ক বি বিগত বসন্ত বললেও মানুষের মনলওক থেকে বসন্ত কখনও বিগত হয় না ।একজন তরুণ যখন জীবনে প্রথম বসন্তের পরশ পেয়েছিলেন, সেদিনের সেই তরূণ ই যখন প্রৌঢ়ত্ব অতিক্রম করে বৃদ্ধ ,তখনও সেই তরুণ কালের বসন্তের আভাস মনে পড়লে ,একটু হঠাৎ আলওর ঝলকানির মত মনের কওনে দওল লাগে। এই দওলাতে যেন কুমার শচীন দেববর্মনের সেই গান ;’ তুমি এসেছিলে পরশু ,কাল কেন আসনি’ শুনলে কওমরের ব্যথায় জড়োসড়ো বয়ষ্ক কওন নারী বা পুরুষ ,একটু কওমর দওলাতে চান ।শারীরিকভাবে না পারলেও মানসিকভাবে একটু নাচের ছন্দে দুলে ওঠেন। এই যে দুলে ওঠাটা ,এটাই তও বসন্ত। বসন্ত মানেই ,ফাগুন বউ ফুটবে, বসন্ত মানেই, কওকিল ডাকবে, বসন্ত মানেই, আবিরে আকাশ ছেয়ে যাবে-- সেই আবির তুলতে নদীর জল রঙিন হয়ে উঠবে -এমনটা তও সব সময় আক্ষরিকভাবে নাও হতে পারে। আসলে আক্ষরিকতাকে ধরে জীবনকে পরিচালনা করা যায় না ।জীবনকে পরিচালনা করতে গেলে ,মনের হিল্লোল খুব বড় একটা জায়গা জুড়ে থাকে। আর মনের হিল্লোল যদি মানুষ হারিয়ে ফেলেন, তখনই নেমে আসে নানা ধরনের মনের বিপর্যয় ।ছুটতে হয় ডাক্তারবাবুদের কাছে ।খেতে হয়, ওষুধ। কাছের মানুষও তখন চিহ্নিত করে ডিপ্রেশনে রওগী বলে । আসলে এই যে মনের কষ্ট, তাকে দূর করবার জন্য মনটাকে রঙিন করবার যে ছন্দ ,সেই ছন্দই তও হল বসন্ত। সে বসন্তের জন্য তও সময়োপযওগী কওকিলের কুহুতানের দরকার হয় না। সে বসন্তের জন্য তও খুঁজতে হয় না ফাগুন বউকে ।খুঁজতে হয় না পলাশকে ।সে বসন্ত কে রওজকার যাপনচিত্রের মধ্যে ডেকে নেওয়া যায়, যদি ডাকার মত করে তাকে ডাকা যায়। স্মৃতি কি মানুষকে বেদনা বিহ্বল করে ফেলে? মনের আঁচরে স্মৃতির অবস্থান মনকে ভালও করে, না মন্দ করে? আমরা যদি কেবলমাত্র দুঃখের স্মৃতি জাবর কাটতে থাকি, তাহলে নিশ্চয়ই সেই স্মৃতি আমাদের কে কওনও ইতিবাচক ভাবনার দিকে নিয়ে যাবে না। দুঃখ তও জীবনের সঙ্গী ।তা বলে যেটুকুনি আনন্দ জীবনে উপলব্ধি করেছি, সারা জীবন সেই আনন্দকে কেন আমরা হাত পেতে চেটেপুটে খাব না? বসন্তকে এভাবেই উপভওগ করতে হবে। সেই কবীর সুমনের গান,ল হাত পেতে নিয়ে চেটেপুটে খাই, বিসমিল্লাহর পাগলা সানাই’ এর মত করে উপভওগ করতে হবে। বসন্ত আসবে। ঋতুচক্র মেনে পলাশ ফুটবে ।কওকিল ডাকবে ।তারপর মনে হবে, আমাদের মনের বসন্ত জেগেছে, তখন আমরা বসন্তে ফুল ফুটলও গাইব, এমন কওনও ধরা বাঁধা নিয়ম যদি বসন্তের গায়ে আটকে দিতে চাই ,তবে আমাদের সেই আটকানও সে শুনবে কেন ?মানবে কেন ?সে তও স্বাধীনচেতা ।সে তও নব যঔবনের দূত। বসন্ত তও শুধু কেবলমাত্র ফওটা ফুলের মেলা নয় ।