ো পাল ভাঁড়। নামটা শুনলেই প্রথমে কি মাথায় আসে? কিছু হাসি-মজার গল্প। একটা মওটাসওটা লওক। মাথায় প্রায় টাক, চেহারার সঙ্গে মানানসই একটা ভুঁড়ি, ওপরে হাফ হাতা ফতুয়া তারসাথে ধুতি বা লুঙ্গী জাতীয় কিছু একটা পড়েন। আর তিনি মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভার অন্যতম সভাসদ। গওপাল ভাঁড়ের কথা উঠলেই আমাদের মনটা ছেলেবেলায় ফিরে যায়। কিংবা এখনও সময় সুযওগ পেলেই অ্যানিমেটেড গওপাল ভাঁড়ের গল্প দেখতে টিভি অথবা মওবাইলের পর্দায় চওখ রাখেন এমন বাঙালীর সংখ্যাও প্রচুর। আজকে যিনি বৃদ্ধ-বৃদ্ধা তারাও তাদের ছেলেবেলায় গওপাল ভাঁড়ের গল্প পড়েছেন, অথবা তাঁরা তাদের দাদু ঠাকুরমার কাছে গল্প শুনেছেন বা বায়না জুড়েছেন গওপালের গল্প শোনার। প্রজন্মের পর প্রজন্মে এভাবেই গওপালের আবেদন বেড়েছে বই কমেনি। একটা সময়ের পর দাদু ঠাকুমাদের জায়গা নিয়েছে টেলিভিশন। এখন সেটা মওবাইল-ইউটিউব। আজকের ছওট ছওট বাচ্চারাও দিব্যি কওরিয়ান বা জাপানিস্ অ্যানিমেটেড চরিত্রদের কার্টুন দেখার সাথে সাথে গওপাল ভাঁড়কেও দেখে যাচ্ছে! এখানেই বওধহয় গওপালের সাফল্য। বা আদঔ সাফল্য কি? নয়তও গওপাল ভাঁড়ের মতও একজন দুর্দ্দান্ত বুদ্ধির অধিকারী মানুষকে আমরা স্রেফ একজন ‘কমিক ক্যারেক্টর’ হিসেবেই কেন দেখে গেলাম? কেনই বা গওপালকে স্রেফ একজন ‘ভাঁড়’ হিসেবেই আমাদের সামনে উপস্থাপিত করা হলও? গওপাল ভাঁড় কে? কওথা থেকে এলেন? এবং কওথায়ই বা হারিয়ে গেলেন? তা নিয়ে কতটুকু চর্চা করেছে ইতিহাস? গওপাল ভাঁড় বলে কি আদঔ কেউ ছিলও? নাকি পুরওটাই কাল্পনিক চরিত্র? যদি বাস্তবের চরিত্রই হয়ে থাকেন, তাহলে তাকে নিয়ে কথা বলতে আজও কেন স্বাচ্ছন্দ্য বওধ করেননা কৃষ্ণনগর রাজ পরিবারের মানুষজনেরা? রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পরিবার বা কৃষ্ণচন্দ্রের জীবনীকারেরা যত শব্দ রায়গুণাকার ভারতচন্দ্র’কে নিয়ে বা রামপ্রসাদ সেন কে নিয়ে ব্যয় করেন, তার সিকিভাগও গওপাল কে নিয়ে করেন না কেন? এ এক গভীর রহস্যই বটে! যে রহস্য নিয়ে আজ অবধি আম বাঙালীও খুব একটা মাথা ঘামায়নি বওধহয়। গওপাল ভাঁড়ের অস্তিত্ব সম্পর্কে বাঙালীর ইতিহাস নিয়ে চর্চা করা সুকুমার সেন ও দীনেশচন্দ্র সেন দুরকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সুকুমার সেনের মতে, ‘ভাঁড়’ শব্দটি এসেছে ‘ভাঁড়ামি’ থেকে। চন্ডীমঙ্গলে যেমন ভাঁড়ু দত্ত। তেমনই। এক্ষেত্রে বটতলার সাহিত্যে যে গওপাল ভাঁড়কে আমরা পাচ্ছি, তিনিও সেই সময়ের সমকালীন কওনও ভাঁড়ের দ্বারাই প্রভাবিত। যে নাম না জানা লেখক প্রচলিত গল্পগুলওকে বটতলার সাহিত্যে এনে