আমাদের জমিটাতে নোনা জল তুলে একেবারে কি করে দিল !
দ্যেখার মতো নয়। ওটা দেখলেই আমার চোখে জল পড়ে।
তা, তোরা কিছু বলিসনি ?
আমরা তো বলেছিলুম, আর এক মাস সময় দাও, ধানটা তুলে ঝাড়িয়ে নিই, তারপর তুমি যা পারো করো।
ধানের উপরেই নোনা জল তুলে দিল !!!
বছর দশেকের ছেলেটা কখন যে ভিটেছাড়া জমিহারা বিপন্ন চাষি হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি। ওর নাগরিক সহপাঠীরা কেউ কোনদিন ওর এই বিপন্ন চাষি হয়ে পড়ার হদিস কোনও ইতিহাস বইয়ে খুঁজে পাবে না। অনুমান করতেও পারবে না কীভাবে ওর শিশু গালের কোমল ত্বকে নোনাধরা দেওয়ালের মতো জীর্ণতার ছাপ এসে পড়ল। হাতের তালু ও পায়ের পাতায় পড়ল অসংখ্য ভাঁজ। ওর চোখে মুখে এখন শুধু একরাশ বিষণ্ণতা, হতাশা। অথচ মনে হয় যেন ভিতরে ক্ষোভের আগুন ছাই চাপা রেখে কথা বলছে।
শিশু মুখের সেই অকৃত্রিম অম্লান হাসি কোথা কখন হারিয়ে ফেলেছে ও জানে না। জানে শুধু ওদের সব কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই শীতে গায়ে জড়ানো গুলিসুতোর শতছিন্ন একটা চাদর। বিনুনি করে বাঁধা চাদরের খুঁট গালে চিবাতে চিবাতে কথা বলছে। বলছে ভয়ে ভয়ে। আতঙ্ক এখনও তাড়া করছে ওদের। তবু যে কথা গুলো বলার সাহস এক সপ্তাহ আগেও ছিল না সে কথাই এখন বলছে। শীতের বেলা দ্রুত গড়িয়ে যাবার আগে বছর দশেকের ছেলেটি কথায় কথায় যেন ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে আকাশে।
বোধহয় বর্ণ পরিচয়ের আগেই চিনেছে মাটি, জল, জমি, ডাঙা, খেত, ফিসারি। ওরা, দ্বীপের শিশু। ওদের শেখাতে হয় না। জন্ম সূত্রেই জেনে যায়, ওদের চাষবাসে শুধু বৃষ্টির জলই একমাত্র ভরসা। নদী খাল খাড়ি সবার মুখেই সমুদ্রের নোনা পানি। নোনা পানি ধান ক্ষেতের বিষ। সবজি ক্ষেত্রের বিষ। হতে পারে বড়ো জোর তরমুজ আর কাঁচা লঙ্কা। একবার প্রকৃতির রোষে আয়লা, আমফানের মতো ঝড় ও বন্যায় নোনা জল চাষের জমিতে ঢুকলে এখন তিন বছর আর এ মাটিতে ধান, এমন কি কোনও সবজিও হবে না। তখন জমি থেকেও নেই। কাজের সন্ধানে যেতে হয় ফিসারিতে।
ফিসারি মালিকরা সুযোগ বুঝে টোঁপ দেবে। আশ্চর্য লোভনীয় টোঁপ। ফিসারিতে জমি দিলে অনেক টাকা পাবে বছরে বছরে, চাইলে অল্প অল্প মাসে মাসে। আর কোনও প্রস্তাবে রাজি না হলে উপহার নোনা জলের বিষ। সে বিষের যন্ত্রণা রক্তে না মিশলে ঐটুকু ছেলে কি জমি দেখে কাঁদার কথা ভাবতে পারে ! ওকে কি কেউ শিখিয়ে দিয়েছে এই আশ্চর্য অভিনয় ! ওর কণ্ঠস্বরে এই সকরুণ ও কার কাছে শিখেছে ? কাতরতা, নিষ্পৃহ উদাস দৃষ্টিবড়োদের নকল করেই ওদের বেড়ে ওঠা। তবে কি .....