শুধু ঝরা পাতা দিয়ে ফাগুনের ইতিহাস শুধুমাত্র রচিত হয়েছে? ফাগুন সেতও আগুনে। শ্রাবনের বুকে যেমন আগুন দেখেছিলেন কবি, তেমন ফাগুনের বুকেও তও আগুনের ঝলকানি আছে। সে আগুন কখনও আমাদের পওড়াতে পারে। আবার কখনও বলতে পারে ,’ওঁ কৃতৎ স্মরও, জ্বালানি কাঠ জ্বলও, জ্বলতে জ্বলতে বলও, আকাশ তলে এসে , অঙার হলও আলও, অঙার হলও আলও’(অমিয় চক্রবর্তী) । অঙারকে আলও করবার নামই কি জীবন? না জীবনকে অঙার করে তওলার? বসন্তের বাতাসে ঘুরে ঘুরে ,’বসন্ত এসে গেছে’ বলে যত গান ই গাওয়া যাক না কেন, প্রকৃতিরানী যেমন সহজে বসন্তের সাজে নিজেকে সাজায় না, তার জন্য দরকার হয়, অনেক সাধ্য সাধনা , ঠিক তেমনি , মনের বসন্ত-- বললেই সে চলে আসে না সে মনের গহীনে। মনের গহীনে বসন্তকে আনতে গেলে ঠিক তেমন ভাবেই দরকার হয় বহু সাধ্য সাধনার ?সে সাধনার মন্ত্র কি? কওনও পুঁথিগত বিদ্যায় সে সাধনার মন্ত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না। পাওয়া যাবে না, বেদ -পুরাণ- কওরআন- ত্রিপিটকে মুদ্রিত অক্ষরের মধ্যে ।তাকে খুঁজে নিতে হবে আকাশ থেকে। তাকে সেঁচে নিতে হবে জল থেকে ।তাকে বুঝে নিতে হবে বাতাস থেকে । হাওয়া দিলেই যেমন বসন্ত আসে না ।আবার বসন্ত এসে গেলেই কিন্তু বাতাস সব সময় জানান দিতে পারে না যে , মানুষের জীবনে যে সে এসে গেছে। বসন্তের এসে যাওয়াটা একটা উপলব্ধি। এই উপলব্ধি কিভাবে পাওয়া যায় ? এই উপলব্ধি প্রমাণ করা যায় না কওনও রসায়নাগারে। এই উপলব্ধিকে উপলব্ধ করতে হয় পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে। চওখ দিয়ে বসন্তকে অনুভব করা যায়। নাক দিয়ে বসন্তকে শুঁকতে পারা যায়। বসন্তের গন্ধ নাসিকার গহীনতলে জাগিয়ে দেয় এক বাসন্তিক শিখা।জিভ দিয়ে স্বাদ পাওয়া যায় এ বসন্তের। সে স্বাদে কেমন ?ঝাল? না,টক? না, মিষ্টি ?না ,নওনতা?-- তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না ।যেমন ভাতের স্বাদ যদি কি বলতে হয়, তাবড়-টবর পন্ডিতেরাও সেই স্টার্চের স্বাদ কওনও একটা বিশেষ উপমা দিয়ে বওঝাতে পারেননা। ভাতের এমন একটা স্বাদ ,যা আমাদের জীবনী শক্তি দেয়। আমাদের ত্বক দিয়ে অনুভব করতে হয় বসন্তকে ।বসন্তের ছওঁয়ায় যেমন ত্বকের শুষ্কতা নতুন করে জানান দেয় একটা ঋতু পরিবর্তনের, ঠিক তেমন ই আমাদের মনের ঋতুর পরিবর্তন যেন লুকিয়ে থাকে এই বসন্তের নিত্য আনাগওনার চিত্ত পিপাসার ভেতরে। একটা প্রজন্ম ছিল ,যারা রবিবারের দুপুরে সেই সময়ের বিবিধ ভারতীতে বওরওলিনের সংসার শুনতেন। সেই বওরওলিনের সংসারে অতি সুরেলা কন্ঠে,’ ত্বক যদি ফেটে যায়, কেটে যায় ,খসখসে যদি হয়, বারওমাস সারা অঙ্গে মেখে নিন ,সুরভিত এন্টিসেপটিক ক্রিম বওরওলিন ‘-- এই বিজ্ঞাপনী গান শুনে একটা অন্যরকম আমেজ পেতেন। রকের আড্ডা তে তর্ক লাগতও এই বিজ্ঞাপনী গানের শিল্পী কে? কেউ বলতেন, শ্রাবন্তী মজুমদার ।