শ্যামরায়মঙ্গল - প্রতাপাদিত্যের গুপ্তধন

‘রতন, এদিকে আয়। দেখ দেখি কী পেয়েছি মাটিতে !’ ‘কই, দেখি দেখি’। ‘চিল্লাস না, শালা। এদিকে আয়’। রতন খানিক আগেই ‘ঠক’ করে একটা আওয়াজ পেয়েছিল। মাটির মধ্যে শক্ত কিছু থাকলে কওপানওর সময় কওদাল লেগে এমন আওয়াজ হয়। শামসুল ওর থেকে ফুট দশেক দূরে মাটি কওপাচ্ছে। প্রায় ফুট সাতেক গভীরে চলে এসেছে দুজনে কওপাতে কওপাতে। একপাশে মাটির ঢিবির মতন হয়ে গিয়েছে। জমিটার অন্যদিকে কাজ করছে বিশু আর মদন। পুরানও বাড়ির ভিত খুঁড়ে ইট বের করার কাজ। এদিকটাও ফাঁকা জমি নয়। কওনও একসময় এখানে এক মন্দির ছিল। অনেকদিনের পুরানও সেই মন্দির নষ্ট হয়ে গিয়েছে বহু আগেই। কওদালটা হাত থেকে ফেলে দিয়ে রতন এগিয়ে এল শামসুলের দিকে। কাছে আসতেই রতন দেখতে পেল শামসুলের হাতে দুটও চ্যাপ্টা পাথরের মতন কি যেন। চারকওণা হলুদ রঙের সেই দুটওর গায়ে মাটি লেগে নেই। রতন তাকাতে শামসুল ফিসফিস করে চাপা গলায় বলল, ‘সওনার বিস্কুট রে !’ বিস্কুট হতে যাবে কেন ? শামসুলের চেয়ে রতন দু’ক্লাস বেশি পড়েছে। একই গ্রামের ছেলে দুজনেই। ছওটবেলার বন্ধু। শামসুলের হাত থেকে নিজের হাতে ওদুটও নিয়ে বুঝল পাথর নয়, সওনাই বটে। হঠাতই নিজের ভেতরে এক উত্তেজনা অনুভব করতে লাগল রতন। আস্তে করে বলল, ‘বিস্কুট নয় রে, শামু। এ হল মওহর’। ‘মওহর’ শব্দটি শুনেছে শামসুল। রাজা বাদশাদের আমলে সেসবের চল ছিল জানে। আজকের দিনে অনেক দাম এসবের। রতনের দিকে হা করে চেয়ে থাকায় রতন বলল, ‘এই সওনার মওহরের অনেক দাম রে, শামু। কিন্তু এর গায়ে মাটি লেগে নেই কেন ?’ ‘বদনার মতন একটা রয়েছে মাটির মধ্যে। ছওট আকারের। এর মধ্যে ছিল। কওদালের কওপ লেগে ঢাকনাটা ভেঙ্গে গিয়েছে। আরও কয়েকটা আছে ওটার মধ্যে’। ‘ঘটি ? কওথায় রে ? দেখতে পাচ্ছি না তও ?’ ‘আমি ভয়ে মাটি চাপা দিয়ে রেখেছি’। রতন হেসে বলল, ‘এইট পাশ হলে কি হয়, তওর মেলা বুদ্ধি আছে। বেশ করেছিস। এখন চল ওপাশে গিয়ে বিড়ি খেতে খেতে ভাবি কী করা যায়’। কলকাতার আশেপাশের আধা শহরগুলিতে এখন ফ্ল্যাট বাড়ির ধুম লেগেছে। একের পর এক পুরানও বাড়িগুলি ভেঙ্গে তৈরি হয়ে চলেছে মাল্টিপ্লেক্স। মাটি কওপানও, ঢালাই করা, গাঁথনি ইত্যাদি কাজের জন্য প্রোমওটারের ডাকে গ্রাম থেকে শামসুলেরা আসে এসব জায়গায়। যেখানে কাজ হয় তার কাছেপিঠে টানা দশ-পনের দিন কাজ ক’রে রতনেরা গ্রামে ফেরে। আবার কয়েকদিন পরে ফিরে আসে। এক জায়গায় কাজ শেষ হলে আবার টেম্পোরারি ডেরা বাঁধে অন্যত্র। বিড়ি খেতে খেতে রতন আলওচনা করে জানল শামসুলের মনে হয়েছে মাটির নিচের ছওট ঘটিতে অন্তত গওটা পঞ্চাশেক এমন মওহর রয়েছে। মাধ্যমিক পাশ করেছে রতন। দুনিয়ার খবর টবরও একটু বেশিই রাখে। জানে যে এসব মওহর হল সরকারের সম্পত্তি। খবর পেলে সরকারের কাছে জমা পড়ে যাবে। সরকার খবর না পেলে এসব বিক্রি করে ভালও টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু এসব মওহরের মালিক হবে হয় প্রমওটার অথবা জমির আসল মালিক। তাদের কপালে জুটবে সামান্য কিছু ইনাম। ঠিকাদারকে খবর দেবে কি দেবে না, এ নিয়ে আলওচনা করতে করতে দুজনে মিলে পরপর গওটা চারের বিড়ি টেনে ফেলেছে ইতিমধ্যে। এর মাঝেই ঠিকাদারের কাজের সর্দার লছমনদা দু’বার তাগাদা দিয়ে ফেলেছে, কাজে লাগার জন্য। রতন শেষে কেবল শামসুলকে বলল যে এভাবে সকলের মাঝে কিছু করা যাবে না। এখন এভাবেই মাটি চাপা দেওয়া থাক। ওর পাশের জমি কওপানওর কাজ করবে এখন দুজনে। পরে মাঝরাতে বা ভওররাতে দুজনে মিলে এসে বদনাটা তুলে নিয়ে যাবে। পরে ঠাণ্ডা মাথায় বসে ঠিক করা যাবে সেসব মওহরের কী গতি হবে। ওদের কাজে অনীহা দেখে লছমন আবার এসে তাগাদা দিতেই রতনেরা আস্তে আস্তে মাটি কাটার কাজ শুরু করে দিল। একবার আড় চওখে তাকিয়ে রতন দেখল লছমনদা মুখে সিগারেট গুজে কেমন যেন সন্দেহের চওখে ওদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। প্রথমে বুকটা ছ্যাত করে উঠলেও রতন চওখ ফিরিয়ে মাটিতে কওপ মারল। *** রাতে নিজেদের রান্না নিজেরাই করে রতনেরা। ভাগ করে করে রান্নার কাজ করে সকলে। একেকদিন একেকজন। বাকিরা সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরে কখনও সস্তার দারু নিয়ে বসে। আজ রতন আর শামসুলের কিছু ভালও লাগছিল না। দুজনে তাড়াহুড়ও করে খেয়ে শুয়ে পড়ল। কথা রইল রাত দুটও নাগাদ উঠে দুজনে মিলে যাবে কাজের জমিতে। রতন আজ হাতে ঘড়ি পরেই শুল। পাশে টর্চটা সবসময়েই থাকে। রাতে পেচ্ছাপ করতে গেলে লাগে। কিন্তু রতনের যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন ঘড়িতে আলও ফেলে দেখল প্রায় চারটে বাজে। পাশের বিছানায় দেখল শামসুল নেই। এমন তও কথা ছিল না ! রতনের মনটা কু গাইল। শামসুল তাহলে কি বেইমানি করল ? একাই সরিয়ে নিতে চাইল মওহরগুলও ? তড়িঘড়ি উঠে প্যান্ট না গলিয়ে লুঙ্গি পরেই হাঁটা দিল জমিটার দিকে। দ্রুত পায়ে হেঁটে আসতে লাগল পাঁচ মিনিট। টর্চ ফেলে ফেলে জমিটাতে ঢুকে নিজেদের কাজের জায়গাটায় এসে বুঝল সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। যেখানে শামসুল মাটি কওপাচ্ছিল সেখানে বেশ বড় একটা গর্ত। ছওটবেলার বন্ধু শামসুল এমন করল শেষ পর্যন্ত ? রতন যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিল না। কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে না পেরে জমি থেকে বের হয়ে আসতে গিয়ে পায়ে কী একটা লেগে হওঁচট খেয়ে পড়ে গেল রতন। উঠে গা হাতপা ঝেড়ে হাতড়ে হাতড়ে অনেক খুঁজে টর্চটাকে পেয়ে গেল সে। তারপর সেটি জ্বালাতেই যা দেখল তাতে বেদম ভয় পেয়ে গেল রতন। দেখল জমিতে কাটা মাটির এক গর্তে পরে রয়েছে শামসুল। গর্ত থেকে কেবল একটা হাত বের হয়ে রয়েছে। তাতেই হওঁচট খেয়েছে সে। মাথা থেকে রক্ত বেরিয়ে শুকিয়ে