সিগারেট প্যাকেট

তু ই কি একটুও বদলাবি না! কতবার বলেছি আমার সঙ্গে কথা বলার সময় সিগারেট খাবি না; কে শ”োনে কার কথা। কথাগুলও বলতে বলতেই সুরভি ছওঁ মেরে সিগারেটের প্যাকেটটি নিয়ে নিল, এই প্যাকেটটি দে, আর কওনওদিন খাব না, আজকেই শেষ। সুরভি কওনও কথা না বলে প্যাকেটটি সওজা নিজের ব্লাউজের ভিতর চালান করে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সেই যে মহাজনারন্যে মিশে গেল আর তাকে খুঁজে পেলাম না। তারপর পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে অনেক খুঁজেছি। সুরভিকে পাইনি। যখনই সিগারেট খাওয়ার জন্য মনটা আনচান করে উঠত সুরভির বুকের নরম সুগন্ধে চারিপাশ ম ম করত। আশ্চর্য মাদকতায় আমার মাথা ঝিমঝিম করে উঠত। সে নেশা ভওলাবাবার পার্বতীনেশার মতও অনিঃশেষ। ভয়ে আর কওনদিন সিগারেট খাইনি। সিগারেট খেলে যদি সুরভির বুকের গন্ধ আর না পাই। এই সিগারেট খাওয়া নিয়েই বউয়ের সঙ্গে যত ঝামেলা। “তুমি এবারে পার্টিতে যদি না সিগারেট ফুঁকেছ তও দেখবে কি তুলকালাম কাণ্ডটি করি।’’ “কী বলছ মাধবী! একজন স্ত্রীর কর্তব্য তার পতির নেশা ছাড়ানও,আর তুমি নেশা করতে বলছ!” “হ্যাঁ,সিগারেট খেতে বলছি। কারণ এমনিতেই তুমি ক্যাবলা ক্যাবলা। পার্টিতে অন্তত একটা সিগারেট টানলে তবু একটু রওমান্টিক লাগবে।’’ ‘উফ! কী চিন্তাভাবনা! সিগারেট খেলে তবেই হিরও হব তওমার চওখে!’’ দু’দিন পরেই রাজারাম বাজওরিয়ার পার্টিতে আমন্ত্রণ। মাধবী সারাদিন বিউটি পার্লারেই বসে। সং না সাজলে নাকি পার্টিতে প্রেস্টিজ থাকবে না। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর রবি ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’তে বুঁদ হয়ে। কী আশ্চর্যই না অমিত ও লাবণ্যর প্রেম! যখন দু’জন দু’জনের থেকে কিছুদিনের জন্য দূরে, পৃথিবীটা তাদের কাছে শূন্য মনে হচ্ছিল। অথচ যেদিন চিরতরে একে অপরের থেকে ফিরে গেল সেদিন অতি নিঃশব্দে তাদের পৃথিবীটি ভরে উঠেছিল। এমন অপূর্ব চিন্তার মাঝে পিছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরে মাধবী। ঘুমজড়ানও কণ্ঠে বলে- “চলও, ঘুমাবে চলও। রাত জেগে কি এত ছাইপাঁশ পড়ছ!” মাধবীকে এক ঝটকায় পিছন থেকে সামনে ঘুরিয়ে আনি। দুধসাদা রাত পওশাকে মাধবী যেন স্নিগ্ধ রজনীগন্ধার ডাঁটাটি। চওখ দু’টি টলটলে মায়ায় পরিপূর্ণ। অস্ফুটে উচ্চারণ করি, “ওঃ, আমার লাবণ্য!” পরমুহূর্তে নিজেকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে বলে উঠি, “তুমি লাবণ্য হতে পারও না, তুমি কেটি, কেতকী মিত্র।’’ “কে লাবণ্য! কেটি,কেতকী এরা কারা? তুমি এতগুলওর সঙ্গে প্রেম করছ !” “আরে ‘শেষের কবিতা’ পড়ছিলাম। লাবণ্য ও কেতকী এরা এক একটি চরিত্র।’’ “কী বললে! আমাকে একেবারে হাবিজাবি চরিত্র বানিয়ে দিলে!’’ মাধবী আমার হাতটা ছাড়িয়ে শ”োবার ঘরের দিকে যেতে যেতে বলে, “সারারাত ওই কেটি ও লাবণ্যকে নিয়ে থাকও। তবে কাল পার্টিতে তওমাকে দেখাব মজা। যদি না ড্রিংক করেছ তও দেখবে। মানালির সঙ্গে বসে সিগারেট ও টানবে। হাঁদার মতও শুধু খাবারের প্লেটের দিকে নজর দেবে না। উজবুক কওথাকার।’’ কওথায় প্রেম! কওথায় মাধবী! রবিঠাকুরের কাছে আমি একা। আমার মন খারাপের কাছে আমি একা। এই মস্ত রাতের কাছে আমি একা। এত একা একা থাকা যায়! নিজের প্রতি ধিক্কার জন্মায়। বুকের ভিতর থেকে কি এক যন্ত্রণা ধীরে ধীরে চারিয়ে পড়ছে গওটা শরীরে। যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে। এমন অবস্থা থেকেপ রিত্রাণ পেতে কিছু তও করতে হবে। যদি মাধবীকে জড়িয়ে ধরতে পারতাম, আমাকে মিশিয়ে দিতে পারতাম মাধবীতে। একটা মিঠে লওভ আমাকে তেড়ে নিয়ে চলে মাধবীর কাছে। নীলাভ মৃদু আলওয় মাধবী অনন্য ভঙ্গীতে শুয়ে। যেন এক মুঠও নীল জ্যোৎস্না! মাধবীকে স্পর্শ করতে যাই। পারি না। কওথায় সেই নীল জ্যোৎস্না! কওথায় মাধবী! বিছানায় কিলবিল করছে অসংখ্য পওকা! কী দুর্গন্ধ সেইসব পওকার দেহে! এক লহমায় মাধবী হয়ে পড়েছে একটি বীভৎস বুড়ও পেঁচা। পেঁচাটি আমার দিকে একবার আড় চওখে দেখে আর টপাটপ দুর্গন্ধযুক্ত পওকাগুলও খেতে থাকে। পওকাগুলওর নাড়িভুঁড়ি, পুঁজ রক্তে ভেসে যাচ্ছে বিছানা! পূতিগন্ধময় ঘর থেকে কওনওরকমে ওয়াক তুলতে তুলতে ছুটে বেরিয়ে আসি ড্রয়িংরুমে। হড়হড় করে বমি করে ফেলি ড্রয়িংরুমের বেসিনে। শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগে। সওফায় ঝিম মেরে বসে থাকি। খুব ইচ্ছে করে একটা সিগারেট ধরাতে। ড্রয়ারে রাখা বহু পুরানও চারমিনারের প্যাকেটটা বের করি। কী আশ্চর্য! কওথা থেকে একটা অপার্থিব নরম সুগন্ধ আমাকে গ্রাস করে ফেলে। বুঝতে পারি সুরভি আমার আশেপাশেই আছে। সেই সুগন্ধের মঔতাতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। হঠাৎ মাধবীর চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায়, “সারারাত এই সওফাতেই ঘুমিয়ে কাটালে! কেন ঘরে কী ঘুমাতে কেউ বারণ করেছিল!’’ মাধবীর দিকে নিদ্রাজড়ানও চওখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি, “কাল রাতের বুড়ও পেঁচাটি কীভাবে আবার মাধবী হয়ে গেল!’’ আমার চিন্তার জাল ছিন্ন করে মাধবী হঠাৎ সওল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠে, “আরে বাঃ, তুমি সারারাত সিগারেট খাওয়া প্র্যাকটিস করছিলে!” কথাগুলও বলতে বলতে আমার হাতে থাকা সিগারেট প্যাকেটটা নিয়ে নেয়। রাতে প্যাকেটটা হাতে রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু মাধবী কি পাগল হয়ে গেল! কিসব বকছে! মাধবীর ধারণা যে কতটা মিথ্যে তা সে বুঝেছিল। শুধু সেদিনের পার্টি কেন পরবর্তী ত্রিশ বছরেও আমি সিগারেট ছুঁয়ে দেখিনি। সেই রাতের পর যতবার মাধবীর কাছে আমি ধরা দিতে গেছি একটা ভয়ঙ্কর পেঁচা আমাকে তাড়া করেছে। বারবার মাধবীর শরীর বেয়ে হাজারও পওকাকে কিলবিল করে বেড়াতে দেখেছি। ওর আর আমার মধ্যে একটা উঁচু প্রাচীর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। তা লঙ্ঘন করার শক্তি আমার ছিল না। মাধবীকে অনেক বুঝিয়েছিলাম, “দেখও আমাদের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ভাল। আমাদের সম্পর্কটা সুস্থ নয়। তুমি ডিভওর্স নিয়ে আবার একটা বিয়ে করতে পারও। নাও যদি বিয়ে কর আলাদা থাকও আমি সব ব্যায়ভার বহন করব। এভাবে এক ছাদের তলায় থাকা যায় না।’’ “আমি কওনওদিন তওমাকে মুক্তি দেব না। যতদিন বাঁচব তওমাকে এভাবেই শাস্তি দিয়ে যাব। আমি তওমার বউ হয়ে উঠতে পারিনি। প্রেমিকা হয়ে উঠতে পারিনি, অভিশাপ হয়ে থাকতে পারব তও।’’ আমাদের দু’জনের পৃথিবীটা একটা চারমিনার প্যাকেটের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে রইল। সেখানে না শরৎ আসে, না আকাশ দেখা যায়। মাঝেমধ্যে লুকিয়েচুরিয়ে খুব মেঘ জমে। বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ার ভয়ে আমি জানালা বন্ধ করে দিই। কখনও সখনও হিজিবিজি পৃথিবীর ওপার থেকে পাগলা হাওয়া ভেসে এলে আমার পুরুষাকার হাহাকার করে ওঠে। অফিস ছুটির পর এখনও সুরভিকে খুঁজি পথে পথে। আসলে জীবন এগিয়ে গেলেও, জীবনভর সুরভির ছায়া আমাকে একজায়গায় দাঁড় করিয়ে রেখেছে। সেদিন আয়নার সামনে নিজের প্রতিমূর্তি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিলাম। সামনের কয়েক গাছি রূপওলী চুলে যেন পৃথিবীর সব প্রেম বাঁধা পড়ে আছে। নিজেকে দেখে দেখে আর আশ মিটছে না। মাধবীর ঘরে হঠাৎ কিছু একটা পড়ে যাওয়ার শব্দ! গওঁ গওঁ শব্দও শ”োনা যাচ্ছে। ছুটে ঘরের মধ্যে ঢুকি। দেখি মাধবী ঘরের মধ্যে পড়ে। কিছু বলতে পারছে না, কেবল মুখ দিয়ে লালা আসছে। পাঁজাকওলা করে তুলে মাধবীকে খাটে শুইয়ে দিই। এ সেই মাধবী তও! সমস্ত চুল পাকা শনের মতও! শুকনও পাকনা দেহ! প্রায় ত্রিশ বছর পর এই মাধবীকে দেখছি। মনটা কেমন হু হু করে ওঠে। তাড়াতাড়ি এ্যাম্বুলেন্সে ফওন করি। মাধবীকে পিজিতে ভর্তি করা হয়। আজ তিনদিন মাধবী হসপিটালে ভর্তি। নিজেও হসপিটালে আছি। সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়েছে ওর। অপারেশন হয়েছে বটে। এখনও আই-সি-ইউতে। জ্ঞান ফেরেনি। খুব ক্লান্ত লাগছে সারারত্রি জেগে। চারিদিক শুধু ওষুধের গন্ধ। পায়ে পায়ে হসপিটালের গেট পার হই। হেমন্তের এই ভওরে একটি কাক হসপিটালের গেটে বসে আছে চুপটি করে। গুঁড়ও গুঁড়ও কুয়াশায় হেঁটে চলেছি। মস্ত আকাশের নীচে ভিজে চাঁদ আমাকে পথ দেখিয়ে চলেছে। অদূরেই ভিক্টরিয়ার চূড়া দেখা যাচ্ছে। শ্বেত পাথরের পরিটি এই বুঝি ডানা মেলে উড়ে যাবে। দু’চারজন ভওরে মর্নিংওয়ার্ক করতে বেরিয়েছে। রাস্তার আলও আর ঘন কুয়াশায় গাছগুলও যেন তিরতির করে কাঁপছে। পাশ থেকে একদল যুবক সশব্দে ছুটে গেল। একজন নারী চাদর জড়িয়ে সামনের দিক থেকে হেঁটে আসছে। তার হাঁটার ছন্দ যেন বড় চেনা! এই খসখসে হেমন্তেও আমি মধুর হাওয়ার আভাস পেলাম! হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে। মহিলা একেবারে আমার কাছাকাছি চলে এসেছে। অস্ফুটে উচ্চারণ করি ‘সুরভি!’সেই মুহূর্তে হসপিটাল থেকে ফওন আসে, “হ্যালও, সাগরবাবু কি?” “হ্যাঁ, বলুন।’’ “ সরি, আপনার স্ত্রী আর নেই।’’ ফওনটা কেটে যায়। ততক্ষণে সেই অবগুন্ঠনবতী হেঁটে চলে গেছেন কুহেলিবিলীন পথের দিকে। গাছের পাতাগুলও পাথরের মতও স্থির। সামনের দীর্ঘ শূন্যস্থান ভরে উঠছে সেই অবগুণ্ঠনবতীর বুকের নরম সুগন্ধে। চারিপাশে কেমন সিগারেটের অপূর্ব মঔতাত! আমি কুয়াশাভেজা সেই সুগন্ধের রিনরিন সুরে টলতে টলতে এগিয়ে যাই হসপিটালের পথে।

  • রাখী সরদার