হারুদার কথা, হারুদাদের কথা

ঘোষদা যখন শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন, তখন ও সেটা আশ্রম ছিল বহিরঙ্গে। অন্তরঙ্গে আশ্রম সত্তা তো রবি অস্তমিত হওয়া মাত্র ই পশ্চিম গগনে হেলে পড়তে শুরু করেছিল। এখন যেমন মাঝে মাঝে সঙ্গীত ভবনের সামনে বাঁকে করে দূর দূর গাঁ থেকে মানুষজনেরা দৈ আর ক্ষীর আনে, তেমন ভাবেই বাঁকে করে নিজের হাতে তৈরি মিষ্টি আনতেন ঘোষদা।অনেকটা বিভূতিভূষণের ,' পথের পাঁচালি' র ' চিনিবাসে' র মত। কলাভবনের ছাত্র যখন সত্যজিৎ, সেকালের শান্তিনিকেতনে জানি না চিনিবাসের মত লোকজনের আশ্রম চত্ত্বরে আনাগোনা ছিল না।তবে ঘোষদা নিশ্চয় ই ,' পথের পাঁচালী ' ফিল্ম দেখেন নি, কারন; ঘোষদার মেঠার ভরা বাঁকে বা তাঁর হাতে ফিল্মের চিনিবাসের মত ঘুঙুর থাকত না।


এখন অবশ্য দূর দূর গাঁ থেকে যাঁরা বাঁকে করে মিষ্টি আনেন, তাঁরা আর সঙ্গীত ভবনের আশেপাশে ভিড় জমান না।কারন, সেখানে বিক্রি হয় না।ভিড় জমান তাঁরা সোনাঝুরি হাটে।আজকের শান্তিনিকেতনের বোধহয় সবথেকে বড় আকর্ষণ এই সোনাঝুরির হাট।রবীন্দ্রনাথের থেকেও বড় আকর্ষণ।সাঁওতাল রমনীদের সঙ্গে বিদূষী কলকাত্তাইয়া রমনীদের ভুলভাল ফুট স্টেপিংসে নাচ, তার ফটো তোলা, ভিডিও করা- এটাই এখন টুরিস্টদের কাছে শান্তিনিকেতনের আকর্ষণ।শান্তিনিকেতন এখন সপ্তাহান্তিক ছুটিতে তারাপীঠে গিয়ে পৌজার্চনা, পান- ভোজন, কপালে বড় করে সিঁদুরের তিলক দিয়ে, কঙ্কালীতলায় আবার পুজোপাঠ করে , সোজ্জা সোনাঝুরি হাট। আদিবাসী রমনীদের নাচের তালে পা মেলানো।সম্ভব হলে তাঁদের যোগাযোগের মাধ্যম জানা।কারন, পাড়ার দুগ্গা, জগদ্ধাত্রী বিসর্জন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলের মিছিল-- সব কিছুতেই এখন বেশ ঠাঁই করে নিয়েছে ধামসা - মাদল।ঠাঁই করে নিয়েছে আদিবাসী মহিলাদের নাচ।সেখানে যদি বলতে যাওয়া হয় , অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার লাইন,' পাষাণে মোড়ানো নগর হৃদয়, জন্মে না কিছু অন্ন, এখানে তোমরা আসবে কিসের জন্য', যিনি বলবেন অমন কথা, লোকে তাঁকে ' পাগল' ঠাওড়াবে।


                   ঘোষদার একবার দৈ , মিষ্টি পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল সেবাপল্লীতেই মুকুলদার ( দে) বাড়িতে। কাজের চাপে ভুলে গেছেন ঘোষদা।তখন ও সেবাপল্লীর বাসিন্দা নন ঘোষদা।' ঘোষদার দোকান' তো দূর অস্ত।গাঁয়ে ফিরে যাওয়ার পর মনে পড়েছে, এই যাঃ, মুকুলদাকে তো মিষ্টি পাঠানো হয় নি।ছেলে হারুকে দিয়ে দৈ , মিষ্টি পাঠিয়ে দিলেন ঘোষদা মুকুল- বীণার বাড়ির উদ্দেশে।