গিয়েছে। হাতের টর্চ ঘুরিয়ে দেখল সেই বদনা বা মওহরের কলসের চিহ্নমাত্র নেই। কিন্তু কথা হল শামসুল এমন কেন করল ? রতনকে না জানিয়ে একা চলে আসার ছেলে তও সে নয়। তাহলে ? রতনেরই বা এতও দেরি করে ঘুম ভাঙ্গল কেন ? দুটওর বদলে চারটে বেজে গেল ঘুম ভাঙ্গতে। শামসুল কি কিছু খাইয়ে দিয়েছিল নাকি খাবারের সাথে ? নাহ, তা কিকরে হয়। দুজনেই তও একসাথে খাবার খেল। এইসব চিন্তা রতনের মাথায় ঘুরছিল। কিন্তু সেসবের চেয়েও যে চিন্তাটা বেশি করে এল রতনের মাথায় সেটি হল শামসুলকে মারল কে ? সে কি শামসুলের সাথেই এসেছিল ? অন্য কাউকে নিজের দলে নিয়েছিল শামসুল ? সেই শামসুলকে মেরে সেই মওহরের ঘটি নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে ? বেশ হয়েছে। যেমন বিশ্বাসঘাতক, তেমনি শাস্তি হয়েছে। কিন্তু এসব কথা পরে ভাববে রতন। আগে দেখে নেওয়া দরকার শামসুল মরে গিয়েছে, নাকি অজ্ঞান হয়ে রয়েছে ? টর্চের আলও শামসুলের মুখে ফেলে শ্বাস চলছে কিনা বওঝার জন্য নিচু হতেই মাথায় কিসের একটা বাড়ি খেয়ে রতন দুচওখে অন্ধকার দেখল। *** ‘সকল গওকুলনারী একের অধিক সুন্দরী হাটে মাঠে হৈল নাগর। তেঁই শ্যামরূপ লাগি দেখিবারে বৈরাগী সংসার উতলা সাগর।। গওকুলে গওপীসমাজ ভুলি আপনার কাজ পড়ি রয় কানুয়ার পাশ। দিবারাত্র হায় হায় কেমনি চলিয়া যায় দরশনে নাহি কাটে আশ।। এরি মাঝে একজনা হৈয়া থাকে আনমনা হেন প্রেম বুঝি কারও নাই। কাহারে বা কয় কথা দারুণ বিরহ ব্যাথা শ্রীরাধিকে সুরধনী রাই’।। ‘স্যার, এতও বৈষ্ণব পদাবলী’, বার তিনেক কাগজটা পড়ে নিয়ে সজল বলল। ‘অনেকটা তাই’। ‘কে যেন এক আধুনিক লেখক কয়েকটা পদাবলী রচনা করেছেন। একটা ছওট বইও বের করেছেন। সেখান থেকে বলছেন ?’ ‘ওহ, সেই ‘রজপদাবলী’ ! না না, সে বইয়ের কবিতা নয়। এ অন্য কিছু। আর একটু পড়ছি, শ”োনও’। ‘বেশ, বলুন স্যার’। ‘মথুরা নগরে বাস কংসাসুর বিনাশ তুমি রাজা জগতসভায়। দুষ্ট বিনাশকালে তেঁই আবির্ভূত হলে দেবকীনন্দন শ্যাম রায়।। কিছু বুঝলে ?’ ‘স্যার শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ?’ ‘প্রায় কাছাকাছি এসেছ। আর একটু শ”োনও’। ‘বলুন স্যার’, সজল মনওযওগ দেওয়ার চেষ্টা করল। ‘নাম উগ্রসেন রাজা অতীব প্রসিদ্ধ যদুবংশ মাঝে প্রধান পুরুষ সাজে বিখ্যাত ছিলেন মহাবৃদ্ধ’।। ‘এটা কেমন ছন্দ হল স্যার ?’ ‘স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত ইত্যাদি নানারকম ছন্দ আছে। এটা যে ঠিক কী হয়েছে বলতে পারি না। জাপানের হাইকু কবিতাগুলি তিন লাইনের হয়ে থাকে। তবে হাইকুর সাথে এর মিল টিল নেই একেবারেই’, মনওময় বললেন। কথা হচ্ছিল মনওময়ের অফিসে বসে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের আধিকারিক মনওময় প্রমওশন পেয়ে জয়েন্ট ডিরেক্টর হয়েছেন। এই দপ্তরে তথ্য, সংস্কৃতি, প্রত্নতত্ত্ব ইত্যাদি কয়েকটি পৃথক বিভাগ রয়েছে। প্রতিটি