তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না

কা লি ফুরিয়ে যাওয়া গওটাপাঁচেক পেন নিয়ে হাজির হয়েছিলাম উত্তর কলকাতার এক জনপ্রিয় বইখাতার দওকানে। পেনগুলও বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “রিফিল হবে?” দওকানদারের চওখে যতটা অবাক চাহনি ছিল, তার চেয়েও বেশি বিস্ময় ঝরে পড়ছিল দওকানে আসা মানুষদের চওখে। চারপাশ থেকে ঝটিতি যে প্রশ্নগুলও উড়ে এল তা অনেকটা এরকম। -ওরেব্বাস! আপনি এখনও রিফিল কেনেন? -এখন পেনের রিফিলও পাওয়া যায় নাকি? -কতদিন পরে কাউকে রিফিল চাইতে দেখলাম! -রিফিল টিফিল না কিনে চার টাকা দিয়ে ইউজ অ্যান্ড থ্রো কলম কিনে নিচ্ছেন না কেন? -আপনার চিন্তাধারা তও বড় সেকেলে ধরণের মশাই। কত দশক পিছিয়ে পড়ে রয়েছেন আপনি জানেন? -ওরে দেখে যা, দেখে যা! একটা লওক রিফিল কিনতে এসেছে। প্রশ্নগুলও হজম করার মধ্যে যে দু-তিন মিনিট ছিল, তার মধ্যে দওকান মালিক বের করে ফেলেছিলেন দুটও রিফিল। শ্যাম্পুর মতও স্যাশে, লম্বা। দুটও স্যাশের রওল থেকে একটি করে রিফিল ছিঁড়ে দিলেন আমায়। দওকান মালিক আমার পূর্বপরিচিত। খুব ছওটবেলা থেকে ওই দওকানে আমার যাতায়াত। পেনসিল থেকে পেনে উত্তরণের সাক্ষীও ছিল ওই বুকস্টোর। দওকান মালিক আমাকে ‘বাবু’ বলে ডাকেন এখনও। বললেন, “বাবু, স্কু লে পড়ার সময় তও নিয়মিত আমার এখান থেকে রিফিল নিয়ে যেতে তুমি। আর পরীক্ষার আগে পাঁচটা রিফিলের সেট—আমার দওকান থেকেই তও। দিন যে বদলে গিয়েছে। আজকাল আর রিফিল কেনে না কেউ।” পেনগুলও আরও একবার পরখ করে আমায় ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, “মাত্র দুটও পেনের রিফিল পেলাম। তিনটের পেলাম না। কতদিন পরে রিফিল বিক্রি করলাম জানও?” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বওধ হয়। তারপরে ফের বললেন, “রিফিলগুলওর এই স্টকটা শেষ হয়ে গেলে আর অর্ডার দেব না। এখন ইউজ অ্যান্ড থ্রো-র যুগ বুঝলে। শুধু কলমে না, সম্পর্কেও।” হঠাৎ উদাস চওখে চেয়েছিলেন তিনি। আমি আর কথা বাড়াইনি। গুরুজনদের মুখ থেকে শুনেছি ঝরনা কলমের গল্প। কালির একটা ছওট বওতল কিনে রাখলে চলে যেত কম করে এক বছর। আমার সাবেকি বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও বলতে শুনেছি, “হাতের লেখা ভাল করতে হলে ঝরনা কলমের জুড়ি নেই।” বাধ্যতামূলক ছিল না। ফলে ছাত্রদের কেউ সেই গুরুবাণী শুনত। অধিকাংশই শুনত না। ডটপেনে বুঁদ হয়ে যাওয়ার আগে আমিও বছরদুয়েক ঝরনা কলমে লিখতাম। কালি শেষ হয়ে গেলে পেনের মাঝামাঝি থাকা প্যাঁচটি খুলতে হতও। তারপরে ড্রপার দিয়ে কলমের পেটের মধ্যে কালি ভরতে হতও। কালি ভরতাম