আসল কথা দিন মাস বছর নয়, যেকোনো মুর্হূতও বদলে দিতে পারে দ্বীপবাসী বালকের দেহ ও মনের গঠন। ওকে তো কেউ ভুলিয়ে দিতে পারবে না, ঐ যেখানে জলকরের অফিস হয়েছে ওখানে ওদের একটা ছোটোখাটো ঘর ছিল। খেলবার জন্য একচিলতে উঠান ছিল। একটা বাতাবি লেবু একটা পেয়ারা ও দুটো কলা গাছ ছিল। আর একটু দূরে যেখানে দাঁড়িয়ে ওখানে দু বিঘা চাষের জমি ছিল। শরীরে মাটির গন্ধ মেখে, জলের গন্ধ মেখে মায়ের দেওয়া জলখাবার বাবার হাতে পৌঁছে দিতে হতো ওকে। বাবা দিনরাত খাটত ঐ এক চিলতে ক্ষেতে। ওর সেই বাবা এখন জেলে। অথচ ও জানে পুলিশে ধরার মতো কোনও অন্যায় কাজ ওর বাবা করেনি। তবু....
এতটুকু লিখে ভাবছিলুম, গল্প লিখছি নাকি প্রতিবেদন ? গল্পের ছলে যখন প্রতিবেদন লেখা হয় প্রতিবেদন ফর্মে গল্প হলে দোষ কি ! কিন্তু ভাবতে গিয়ে কী যে হল কে জানে ! হঠাৎ গল্পটা গেল থেমে। এভাবে আকস্মিক থেমে যাবে, স্তব্ধ হবে কীবোর্ড, একটু আগেও ভাবতে পারিনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিও দেখতে দেখতে সহানুভূতি, রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা রক্তের ভিতরে অদ্ভুত চাঞ্চল্য তৈরি করছিল। একে তো প্রকৃতির ভারসাম্যের কথা ভুলে শুধু আমাদের বাঁচবার তাগিদে আমরা নদী, সমুদ্রে বাঁধ দিয়ে অরণ্যের, প্রকৃতির অধিকার হরণ করেছি। এখন প্রকৃতির তাণ্ডবে মানুষ শুধু বিপন্ন নয়, মানুষের তাণ্ডবে প্রকৃতিও বিপন্ন। ভবিষ্যতে দ্বীপ গুলো আদৌ থাকবে কিনা সন্দেহ। তার উপর বাদা, বন-জঙ্গল, বন্য শ্বাপদের সঙ্গে যুদ্ধ করে যারা আবাদি জমি তৈরি করেছিল, জমির মালিকানা পেয়েছিল তার থেকে বেশি যুদ্ধ করে, তাদেরকেই করা হচ্ছে জমি থেকে উৎখাত।
এখন যতদিন পেরেছে জমি হাঙরদের দাপট সহ্য করেছে, অবশেষে আর সহ্য করতে না পেরে প্রতিবাদে পথে নেমেছে নারী-পুরুষ সকলে। এসব অঞ্চলে আবাদি জমি রক্ষার এই লড়াই প্রায় দুশো বছরের পুরানো। তাছাড়া স্বাধীনতার ঠিক আগে তেভাগার আন্দোলন, আটাত্তরে ভূমি সংস্কার আইন ঘোষিত হওয়ায় বর্গা আন্দোলন এই অঞ্চলেই দানা বেঁধেছিল। তাই এই হতভাগ্য ছেলেটিকে সামনে রেখে জল, জমি মাটি, ফসলের লড়ায়ের পুননির্মাণ নিয়ে গল্প একটা লেখাই যায়। সেই সংকল্প নিয়েই কোমর বেঁধে নেমেছিলাম। অথচ কয়েকটা শব্দ লেখার পরেই কেন এই নৈশব্দ ! বুঝে উঠতে পারছি না। মাউসে হাত রেখে কী যেন খুঁজে চলেছি....
