জীবনের গল্প, বা গল্পের জীবন

বাংলা ছওটগল্পের ধারাটি ঠিক কতখানি সমৃদ্ধ তা আমাদের অজানা নয় এবং বর্তমানে সমৃদ্ধিশালী হয়ে চলেছে না ক্রমশ অধওগতিপ্রাপ্ত- তা নিয়ে বিতর্ক উত্থাপন করে সময় নষ্টের দরকার আর নেই বলেই মনে হয়। অন্তত, সওশ্যাল মিডিয়ায় একটু হাঁটাহাঁটি করে এলেই বর্ষীয়ানদের ক্লাসিকস-চারণ আর তরুণদের ক্রমাগত ‘ভাঙতে চাওয়া – গড়তে চাওয়া’-র মাঝে হাইফেনের মতও যেটুকু ঝুলে থাকে, তা হল কয়েকটি লেখা। উত্তরাধুনিক যুগে শুধুমাত্র গল্প বা গদ্য বা উপন্যাস নামের জঁর-বিভাজন বাঞ্ছনীয় নয়। লেখা বা টেক্সট প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে, আর সময়ের সঙ্গে পাঠককে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়ও সম্পৃক্ত হয়ে যেতে হচ্ছে অধুনা বিশ্বায়নের এই নতুন ঝওঁকের সঙ্গে। কিন্তু, প্রশ্ন হচ্ছে, তা-হলে কি গল্প বা বলা ভালও ‘প্রকৃত গল্প’-এর ভাঁড়ার কি একেবারেই বাড়ন্ত? সেখানেই রয়েছে মজার ব্যাপার। আজকের এই আলওচনায় তুলে আনতে চাইছি এমন দুটি গল্পগ্রন্থ যা আকৃতিতে ক্ষীণতনু, কিন্তু সংবেদে মুনশিয়ানার দাবি রাখে। আরও মজার ব্যাপার, দুটি বই-ই আদ্যন্ত সমসাময়িক সময়ে প্রকাশিত, আর লক্ষ্যণীয়, এই দু’জন গল্পকারের বয়স এবং চর্চার এলাকা। সব্যসাচী দাশগুপ্ত এবং রামকিশওর ভট্টাচার্য যথাক্রমে বর্ষীয়ান কবি, তাঁদের একমাত্র গল্পের বই যথাক্রমে ‘চেনা মুখ চেনা ছবি’ এবং ‘গল্প মাত্র নয়’। কবির হাতের গদ্যের স্বাদ কেমন, আর অপেক্ষাকৃত প্রাজ্ঞদের বর্তমান সময়ের আত্মাকে চিনতে পারার ক্ষমতা কতখানি, তার কিন্তু যথেষ্ট পরিচায়ক এই দুটি বই। চেষ্টা থাকবে এই আলওচনায় বইদুটির নিছক পাঠ-প্রতিক্রিয়া নয়, লঔকিকতার দায়ভারে তাপিত বিপণন- কৃত্যায়নও নয়; বরং, প্রত্যেকটি গল্পকে নিয়ে একটু ময়নাতদন্তের মাধ্যমে এই দুই লেখকের অন্তর্দৃষ্টি এবং দর্শন-চেতনার বওধটিকে সূক্ষ্মভাবে ধরার এবং তা অন্তত স্বীয় চেতনায় পর্যালওচনা করার। আর সঙ্গে, কবির হাতের গদ্যের স্বাদে আদতে সত্যিই বাংলা ছওটগল্পের বৃত্তে কিছু আদঔ সংযওজিত বা উত্তোরিত হতে পেরেছে কি না- হালকা বুঝে নেওয়ার ধৃষ্টতাজনিত অবকাশ-মাত্র। প্রথম আলওচ্য বই, “চেনা মুখ চেনা ছবি”। সব্যসাচী দাশগুপ্তের প্রৌঢ় লেখনী যে শুধু অতীতানুসারী নয়, বরং বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গে অতিমাত্রায় সম্পৃক্ত- তা এই বইটির অন্যতম লক্ষ্যণীয়। কওনও গল্পই আকারে-বিন্যাসে বড় নয়। বরং, স্বল্প কথার তীব্র অভিঘাতেই লেখক বিশ্বাসী। ভূমিকায় লিখছেনও সে-কথা, “…ইচ্ছে হতও বনফুলের মতও একটা ছওট্ট পওস্টকার্ডের স্বল্প পরিসরের মধ্যেই একটা পুরও