বৃষ্টি পড়লেই সুরঙ্গমার বুকের ভেতর এক অনাবিল আনন্দের অনুভূতি হয়, । একটু ভুল হল । যে কোনও সময় বৃষ্টি পড়লেই হয় না । বর্ষাকালে সারাদিন ধরে কখনও ফিসফিস কখনও টিপ টিপ ,কখনও ঝমঝম ঝরে যাওয়া বৃষ্টি দেখলেই এমন হয় । ধরুন রাতভোর ঝমঝমিয়ে, বৃষ্টি হয়েছে । এমন একটি ঘনঘোর বৃষ্টির সকালে অনেকক্ষণ ধরে বালাপোশ মুড়ি দিয়ে কুন্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে থাকবে সুরঙ্গমা । শুয়ে শুয়ে, পুরোনো স্মৃতি হাতড়াবে । চোখ বুজে চলে যাবে কোনও সুখ স্বপনে । অথবা ধরুন বৃষ্টি শুরু হলতার ঘুম থেকে ওঠার পর । ঝরঝর করে ঝরেই যাচ্ছে । মেঘলা ধূসর আকাশ । বৃষ্টির, জন্য ঘরের বাইরে বের হওয়া যাচ্ছে না । তখন চায়ের পেয়ালা হাতে ব্যালকনিতে বসে সুরঙ্গমা গাইবে –‘এমনও দিনে তারে বলা যায় এমনও ঘনঘোর আঁধিয়ায় ।‘
? আবার সেই বৃষ্টি যদি রাতেও চলতে থাকে তখন সুরঙ্গমা চাইবে,’ রবিনা ট্যান্ডনের মত ভিজতে ভিজতেটিপি টিপি বরষে পানি …” গানের সঙ্গে নাচতে ।‘
সুরঙ্গমা নিজে তো রবিনা হবেই । কিন্তু অসুবিধা হল অক্ষয়কুমারকে কে নিয়ে। বিয়ের আগে অক্ষয়কুমারের জায়গায় মনে মনে নিজের পছন্দের পুরুষদের বসিয়ে নিত । বিয়ের পর খুব ইচ্ছে স্বামী ভবেশকে সেই জায়গায় বসাতে। কিন্তু ওখানেই যত গণ্ডগোল ।
মাত্র, ছ’মাস হল বিয়ে হয়েছে তাদের । বর্ধমানের অজ পাড়াগাঁয়ে শ্বশুরবাড়ি । বিয়ের পরই স্বামীকে বগলদাবা করে শহরে চলে এসেছে । চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভবেশের শরীর থেকে গ্রাম্য আস্তরণ খুলে ফেলতে । স্ত্রীর মনমত হয়ে ওঠার ইচ্ছে ভবেশেরও । কিন্তু সমস্যা শুরু হয়েছে বর্ষা শুরুর পর থেকে । সুরঙ্গমা লক্ষ্য করেছে আকাশ ভেঙে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হলে ভবেশ কেমন যেন উদাস হয়ে যায় । জানলার পাশে চুপ করে বসে থাকে । বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকলেও ওর দৃষ্টি বৃষ্টিতে থাকে না। আকাশ ধোয়া জলে ভাসতে ভাসতে দূরে কোথাও হারিয়ে গেছে ।
যে সুরঙ্গমার বৃষ্টি পড়লেই নাচতে ,গাইতে, স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে হত । সেই এখন বর্ষা স্পেশাল লেডি গোয়েন্দা ।
, নভেম্বরে বিয়ের পর কতবারই তো বৃষ্টি হয়েছে । তখন তো ভবেশ এমন করেনি । বরং কখনও কখনও বৃষ্টির দিনে ডিমভাজা খিঁচুড়ি রান্নার ফরমাশ করেছে । কিন্তু এই বর্ষাকাল শুরুর পর থেকেই …।
, এমনই এক ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির দিনে সুরঙ্গমা ঘুম থেকে উঠে দেখল, তাদের ছোট্ট ব্যালকনিতে করুন মুখে বসে আছে ভবেশ। ধীর পায়ে পাশে গিয়ে দাঁড়াল । আলতো করে হাত দিল কাঁধে । কিছু বলার আগেই সুরঙ্গমার কোমর জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল ভবেশ। এমনই দম চাপা সেই কান্না যে সুরঙ্গমা তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় ।
খানিকক্ষণ কাঁদার পর হঠাৎ যেন ভীষণ লজ্জা পেয়েছে এমন ভাবে ভবেশ উঠে পড়ল । তাড়াতাড়ি বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল । যাওয়ার আগে একবার থমকে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে “সরি “বলল ।
ঘন বর্ষায় সুরঙ্গমা বুকের ভেতর শীতের কাঁপন । কোথায় যেন এক চুলচেরা ফাঁটল। যে ফাঁটল প্রথমে দৃষ্টিগোচর হয় না । আস্তে আস্তে সেই সরু ফাঁক দিয়েই হড়কা বান আসে । সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায় । চারিদিকে তখন শুধুই ধ্বংসের বন্যা ।
সুরঙ্গমা বুঝতে পারে না তার এখন কী করা উচিত । আনমনা হয়ে গ্যাসে চায়ের জল চাপিয়ে জানলার পাশে এসে দাঁড়ায় । বাইরে অঝোর ধারায় বর্ষন চলছে ।, ফুটন্ত জলে চায়ের পাতা দেয় । এক একটা চায়ের পাতা যেন উত্তাল সমুদ্রে ছোট্ট পানসি । একবার ডুবছে একবার ভেসে উঠছে । গ্যাস নিভিয়ে সুরঙ্গমা ভাবতে থাকে কী এমন হতে পারে যার জন্য ভবেশ অমন ডুকরে কেঁদে উঠল!