আশ্চর্য ! হঠাৎই মনে হল চোখের সমনে থেকে কম্পিউটার স্কিনের সব লেখা মুছে গেল। সেভ না করায় উড়ে গেল নাকি ? কোথা হারিয়ে গেল আমার সেই বিষণ্ণ বালক ! এই মুর্হূতে আমার গল্পের নায়ক সে ! আমার সমস্ত সত্তা নিয়ে ওর মধ্যে মিশে যেতে চাই। এই মাত্র কয়েকটি শব্দে ওকে আঁকতে চেয়েছি, এখনি উধাও ! তারপর ধীরে ধীরে সব অন্ধকার।
মনে হল অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছি আমি। বাইরে কি ঝড় উঠল ! বৃষ্টি এলো ! কারেন্ট চলে গেলো ! কিছুই বুঝিতে পারছি না। শুধু দেখছি চারদিক থেকে অন্ধকার নামছে। বাঁশ বনের অন্ধকার, বাদা বনের অন্ধকার গোয়াল ঘর উঠান পেরিয়ে ঢুকছে দাওয়ায়, যেখানে আমরা পড়তে বসি। গণ্ড গ্রামে সূর্যাস্তের পরেই আমাদের পড়তে বসতে হয়। কে আর বেশি রাত পর্যন্ত কেরসিন পোড়াবে ! অবশ্য পড়তে বসলেও চারদিকের নৈশব্দে কান থাকত সদা সতর্ক। তাই একসময় শুনতে পেলুম মায়ের পায়ের শব্দ। বই খাতা ফেলে আমি তখন অন্ধকারে মায়ের পাশে এসে এমন ভাবে দাঁড়িয়েছি যাতে মা দেখতে না পায়। বোধহয় আমরা পড়ছি ধরে নিয়েই মা আর দিলিপ কাকা নিচু গয়লায় কথা বলছে-
বৌদি, দাদাকে বলো, আজই দক্ষিণ মাঠ ট্রাক্টর করিয়ে নিতে।
তোমার দাদার কথা ছেড়ে দাও। তার তো এসব দিকে কোনও হুঁশ নেই।
দাদা আজ মাঠে যায়নি ?
আর মাঠে ! বলে নিজের জমি কীভাবে চাষ করবে তার ঠিক নেই দিনরাত সকলের চিন্তা করে মরছে। তুমিই বলো, একবার ট্র্যাক্টর দক্ষিণ মাঠ থেকে উঠে এলে আবার কবে নামবে তার ঠিক নেই। হালটা তো করে নিতে হবে। তা বাবুর পাত্তাই নেই।
কিন্তু আমি তো শুনছি, কাল সকালের আগেই ধাড়াদের ছ বিঘা চষে দিয়ে ট্রাক্টর চলে যাবে পূর্বের মাঠে।
কি করি বলতো ?
