রাজা রামমোহন সিনেমাটি ১৯৬৫ সালের অক্টোবর মাসে মুক্তি পেলেও আমার দেখার সুজোগ হয়ে ছিল তার পঞ্চাশ বছর পরে। বারাণসীর রঙ্গপ্রবাহ সমিতি দ্বারা আয়োজিত প্রতি মাসের সিনেমা চর্চা আসরের এক বৈঠকিতে। ধ্রুপদী সিনেমা দেখা এবং চর্চা ছাড়া রঙ্গপ্রবাহ নাটকের এক নবতরঙ্গের যুবকের দল।
বারাণসীতে সিনেমা নিয়ে চর্চার আগ্রহ দেখা যায় বিংশশতাব্দীর সোত্তরের দশকে। তখন কিছু যুবকেরা কোলকাতার ফিল্ম সোসাইটি থেকে খুবই প্রভাবিত। সেই প্ররণা এবং উৎসাহ নিয়ে বারাণসী তে ফিল্ম সোসাইটি গড়ার প্রচেষ্টায় তল্লিন হয়।
গোদোলিয়া চৌরাস্তার পাসেই সেই সময় দি রেস্টুরেন্ট। সেই রেস্টুরেন্টের আব-ও-হাওয়া কোলকাতার কফি হাউসের মতই গুলজার। রাজনিতি থেকে নিয়ে সমাজ ব্যবস্থা, শিল্প সংস্কৃতি থেকে নিয়ে স্টক মার্কেট; কোনোটাই বাদ যায় না। সেই নিয়ে তর্ক বিতর্কে সবাই মশগুল। রেস্টুরেন্টের এক টেবিলে সেই ফিল্ম সোসাইটি গড়ার উদ্যোগ নিয়ে ভাবনা চিন্তায় কয়েক যুবক। তারা বারাণসী ফিল্ম সোসাইটির উদ্বোধনের কার্যকলাপের নির্ধারণে ব্যস্ত। সৌভাগ্য ক্রমে কোলকাতা ফিল্ম সোসাইটির অন্যতম কান্ডারী সত্যজিৎ রায় সেই রেস্টুরেন্টের দ্বারে উপস্থিত হন। জয় বাবা ফেলুনাথ সিনেমা শুটিংয়ের কাজে সত্যজিৎ বাবু সেই সময় ব্যস্ত, তাই কাশীর পথে ঘাটে তার বিচরণ। সত্যজিৎ বাবু কে নিজেদের মাঝে পেয়ে সেই যুবকের দল আপ্লুত। পরিচয় পর্ব সারা হলে, তারা বারাণসী ফিল্ম সোসাইটির কথা তাঁকে জানায়। সত্যজিৎ বাবু খুবই উৎসাহ দেন। সত্যজিৎ বাবু কে বারাণসী ফিল্ম সোসাইটির প্রথম আয়োজনের প্রধান অতিথির নিমন্ত্রণ করা হয় এবং নির্দিষ্ট দিনে সত্যজিৎ বাবু সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে কোলকাতা ফিল্ম সোসাইটি গড়ার অভিজ্ঞতা সবাইকে বলেন।
ধ্রুপদী সিনেমার চর্চার এক পরিবেশ গড়তে বারানসি ফিল্ম সোসাইটির অবদান কম নয়। কিছু বছর পরে সোসাইটি ভেঙে যায় কিন্তু ফিল্ম নিয়ে চর্চা থামেনি আজও। নতুন প্রজন্মের আগ্রহে সেটা বজায় রয়েছে। যেমন রঙ্গপ্রবাহ দ্বারা পরিচালিত প্রতিমাসের চলচ্চিত্র চর্চার আসরে ধ্রুপদী সিনেমার দেখা ও চর্চা করার এক স্থান বিশেষ। যেখানে রাজা রাম মোহন সিনেমাটি দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার।
রাজা রামমোহন ফিল্মটি দেখতে দেখতে মনে দুটো প্রশ্ন জাগে। প্রথম রাজা রামমোহন কাশি এসেছিলেন যদি তাহলে কতদিন ছিলেন কোথায় থাকতেন, কাদের সংস্পর্শ পেয়ে নিজেকে আগামী দিনের জন্য গড়ে নিচ্ছিলেন ইত্যাদি ? অনেক প্রশ্নের উত্তর আমি আজও পাইনি। কিন্তু অনেক অজানা কথা জানা গেছে সেই সূত্র ধরেই।
রাজা রাম মোহন রায়ের জন্ম সেই নবাব আমলে। হুগলি জেলার রাধানগর গ্রাম। এই গ্রামের নাম ডাক খুব। এখানে বাস করেন রায়রায়ান বংশের মানুষেরা। নবাব এর কাছে এদের খাতির ছিল। নবাবের কর্মচারী হিসেবে ছোটখাটো জমিদার এরা। প্রচুর জমির মালিক, রায়রায়ান বংশের প্রচুর বিত্ত।