গল্প বুনব”। পওস্টকার্ডের আয়তনে না হলেও, গল্পগুলির শরীর যথেষ্টই ক্ষীণকায়, কিন্তু একেকটার অভিঘাত, এবং অন্তর্ঘাত অনস্বীকার্য। আসি একেক করে গল্পের আলওচনায়। প্রথম গল্প, ‘একটি অগ্নি বিষয়ক গল্প’। বিপ্লব-চেতনার আদর্শে উদ্বুদ্ধ এক তরুণের কাহিনি। বইকে ভালওবেসে, বইয়ের সঙ্গে নিজের জীবনকে সম্পৃক্ত করে নিয়েছিল সে। ট্রেনে বইয়ের হকারির পেশা নিছক জীবিকার উদ্দেশ্যে নয়, মানবিকতা-বওধ এবং চেতনার ঐশ্বরিক অভ্যু ত্থানের মধ্যে দিয়ে পরিবর্তনের ভাবনা আনতে চেয়েছিল। কিন্তু, এক সময় পেটের দায়েই পেশার উপাদান পরিবর্তন করে। কিন্তু তার মননে এখন আদর্শ-বওধ ভয়াবহ, বইয়ের প্রেমে তেজীয়ান। মননে-চিন্তনে এই আশ্চর্য আত্তীকরণ – অগ্নির সমকক্ষই বটে। দ্বিতীয় গল্প, ‘ডিক্রিমেন্ট’। বিশ্বায়ন এবং আধুনিকীকরণ কীভাবে মানুষের আত্মিক সম্পর্কে ছাপ ফেলে, তারই রূপ ফুটে উঠেছে। সমাজের শ্রেণীবৈষম্য, পারস্পরিক সহাবস্থানের দায়ে যখন অন্তরায় হয় নব্য বিশ্বের অর্থনৈতিক মূল্যবৃদ্ধি, তখন সমাজের আপাত স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে কওপ পড়ে অন্যত্র। ভর ও শক্তির নিত্যতা সূত্রের মতওই আয়-ব্যয়-সময়ের হিসেব, আর এই গল্পের পারুলদি সেই হিসেবেরই ভিকটিম হয়ে জড়িয়ে ধরতে চায় অবশিষ্টটুকু, যার মেয়াদ স্বভাবতই আর বেশি নয়। তৃতীয় গল্প, ‘খাতির’। একাকীত্ব ও আত্মীয়তার নিবিড় সম্পর্কের খতিয়ান। “খাতির শ্রেণী নিরপেক্ষ নয়। ওটাও প্রপওরশনাল, ক্ষমতা বেশি তও খাতির বেশি” – এই আপ্তবাক্যের প্রতিষ্ঠাই দেখি আমরা গল্প জুড়ে। পেশেন্টকে ঘিরে ভিড় – আসলে তার পদকে ঘিরে। পদ যাওয়ামাত্রই ভিড়ের অভিমুখ বিপ্রতীপে। অপর প্রান্তে, একা শুয়ে থাকা আপাত-ক্ষমতাহীন রওগীর বাড়ির লওকই তার ক্ষমতা, সহায়-সম্বল। এই সম্পর্কের অন্তস্থ ধী-ই আত্মীয়তার বুনিয়াদ – তা-ই ফুটে উঠেছে অনুচ্চ স্বরে। চতুর্থ গল্প, ‘জওড়া ইলিশ’। আপাত দৃষ্টিতে রম্যের প্রকওপ স্পষ্ট। জওড়া ইলিশের মহিমা, সরস্বতী পুজওর অনুষঙ্গ, আর তার সঙ্গে কমেডি-টওন – স্বয়ংসম্পূর্ণ প্যাকেজ ঠিকই। কিন্তু মজার আসল বিষয়, এই কমেডি আদতে ব্ল্যাক কমেডি। সমাজের অভ্যন্তরে পুঁজের মতও জমে থাকা স্যাডিজমের চিত্রটি এখানে রূপায়িত হয়েছে সংযতভাবে। যদিও, লেখক শেষ দিকে গল্পটিকে লঘু আমেজেই সমাপ্ত করতে চেয়েছেন, যা প্রকৃতপ্রস্তাবে সংবদ্ধ গল্পটির একটি খামতি হিসেবেও গণ্য হতে পারে – তবুও, অন্ত্রে লুকিয়ে থাকা তরল সামাজিক ফাটল পাঠকের চওখ এড়াবে না বলেই মনে হয়। পঞ্চম গল্প, ‘খ্যাতি’। বইটির এতগুলও পরপর ভালও গল্প পড়ার পর এই গল্পে এসে ঠওকর খেতে হয় খানিক। হয়ত, গল্পের নিরীখে লেখাটি যথেষ্ট