তারপর দেখি দিলিপ কাকার এক হাতে কোদাল আর এক হাতে পাঁচ বেটারির টর্চ। মা হ্যারিকেন হাতে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ঘর থেকে। বছর সাতেকের আমিও পিছু নিয়েছি মায়ের। শীতের রাত বেশি না হলেও চারিদিকে গাঢ় অন্ধকার। গত পরশু গেছে পূর্ণিমা। আজ চাঁদ উঠবে আর একটু পরে। দাদু শিখিয়েছে, চাঁদের ঘড়ি মারা। কিন্তু কাকা আর মা চলেছে কোথা হন হন করে এই অন্ধকারে ! অন্ধকার বলেই আমিও যে চলেছি তা ওরা দেখতে পায়নি। কি হাড় কাঁপুনি শীত রে বাবা ! সন্ধে হতেই ঠাকুমা গুলি সুতোর চাদর পেঁচিয়ে ঘাড়ের কাছে গিঁট বেঁধে দিয়েছে। হাত দুটো বগলে চেপে ধীরে ধীরে হাঁটছি। পাড়া ছাড়তেই বুঝলুম, দিলিপ কাকা আর মা যাচ্ছে দক্ষিণ মাঠের দিকে।
বাবা ফেরেনি বলেই তাহলে মা দিলিপ কাকাকে নিয়ে এত রাতে চলেছে মাঠে। কী মজা ! কী মজা ! আমাদের জমিতে ট্রাক্টর হবে ! আনন্দে আর শীত লাগছে না আমার। ঐ তো ট্রাক্টরের মোটরের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। হেডলাইটের আলো রাতের অন্ধকার চিরে মাটি থেকে আকাশ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। এবার ফাঁকা মাঠ। ট্রাক্টর মুখ ঘোরালে এদিকেও আলো এসে পড়বে। মা, কাকা পিছনে তাকালেই আমাকে দেখে ফেলবে। তা দেখুক। এখন আর আমি ফিরে যাব না। অন্ধকারে যাবই বা কি করে !
অনেকটা পিছিয়ে পড়েছি আমি। হ্যারিকেন বা টর্চের আলো নয়, চাঁদের আলোর পথ ধরে চলেছি। দূরে দূরে। ভয়ে ভয়ে। মাঠ ভর্তি ছিপছিপে জল। জল কী ভীষণ ঠান্ডা। তবু জলে ভাসা চাঁদের আলো পায়ের আঘাতে ভাঙতে বেশ লাগছে আমার। তবে সাবধানে। জোরে শব্দ করলেই ধরা পড়ে যাব। ট্রাক্টরের শব্দ কাছাকাছি আসতে পায়ের শব্দ ঢাকা পড়ে যায়। এবার আর লুকানো যাবে না। আমাদের জমির আলে গিয়ে দাঁড়িয়েছে মা আর কাকা। ট্রাক্টর মুখ ঘুরিয়ে এদিকে এলেই ধরা পড়ে যাব। মা খুব বকবে না তো !
ভাবছি, মায়ের বকুনি খেলেও সেদিন থেকেই আমিও তো কাদা জল মেখে দাঁড়িয়ে আছি। কী করে মুছবো সেই স্মৃতি। পিছন ফিরে তাকালে আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই শীতের রাত, মা দাঁড়িয়ে আছে হ্যারিকেন হাতে, অনেক রাত পর্যন্ত ট্রাক্টরের হেডলাইট পাক খাচ্ছে আমাদের। সাত বছরের চাষির ছেলে শীত উপেক্ষা করে নিজেদের জমি চষার আনন্দে আত্মহারা। পরের দিন থেকে হবে মাটি চালা, বাঁধ দেওয়া, সেচ দেওয়া, সার, খোল ছড়ানো। আরও দুদিন পরে তলা ভাঙা, দল বেঁধে ধান রোয়া, সবই যেন একের পর এক উৎসব। মা, বাবা, কাকা, জ্যেঠা, পাড়ার সকলের সঙ্গে আমিও অবলীলায় কাদা জল মাখছি। সে উৎসবে পরিশ্রম আছে কিন্তু ক্লান্তি নেই। আছে উৎসাহ, উদ্দীপনা। পারিবারিক উচ্ছ্বাস। সকালে দাঁতন করতে করতে বাবার পিছু পিছু পৌঁছে যাওয়া শিশির ভেজা ধান ক্ষেতে। তারপর নরম পায়ের আলতো ছোঁয়ায় শিশির ঝরাতেই কচি ধানের সবুজ পাতার সে কী হাসি!
