পয়লা যখন একলা হল

সা মাজিক মাধ্যমে ইদানীংকালে একটা ‘মিম’ মাঝে-মাঝে দেখতে পাওয়া যায়, যেখানে পয়লা বৈশাখকে লেখা হয় বাংলা অক্ষরে সংখ্যায় ‘১’এর পাশে একটা ‘লা’ জুড়ে দিয়ে। একলা বৈশাখ। পওস্টে হাজারে হাজারে লাইক, কমেন্ট, পলকে হওয়াটসঅ্যাপে শেয়ার! একলা হয়ে যাওয়া ত ো বরং চিন্তার বিষয়, কিন্তু এরকম বহুল আনন্দের সঙ্গে লওকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে কেন? না, অনেক তরুণ- তরুণীর কাছে এই একবিংশ শতকের অধুনা-উত্তরাধুনিকতা বড়ই একলা, বিষাদাছন্ন। না আছে রূপ- রস-গন্ধ-স্পর্শ, না আছে একটু সময়কে ঝালিয়ে নেবার এক্তিয়ার। সামাজিক লঔকিকতা আর স্ব-নির্মিত ঘেরাটওপের দওদুল্যমানতায় নব্য ‘বং’জগত যে প্রায় ক োমায় যেতে বসেছে- এও ইদানীং আর অজানা নয়। কিন্তু, এই একলা হবার মর্ষকামে (একলা হতে চাই, হয়েও যাই, তারপর দুখী-জীবনের স্ট্যাটাস চেপকাই) একলা, থুড়ি, পয়লা বৈশাখ? সে কেমন আছে? তার খওঁজ কি কেউ নেয়? অভিযওজনবাদের সমানুসারী নিয়মে সে কি এখনও স্বালওকদীপ্ত নাকি বৈশাখের খরতায় ঝলসাতে ঝলসাতে প্রায়ান্ধকারে নিমজ্জিত? আসুন না, একটু পয়লা বৈশাখের সঙ্গে আলাপচারিতা সেরে আসি। দেখে আসি, আজকের এই সংস্কৃ তিতে সম্পূর্ণ বেমানান হয়ে যেতে, তার আর কতটা বাকি। হেঁটে যাচ্ছি বাংলার ক োনও এক নাম-না-জানা রাস্তা দিয়ে, দেখি একটা চায়ের দওকানের সামনের বেঞ্চিতে জড়সড় হয়ে বসে আছে আমাদের চিরচেনা পয়লা বৈশাখ। ত োবড়ানও গাল, ক োঁচকানও চওখ- মুখের চাইতেও যেটা বেশি লক্ষ্যণীয়, এই ভরা গরমেও একখানা বেঢপ হনুমান টুপি পরে বসে আছে। - ক ী ব্যাপার ভায়া? মতিভ্রম হল নাকি? সে উত্তর দেয় না। চওখে ঘওর। গ্লাসের লালচে তরল পদার্থটা লিকার হিসেবে চা-ই ত ো? নাকি,সক্কাল সক্কাল…! কিছুক্ষণ ইতিউতি চেয়ে ঠওঁট নাড়ে। - আসলে আলমারিতে তুলে রাখার আগে একবার রওদে দিতে বের করা হয়েছিল হনুমান টুপিটা। তাই একবার পরে দেখে নিলাম এমনিই। এই গওটা শীতে একবারও পরাই হয়নি। ছওঃ! একেবারে পাগলে গেছে। - আরে আজকের দিনে কেউ হনুমান টুপি পরে? কত নতুন নতুন জ্যাকেট, সওয়েটার, ক োট- উইন্ডচিটার – মাঙ্কি ক্যাপ আজকের দিনে অচল! - তা অচল ত ো আমিও হয়ে গেছি আজকের দিনে। আমাকেও কি ফেলে দেবে নাকি হে? বেকুবের মত ো বসে রইলাম। অচল! পয়লা বৈশাখ! সত্যিই। কথাটা তলিয়ে দেখলে ভুল কিছুই বলেননি পয়লা বৈশাখবাবু। আজকের রঙচঙে রঙ্গ-দুনিয়ায় সে কি আদঔ তামাম বাংলার অন্যতম আনন্দ- সমাগমের প্রতীক হয়ে উদ্ভাসিত? নাকি, বৈকুণ্ঠধামে যাত্রার সময় সমাগত? মন চলে হাওয়ার গতিতে। পঔঁছে যাই ছওটবেলায়। পয়লা বৈশাখ! আহা, আলাদাই মেজাজ তার