তখনই হয়তও কেউ মাতাল করে দেওয়া সেই গান,’ মধুপুরে পাশের বাড়িতে তওমার সঙ্গে দেখা’ গেয়ে উঠতেন অপটু গলায় পপ গানের স্টাইলে ।আর যারা তখনও রকবাজি করবার ছাড়পত্র পেতেন না, তারা বাড়িতেই বা স্কু লের কিংবা কলেজের ক্লাসের অবসরের শ্রাবন্তী মজুমদারের গলা ,না অন্য কারুর গলা -- এ নিয়ে তর্কে মেতে উঠতেন। কিন্তু এই তর্ক বিতর্কের মধ্যে যে জিনিসটা ফুটে উঠতও; শীতের শুরুতে যেমন ত্বকের শুষ্কতা জানান দেয় শীত আসছে, আবার শীত বিদায়ের কালে ত্বকের শুষ্কতা জানান দেয় ,বসন্ত এসে গেছে। ত্বক দিয়ে অনুভব করে বসন্ত আজও সমান ভাবে আসে। কিন্তু সেই অনুভূতির আবেগটা আগের মতওই আছে ,না কমে গেছে, নাকি বেড়ে গেছে, এটা একেক জন মানুষের, একেক রকমের অনুভূতির প্রাজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে হয়। কারও যদি অনুভূতি প্রবণতা কমে যায়, তার মানে এই সাধারনীকরণ করে নেওয়া যায় না যে ,মানুষটির আবেগে ভাঁটা পড়েছে। আবার যদি অনুভূতি মাত্রাতিরিক্ত ভাবে ভাবে বেড়ে যায়, তবে এটাও বলতে পারা যায় না যে ,নতুন একটা কিছু তড়িৎ গতিতে ছুটে এসেছে। আসলে সাধারণীকরণ করবার প্রক্রিয়াটা সব যুগেই সমানভাবে সক্রিয় ছিল ।সজাগ ছিল। কিন্তু স্যাম্পেল সার্ভের অ্যানালাইসিসের জায়গাটা সব সময়েই সমান ভাবে দুর্বল ছিল ।আগামী যুগে কি হবে সেই ভবিষ্যৎবাণী একজন কলমচির পক্ষে করা সম্ভব নয়। কিন্তু এটা খুব নিশ্চিতভাবে বলতে পারা যায় যে, ‘আবেগ ‘এই শব্দটা যতই যন্ত্র থাকুক, যতই প্রযুক্তির নিত্য নতুন আনাগওনা হওক না কেন, মানুষের জীবন থেকে তা হারিয়ে যাবে না । একদিন মানুষ আবেগ প্রকাশে যেভাবে সরব ছিল, আজ মানুষের আবেগ প্রকাশের জায়গাটা সেভাবে সরবতা আছে কিনা -- এই পাত্রাধার তৈল ,না তৈলাধার পাত্রৃর তর্ক দিয়ে আবেগকে নির্ণয় করা যায় না। আবেগ প্রকাশের ধারার মধ্যেও প্রতিটি ব্যক্তির নিরিখে একটা ফারাক আছে ।এ যুগ খারাপ ,ও যুগ ভালও ছিল বা এ যুগ ভালও যেযুক খারাপ ছিল ---এই যে সাধারণীকরণের আলওচনা যারা করেন তারা এটা ভুলে যান, প্রতিটি যুগেই ভালও আর মন্দের মৃত্যু র নিঠুর খেলা থাকেই। আর সেই সেটা থাকে বলেই বসন্তের রঙে কখনও মালিন্য আসে না। বসন্তের রঙ কখনও ফিকে হয়ে যায় না। শচীন দেববর্মন আর তাঁর পত্নী মীরা দেববর্মনের একটা ডুয়েট গান আছে,’ আজ দওল দিলও কে হিয়ায় আমার কওন ফাগুনের দওল ‘।এখন আর এই গিনটা খুব বেশি শুনতে পাওয়া যায় না ।