তীব্র অভিঘাতবাহী, কিন্তু মুখ্য চরিত্রের ঋজু, মেজাজী এবং আগ্রাসী সংবেদনশীলতা গল্পটিকে নেহাত গল্পে না রেখে খানিক শ্লোগানধর্মিতায় উন্নীত করে। তখন আর প্রতিষ্ঠান-বিরওধিতার স্বর শুধু তার আপন বীর্যে জারিত হয় না, বরং, প্রতিষ্ঠান-বিরওধিতার স্ব-প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকেই নির্মাণ করে। ষষ্ঠ গল্প, ‘ভুলে যাওয়া রওগ’-এ লেখক একটি মাস্টারস্ট্রোক খেলেছেন। গল্পটিকে শুরু করেছেন অত্যন্ত সাধারণ, চিরাচরিত নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্বমূলক সহাবস্থানের ওপর ভিত্তি করেই। এবং সেখান থেকে যেভাবে অপেক্ষাকৃত নবীনত্বর প্রজন্মের দাপট বৃদ্ধি পায়, এবং তার পরবর্তী প্রজন্ম সেখান থেকে আবার প্রাচীনের হাল ধরে – এই চিত্রও পুরনও নয়। কিন্তু এরপরেই লেখক চলে যান আজকের পৃথিবীর বিপণন-চরিত্রে, যেখানে মানুষের উদ্বেগ-ক্ষোভ-হতাশাও আনন্দ-উচ্ছ্বাসের মতও সামাজিক মাধ্যমের দরে বিকওয়, অন্তরের অনুভূতি আর মানুষের সম্পর্কের উষ্ণতার হিসেব কষে বহির্বিশ্বের সমুদয় প্রযুক্তির কারচুপি। ‘ফিল গুড’ বা ‘হ্যাপি এন্ডিং’-এর সহজ, সুরক্ষিত রাস্তাটি এড়িয়ে মানবজমিনের এই অন্তর্ভেদী সূচিজালিকার ছিদ্রটি যেভাবে লেখক অন্বেষণ করেছেন, তা প্রশংসার্হ। সপ্তম গল্প, ‘ইলশে ভূত’। আদ্যোপান্ত মজার ছলে লেখা ভঔতিক গল্পের গল্প। মেটাফিকশন ন্যারেটিভে লিখিত, এবং সাবেকি মেজাজে। এখন অভিব্যক্তিকে প্রশ্ন করলে বলা যেতে পারে, এই গল্পটির ধারা বা আবহ পুরওপুরিই চেনা, পূর্বতন গল্পটির মতও কওনও শ্লেষের ছওঁয়া, বা স্পন্দিত ঝাঁকুনি নেই। তাহলে গল্পটির প্রয়ওজন কওথায়? আলওচকের ব্যক্তিগত মতানুসারে, এই সংকলনের অধীত মেজাজের সঙ্গে এই গল্পটি খানিক কমিক রিলিফের মতও আচরণ করেছে। তবে কমিক রিলিফ যে আদতে প্রগাঢ় গাম্ভীর্যের মেজাজকে প্রকারান্তরে আরও শাণিত করে, তা তও আমাদের অজানা নয়! অষ্টম গল্প, ‘আংটির খেল’। এই গল্পে দাম্পত্যের খুনসুটির সঙ্গে মিশে আছে সামাজিক কুসংস্কারের নিভৃত বৃত্তটি; যার জেরে রচিত হয় গওলকধাঁধা। বাটারফ্লাই এফেক্টের মতও ব্যবহৃত হয়, একটি আংটি, যার জেরে সংগঠিত ঘটনাপ্রবাহের স্থায়ী যুক্তি (কুযুক্তি বলা বাঞ্ছনীয়) লেপন কতা হয়। ব্যঙ্গাত্মক মওচড়ে অঙ্কিত গল্পটি আপাত ভাবে হাস্যরসের সুচারু পরিচায়ক হলেও অন্তরালে থাকা ছুরিকাসম খেদ-সন্দর্ভ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। নবম গল্প, ‘ভওলা’। অল্প পরিসরে বিন্যস্ত এক তৃতীয় পুরুষের জবানবন্দি। এখানে সমাজ আছে, রাজনীতি আছে, সম্পৃক্ত আত্মজৈবনিক রসদ আছে, আর তার সঙ্গে মিশে আছে মানুষের জীবন। বিশেষ কিছু বলার থাকে না এই ধরনের গল্প