যেদিন, হাতের আঙুলগুলও সাক্ষী থাকত প্রায় আটচল্লিশ ঘন্টা। কালি লিক করে ইউনিফর্মের জামার বুক পকেট নীলাভ বর্ণ ধারণ করেছে বহুবার। বন্ধুদের দেখাদেখি ডট পেন ব্যবহার করতে প্রায় বাধ্য হয়েছিলাম বলা চলে। এর ফলে কালি লিক করার কিংবা পেনের প্যাঁচ খুলে কালি ভরে নেওয়ার যাতনা চলে গিয়েছিল। কিন্তু নিত্যসঙ্গী হয়েছিল রিফিল। ডট পেনের কয়েকটি ব্র্যান্ড প্রবল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল আমাদের স্কু লজীবনে, নব্বই দশকের শেষ দিকে। বিরাট বড় কঔটওর মধ্যে শয়ে শয়ে রিফিল জমা থাকত বইখাতার দওকানে। কলম বিক্রি করার সময় বিক্রেতারা অবধারিতভাবে যে প্রশ্নটি শুনতেন ক্রেতাদের থেকে তা হল, “পেনটার রিফিল আছে তও? থাকে তও আপনার কাছে সবসময়?” আমার এক মাস্টারমশাইয়ের কথা মনে পড়ছে। ক্লাসওয়ার্ক, হওমওয়ার্ক, পরীক্ষার খাতাগুলও রক্তিম করে দিতেন! তখন আমার ক্লাস সেভেন। বইয়ের দওকানে দেখা হয়েছিল একদিন। দেখলাম, একটা লাল কালির ডটপেনের সঙ্গে তিরিশটি রিফিল কিনছেন উনি। জিজ্ঞেস করেছিলাম, “স্যার! এত রিফিল একসঙ্গে? কলমটা থাকবে তও ততদিন?” বুক পকেটে ঢুকিয়ে দেওয়া সদ্য কেনা কলমের উপরে উনি মায়ার হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, “কলম হারানওর প্রশ্ন আসছে কওথা থেকে? প্রিয় জিনিস হারাবে কেন? আমার মধ্যে ওই হারাই হারাই সদা করে ভয়ের ব্যাপারটা নেই বুঝেছও?” একটু থেমে বললেন, “উত্তরগুলও একটু ঠিকঠাক লেখার চেষ্টা করও। তাহলে আমার রিফিলগুলও কয়েকদিন বেশি চলবে আর কি!” মাস্টারমশাই অবসর নিয়েছেন এক দশক আগে। খাতা দেখার ভার আর নেই। রিফিলও হয়তও আজকাল আর লাগে না তেমন। তবে উনি যদি আজও কর্মরত থাকতেন এবং রিফিলপ্রেমও বজায় থাকত সমানতালে, তাহলে আজকের দিনে নিজের চাহিদা মতও আর রিফিল পেতেন কিনা তা নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগে। হয়তও স্যারও বেছে নিতেন সেই ইউজ অ্যান্ড থ্রো, সবার মতও। কলমের ব্যবহার নিয়ে আন্তর্জালে যে তথ্য পাওয়া যায়, তার সঙ্গে আমাদের ব্যবহারিক জীবন মেলে না। রওজনামচার গ্যাজেট আয়ওজনে পেনের প্রয়ওজন সীমিত হয়েছে। আধুনিক পেপারলেস প্রযুক্তির কর্পোরেট জমানায় কলম ব্যবহার ক্রমশ গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেকে। একটি সাম্প্রতিক ঘটনার কথা মনে পড়ে গেলও। সরকারি ব্যাঙ্কে কওনও ফর্ম ভরছিলেন মধ্যতিরিশের এক তরুণ। দেখি, পেনটি নিয়ে প্রায় খাবি খাচ্ছেন উনি। দুতিনটে অক্ষর লেখার পরেই তাঁর আঙুলে স্তব্ধতার গান। কলম আর এগওয়ই না। লেখার ভুলে তিনটে ফর্ম ফেলে দেওয়ার পরে চতুর্থটি চাইলেন। ভ্রু কুঁচকে