                    শিল্পী মুকুল দে হঠাৎ দেখেন ছোট একটা ছেলে ঢুকে পড়েছে বাড়ির ভিতরে।তিনি ঘোষের পো কে তখন ও চিনতেন ই না।ফলে ভাবলেন কোনো দুষ্টু ছেলে হয়তো ঢুকে পড়েছে বাড়িতে।লাঠি নিয়ে তাড়া করলেন মুকুল দে। ঘোষদার ছেলে তখন বাবার পাঠানো মিষ্টি , দৈ সব মুকুল দের উঠোনে ফেলে , মুকুলদার লাঠির হাত থেকে বাঁচতে চোঁ চ্যাঁ দৌড়।মুকুলদা তো লাঠি হাতে তাড়া করেছেন ছেলেটিকে , কিন্তু ওই টুকু ছেলের গতির সঙ্গে শারীরিক ভাবে অনেকটাই নুব্জ হয়ে পড়া শিল্পী তখন আর পারবেন কি করে?


মুকুলদা দৌড়তে গিয়েই মুখোমুখি হয়ে পড়লেন ঘোষদার।অমন মারমুখো হয়ে মুকুল দে কে দৌড়তে শান্তিনিকেতনে কেউ কখনো দেখে নি।তবে সন্ধ্যের মুখে সেকালর শান্তিনিকেতনে লোকজন বেশি ছিল না।কিন্তু ঘোষদার মুখোমুখি হয়ে মুকুল দে শান্তিনিকেতনের পরিবেশ কেমন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ছিঁচকে চোরের উপদ্রব বাড়ছে-- এসব নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন তখন।



ঘোষদা তো ততক্ষণে বুঝে গেছেন কি ঘটনা ঘটেছে।তিনি যে সবটা খুলে বলবেন মুকুলদাকে, মুকুল দে , সেই ফুরসত ঘোষদাকে দিলে তো! মনের সুখে তখন পালিয়ে যাওয়া ছেলেটার উদ্দেশে অগ্নিবর্ষী কথা ছুঁড়ে চলেছেন মুকুল দে।


তখন ও যেন শান্তিনিকেতনের বুকে ছড়িয়ে রয়েছে গুরুদেবের পদচিহ্ন।তাঁর সান্নিধ্যে কাটানো মানুষজনেরা ছড়িয়ে রয়েছেন গোটা আশ্রমের ইতিউতি। শান্তনিকেতন ছাপিয়ে নোতুন গজিয়ে ওঠা উপনগরী তখনো তৈরি হয় নি।পাঁচিল দিয়ে আশ্রম চত্ত্বর ঘিরে দেওয়া - তখন শান্তিনিকেতনের মানুষ স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন না।সবুজ তখন আপন মাধুর্যে আধমরাদের ঘা দিয়ে বাঁচাচ্ছে।


এমন সময়েই ঘোষদা সেবাপল্লীতে অন্নদাশঙ্করের ' ইতি' র ঠিক সামনে বাড়ি করলেন।প্রথমে বোধহয় পাকা ঘর ছিল না।ঘোষদার দোকান টি পাকাঘরের ছাউনির নীচে এসেছে বেশ অনেককাল পরে।যদি খুব ভুল না করি, আটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ঘোষদার দোকানের ছাউনি পাকা হয়েছে।


ঘোষদা সত্যিই মিষ্টি তৈরির অন্ধিসন্ধি জানতেন।পুরনো আশ্রমিকদের বাড়ি বাড়ি দীর্ঘদিন বাঁকে করে মিষ্টি দেওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে ঘোষদা বুঝেছিলেন, পুরনো মানুষদের মধ্যে রসগোল্লার চাহিদাটা বেশিই রয়েছে।বোলপুরে বিচিত্রা সিনেমা হলের কাছে ভোলানাথ সুইটস খোলার পর ও রসের মিষ্টির আকাল শান্তিনিকেতনে বেশ ভালোরকম ই ছিলো। এই সময়ে ঘোষদার হাতের গুণে শান্তিনিকেতনের প্রায় প্রতিটি ঘরেই তাঁর তৈরি মিষ্টি হয়ে উঠল নিত্য সঙ্গী।