দুই) (
, বেশ কয়েকদিন অঝোর ধারায় বৃষ্টি পর চনমনিয়ে রোদ উঠেছে । ছোট্ট ব্যালকনির টবে বনসাই গাছগুলির উপর রোদের চাদর । ভবেশ এই গাছগুলোকে একদম পছন্দ করে না । সুরঙ্গমাকে বহুদিন বলেছে এই, গাছ যেন সে আর না লাগায় । ওর মতে যে বৃক্ষ অফুরন্ত অক্সিজেন দিতে পারে তাকে সঙ সাজিয়ে চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে রাখা পাপ ।“
সামান্য বনসাই নিয়ে ভবেশের লেকচার শুনে সুরঙ্গমার রাগ হয় । বলে, “ কত দাম এই গাছগুলোর তুমি জানো? সারা পৃথিবীতে এখন বনসাইয়ের ভীষণ কদর । গ্রামের মাঠে ঘাটে বিনা পয়সায় তুমি বটের চারা পাবে । অথচ এইগুলি অর্ডার দিয়ে আনাতে হয় । বনসাই দিয়ে ঘর সাজানো একটা আর্ট । তুমি ওসব বুঝবে না । “
, “ বউয়ের কথায় ভবেশ করুণ হাসে । বলে তুমি ঠিকই বলেছ , এখন তো সারা দুনিয়াজুড়ে বনসাইদেরই দাপাদাপি । যা কিছু অপ্রাকৃত সেগুলিই, অসামান্য অসাধারণ , অস্বাভাবিক ,অনৈসর্গিক ,অলৌকিক ।, কিন্তু এগুলো নিয়ে জীবনের খানিকটা সময় হয়ত কাটানো যায় । কিন্তু তারপর ক্লান্তি আসে । আচ্ছাতুমিই বলো ,গরমের দিনে একটা বট গাছের তলায় বসে যে শান্তি পাওয়া যায় , একটা বনসাই দিয়ে ঘর সাজিয়ে কি তা পাবে ? “
সুরঙ্গমা বিরক্ত হয় । মনে মনে ভবেশকে ‘গাঁইয়া ‘বলে গালাগালিও দেয় ।
তিন) (
? সকালের জল খাবারে আজ লুচি বানাল সুরঙ্গমা । খুব ইচ্ছে করছে ভবেশের সঙ্গে একটু খোলা জায়গায় গিয়ে বসতে । কিন্তু এই ছোট্ট ফ্ল্যাটে খোলা জায়গা কোথায়মনে হতেই লুচি তরকারি প্লেটে,” সাজিয়ে ভবেশ কে বলল চলো ছাদে গিয়ে বসি ।“
ছাদে গিয়ে দেখল অনেকদিন বাদে রোদ ওঠায় অনেকেই জামা কাপড় শুকোতে দিয়েছে । সেই কাপড়ের টুকরো ছায়ায় বসে খেতে খেতে গল্প করল দুজনে । এই যেমন ছোটবেলায় ভবেশ কী খেতে ভালবাসত … কোথায় বেড়াতে যেতে ভালবাসত … আসলে ভবেশের বন্ধ মনের ছোট ছোট খুপরিগুলোর একটা একটা করে খুলতে চাইছে সুরঙ্গমা ।
ভবেশও আজ বেশ মুডে আছে ।, মুখে গরম লুচি পুরে বলল “জানো সুরো, একবার খুব বৃষ্টি হচ্ছে বাবা কোথায় যেন গেছে । সন্ধে হয়ে গেছে তখনও ফেরেনি । সবাই চিন্তা করছি । এমন সময় বাবা ফিরল ছাতা ভরতি কই মাছ নিয়ে । “
“ছাতা ভরতি মাছ ?” সুরঙ্গমা একটু অবাকই হয়েছে ।
“ সেইসময় গ্রামের মানুষ তো এখনকার মত ফোল্ডিং ছাতা ব্যবহার করত না । বড় হ্যান্ডেল দেওয়া দাদুর ছাতা । বাবা পুকুরের ধারের রাস্তা দিয়ে ফিরছিল হঠাৎ দেখে একঝাঁক কই মাছ রাস্তা পার হচ্ছে ।“
? এবার সুরঙ্গমা হো হো করে হেসে ওঠে । বলে “তুমি আমাকে পাগল পেয়েছ যা বলবে আমি তাই বিশ্বাস করব ? “
