধার বাঙালী টোলা অঞ্চলের পর্ষদ পদে অধিষ্ঠিত। মদন পুরা রোডের ওপর রয়েছে মেট্রো স্টোর। আলংকারিক আছেন অনেক তাদের মধ্যে অন্যতম ধারা ব্রাদার্স, এই প্রতিষ্ঠানের বয়স এক শত বছরের অধিক।
পয়লা বৈশাখ মানে হারমোনিয়াম নিয়ে গেয়ে ওঠা 'এস হে বৈশাখ'। শুধু রবীন্দ্র সংগীত নয়, থাকবে নজরুল, দ্বিজেন্দ্রর সঙ্গে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত।
নব প্রজন্মের তবলা বাদক বব ভট্টাচার্য জানালেন, বর্ষ বরণের আয়োজন আমরা পয়েলা বৈশাখের পূর্ব সন্ধ্যা থেকেই করেছি। লয় কুঞ্জ সঙ্গীত একাডেমী প্রয়াত পণ্ডিত নীলকন্ঠ শাস্ত্রী মহাশয়ের জন্ম বার্ষিকী তে এক সঙ্গীত সভার আয়োজন করেছে। অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি কিংবন্তি শিল্পী পণ্ডিত কিশন মহারাজের সুপুত্র তবলা বাদক পণ্ডিত পুরন মহারাজ থাকছেন। সঙ্গীত পরিবেশন থাকছেন বর্ষা বসাক, প্রিয়াংশু ঘোষ ( গায়ন ), রণিত চ্যাটার্জি ( সেতার), তবলায় থাকছেন বব ও জয় দে’র মত শিল্পী।
সন্ধ্যে বেলায় কাশীর সর্ব প্রথম বারোয়ারী দুর্গা পূজার শিরোপা যেই সংগঠনের মনে বারাণসী দুর্গোৎসব সম্মিলনী (১৯২২) সঙ্গীতানুষ্ঠান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রণদামামা স্তব্ধ হওয়ার অব্যবহিত পরেই ১৯২১ সালের শারদীয় শুভলগ্নে অঙ্কুরিত হয় বর্তমানের বারাণসী দুর্গোৎসব সম্মিলনী। শুরু হয় প্রাচীন নগরী কাশীতে প্রথম সর্বজনীন দুর্গাপুজো।
সম্মিলনীর সূতিকাগার ছিল নদেশ্বরের মিন্ট হাউস এবং সেই পূজার উদ্যোক্তা ছিলেন তৎকালীন বঙ্গসমাজের মুকুটমণি ও কাশীনরেশের সচিব রায়বাহাদুর ললিত বিহারী সেন। সঙ্গে ছিলেন সুরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ভূপেন্দ্র বিশ্বাস, চন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। কিন্তু পূজাস্থল বাঙালিদের আবাসস্থল থেকে বহুদূরে হওয়ায় শহরের কিছু উৎসাহী পরের বছর বারোয়ারি দুর্গাপূজা শুরু করেন পাঁড়ে হাউলির সি.এম.অ্যাংলো বেঙ্গলি প্রাইমারি স্কুল প্রাঙ্গণে। তারপর দুটি পূজা মিলে এক হয় ১৯২৩ সালে। শ্রীযুক্ত হরিকেশব সান্যাল মহাশয় সংস্থার নামকরণ করেন বারাণসী দুর্গোৎসব সম্মিলনী। সঙ্গীতানুষ্ঠানের শেষে মিষ্টি মুখ। বলতে দ্বিধা নেই পয়লা বৈশাখ এক অনন্য অনুভূতি। কারণ আমরা বাঙালি, আমাদের নিজস্ব একটি উদযাপনের দিনগুলির মাঝে আছে নববর্ষ। হাতে মিষ্টির বাক্স আর একখানা দিনপঞ্জি (ক্যালেন্ডার) নিয়ে বাড়ি ফেরার আনন্দই আলাদা। এক অমোঘ অনুভূতি সৃষ্টি করে।