শান্তিনিকেতনের বহু পুরনো কালোর দোকান,  যা গুরুদেবের সময় থেকেই শান্তিনিকেতনের আত্মার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল, সেই দোকানের সঙ্গে খানিকটা চরিত্রগত পার্থক্য রেখেই সেবাপল্লীর দোকানটা শুরু করলেন ঘোষদা। সঙ্গী পুত্র হারু ,ঘোষ দার দোকান যখন জমে উঠতে শুরু করেছে সেবাপল্লীর বুকে ,আর তাঁকে বাঁকে করে মিষ্টি বেচতে হয় না শান্তিনিকেতনের মানুষদের দোরে দোরে, শান্তিনিকেতনের মানুষরাই এসে কিনে নিয়ে যান তাঁর দোকান থেকে নানা রকমের মিষ্টি। তাঁর দোকানের দই এর প্রসিদ্ধিও গোটা শান্তিনিকেতন জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ।


           তখন কৈশোর উত্তীর্ণ হারু,  বাবার দোকানের সঙ্গে শান্তিনিকেতনের অধিবাসীরা ছাড়াও ,শান্তিনিকেতনে পড়তে আসা ছাত্রদের একটা সংযোগ তৈরি করলেন। আজকাল ম্যানেজমেন্ট পড়া ছেলেপুল মেরা এটা যাকে বিজনেস প্রমোশন বলে, সেই' বি পি'র কাজটা প্রথাগত শিক্ষা তেমন একটা কিছু না পাওয়া ঘোষ পুত্র হারু, তার নিজের বাকপটুত্বের  ভেতর দিয়ে এমন একটা জায়গায় এনে দাঁড় করাতে পেরেছিল ,যেখানে আটের দশকের শেষ দিক,  যখন এত চকচকে দোকানপাটের পত্তন শান্তিনিকেতন কে ঘিরে ঘটেনি ।বাজার অর্থনীতির জেরে শান্তিনিকেতন তার নিজস্ব আশ্রমিক চরিত্র সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেনি। সেই সময়কালে যেমন ব্যবসার দিকেও একটা সাফল্য ঘোষদার ঘরে তাঁর পুত্র তুলতে পেরেছিল। ঠিক তেমনি ই, শান্তিনিকেতনের নিজস্ব যে বৈশিষ্ট্য, মানুষের সঙ্গে মানুষের একটা রক্তের সম্পর্ক ব্যতিরেকে আত্মার আত্মীয়তা তৈরি করা ।যে উদ্দেশ্য ঘিরে গোটা জীবন ধরে লড়াই করে গিয়েছিলেন গুরুদেব বা তার প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে আসা মানুষ জনেরা। সেটাকেই যেন একটা অদ্ভুত নতুন আঙ্গিকে পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে দিয়েছিলেন ঘোষদা আর হারুদা।


               অত দিনে মিষ্টির সঙ্গে আরও বেশকিছু জিনিস যুক্ত হয়েছে সে দোকানের বিক্রির তালিকাতে। কচুরি ,ঘুগনি, ডিম- টোস্ট । চা তো ছিলই ।এ সবই ধীরে ধীরে শান্তিনিকেতনের জল মাটির গুণের সঙ্গে ঘোষদার দোকান কে বাইরে থেকে পড়তে আসা ছেলেমেয়েরা, বিশেষ করে বিদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে একটা অন্যরকমের আকর্ষণের বিষয়বস্তু করে তুলল ।