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হল বাইরে ঝড় বৃষ্টি থেমে গেছে। জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি পরিস্কার আকাশে উঠেছে ভোরের চাঁদ। আবার কখন ফিরে এসেছে আলো। বন্ধ করা হয়নি কম্পিউটার। কারেন্ট আসতেই কম্পিউটারের মুছে যাওয়া স্কিনে আবার দেখি জ্বলজ্বল করে ফুটে উঠেছে লেখা। বছর দশকের ছেলেটা তখনও একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে নদী বাঁধে। মাথা নিচু করে পায়ের দিকে তাকিয়ে সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে।
তা তোরা থাকিস কোথা ? ছেলেটি নিরুত্তর।
একবার উদাসীন চোখে তাকিয়ে মাথা নিচু করে নেয়।
তোদের ঘর কোথা ? কোথা বাড়ি তোদের ?
ঘর ! ঘর ! বলতে বলতে চারিদিকে তাকায় ছেলেটা।
তারপর একটু থেমে হাত বাড়িয়ে দেখায়- ঐ ঐ তো ! ওখানে।
ওখানে ? ওখানে তো কিছু নেই রে !
ছেলেটি এবার যেন একটু জোর দিয়েই বলে, ঐ ঐ ওখানেই তো আমাদের ঘর। ওখানে ! ওখানে !
ও, ওখানেই তাহলে তোদের ঘর ছিল ?
হ্যাঁ, একটা ঘর ছিল। কাকাদেরও ছিল। নব হাজরা, শ্যাম মাইতি আর কেদার মোল্লার দল এসে ভেঙে দিয়ে গেছে।
তাহলে তোরা এখন থাকিস কোথা ?
ছেলেটি হাত বাড়িয়ে দেখায়- আমরা ঐদিকে থাকি।
তোর সঙ্গে আর কে আছে ?
মা আছে, বাবা আছে, আরও অনেকে আছে।
তারা কোথা ?
ঐ ওখানে সব পাহারা দিচ্ছে। ছেলেটি নদী বাঁধ ধরে চলে যায় দূর গ্রামে। সাংবাদিকটিও ছেলেটিকে অনুসরণ করে।
সূর্যাস্তের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে সরু বাঁধের দুপাশে বিছানো শীতলপাটির মতো নোনা জলের ভেড়ি গুলোতে। স্থির শান্ত জলের ক্যানভাসে লাল রঙের হালকা পোঁচ। বাঁশের ডগায় বসে দু-একটা ফিঙে তাকিয়ে আছে আগুন রাঙা আকাশের দিকে। তিনশো চারশো বিঘার এক একটা ভেড়ি। ভেরির মাঝখান দিয়ে সরু আল পথ মিশে গেছে ফিসারি অফিসের সংলগ্ন মাঠে। কী হয় না এই মাঠে ! পার্টির ছেলেদের নিয়ে ছোটখাটো দলীয় সভা, জলকর অফিসের বাবুদের সান্ধ্য আমোদ-প্রমোদ, ফুটবল প্রতিযোগিতা, জমি দিতে অনিচ্ছুক কৃষকদের ডেকে এনে চাপ সৃষ্টির নানা কৌশল, পুলিশবাবুদের সঙ্গে নিয়ে ফিসারির বিরুদ্ধে চক্রান্তকারিদের খুঁজে বের করার আগে তাদের তালিকা প্রস্তুত, বাইরের কোনও যোগসাজশ আছে কিনা তার গুরু গম্ভীর পর্যালোচনা আরও কত কি হয় এখানে।