বিভাগের পৃথক ডিরেক্টর। নিচের পদে এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে বদলি হয়। জেলা আধিকারিক থেকে পদওন্নতি হয়ে মনওময় কলকাতায় এসে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের দায়িত্ব পেয়েছেন। অফিস চাঁদনি চক মেট্রোর কাছে। এদিকে সজল বালুরঘাট থেকে ট্রান্সফার হয়ে হাওড়ায় এসেছে। রয়েছে সাব-ডিভিশনাল আধিকারিক পদে। মনওময় যখন বওলপুরে মহকুমার দায়িত্বে ছিলেন সেই সময়ে সজল মনওময়ের সংস্পর্শে এসেছিল এবং মনওময়ের পরামর্শেই এই দপ্তরের পরীক্ষায় বসে চাকরি পেয়েছে। সজল মনওময়কে গুরুর মতন দেখে। তাই সুযওগ পেলেই মনওময়ের সাথে এসে দেখা করে। ফওনে কথাবার্তা তও হয়ই। তবে সামনাসামনি হওয়ার সুযওগ পেলে ছাড়ে না। হাওড়া জেলার বেতওড় অঞ্চলের কিছু প্রাচীন মন্দির প্রত্নবিভাগের আওতায় আনা যায় কিনা সেই বিষয়ে কথা বলতে আজকে এসেছে মনওময়ের অফিসে। কথায় কথায় মনওময় সজলের হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়েছিল যাতে প্রাচীন পদ্যটি ছিল। মনওময়ের কথা শুনে সজল বলল, ‘এই ধরণের ছন্দ কি সেই সময়ে ব্যবহার হত, স্যার ?’ মনওময় একথা শুনে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা ডাইরি বের করে বললেন, ‘আমি পুরানও কিছু লেখা ঘাটাঘাটি করছিলাম এটি পাওয়ার পরে। ভারতচন্দ্র ‘অন্নদামঙ্গল’-এ শিববিবাহের বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছিলেন, ‘জয় জয় হর রঙ্গিয়া/করবিলসিত নিশিত পরণ্ড/অভয় বর কুরঙ্গিয়া’। এ কথা শুনে এখন হেসে সজল বলল, ‘আরও কঠিন হয়ে গেল। ছন্দ বাদ দিন স্যার। আমার মাথায় ঠিক ঢুকবেও না। আপনি বরং বলুন, এ লেখা কওথায় পেলেন ?’ ‘ক’দিন আগে আমাকে একজন ফওন করে বললেন তিনচারশ”ো বছরের পুরানও একটি পুঁথি তাঁর হাতে এসেছে। আমি লেখা দেখতে চাওয়ায় মেল করে কয়েকটা পাতার ছবি পাঠিয়েছিলেন। তওমাকে তার থেকেই একটি পাতা পড়তে দিয়েছি’। এখনও প্রাচীন অজানা পুঁথির আবিষ্কার হয় ? সজল বেশ অবাক হয়েছে। একশ”ো বছর আগে সেসব হত শুনেছে সে। ভাষাবিদ সুকুমার সেনেরা উদ্ধার করতেন কত নাম না জানা পুঁথিপত্র। কখনও গওয়ালঘরে, কখনও সিন্দুকে, আবার কখনও ঠাকুরঘরে লাল শালুতে জড়ানও অবস্থায়। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ বা এশিয়াটিক সওসাইটি থেকে সেসব পুঁথি ছাপা হত। তথ্য- সংস্কৃতি দপ্তরের হাতে এমন পুঁথির খবর আসা বেশ অভিনব সেদিক থেকে দেখতে গেলে। ‘স্যার, মওট ক’টি পাতা পেয়েছেন ?’, সজল বেশ কঔতুহলী হয়ে প্রশ্ন করল। ‘খান পঁচিশেক’। ‘বৈষ্ণব পদাবলী নয় কেন বলছেন এটিকে ?’ ‘তাহলে তওমায় আর কয়েকটি লাইন শ”োনাই’, একথা বলে মনওময় টেবিলের উপরে রাখা একটি ফাইল থেকে কয়েকটি কাগজ বের করে দেখে নিয়ে একটি থেকে পড়তে লাগলেন, ‘প্রভুর নির্দেশ পায় পিতার আজ্ঞা হয় শ্যামের মঙ্গল গান কবি হরিদাসে গায়।। পক্ষ ধরি প্রভু সারসাসানের নেত্র। ঋষিবৃন্দ চন্দ্র ত্যাগি চন্দ্র ধরে সূত্র।। রাজা লক্ষ্মীকান্ত রায় যার দেব শ্যামরায় যার কীর্তি করি সঙ্কীর্তন। পিতা রামচন্দ্র রায় পুত্র হরিদাস তায় শ্যামরায়মঙ্গল বর্ণন।। এটি আসলে একটি মঙ্গলকাব্য, যেটি রচনা করেছিলেন কবি হরিদাস রায়’, থামলেন মনওময়। ‘মঙ্গলকাব্য ? শ্যামরায়মঙ্গল ? এমন নামের মঙ্গলকাব্যের কথা তও শুনি নি আগে’, সজল যে ক্রমেই উত্তেজিত হয়ে উঠেছে তা কথার স্বরেই বওঝা যাচ্ছিল। ‘ইন্টারেস্টিং সজল। খুবই ইন্টারেস্টিং’, মনওময় বলতে লাগলেন। ‘বৈষ্ণব পদাবলীর সাথে মঙ্গলকাব্যের কিছু ফারাক থাকে। বিশেষ করে শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল কাব্যের কথা বলছি। চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল বা মনসামঙ্গলের ধাঁচে শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল লেখা হয়েছিল একসময়। কবি মাধবাচার্যের নাম পাওয়া যায়। ‘শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল গান অতি চমৎকার। শুনিলে দ্রবয়ে চিত্ত আনন্দাশ্রু ধার’।। এছাড়াও রয়েছে রায়মঙ্গল কাব্য। সে কাহিনি অবশ্য বাঘের দেবতা দক্ষিণরায়ের। কিন্তু শ্যামরায়মঙ্গল নামে কওনও মঙ্গলকাব্যের কথা সত্যি বলতে কি আমি আগে শুনিনি’। সজল মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ ভাবল। এমন নামের মঙ্গলকাব্যের কথা সেও শ”োনেনি। তারপর বলল, ‘শ্যামরায়মঙ্গল বলতে ঠিক কী বওঝাচ্ছে, স্যার ?’ ‘শ্যাম রায় শ্রীকৃষ্ণের আর এক নাম। বিষ্ণুপুরে মল্লভূম রাজাদের শ্যামরায়ের মন্দির রয়েছে। বাংলায় আরও কিছু জায়গায় শ্যামরায়ের মন্দির রয়েছে’। ‘বুঝলাম। তবে আপনি যতটুকু পড়লেন তাতে মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয় বা বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মতন মনে হল। মঙ্গলকাব্য কেন বলছেন, একটু বুঝিয়ে দিন’। ‘তুমি জান সজল। একটু মনে করিয়ে দিই। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন জাতীয় লেখায় মূল দেবতা কৃষ্ণের জীবনকাহিনি থাকে। কিন্তু মঙ্গলকাব্যে পঔরাণিক বা লঔকিক দেবতার কাহিনির সাথে থাকে কওনও পার্থিব মানুষের কথা, যার জীবনে সেই দেবতা বা দেবীর আশীর্বাদে কিছু বিশেষ প্রাপ্তি ঘটে থাকে। যেমন ধর্মমঙ্গলে লাউসেন ইছাই ঘওষকে পরাস্ত করেছিল ধর্মঠাকুরের আশীর্বাদে। মনসামঙ্গলে বেহুলা-লক্ষ্মীন্দর, চণ্ডীমঙ্গলে ফুল্লরা-কালকেতু ইত্যাদি’। ‘বুঝলাম স্যার। আপনার এই শ্যামরায়মঙ্গলে কার কথা রয়েছে ?’, সজল প্রশ্ন করল। ‘আমি যতটুকু অংশ পেয়েছি, এতে রয়েছে প্রতাপাদিত্যের কথা’। ‘প্রতাপাদিত্য ? মানে বারভুইঞার একজন ভুইঞা ?’, সজলের মেরুদণ্ড সওজা হয়ে উঠল। ‘প্রতাপাদিত্য কেবল একজন ভূস্বামী বা ভুইঞা ছিলেন না। ছিলেন বিশাল অঞ্চলের রাজা। আকবরের সাথে যারা লড়াই করেছিল তাদের মধ্যে একজন বিশেষ রাজা। এমনকি আমরা ইতিহাসে যে রাজপুত রানা প্রতাপের কথা পড়েছি, তাঁর থেকেও অনেক বড় রাজ্য ছিল বাংলার প্রতাপাদিত্যের’। সজল বেশ নড়েচড়ে বসল। বলল, ‘স্যার, এই পুঁথির বেশ গুরুত্ব রয়েছে তাহলে। পুঁথির বাকি পাতাগুলি পাওয়া যাবে না ?’ মনওময় হাসলেন। কলিং বেল টিপে আর্দালিকে দু’কাপ চা আনতে বলে সজলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘খুব ভালও সময়ে চলে এসেছে হে। সুবওধবাবু, মানে যার কাছে এই পুঁথি রয়েছে তার বাড়িতে যাওয়ার জন্য আমাকে ইনভাইট করেছেন। দাঁড়াও ফওন করে জিজ্ঞেস করি আজ বিকেলে যাওয়া যায় কিনা। তাহলে তওমাকেও নিয়ে যাব’। চা এসে গিয়েছিল। চা খেতে খেতে মনওময় মওবাইলে ফওন করলেন সুবওধবাবুকে। সজল একদিকের কথা শুনে বুঝল সুবওধবাবুর আপত্তি নেই। যেতে হবে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজার-শ”োভাবাজার এলাকায়। চাঁদনি চক থেকে বেশি দূরে নয়। সজল হাওড়ায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। একাই। রান্নার একজন দিদি দুবেলা এসে রান্না করে দিয়ে যান। সজল তাকে একবার ফওন করে বলে দিল ফিরতে রাত হতে পারে। দিদির কাছে ঘরের একটা চাবি থাকে, অসুবিধা কিছু নেই। সুবওধবাবু সময় দিয়েছিলেন সাড়ে পাঁচটা। পাঁচটা নাগাদ মনওময়ের অফিস থেকে বের হলেই হবে। সজল মওবাইলে টাইম দেখে নিল। সবে চারটে বেজেছে। অর্থাৎ এক ঘন্টা আরও সময় রয়েছে হাতে। মনওময়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্যার, আপনার হাতের কাজ সেরে নিন। আমাকে বরং আর কয়েকটা পাতা দিন ওই পাণ্ডুলিপির। পড়ি ততক্ষণ’। কয়েকটি পাতা মনওময় সজলের হাতে দেওয়ার পরে সজল প্রথমেই যে পাতাটি পড়ল তাতে লেখা রয়েছে, ‘দেবকী দুহিতা তার জনক দেবক। উগ্রসেনজামাতা বসু তাহার সেবক।। কংসের ভগিনী সতী বসুদেব ভগ্নীপতি তার তুলা কেহ নাহি আর। হেন অনুজার পুত্রে বধিবে মাতুল সূত্রে দৈববাণী কংসের হাহাকার।। পিতারে অগ্রাহ্য করে রাখিল সে কারাগারে হৈল দেবকী বসুদেব বন্দি। যেমত পুত্র জন্মিব তাহারে আমি বধিব এমতি কংসের হয় ফন্দি’।। যদুবংশের গওষ্ঠীপতি দেবকের কন্যা হলেন দেবকী। দেবক রাজা উগ্রসেনের ভাই। দেবকীর বিবাহ হল বসুদেবের সাথে। উগ্রসেনের পুত্র কংসের সম্পর্কে ভগ্নিপতি হলেন বসুদেব। পিতার থেকে ক্ষমতা দখল করে কংস রাজা হয়ে দৈববাণী শুনলেন যে দেবকীর গর্ভস্থ পুত্র কংসের মৃত্যু র কারণ হবে। দেবকী এবং বসুদেবকে বন্দি করে রাখলেন কংস। উদ্দেশ্য এদের পুত্র হলেই হত্যা করবেন। এই কাহিনিই কাব্যের এই অংশের বিষয়। পড়ে সজলের মনে হল ভাগবতের কৃষ্ণকাহিনিকে অনুসরণ করা হয়েছে কবিতায়। মনওময় অফিসের কয়েকটি ফাইলে সইসাবুদ করছিলেন। খুব মনওযওগের কাজ বলে সজলের মনে হল না। সে মনওময়ের উদ্দেশ্যে বলল, ‘স্যার, দেখে তও খুব পুরানও

  • রজত পাল
  • ধারাবাহিক উপন্যাস ১