                 ঘোষদা তখনো বেঁচে ।এই কলমচি,  অন্নদাশঙ্কর বা লীলা রায়ের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে গেলেই আটের দশকের শেষকাল থেকে নয়ের দশকের একদম প্রথম যুগ, যতদিন লীলা রায় জীবিত ছিলেন,  স্টেশনে নেমে ,এক -দুই পাউন্ড প্লেন পাউরুটি  কেনবার স্মৃতি ,আর সঙ্গে ঘোষদার দই,  তাই দিয়ে দুপুরের খাবার --এই রোমান্থানে আজও কেমন উদাস হয়ে যায় ।


               আজকের প্রজন্ম লোকাল বেকারির তৈরি এক পাউন্ড ওজনের প্লেন পাউরুটি প্রায় দেখেই না ।স্লাইস পাউরুটি বলতে তারা জানে কোয়াটার সাইজের পাউরুটি। একটু কৌলিন্য হীন দোকানে যে ধরনের পাউরুটি মাখন, দুধের সর ইত্যাদি  দিয়ে নানাভাবে খরিদ্দারের মুখে ওঠে। সেকালে আমরা সেবাপল্লী' ইতি'তে পৌঁছিয়েই,  ওই নরম তুলতুলে লোকাল বেকারির প্লেন পাউরুটি আর ঘোষ দার দই দুপুরবেলায় পেট পুরে খেতাম। খিদের মুখে ষে  যেন একেবারে ছিল অমৃত।


                      বীণা দি, শিল্পী মুকুল রায়ের পত্নী ,তিনি যতদিন জীবিত ছিলেন, শান্তিনিকেতনে গেলে সকালবেলা জলখাবারটা আমার ছিল তাঁর বাড়িতে বাঁধা। বীণাদির মত কচুরি তৈরি করতে বাংলা কেন, ভূ- ভারতের বোধহয় কেউ পারেন না! এটা আমার মনের একান্ত বিশ্বাস! আসলে, মুকুল বাবুর জীবিত অবস্থায় থেকে বীণাদির হাতের কচুরির যে স্বাদ, তিনি  বেশি অসুস্থ হয়ে পড়াবার আগে পর্যন্ত ,যতদিন নিজের হাতে কচুরি তৈরি করতে পারতেন বা কচুরির উপকরণ কোনটা কি হবে, সহযোগীদের বলে দিতে পারতেন ,একদম একরকম ছিল।


                      প্রায় তিরিশ বছর বীণা দি তত্ত্বাবধানে তৈরি কচুরিতে কখনো আমি স্বাদের কোন  হের ফের পাইনি। যদিও বীণাদি, অন্নদাশঙ্করের একদম বাঙালি ঘরানার জলখাবারের ছিলেন বেশি ভক্ত ছিলেন। একবার অন্নদাশঙ্করের( তখন ও তিনি কর্মরত, স্বেচ্ছাবসর নেন নি)  বাড়িতে গিয়ে বীণাদি দেখেন;  চিড়ে  আর নারকোলকোড়া দিয়ে সকালের জলখাবার সারছেন দুঁদে আই সি এস অন্নদাশঙ্কর। এ কথাটা তিনি বারবার বলতেন ; লীলাদির বাড়ির জলখাবার ছিল আমার কাছে বিশেষ লোভনীয়।


             তবে একটু অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলি;  নানা উপকরণ সহযোগে চিড়ের সঙ্গে চিজ কিউব খাওয়া --এটা ছিল আবার লীলা রায়ের খুব পছন্দের একটি বিষয় ।আর তাঁর কাছ থেকেই আর কিছু না হোক ,এই চিড়ে  আর চিজ কিউব   খাওয়াটা আত্মস্থ করে আমি বড় মানসিক তৃপ্তি  অনুভব করি।