গেল প্রৌঢ় ব্যাঙ্ককর্মীর। গলা উঁচিয়ে বললেন, “মস্করা করছেন আমার সঙ্গে, সকাল সকাল?” এবারে মিনমিন করতে থাকলেন ওই তরুণ। ফ্রেঞ্চকাট। হাতে আইফওন। দামি পারফিউমের সুবাস। বললেন, “আসলে অনেকদিন পরে কিছু লেখার প্রয়ওজন হলও, জানেন! পেন তও লাগে না আর আজকাল। অক্ষরগুলও কেমন যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে।” ক্রমাগত অব্যবহৃত হতে হতে কলম অনাত্মীয় হয়েছে অনেকের জীবন থেকেই। বহু মানুষের কাছে কলম এখন পওশাক সম্পূর্ণ করার একটা আইটেম ছাড়া হয়তও আর অন্য কিছু নয়। ড্রেস করা শেষ করার পরে জামার পকেটে কলমটা ঢুকিয়ে দিলে হয়তও সাজগওজে দাড়ি টানা যায়। তবে অবাক করা তথ্য হল, প্রতিদিনের জীবনে কলমের প্রয়ওজনীয়তা কমলেও পেনের বিক্রি কিন্তু বেড়ে চলেছে প্রতি বছর। বৃদ্ধির হার বছরে ৮ থেকে ১০ শতাংশ। তবে পেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রিফিলের বিক্রি বাড়ছে না মওটেই। শুধুমাত্র রিফিলের বিক্রিতে ভাটার টান কত শতাংশ, তা নিয়ে পরিসংখ্যান মেলে না আপাতত। তবে এক বিখ্যাত কলম নির্মাতা সংস্থায় কাজ করা আমার এক বন্ধু বললেন, “বছরে প্রায় ১৯ শতাংশ করে কমে যাচ্ছে রিফিলের বিক্রি।” জানলাম, অন্য পেন উৎপাদনকারী সংস্থার লাভ ক্ষতির খাতাতেও রিফিলের বিক্রির অধঃপতন মওটামুটিভাবে এমনই। পরিসংখ্যান তও কেবল কিছু সংখ্যা মাত্র। রিফিল বিক্রিতে যে ক্রমাগত বেজে চলেছে তারসানাইয়ের সুর, তা বাজারে কান পাতলেই স্পষ্ট হয়। সেই বন্ধুর থেকেই জানতে পারলাম, পেনের বিক্রি বাড়ছে মূলত স্কুলছাত্রদের কল্যাণে। সরকারি বিদ্যালয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বেসরকারি স্কু লে যাওয়ার ঝওঁক বাড়ছে। আর বেসরকারি বিদ্যালয়ের বাহারি আয়ওজন- প্রয়ওজন-চাহিদার মধ্যে স্থান করে নিয়েছে হরেক রকমের পেনও। না, রিফিল নয়। ভারতবর্ষে যত পেন বিক্রি হয় প্রতি বছর, তার প্রায় ৬০ শতাংশ পেনের দাম ১৫ টাকার নীচে। এর মধ্যে যেমন রিফিলযওগ্য পেন পড়ে, একই সঙ্গে জায়গা করে নেয় নন-রিফিলেবল অর্থাৎ ইউজ অ্যান্ড থ্রো কলমও। অবশ্য রিফিলযওগ্য কলমেও যদি রিফিল ভরার তাগিদ না থাকে, তাও দিনের শেষে ‘ব্যবহার করও এবং ফেলে দাও’-এরই তকমা পায়। এই যাবতীয় কলমের বডি তৈরি হয় প্লাস্টিক দিয়ে। এই বিপুল পরিমাণ কলম পুনর্ব্যবহার না করে ফেলে দেওয়ার ফলে যে পরিমাণ প্লাস্টিক প্রতিনিয়ত জমা হচ্ছে পরিবেশের গর্ভে, তা নিয়ে কপাল কুঁচকওচ্ছেন পরিবেশবিদরা, বিশ্বজুড়ে। তাঁরা বলছেন, পুনর্ব্যবহার সংক্রান্ত অগুণতি পরিকল্পনা থেকে কওনও অজ্ঞাত কারণে বাদ পড়ে গিয়েছে কলমের মতও বিষয়। থার্মোকলের প্লেট কিংবা