রামমোহন এই বংশেরই ছেলে। জন্ম ১৭৭৪ সালে। কেউ কেউ অবশ্যই বলেন রামমোহনের জন্ম ১৭৭২ সালে। পিতা রমাকান্ত রায়ের তিনি দ্বিতীয় পুত্র। মা তারিনী দেবী। মায়ের প্রভাবই পড়েছিল রামমোহনের জীবনে। রামমোহনের শিক্ষার আরম্ভ রাধানগর গ্রামে। টোল চতুষ্পাঠী তেই। তিনি মনোযোগী ছাত্র। সবকিছুকে খুঁটিয়ে, তন্ন তন্ন করে জানার ইচ্ছা প্রবল।
সেই সময় নবাব দরবারে চাকরি করতে গেলে আরবি ফারসি শিক্ষার প্রয়োজন। তাই রামমোহনকে পাঠিয়ে দেওয়া হল পাটনায়। আরবি ভার্সিটিতে রামমোহন কেবল বিদ্যা চর্চায় নয়, একেবারে মোজে গেলেন। এই দুই ভাষাকে এমন আয়ত্ত করলেন যে এই ভাষায় কথা বলতে, আলোচনা করতে, চিন্তাভাবনা করতে তার কোন অসুবিধাই হতো না। এমনকি কঠিন জিনিস কে পর্যন্ত তিনি সহজ করে বলতে লিখতে পারতেন আরবি ফার্সিতে। সেই সূত্রে ইসলাম ধর্মের সবকিছুই তার জানা হলো। তিনি মুসলমানি আদব-কায়দা কিছু কিছু পছন্দ করতেন। জোব্বা চাপকান পড়তেন। এই পোশাকেই তাকে মানাত ঢের। আরবি ফার্সি শিক্ষা ও আদব কায়দা অর্জন করে রামমোহন পাটনা থেকে কাশি চলে আসেন।
জগৎ বিখ্যাত রাজা রামমোহন রায় সংস্কৃত সাহিত্য এবং বেদে বেদান্ত আদি অধ্যয়নার্থ কাশী প্রবাসী হন। কারণ কাশী সংস্কৃত চর্চার বিখ্যাত জায়গা। বড় বড় পন্ডিতদের বাস এখানে তাই সংস্কৃত সাহিত্য ভান্ডার লুট করে নিলেন রামমোহন। বেদ, বেদান্ত, মীমাংসা, স্মৃতি শাস্ত্র, কাব্যশাস্ত্র তখন তার নখ দর্পণে।
রামমোহন ভারতের জ্ঞানের ভান্ডার উপনিষদের পাট নিলেন ব্রহ্মসূত্র পড়লেন গীতাকে বুঝে নিতে চাইলেন উপনিষদ পড়ে তিনি সিদ্ধান্ত করে ফেলেছিলেন প্রতিমা পূজার কোন মানে হয় না।
প্রতিমাপূজা সম্পর্কে যেটুকুও বিশ্বাস ছিল একেবারে ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল উপনিষদের জ্ঞান লাভ করে। কেবল কি তাই? হিন্দুধর্মের ধর্মশাস্ত্র সবই পড়লেন। পড়লেন ষড়দর্শন, ধর্মশাস্ত্র, স্মৃতিনিবন্ধ। অন্যদিকে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, তন্ত্রকে অধিগত করলেন প্রচণ্ড পরিশ্রম নিয়ে। পড়ার জন্যেই পড়া নয়, পড়ার মধ্য দিয়ে তিনি বুদ্ধি আর অনুভব দিয়ে জানতেও চাইলেন, মানুষের জীবনে অধ্যাত্মভাবনার স্থান কোথায়। বিভেদবুদ্ধির কারণ কী। অসংখ্য দেবদেবীর কল্পনার মোহ কেন এল। জ্ঞান আর জ্ঞানের প্রসার চাই। তাহলেই ঝাপসা ভাবটা কেটে যাবে, অন্ধকার চলে যাবে, ফুটে উঠবে আলো।
বেদ বেদান্ত পুরাণ চর্চার কেন্দ্র এই কাশী। পন্ডিত বহুল এই নগরীতে প্রকাশানন্দের সঙ্গে বিচার করে রামমোহন বুঝিয়ে দিলেন মানুষকে মানতে হবে। মানুষ ছাড়া ঈশ্বর চলে না। রামমোহনের মন তৈরি হচ্ছে একেশ্বর বাদের দিকে - একমেবাদ্বিতীয়ম।
অধ্যয়নার্থ কাশীপ্রবাসী রাম মোহনের বিষয় ১৮২৬ সালে William Adam সাহেব লিখিয়াছিলেন,
"Rammohon, after relinquishing idolatry, was obliged to reside for ten or twelve years at Benares, at a distance from all his friends and relatives, who lived on the family estate at Burdwan, in Bengal.” "Probably he fixed his residence at Benares on account of the facilities
afforded by that sacred city for the study of Sanskrit * * * Probably however in such a seat of Hindu learning as Benares, he might have obtained employment by copying manuscripts. In any case, he seems, to have remained there until his father's death in 1803. *"