                 হারুদা যবের থেকে দোকানের পুরোপুরি হাল ধরলেন, তবে থেকে ঘোষদার দোকানের খাদ্য তালিকাতে ও স্বাদের বেশ কিছু রকমফের হলো। কিন্তু সেই রকমফের যেমনই হোক না কেন ,হারুদা বা বৌদির হাতের কচুরি সঙ্গে আমি চিরদিনই একটা অদ্ভুত মিল খুঁজে পেতাম বীণা দির হাতে তৈরি কচুরির সঙ্গে। বীণা দি র তৈরি করা কচুরি অনেক বেশি উপদেয়  হত। অনেক খাটি মশলা পত্র থাকতো।ভালো তেলে ভাজা হতো। অত্যন্ত পরিচ্ছন্নভাবে রান্না করা হতো ।কচুরির সঙ্গে হারুদার মত আধা সেদ্ধ হওয়া মোটর থাকত না। ঘুগনি থাকত না ।তবুও কোথায় যেন বীণাদি চলে যাওয়ার এই এতো বছর পরেও, হারুদার হাতে তৈরি কচুরি খেলে, একটু হলেও বীণাদির  তৈরি কচুরির স্বাদ পেতাম।


                 মাঝে মাঝে হারু দা কে জিজ্ঞেস করে ফেলতাম, আপনি কি বীণাদির কাছে কচুরি তৈরি শিখেছেন ? হারু দা , মুকুল দের ভাড়ির প্রসঙ্গ এলেই , বারবার মুকুলদার কাছে সেই তাড়া খাওয়ার কথা বলতেন।


             তখন শান্তিনিকেতনে এত খাওয়ার জায়গা আজকের মত হয়নি। এই সময়ে ধীরে ধীরে ছাত্রদের দুপুর, রাতের  খাবার  ব্যবস্থা করলেন হারুদা ,বৌদি ।কিছুদিন চললেও এসব ছোট দোকানের ক্ষেত্রে  যা হয়, তাইই হলো। বহু ক্ষেত্রেই ঠিকমতো টাকা পয়সা ফেরত পেতেন না হারুদারা। আজকের এই মাগ্গি গন্ডার বাজারে যখন ধীরে ধীরে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও জোরদার ভাবে বাড়তে শুরু করল, তখন এ সমস্ত চালানো হারুদার পক্ষেও বেশ দুঃসাহ হয়ে উঠল ।


               হারু দার দুঃখ করতেন, ছাত্রদের মানসিকতার সেকাল একাল ঘিরে ।সাত - আট , এমন কি নয়ের দশকেও ছাত্রদের মধ্যে গোটা মাস জুড়ে খাবার খেয়ে ,টাকা দিতে না পারার তেমন একটা প্রবণতা ছিল না ।আর্থিক সমস্যা থাকলে তাঁরা অকপটে নিজেদের অসহায়তার কথা বলতো। হারুদা কখনোই তাঁদের খাবার বন্ধ করে দিতেন না। দুমাসই হোক, তিন মাসই হোক ,ছেলেপুলেরা কিন্তু ঠিক এসে হারুদার পাওনা টাকা দিয়ে যেত।



                 কিন্তু ক্রমেই যেন গোটা সমাজ ব্যবস্থার যে উলোটপালট ,তার হওয়াটা কেমন উথালি পাঠালি করে দিতে শুরু করলো শান্তিনিকেতনের পরিমণ্ডলটাকেও ।একটা বড় অংশের ছাত্রদের মধ্যে দুমাস ,চার মাস টাকা  বাকি রেখে, আবার দোকান বদলে ফেলা , কোন দোকানেই পয়সা না দেওয়ার প্রবণতা দুর্ভাগ্যজনক হলেও বলতে হয় এগুলো ক্রমশ বাড়তে লাগলো। হারুদা অনুভব করলেন ,ছাত্রদের এই একটা অংশের অমনতরো  মনোভাবটা ,অভাব থেকে হচ্ছে না। এটা তাদের মধ্যে একটা সাধারণ প্র্যাকটিস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর বহু ক্ষেত্রে এইভাবে  হারুদাদের মত ছোট ছোট দোকানদারদের টাকা না দিয়ে, সেসব টাকা ব্যবহৃত হচ্ছে অন্যভাবে ।কিভাবে হচ্ছে তা  আজকের বুদ্ধিমান পাঠককে আলাদা করে বলে দেবার কোন দরকার নেই।