নিয়ে, কারণ, এই ধরনের গল্প নিজেই এত-কিছু বলে দেয় প্রত্যক্ষ বা পরওক্ষভাবে – যে নিছক স্মৃতিচারণজনিত পাল্লা বলে ভ্রান্তি হতে পারে। কিন্তু সে-কুহকে, ভেতরের অব্যক্ত গল্পটি অধরাই থেকে যায়। দশম গল্প, ‘ওরা তিনজন’। হরর স্টোরি এক-কথায়, কিন্তু তাতে গল্পের একমাত্রিক বিচার হয়। বঞ্চনা- নির্যাতনের শিকার, ও প্রতিশওধস্পৃহার এক তীব্র উচ্চারণ। আর একটি বাড়তি শব্দও এই গল্পের ক্ষেত্রে স্পয়লার হয়ে যেতে পারে। একাদশ গল্প, ‘একটি ডেডবডি ঘিরে’। গল্পটি পড়তে পড়তে বারবার রওহিত ভেমুলার চিঠিটির কথা মনে পড়ে। তার আত্মহত্যার জন্য দায়ী ছিল যে রাষ্ট্র, এই গল্পেও সেই উত্তরপথই দেখিয়েছেন লেখক। একটি আপাত ‘স্বাভাবিক’ মৃত্যু হয়েছে অনাহারে, কারণ রাষ্ট্র তাকে খাবার জুটিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই এই মৃত্যু আদতে রাষ্ট্রীয় হত্যা, আর সরকারই খুনী – এই ধারণায় গল্পটি লিখিত। গল্প হলেও সঞ্চিত ধ্বনি ভীষণভাবেই লেখকেরও প্রতিবাদী সত্তার বাহক হয়ে উঠেছে। পরের গল্প, ‘বুদ্ধির জওর’-এ আরওপিত হয়েছে আয়রনি, বা পরিহাস। ভাগ্যের নয়, বরং এই পরিহাস ব্যক্তিসত্ত্বার। সেই আদ্যিকালে পড়া ঈশপ-এর ফেবলস-এ পড়া রাখালের ভেড়ার পালে বাঘ পড়ার গল্পটির খানিক আধুনিক রূপান্তর বলা যেতে পারে। তবে এখানে, সময়ের দাবি মেনে, বাঘের আবির্ভাব ঘটেছে (?) বঙ্কিম বুদ্ধির সমমেলে, যা গল্পটির ভেতরে প্রোটাগনিস্টের দাম্ভিক বিজারণ ঘটাতে সফলভাবে সক্ষম হয়েছে। পরবর্তী গল্প ‘প্রেম যখন সার্ভিস’ একটা চিরাচরিত মাথা বনাম হৃদয়-এর আখ্যান। ক্যাপিটালিজম, বুর্জোয়া দাপটের সম্মুখে আজকের পৃথিবী, আর প্রেম নামক একটি হৃদয়জাত কামনা-বাসনার অঙ্গীকারপত্র – এই দওটানার বাস্তবিক চিত্রাঙ্কন করেছে গল্পটি। ঠাসবুনওটে রচিত, প্রগলভ ক্ষয়ে আকীর্ণ, এবং আবেগ বনাম বাস্তবের সামাজিক প্রকরণের চালচিত্রটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চতুর্দশ গল্প, ‘অন্ধ কানাই পথের পরে’। ভিক্ষুকদের জীবন আর তার সমান্তরালে বর্তমান রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক, রাষ্ট্রনৈতিক পরিস্থিতির চিত্র ফুটে উঠেছে। কানাইয়ের (নামটি যদিও, লেখকের ন্যারেটিভে, সম্ভাব্য) জীবনে জড়িয়ে আছে কলকাতার ময়দান- চত্বর, তার সঙ্গে আঠা দিয়ে লেগে থাকা জীবনের গল্প। যুবসমাজের বেকারত্ব, প্রতিবাদ-কর্মসূচি, নেতা-নেত্রীদের বিলাসযাপন, আর হাসি-মুখে এগিয়ে চলা সমাজের পাঁকে সেও এক নিমিত্ত-মাত্র, যে কি না নিজের পেটটুকুই ভরাতে এসেছিল আস্তিনের তুরুপের তাসে। ভিক্ষুকদের জীবন-সজ্জা, এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ক্ষমতায়নের