“আরে , সত্যি বলছি । বর্ষায় অনেক সময় কই মাছ কান ঘষে ঘষে পাড়ে উঠে আসে । ওরা বেশিরভাগ সময় দল বেঁধেই থাকে । তুমি তো শহরে বড় হয়েছ , গ্রামের অনেক কিছুই জানো না । “
সুরঙ্গমা দেখল কথাগুলো বলার সময় ভবেশ কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল ।, “ কথার মোড় অন্যদিকে ঘোরাতে বলল কফি কেমন হয়েছে?” বললে না তো
কফি কাপে চুমুক দিয়ে ভবেশ জানাল , ‘ভাল , বেশ ভাল । “
কফি খেয়ে ভবেশ, “ বাজারে বের হতেই সুরঙ্গমা ননদকে ফোন করল । ইনিয়ে বিনিয়ে বিয়ের আগে ভবেশের কোনও মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল কি না জানার চেষ্টা করল । কিন্তু সেইরকম কিছুই জানতে পারল না । খানিকক্ষণ পরে বেশ হাসিমুখেই বাজার থেকে ফিরল ভবেশ । এসেই বলল আজ খাসীর মাংস এনেছি । বেশ জমিয়ে রান্না করো তো ।“
সুরঙ্গমা কিন্তু ভবেশের মত, হাসিমুখে থাকতে পারছে না । একটা বেসুরো মন দিগভ্রান্ত পথে দৌড়চ্ছে কোথায় যেন একটা বড় ভুল হয়ে যাচ্ছে । ধীরে ধীরে কেউ যেন হারিয়ে যাচ্ছে ।
দুপুর থেকে আবার ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি । এমন বৃষ্টির দিনে মাটন আর গরম ভাত সুরঙ্গমারও ভীষণ প্রিয় । ভবেশ খুব হাসছে আজ । বৃষ্টির দিকে একবারও তাকাচ্ছে না । অনেক এলোমেলো গল্প করছে । এত হাসতে ভবেশকে শেষ কবে দেখেছে সুরঙ্গমা মনে করতে পারে না । ভবেশের ঠোঁট নয় চোখের দিকে তাকিয়ে আছে সে । খুঁজে বেড়াচ্ছে একঝলক রোদ । যে রোদের তাপে সে প্রস্ফুটিত হবে ।
খাওয়া শেষে ভবেশ, চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল । এঁটো বাসন ধুয়ে রান্নাঘর গুছিয়ে, সুরঙ্গমা এলো। বুঝতে পারল ভবেশ ঘুমোয়নি । জোর করে চোখ বুজে শুয়ে আছে । মাথার দিকের বন্ধ জানলাটা খুলে দিল । খুলতেই একঝলক জোলো হাওয়া ।
,” মুখের চাদর না সরিয়েই ভবেশ বলল জানলাটা বন্ধ করে দাও প্লিজ । “
সুরঙ্গমার আজ ভীষণ ঝগড়া করতে ইচ্ছে করছে । হয়ত ঠিক জায়গায় আঘাত করতে পারলে গুপ্ত দরজার তালা ভেঙে যাবে । যেখানে বন্দী হয়ে আছে কোনও রহস্য ।
,” ভবেশ আবার বলল জানলাটা বন্ধ করো ।“
“ আমার বৃষ্টি দেখতে ভাল লাগছে ।“
“আমার ভাল লাগছে না ।“
“সবসময় তোমার ভাল লাগাকেই?” মেনে নিতে হবে কেন
“মানে ?কী বলতে চাইছ তুমি ?”এবার মুখের চাদর সরিয়ে উঠে বসেছে ভবেশ।
এটাই তো চাইছিল সুরঙ্গমা । বলল ,”সামান্য একটা জানলাই তো খুলে রেখেছি। আমার এখন তোমার, কাঁধে মাথা দিয়ে বৃষ্টি ঝরা দেখতে ইচ্ছে করছে। কত সখ ছিল বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজব নায়িকাদের মত ভেজা শিফনের শাড়ি পরে নাচব …”