                 হারুদা শুরু করলেন হোম সার্ভিস। বিশেষ করে যে সমস্ত মানুষ জনেরা   স্থায়ী ভাবে এখন আর  শান্তিনিকেতনে থাকেন না, মাঝেমধ্যে আসেন। তাঁরা আর বাড়িতে আলাদা করে রান্নাবান্নার ব্যবস্থা রাখতে চান না ।অথচ একেবারে হোটেল ,রেস্টুরেন্টের অতিরিক্ত তেল মশলার খাবারও খেতে চান না। তাঁদের জন্য দারুন সুস্বাদু, অল্প তেল ,অল্প মশলার ঘরোয়া রান্না করে দিতে শুরু করলেন হারুদা ।সবসময় এই কাজে তাঁর সঙ্গী বৌদি ।


           সে ব্যবসাও যে খুব একটা টিকলো এমনটা নয় ।হারুদা  মাঝে, নতুন করে তৈরি করা বাড়ির দোতলাতে ,ছাত্রদের থাকবার ব্যবস্থাও করেছিলেন। কোনটাই সেভাবে সাফল্যের মুখ দেখতে পেল না ।



            আসলে শান্তিনিকেতনটা যে ক্রমশ বদলে যাচ্ছে ,আশ্রমের সামগ্রিক পরিবেশ, যে ভাবনা গুরুদেব বা তাঁর স্নেহধন্য মানুষজনেরা লালন করতেন ,সে জায়গাটা যে  ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে ।এই বাস্তবতার মধ্যে দাঁড়িয়েও হারুদার মতো মানুষদের সেটা মেনে নেওয়া, আর সহ্য করা দুটোই বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়াতে শুরু করেছিল। মানুষজন ঝাঁ চকচকে দোকানের দিকে ঝুকছে ।হারুদার দোকান, আজকে যারা আশ্রমিক মানসিকতায় শান্তিনিকেতনে যান না ।গুরুদেবকে উপলব্ধি করবার জন্য শান্তিনিকেতনে যান না ।যান বেড়াতে। যান উইকেন্ডে সময় কাটাতে। তাদের কাছে এতটুকুনি আলোর ঝলকানি ছাড়া ,নারকোলের ডাল ,আর কিছু ছিটেবেড়া দিয়ে সীমানা নির্ধারিত ,ঘোষ দার মিষ্টির দোকানের কোনো আকর্ষণই নেই। বেশিরভাগ মানুষই নামই শোনে নি ঘোষ দার। শান্তিনিকেতনে যাওয়া ,বিশেষ করে শান্তিনিকেতনের উপকণ্ঠে যে সমস্ত প্রমোদকানন গড়ে উঠেছে সেখানে থাকা লোকজন জানে না সেদিনের আনন্দকে।উপলব্ধিত করতে চায় না। আর ঝাঁচকচকানিটাই যখন সামাজিক কৌলিন্যের দিকচিহ্ন হয়ে উঠল, তখন ধীরে ধীরে যেটুকুনি জৌলুশ ছিল ,সেটুকু নিয়ে ই হারাতে শুরু করল ঘোষদা দোকান। তারপর 'মৃত্যু' সেই অমঘ বিচ্ছেদকে  চিরতরে স্থায়ী করে দিল। হারুদা কে অতীত করে দিলো।কিন্তু আমরা যাঁরা সেকালের শান্তিনিকেতন কে দেখবার সুযোগ পেয়েছিলাম ,চিনবার চেষ্টা করেছিলাম ।আমাদের কাছে হারুদা ,যতদিন বাঁচবো, ততদিন চির অম্লান হয়ে থাকবেন।

  • গৌতম রায়