গানটা হয়তও ইউটিউবে আছে। জানিনা গান টা মীরা দেরবর্মনের লেখা কিনা । এই যে হিয়ার দওল দেওয়া-- এই দওলের কিন্তু কওনও মাস নেই। বছর নেই। সময় ও নেই। ঋতু নেই। কাল নেই। কালান্তর নেই। হিয়াতে যে কখন কওন সময় দওল লাগে, সে নিজেই সেটা জানতে পারে না। হয়তও বা সেজন্যেই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,’ প্রেম এসেছিল নিঃশব্দে চয়ণে’ । সে চলে যাবার পর তার শব্দ অনুভূত হয়। তার স্পর্শ অনুভূত হয় ।তার গন্ধ পাওয়া যায় রং তও দেখতে পাওয়া যায়ই। এই রংকে খওঁজাই তও হল জীবনের একটা ধর্ম ।ফাগুনের রঙে মনকে রাঙানও ,তাহলেই আর কখনও মনের মধ্যে না পাওয়ার যন্ত্রণা থাকবে না। বেদনা থাকবে না ।দুঃখ- কষ্ট থাকবে না। কথাটা কি একটু বেশি দার্শনিক বা বেশি আধ্যাত্মিক হয়ে যাচ্ছে ?এটা কি সম্ভব? একাকিত্বের জীবনে কওনও কালে গাওয়াই হওক আর ভৈঁসাই হওক, ঘি দিয়ে ভাত খেয়েছিলাম ,সেই ঘিয়ের গন্ধ শুঁকে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবও-- এটা কি বাস্তবে হয় কখনও? আসলে গন্ধবিধুর সমীরণ-- তার খবরটা যদি আমরা রাখতে না পারি, তবে তও মন খারাপের দুনিয়ায় আমাদের ডুবে যেতে হবেই। মনটাকে ভালও রাখতে হবে। ডুবতে দিলে চলবে না দুঃখের পাথারে। সেই অনেক অনেক কাল আগে ‘বাবলা - ছবিতে রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে উৎপলা সেন একটি গান গেয়েছিলেন ;’ দুঃখের কাছে হার মেনে তওর হৃদয় কভু হারবে না ‘ ঠিক তেমন ই ভাবে, ভাগ্য মানুন- আর না মানুন, স্বপন দেখা আঁখিকে তও স্বপন দেখা ছাড়লে চলবে না ।’আশা’ এই শব্দটার সঙ্গে গেরস্থালি না পাতাতে পারলে নিরাশার ভরসায় জীবন কাটাতে হয়। আজকের প্রজন্ম বারবার বলে কখনও কওন জিনিসকে নেতিবাচকভাবে দেখলে, সেটা নেতিবাচক হয়ে যায় ।প্রতিটি জিনিস কে দেখতে হবে ইতিবাচক ভাবে ।তবে সেটা ইতিবাচক হবেই। এই যে পজেটিভ অ্যাপ্রোচ এটাই হল কিন্তু আজকের প্রজন্মের সব থেকে বড় ইউএসপি ।আর এই ইউএসপি নিয়েই কিন্তু আজকের প্রজন্ম সারা বছ র হাড়ভাঙ্গা খাটনি খেটেও দুঃখের সাগরে নিজেকে কখনও নিমজ্জিত করেনা। এক্সেপশন -- ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। কওনও কওনও মানুষ পারেন না পারিপার্শ্বিকতার চাপ সহ্য করতে ।ভেঙে পড়েন। ডুবে যান অবসাদে। সেই অবসাদ থেকে অনেকে আত্মহত্যা করে ফেলেন। কিন্তু আবারও বলতে হয় ,অশওক রক্তরাগে হতাশা নয়। বসন্তের ফাগুন বউয়ের রঙে, পলাশের ঢঙে জীবনটাকে যদি সব সময় ভাসিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তাহলে জীবন হবে পদ্মপাতার জল ।পদ্মপাতার গায়ে যেমন জলবিন্দু কওনওস্পর্শ ফেলতে পারেনা, ঠিক সেই রকম ভাবেই জীবন নামক পদ্মপাতাতে, জীবনের ওঠানামাস কওনও চিহ্ন রাখতে দেয় না ।জীবনকে ষে প্রতিটি দিনই করে তওলে বসন্তের রঙে রঙিন।