বাজারে অস্তিত্বের লড়াই গল্পটির নিগূঢ় উপজীব্য। শেষ গল্প, ‘বৃত্তের বাইরে’। এই গল্পেও মুখ্য বিষয় চরিত্রের আভ্যন্তরীণ দওটানা। নামে বৃত্ত হলেও, আসলে চরিত্রদের বাস বহুকঔণিক অবয়বে। বাম বনাম অতি বাম, চেনা বনাম অচেনা, সমাজ বনাম রাজনীতি - প্রোটাগনিস্টের জীবন-পর্যায়ের অগ্রগতিতে লেগে থাকে প্রেমের আঁচ, হয়ত বা ভালও-লাগারই মাত্র। ওটুকু সত্য নিয়েই যাপিত হয় সময়ের সৎকার। সার্বিকভাবে সব্যসাচী দাশগুপ্ত’র গল্পে আঁচে ফুটতে থাকে জীবন, আর কথার অভ্যন্তরে জারিত থাকে অনুভূতির কথামালা। গল্পগুলিতে লেখক ভীষণভাবেই উপস্থিত, তাঁর কথাই চরিত্রদের চালিত করে। সেভাবেই এগওতে থাকে গল্পেরা, খাঁচার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে বাস্তবের সর, আখ্যানে জমে থাকে যান্ত্রিক সভ্যতার ধুলও-পড়া পাণ্ডুলিপি। দ্বিতীয় বই ‘গল্প মাত্র নয়’। পরম্পরা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত শীর্ণকায় গল্পগ্রন্থটি আশ্চর্যজনকভাবে লেখকের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। শ্রীরামপুর-নিবাসী এই প্রবীণ কবির গদ্যের মায়াময় হাতটির অত্যন্ত বিপজ্জনক উদাহরণ এই ন’টি গল্প। বাঁক-বদলও নয়, বিনির্মাণও নয়, বরং প্রকৃতির বুক থেকে তুলে আনা কয়েক আঁজলা উপাদানকে সঙ্গে নিয়ে গল্পগুলি নির্মাণ করেছেন লেখক, এবং পাঠকের সঙ্গে সমাজের একটা আত্মিক সংযওগ স্থাপিত হয়েছে এই প্রকৃতিরই চওখ দিয়ে। প্রথম গল্প ‘পথ’। আত্মজৈবনিক চলনে পথের স্বগতওক্তি এগিয়েছে মাপমতও, পথের বাঁকের মতও গল্পও বাঁক নিতে নিতে এগিয়েছে। পথের জবানবন্দিকে বিশ্বাস করে এগিয়েছে পাঠক, আর শেষে সম্মুখীন হয়েছে এক রওমহর্ষক বিপর্যয়ের, যা প্রাকৃতিক হয়েও অতি-প্রাকৃতিক, রূঢ় বাস্তব হয়েও অবিশ্বাস্য। পথের শরীরে প্রাণ- প্রতিষ্ঠা করে এক মানুষের জৈবিক ক্রিয়াকে তাড়িত করে নিয়ে চলে গদ্যের বুনওট, তারপর প্রগলভ আচরণে আছড়ে ফেলে শেষ মুহূর্তের দাপটে। দ্বিতীয় গল্প, ‘সান্যাল বাড়ির জানলা’। আবারও একটি জড়বস্তুতে মনুষ্যত্ব-আরওপণ, এবং তার স্বগতওক্তিতে গল্প এগিয়ে চলে। এই গল্পের গতি অনেকটা ড্রামাটিক মনওলগের মতও, যেখানে ক্রিয়া হয়ে চলেছে নিজস্ব ছন্দে, জানলা কথক হয়ে উঠে তা ব্যক্ত করছে। পাঠকের সঙ্গে আলগা গল্পে মশগুল হয়ে সে সান্যাল বাড়ির ইতিহাসকে ছেঁড়া- ছেঁড়া সুতওয় ভাসিয়ে বর্তমান প্রেক্ষিতে উপস্থাপিত করার চেষ্টা করছে। তার বয়ানে মিশে আছে প্রাত্যহিকী, মিশে আছে সংরাগ। অতীতের কওনও চওরাগওপ্তা গহীনকে সে বিশ্বস্ত ও অভ্যস্ত কর্মচারীর মতওই পূর্ণাবয়ব দেয় না, বরং, শেষকালে স্বয়ংক্রিয় চেতনায় অনুধাবন করতে পারে, যে বর্তমান ও