দূর গ্রামে লাঠি হাতে গ্রাম পাহারা দিচ্ছে ছেলেটির মা, ঠাকুমা, কাকিমা, পিসিমা, জেঠিমা, দিদিরা। নিতান্ত সাধারণ ঘরের মহিলা সব। দল বেঁধে ঘুরে দেড়াচ্ছে। পুলিশ প্রশাসনের কাউকে দেখলেই ঘিরে ধরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। চোখে মুখে তাদের প্রতিরোধের স্পষ্ট দৃঢ় বলীরেখা। সাংবাদিক দেখলে ছুটে আসছে অত্যাচারি জমি হাঙরদের কুকর্মের অভিযোগ ক্যামেরার সামনে তুলে ধরতে। ওদের স্বামী পুত্র কাকা খুড়ো ভাই দাদারা কেউ জেলে, কেউ পুলিশের ভয়ে লুকিয়ে বা পালিয়ে বাঁচে, কেউ কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে। ওরা জমি ভিটে জীবন জীবিকা সব হারিয়েছে। তবু ক্ষুধার্ত পশুদের হাত থেকে সম্মানটুকু বাঁচাতে দিনরাত গ্রাম পাহারা দিচ্ছে ! সাংবাদিক বন্ধুটিকে ওরা ঘিরে ধরতেই ছেলেটি চকিতে মিশে যায় লাঠি হাতে ব্যস্ত মায়েদের ভিড়ে।
কতদিন এভাবে পাহারা দিতে হবে ওরা জানে না। অতীতেও দিয়েছে। জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘের সঙ্গেই বাস করা তো নয় দ্বীপ বাসীদের, আজীবন লড়াই চালিয়ে যেতে হয় ভিটেমাটি জলজমি রক্ষা করতে। কখন কোন হাসান, হোসেন মিঞা কিংবা ভূইফোঁড় জঙ্গি নেতা বেতাল বাদশা হয়ে দেখা দেবে তা কেউ জানে না। এই গর্জে ওঠা মায়েদের দেখে সাংবাদিক বন্ধুর নিশ্চয়ই মনে হবে কাকদ্বীপের সেই চন্দনপিঁড়ি মরেনি আজও। চন্দনপিঁড়ি শুধু একটা গ্রাম ছিল না, অহল্যা মায়ের রক্তে রাঙা মাটি। ‘অহল্যা মা তোমার সন্তান জন্ম নিল না/ঘরে ঘরে সেই সন্তানের প্রসব যন্ত্রণা।’ হঠাৎ সে ইতিহাস মনে পড়ে যাওয়ায় মনে হলো, বছর দশেক না হয়ে যদি এই ছেলেটির বয়স এখন আটাত্তর কিংবা আশি হতো তাহলে বোধহয় বেশ মানাতো।
কিংবা সেই যে আরও শ’খানেক বছর আগে, ওর পূর্ব পুরুষেরা কোন এক ইংরেজ সাহেবের চেষ্টায় কোম্পানির আবাদি জমি বৃদ্ধি করতে বনজঙ্গল কেটে বিষধর সাপ, কুমির, বুনো শূকর আর বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করে নদী সমুদ্রের চারপাশে বাঁধ দিয়ে নোনা জল আটকে ছিল- সে গল্প কি কেউ ওকে শুনিয়েছে ! সে গল্প এখানে মুখে মুখে ফেরে, আজ না শুনলেও একদিন শুনবে। আপাতত ছেলেটি সাংবাদিকের নাগালের বাইরে। এই ভিড়ে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। অন্যদিকে জেলার পুলিশ অধিকর্তা বিশাল বাহিনি নিয়েও প্রতিবাদী নারী ও শিশুদের সামলাতে হিমসিম খাচ্ছেন।
আমি তখন গল্প লেখা ভুলে অতীতে কান পেতে শুনছি। দূর থেকে ভেসে আসছে এক গান। শুধু শুনতে পাচ্ছি না, জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে ঐ বছর দশেকের ছেলেটির সঙ্গে গলা মিলিয়ে গাইছি - ‘চাষিদের খুনে রাঙা পথে দেখো, হায়নার আনাগোনা।’
ধীরে ধীরে অন্ধকার সূর্যাস্তের সব আগুন যেন গিলে নিচ্ছে।