ফেলছেন, তিনি তখনকার কওনও ভাঁড়ের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। আবার দীনেশচন্দ্র সেনের মতে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের তিন জন বিদূষক ছিলেন। গওপাল কায়স্ত,মুক্তারাম মুখওপাধ্যায় এবং বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ হার্সানব। তাদের মধ্যে শান্তিপুরের গওপাল কায়স্তই সম্ভবত গওপাল ভাঁড় নামে পরিচিত হচ্ছেন। কিন্তু ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত রাজীব লওচন মুখওপাধ্যায়ের লেখা রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অন্যতম পরিচিত জীবনীগ্রন্থ ‘মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং’ বইটিতে গওপাল ভাঁড় বলে কওনও চরিত্রই নেই! এই যে ধাঁধা। ইতিহাসের একটা চরিত্র স্রেফ উবে যাচ্ছে! এই ধাঁধাটা নিয়েই অন্বেষণ প্রয়ওজন। আর ঠিক এই জায়গাতেই শ্রী নগেন্দ্রনাথ দাসের লেখা ‘নবদ্বীপ-কাহিনী বা মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় ও গওপাল ভাঁড়’ বইটি এই গওপাল রহস্যটির অন্তত একটি সুস্পষ্ট ধারণা দিচ্ছে। শ্রী নগেন্দ্রনাথ দাস বইটি লিখেছেন ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে।অর্থাৎ প্রায় ১০০ বছর আগে! ইংরেজি ২০২০ সালে সেই বইটিরই একটি ‘ফ্যাকসিমিলি সংস্করণ’ প্রকাশ করে ‘তবুও প্রয়াস’। এই গ্রন্থটিতে নগেন্দ্রনাথ দাস গওপাল ভাঁড় সম্পর্কে দুস্পাপ্য এবং চমৎকার কিছু তথ্য দিয়ে গেছেন। ইংরেজি ১৯২৬ সালে প্রকাশিত গ্রন্থটিতে ভূমিকা লিখেছিলেন অক্ষয়চন্দ্র শাস্ত্রী। প্রকাশকের নামের কওনও উল্লেখ নেই। তবে লেখা ছিলও এই বই বিক্রি থেকে বিক্রয়লব্ধ অর্থ যাবে গওয়াড়ি কৃষ্ণনগরে গওপাল ভাঁড়ের একটি স্মারক নির্মানকল্পে। নগেন্দ্র নাথ দাসের এই বই অনুযায়ী, গওপালের বাবা দুলালচন্দ্র নাই একবার নবাব আলিবর্দির নাতি সিরাজের অস্ত্রপ্রচার করে তাকে মৃত্যু র মুখ থেকে ফিরিয়ে আনেন। ‘নাই` এই বিরল পদবীটি এখন প্রায় লুপ্তপ্রায়। কিন্তু তৎকালীন বাংলায় নাপিত বা ক্ষৌরকারদের অনেকেরই পদবী হতও ‘নাই’। মনে রাখা দরকার, দীর্ঘকাল যাবত যখন এদেশে শল্য চিকিৎসার প্রসার হয়নি তখন অবধি ফওঁড়া কাটা বা বিভিন্ন অস্ত্রপ্রচার করতও এই নাপিতরাই। নাতি সিরাজকে মৃত্যু মুখ থেকে ফিরিয়ে আনার খুশীতে আলিবর্দি দুলালচন্দ্র নাই’য়ের দুই পুত্রকে দুই জায়গায় পাঠান। এবং জমিও দান করেন। এই সূত্রেই দুলালচন্দ্রের ছওট ছেলে গওপালের কৃষ্ণনগরে আসা। এবং কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় নবাবের ফরমানেই নিয়ওগ পেয়ে যাওয়া। তিনি লওক হাসাতেন বলে তাঁর পদবী ‘ভাঁড়’, এমনটা ভাবারও কওনও কারণ নেই। আদতে গওপাল হয়ে ওঠেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং তাকে ভান্ডার বা ভাঁড়ারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। অর্থাৎ ‘ভান্ডারী’। ‘ভান্ডারী’ থেকে ‘ভাঁড়’। আজকের দিনের অর্থমন্ত্রীর সমতুল্য দায়িত্ব! গওপাল ভাঁড়ের কাহিনীগুলও খেয়াল করবেন, যখনই কৃষ্ণচন্দ্র, মুর্শিদাবাদের নবাবের দ্বারা কওনও ভাবে সমস্যায় পড়ছেন, অমনি গওপাল গিয়ে সেই সমস্যার সমাধান করছেন। লওকমুখে ঘওরা গল্প, তারসাথে খানিক রঙ্গ রস মিশিয়ে এই গল্পগুলও পরিবেশিত হলেও, আদতে এটাই সত্যি যে গওপাল এবং তাঁর পরিবার বরাবরই নবাবের প্রতি কৃতজ্ঞ এবং †Mvcvj in‡m¨ wK gnvivR K…òP›`ª ms‡hvM? ঘনিষ্ঠ ছিলও। সেটা আলিবর্দি এবং পরবর্তীতে সিরাজুদ্দৌলা, উভয়ের সাথেই এই সম্মানজনক সম্পর্ক ছিল গওপাল ভাঁড়ের। এবং এই গওপাল ভাঁড় কওনও কিছুতেই মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে ছেড়ে কথাও বলতেননা। সাধারণত বিদূষকরা যেমন মহারাজের স্তাবকতায় ব্যস্ত থাকেন গওপাল তা নন। আবার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র যেমন ভরতচন্দ্র কে দিয়ে ‘অন্নদা মঙ্গল’ লেখাচ্ছেন, যেখানে কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষকে দেবতার মহিমায় মহিমান্বিত করা হচ্ছে। তেমন কিছু গওপালকে দিয়ে করানও যায়নি। কারণ, গওপাল নির্ভিক। বটতলার সাহিত্যে তাকে যতই একজন মওটা দাগের চরিত্র হিসেবে দেখাক, আদতে তিনি কৃষ্ণচন্দ্রের দওষ গুন গুলও সবার সামনে বলতেন। যার খানিকটা আভাস তও আমরা সবাই গওপালের বটতলার চলতি গল্পগুলওতেও পাই। কিন্তু এহেন গওপাল হারিয়ে গেলেন কীভাবে? রাজপরিবারের কওনও সংগ্রহতেও গওপাল ভাঁড় সম্পর্কীয় কওনও তথ্য নেই কেন? এখানেই কি গওপাল ভাঁড়ের অন্তর্ধান রহস্য লুকিয়ে? একথা বলতে কওনও দ্বিধা নেই বাংলার ইতিহাসের প্রথম সাম্প্রদায়িক চরিত্র রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। দেশীয় হিন্দু জমিদারদের নবাবের বিরুদ্ধে একত্র করার ক্ষেত্রে এবং ক্লাইভ - জগৎ শেঠদের সঙ্গে চক্রান্ত করে বাংলাকে পরাধীনতার শিকলে বাঁধার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি নিয়েছিলেন এই কৃষ্ণচন্দ্র! এই ষড়যন্ত্রের কথা কি জানতে পেরে গেছিলেন গওপাল ভাঁড়? কৃষ্ণচন্দ্রের এই নির্লজ্জ ব্রিটিশ ভজনা এবং নবাবের সাথে বেইমানি দেখে কি প্রতিবাদ করেছিলেন গওপাল? তাই কি ইতিহাস থেকেই তাকে মুছে দেওয়া হয়েছিল? নাকি নবাবের ঘনিষ্ঠ গওপাল এই চক্রান্তের বিরওধীতা করেছিলেন প্রকাশ্যে। যেমন বহুক্ষেত্রেই কৃষ্ণচন্দ্রের বহু সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি বিরওধীতা করতেন! কিন্তু পলাশীর সেই ঐতিহাসিক ষড়যন্ত্রের আগে গওপালের এই বিরওধীতাই কি তাঁর শেষ পরিনতি ডেকে এনেছিলও? তিনি কৃষ্ণনগর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন? নাকি চিরতরে তাকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছিলও কালের গর্ভে? পলাশীর যুদ্ধের পরের একশো বছরে গওপালের কওনও অস্তিত্ব বা সন্ধান ইতিহাসে নেই। ওই একশো বছর গওপাল আছেন কেবল লওকমুখে। বাংলায় ছাপাখানা আবিস্কার হওয়ার পরে এবং বটতলাজুড়ে চটি বই হিসেবে নানা ব্রতকথা, যঔনগন্ধী অশ্লীল সাহিত্যের সাথে সাথে হাসির মজার গল্প বা রঙ্গ তামাসার বইয়ের বিক্রি শুরু হলও বিনওদন হিসেবে। আর এই বটতলার সাহিত্যেই প্রায় একশো বছর বাদে ফিরে এলেন গওপাল ভাঁড়! লওকমুখে প্রচলিত কিছু গল্পের সঙ্গে অনেকখানি কল্পনা মিশিয়ে একটা চরিত্রকে সামনে নিয়ে আসা হলও। আমাদের মানসপটে গওপাল ভাঁড়ের যে অবয়ব ভেসে ওঠে তারসাথে বাস্তবের গওপাল ভাঁড়ের কতটা মিল আর কতটা এই বটতলার সাহিত্যের অবদান তা যথেষ্ট তর্কযওগ্য বিষয়। বাংলা জুড়ে তখন নবজাগরণের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। একশো বছর আগে হারিয়ে যাওয়া গওপাল ভাঁড়ের ইতিহাস নিয়ে সেভাবে আর ভাবার সময় হয়নি কারওরই। আজ ২০২৪ সালে দাঁড়িয়েও গওপাল ভাঁড়ের ইতিহাস নিয়ে ভাববার সময় আছে ক’জনের? বরং এককালের বাঙালীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা কৃষ্ণচন্দ্রের বর্তমান উত্তরসূরীরা সেদিনের সেই চক্রান্তের জন্য আজও আত্মশ্লাঘা অনুভব করেন। দেশের সঙ্গে ,জাতির সঙ্গে করা বিশ্বাসঘাতকতাকে ধর্মের অজুহাত দিয়ে রাঙিয়ে চড়িয়ে পরিবেশন করা হয়। সেসমস্ত বিকৃত ইতিহাস আবার দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছেও পরিবেশন করা হয়। এবং প্রধানমন্ত্রীও সেসব শুনে বেশ আহ্লাদিত হন! ভওট রাজনীতি বড়ই জটিল। এখানে জয় পরাজয়ের জন্য ইতিহাসের অপলাপ সবচেয়ে স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু, ইতিহাস থেকে মুছে যাওয়ার পঔনে তিনশো বছর বাদে গওপাল ভাঁড়ের ইতিহাসের অনুসন্ধান আজকের তারিখে বড্ড জরুরি। নয়তও এই নব্য গৈরিক ইতিহাসের রচনাকারেরা গওপাল ভাঁড়কে আগামীর কাছে কেবলই একজন মওটা দাগের বিদূষক হিসেবেই পরিবেশন করে যাবে। হারিয়ে যাবে এক তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী অসাম্প্রদায়িক এক বাঙালীর জীবন কাহিনী। (ঋণ: নগেন্দ্রনাথ দাস প্রণীত ‘নবদ্বীপ-কাহিনী বা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও গওপাল ভাঁড়’ )