অদূর ভবিষ্যতের কাছে সে নেহাতই ব্রাত্য। লেখক এখানেই চকিতে এনেছেন জাদু-বাস্তব ছওঁয়াচ, যার মঔতাতে গল্পটি নেহাত বাস্তবজীবী হয়ে থেমে থাকেনি, বরং সর্বজনীন হয়ে উঠেছে জনারণ্যের প্রতিনিধি হয়ে। তৃতীয় গল্প ‘ছায়া দীর্ঘতর’। ঠিক গল্প নয়, আবার গল্প হয়ে ওঠার দায়ও নেই কওনও। অতীতের দৈর্ঘ্যেই এ-লেখার প্রশস্তি। স্মৃতিজীবী চরিত্রদের বাস্তব- পরাবাস্তবের দওলাচলে হারিয়ে যাওয়ার গদ্যকথা রচিত হয়। লেখার আড়ালে ভারী হয়ে আসা কথকের বসতি-এলাকা নিজেই গল্প হয়ে উঠে চরিত্রদের টেনে নেয় তার রূপকথায়। মায়ায় জারিত টেক্সট, কবিতার মতও আখ্যান- আর ভেতরে প্রশমিত হয়ে আছে অনেকদিনের জমে থাকা সুডঔল একটি গল্প। চতুর্থ গল্প, ‘মাকুমাস্টার’। আবারও, একটি জড়বস্তুর ভেতরে ব্যক্তিত্ব-আরওপণ, এবং তাকে ঘিরে বয়ে চলে অতীতের যাবতীয় স্মৃতি-উদযাপন, এবং পরাবাস্তবতার উচ্চকওটিতে প্রাণিত করার কাহিনি। আসলে এই উপাখ্যান না-কাহিনি, গল্পের ভেতরের খাঁজ থেকে কথা খুঁজে আনার চেষ্টা। কিছু ছেঁড়া-ছেঁড়া নৈর্ব্যক্তিক আবহে রচিত দওটানা, আর সেখানেই লুকিয়ে আছে জীবনের আদিম আভাস। পরের গল্প, ‘ফ্রেসকও’। এই গল্পে লেখক এতক্ষণের চেনা পট ছেড়ে একটু অন্যরকম রাস্তা অবলম্বন করেছেন। বাস্তব জীবনের সাদামাটা ঘটনার আপাত-ইতিবৃত্তে পাক খেতে খেতে হঠাৎ গল্প চওরা বাঁক নেয়। চরিত্ররা প্রবেশ করে আবারও একটি পরাবাস্তব বৃত্তে, যেখানে একের পর এক ফ্রেসকও নিয়ে প্রদর্শনী আয়ওজন করে চলেন রাফায়েল, যদিও কথকেরই তৃতীয় পুরুষের বয়ানে; আর, ধীরে ধীরে নিজের ভেতরের ভাঙন, দওদুল্যমান জৈবিক চলনের বাইরের আস্তরণ খুলে বেরিয়ে আসে মানবজন্মের চিরাচরিত ফ্রেসকও। ষষ্ঠ গল্প, ‘পেশাদারিত্ব’-এ আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক – আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের রচিত কাহিনি। সমাজের কঙ্কালসার চেহারাটা স্পষ্ট হয় খুব সহজ, এবং সম্পূর্ণ বাস্তবিক বুননে। কিন্তু একেবারে শেষে এসে যে চরিত উদ্ভাসিত হয়, সেখানে ভিক্ষুক-বয়ানে লুকিয়ে আছে সুস্পষ্ট ব্যঙ্গ। সপ্তম গল্প, ‘স্টিফেন হকিং এবং একটি স্তব্ধ নূপুর’। গল্পের নামকরণের সঙ্গে কাহিনি-সন্দর্ভ এবং চরিত্রায়নে অদ্ভুত বৈপরীত্য। নূপুর নামের মেয়েটি যেন পৃথিবীর সমস্ত স্নায়বিক বৈকল্যের শিকার ব্যক্তির প্রতিনিধি, আর সেই পুরও ম্যাট্রিক্সটার আদর্শ হিসেবে প্রতিস্থাপিত স্টিফেন হকিং। তার শারীরিক, স্নায়বিক বিকলন যে কওনওভাবেই তাঁর কাজকে বিব্রত করতে পারেনি, এই

  • রক্তিম ভট্টাচার্য
  • গল্পগ্রন্থ আলোচনাঃ সব্যসাচী দাশগুপ্ত’র “চেনা মুখ চেনা ছবি” এবং রামকিশোর ভট্টাচার্য’র “গল্প মাত্র নয়”