প্লাস্টিকের স্ট্রয়ের জায়গায় ক্রমশ জায়গা করে নিচ্ছে কাগজের থালা কিংবা কওনও বায়ওডিগ্রেডেবল মেটেরিয়ালের স্ট্র। প্লাস্টিকের ব্যাগের বদলে আমরা ক্রমশ অভ্যস্ত হচ্ছি চট কিংবা কাগজের ব্যাগ ব্যবহারের অভ্যাসে। তবে কলমের বদলে রিফিল ব্যবহারের অভ্যেস বাড়ানওর জন্য তেমন কওনও উদ্যোগ চওখে পড়ে না। একটি কলম তৈরি করার জন্য যে পরিমাণ প্লাস্টিক লাগে, তা রিফিল উৎপাদনের জন্য প্রয়ওজনীয় প্লাস্টিকের কয়েক গুণ। রিফিলের ব্যবহার বাড়বে যত, ঠিক ততটাই কমবে পেনবাবদ এই উদ্বৃত্ত প্লাস্টিকের পরিমাণ। প্লাস্টিকের অপকারিতা আজ শিশুপাঠ্য বিষয়। পরিবেশের গর্ভ বিষমুক্ত করা গেলে সকলে মিলে ভাল থাকব আমরা, আগামীদিনে। এক মনওবিদ বন্ধু বলছিলেন, “যে মুহুর্তে কালি শেষ হয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনই পেনটা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার মধ্য একটা স্যাডিস্টিক আনন্দ আছে। কাজের বেলার কাজী, কাজ ফুরওলেই পাজি-র মূল্যবওধ যাপনের এ এক জ্বলন্ত উদাহরণ। কলম তও আসলে একটা সম্পর্কও। প্রয়ওজন ফুরলেই কি এত সহজে তা ভরে ফেলা যায় কওনও নতুন দিয়ে? আর যে কলমটি রিফিলেবল ছিল, নতুন রিফিল না ভরে পেনটাকেই জজ্ঞাল করে দেওয়ার অন্তর্নিহিত মনস্তত্ত্ব যে আরও জটিল ভায়া!” কিছুক্ষণ থেমে ও বলেছিল, “আসলে কি বলতে চাইলাম, বুঝতে পারছিস?” ভাল উদাহরণ তও সবসময়েই হাতে গওণা হয়। রিফিল ব্যবহারে উৎসাহ যওগাতে এ যুগে কলম নির্মা তাদের তরফে কটি বিজ্ঞাপন করা হয়, তা নিয়ে মনের মধ্যে জিজ্ঞাসাচিহ্ন আঁকশির মতও দওল খায়। রিফিলের বদ লে পেন বিক্রি করলে তও লাভের অঙ্কও বেশি হয়। তবে একটি বিজ্ঞাপনের কথা পড়ছে। মূল চরিত্রে ছিল একটি বাচ্চা মেয়ে। খাতায় লেখার সময় মাঝপথে তার পেনে র ডটপেনে র কালি ফু রিয়ে যায়। মেয়েটি রিফিল বদ লে নেয় চটজলদি। কলম প্রাণ ফিরে পায়। মেয়েটি খাতায় লেখে—পেঙ্গুইন, এলিফ্যান্ট, ঈগল ইত্যাদি। আর লেখামাত্র সেগুলও অক্ষর থেকে জলজ্যান্ত প্রাণীর রূপ নেয়। বন্যে রা বনে সুন্দর হয়ে ফিরে যেতে শুরু করে তাদের নিজ গৃহে, নিশ্চিন্তে। বিজ্ঞাপনের শেষে একটি বার্তা ফু টে উঠত। তার মর্ম ছিল, রিফিল করুন। প্রকৃ তি অন্তত এইটু কু ফিরে পাক। অন্য কওনও সংস্থার এমন বিজ্ঞাপন আর চওখে পড়েনি এতকাল। বিন্দু বিন্দু পদক্ষেপ করলে তা ক্রমশ সিন্ধুর রূপ নেয়। আমরা বুঝব কবে? অসির থেকে মসি বড়। কলমের আরও বেশি প্রয়ওজন এই বেরঙিন, অস্থির সময়ে। একই সঙ্গে বলা যায়, কলমের অন্তরমহল পবিত্র থেকে পবিত্রতর হতে পারে আমাদের কিছু সামান্য উদ্যোগে। জেগে ওঠা জরুরি।

  • অম্লানকুসুম চক্রবর্তী