সুরঙ্গমার কথা শেষ করার আগেই ভবেশ বলে উঠল ,” তোমার মত শহুরে মেয়েরা এসব?” ছাড়া আর কী ভাবতে পারে বলেই বিছানা থেকে নেমে অন্য ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল ।
সুরঙ্গমা দৌড়ে, গিয়ে দরজা আগলে দাঁড়ায় । “একদম এ ঘর ছেড়ে যাবে না । আজ তোমাকে বলতেই হবে গ্রামের মেয়েরা বৃষ্টি পড়লে কী এমন করে যা তুমি বিয়ের পরও ভুলতে পারছ না । “
সুরঙ্গমার কথায় ভবেশ থমকে দাঁড়ায় । কপাল কুঁচকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে । কোথায় যেন কড়কড় শব্দে বাজ পড়ল । ভবেশ থপ করে বিছানায় বসে পড়েছে । আলোর ঝলকানিতে কেমন যেন ভেঙে পড়া বট গাছের মত দেখাচ্ছে তাকে । সুরঙ্গমা শান্তভাবে পাশে গিয়ে বসল । বাইরে তখনও অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে । ওরা দুজনে জানলার দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকে ।
,” অনেকক্ষণ পর ভবেশই মুখ খোলে । বলে জানো সুরো , গ্রামের বাড়িতে যখন ছিলাম এমন বর্ষায় নাওয়া খাওয়ার সময় পেতাম না । “
“কেন ?” ভবেশের কাঁধে মাথা রেখে সুরঙ্গমা জানতে চায় ।
“এই ঘন বর্ষা জমিতে বীজপোতার সময় । জমি ভরতি মুনিষ । কী আনন্দ ! কখনও বীজতলায় পা দিয়েছ ? দিলে বুঝতে পারতে শীতলতা কাকে বলে ।? প্রতিটি শিরা উপশিরা বেয়ে মিষ্টি এক শিহরণ সারা শরীরে কেমন ভাবে ছড়িয়ে পড়ে । পায়ের পাতা ডোবা জমিতে জল ছপ ছপ করে বীজ পুঁতছি … বীজধানের জমিগুলো ঘন সবুজ … সেই ঘন সবুজ বীজধান তুলে লাইন ধরে জমিতে পুতছি … কিছুদিনের মধ্যেই সেই ধানগাছ জল পেয়ে লকলকিয়ে ওঠে । একজন চাষীর কাছে এর থেকে সুন্দর দৃশ্য আর কিছু হতে পারে না । সেইসব দিনের কথা মনে করে আমার গায়ে কেমন কাঁটা দিচ্ছে দেখো আমি আবার চাষ করতে চাই সুরো ,আবার ফসল ফলাতে চাই । মাঠ ভরতি সোনালি ধান … সেই ধানের বোঝা মাথায় নিয়ে বাড়ি আসা … বাড়ির উঠোনে ভরতি সোনালি ধানের বোঝা …”
, সুরঙ্গমা তাকিয়ে থাকে ভবেশের মুখের দিকে । এই ছয়মাসে ভবেশের এত উজ্জ্বল মুখ সে আগে কখনও দেখেনি । নায়িকা নয় আজ সুরঙ্গমার খুব বীজধানের জমি হতে ইচ্ছে করছে। ভবেশকে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করছে ওগো চাষী , এসো , বপন করো তোমার বীজ আমার শরীরে ।
, সুরঙ্গমার দু চোখে এখন মা হওয়ার স্বপ্ন । সে বুঝতে পারে বনসাই নয় একমাত্র বৃক্ষই পারে নতুন প্রজন্মের জন্ম দিতে ।
ভবেশের চোখ দিয়ে সুরঙ্গমা দেখতে থাকে সবুজ মাঠ … সোনালি ফসল… বটের শীতল ছায়া… তিরতির করে বয়ে চলা নদী …