দেহের জন্ম হয়তো রামমোহনের সেই ১৭৭২ কিংবা ১৭৭৪ সালে হলেও, মানসিক জন্ম লাভ এই কাশীতেই। মানুষের মানসিকতাই তার দিক নির্ধারণ করে আর হয়তো এটাই মোক্ষ লাভের পাথেয়।
রাজা রামমোহন ফিল্মটি দেখতে দেখতে মনে দ্বিতীয় বিষয় টি যা আকৃষ্ট করলো তা হল প্রায় চোদ্দ মিনিট পরের দৃশ্য। কাশীর ঘাটে সহমরণের সে ভয়ঙ্কর দৃশ্যায়ন কাউকেই বিচলিত করতে সক্ষম। ফিল্ম দেখা শেষ হলেও তার রেশ ছিল দীর্ঘ সময় ধরে। সঙ্গে বার বার রবীন্দ্রনাথের ‘ কথা' কাব্যগ্রন্থের 'বিবাহ' কবিতাটি মনে পড়ছে। ১১ কার্তিক ১৩০৬ বঙ্গাব্দে লেখা।
'বরের বেশে মোতির মালা গলে/মেত্রিপতি চিতার পরে শুয়ে। /দোলা হতে নামল আসি নারী,/ আঁচল বাঁধি রক্তবাসে তাঁরি /শিয়র পরে বৈসে রাজকুমারী /বরের মাথা কোলের পরে থুয়ে।/…
ঘন ঘন জাগল হুলুধ্বনি,/ দলে দলে আসে পুরাঙ্গনা। /কয় পুরোহিত 'ধন্য সুচরিতা', /গাহিছে ভাট 'ধন্য মৃত্যুজিতা', /ধূ ধূ করে জ্বলে উঠল চিতা-
কন্যা বসে আছেন যোগাসনা। /জয়ধ্বনি উঠে শ্মশান মাঝে, /হুলুধ্বনি করে পুরাঙ্গনা।’
মনে প্রশ্ন জাগে তাহলে কি কাশী তেও সহ মরণের তাণ্ডব ছিল। আশ্চর্য তথ্য পাই যে, সাধককবি রামপ্রসাদ সেনের পুত্র রামগতি সেনের মৃত্যুর পর তাঁর পত্নী মণিকর্ণিকা ঘাটে সতী হন। শুধু তাই নয় অষ্টাদশ শতাব্দী ও ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে ভারতবর্ষে সতীদাহ ছিল একটি উল্লেখযোগ্য সামাজিক প্রথা। বেনারস ম্যাজিস্ট্রেটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে শহরে যে ১৩ জন বিধবা 'সতী' হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্তত কয়েক জন ছিলেন বাঙালি : জনৈক সুধারাম বিদ্যালঙ্কারের সহধর্মিণী চন্দ্রমণি ৭০ বছর বয়সে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের ১১ এপ্রিল স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যান।৩০ ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দের ২ মার্চ রামগোপাল বিশ্বাসের বিধবা পত্নী ৫০ বছর বয়সি সবিতা 'সতী' হন।” ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দের ৭ ফেব্রুয়ারি রামকান্ত চক্রবর্তীর ৪০ বছর বয়সি বিধবা পত্নী তারিণী ঠাকুরানি এবং ১১ মার্চ রামকান্ত ভট্টাচার্যের বিধবা পত্নী পার্বতী 'সতী' হন। ঐ বছরের ২২ অক্টোবর জনৈক হরেরাম ভট্টাচার্যের সহধর্মিণী রাজেশ্বরী 'সতী' হন ৮০ বছর বয়সে।
কাশীর এক একঘাটে পাথরের শিলা স্থাপিত আছে। কাউ সে দিকে একটু গভীর ভাবে মনোযোগ দিলে দেখতে পাবে সেই শিলা তে এক দম্পতির মূর্তি। স্থানীয় লোকে সেই গুলো কে সতী বেদি বলে। এক সময় নাকি সেই স্থলে সহ মরণের কৃত্য সম্পন্ন করা হত। সেই বেদি হরিশচন্দ্র, দশাস্থমেধ, মনিকর্ণিকা, প্রহলাদ ঘাট, রাজ ঘাট পর্যন্ত ব্যাপ্ত। কাশী নগরীর অনেক অঞ্চলে সতী পিঠ বর্তমান।
তাই আজ সেই মহান সমাজ সংস্কারক রাজা রাম মোহন রায় কে প্রণাম জানাই। যার জন্য আমাদের সমাজ সেই কুসংস্কার কে বর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।