তখন। বাঙালিদের কাছে দুর্গোৎসবের পর বওধ হয় সবথেকে আনন্দের উৎসব। একদিনের ব্যাপার, কিন্তু তার প্রস্তুতি সপ্তাহখানেক ধরে চলে তুঙ্গে। শীতের আমেজ পেরিয়ে, বাসন্তী সুরের হাতছানি ছাড়িয়ে চৈত্র সেলের ডাকাডাকিতে খানিক দর-কবজা করে অবশেষে সে আসে। রাস্তায় ভিড়, আমাদের এই ঘিঞ্জি স্টেশন রওড দিয়ে পয়লা বৈশাখের প্রায় আধমাস আগে থেকে হাঁটা-চলা করাই অদম্য সাহসিকতার পরিচয়। আর দিনটা এসে পড়লে? সক্কাল সক্কাল ক োথাও না ক োথাও ঠিকই শুরু হয়ে যেত, “এসও হে বৈশাখ, এসও এসও”। প্রখর গরমের তাতে কেন যে বাঙালির একচ্ছত্র গর্ব-সম্রাট দাড়িওয়ালা দাদুর এরকম গান লেখার ইচ্ছে হয়েছিল জানি না, তবে মেজাজটা ভালওই জমে উঠত সুরে-তালে-পরিবেশনায়। বাড়িতে দাদু “রবীন্দ্র রচনাবলী” থেকে পড়ে শওনাতেন ক োনও দীর্ঘ কবিতা, বা ক োনও গল্প বা গীতিনাট্যের অংশ। টিপিক্যাল আটপঔরে বাঙালি হয়ে উঠতে দ্বিধা হত ো না একবারও, বরং, এই বিশেষ দিনটির আদি সন্দর্ভে পুরও বঙ্গ-প্রজাতিকে নিয়ে বেশ প্রচ্ছন্ন গর্ব অনুভব করতাম। পকেটে না হলেও মেজাজে ছড়িয়ে পরত আভিজাত্য, বড়দের গওঁফের ক োণ ঘেঁষে ফুটে উঠত মুচকি হাস্যঝলক। পাড়ায় হালকা অঙ্গসজ্জা, প্রতিবেশী ক্লাবে ফাংশান, গান-বাজনার জলসা-মজলিশ বসে শেষও হয়ে যেত বেলা পড়ার আগেই। সকালবেলাটা যদি দখলে নেয় সাহিত্য, বিকেল থেকেই ‘ফ্যাশন’-এর তদানীন্তন তাৎপর্য বেশ তরিবত করেই মূর্ত হয়ে উঠত। এপাশে লওক, ওপাশে লওক, মধ্যিখানে বৈশাখী আলওয় মওড়া সন্ধ্যে। যদিও, তিথিমতে সূর্যোদয়ের পর থেকেই ফওনে শুভেচ্ছা, প্রণাম তরঙ্গ-বৈতরণী পারাপার করত, আসল আনন্দের আসর জমত এই ভরাটি সন্ধ্যের সময়েই। আমাদের গায়ে তখন সেলে কেনা সস্তার পাঞ্জাবি, যার হয়ত বেখেয়ালে হাত-ত োলায় বগল ফেঁসে যাবে সামনের সপ্তা’তেই। তবু, তাতেই আমাদের মজা। সাতটা বাজতে না বাজতেই রেডি হবার ত োড়জওড়, বাড়ির বড়দের তাগাদা লাগানও। মিষ্টির প্যাকেট তখন স্বপ্নচারিণীর মত ো অন্তরাত্মায় উঁকি মারছে। শুধু কি নিমকি-লাড্ডু-জিবেগজা? উঁহু, কখনও কখনও সুঘ্রাণে মাত োয়ারা করত অন্য মিষ্টির রসে ভেজা জবজবে শিঙ্গাড়া, কপাল আরেকটু সঔখীন হলে মিলত ভুজিয়ার প্যাকেট। ছানার জিলিপিও দেখেছি এক-দু’বার। দওকানে দওকানে লওকে-লওকারণ্য। যে দওকানে হয়ত কেউ সারা বছরে একবার উঁকি মারার সময়টুকুও ব্যয় করতে চান না, পয়লা বৈশাখের দিনে সাতটা বাজতে না বাজতেই কান-এঁটও হেসে সেখানে পঔঁছে যান ঠিকই। লঔকিকতার এই সদাহাস্যময়, সীমাহীন উদযাপনে কে আর নিজেকে বাদ রাখতে চায়! নাহ, একটু গভীরে যাই। আজ ব্যাটাচ্ছেলে কেমন মনটাকে উদাস করে দিয়েছে। চওখের সামনে ভেসে উঠছে মায়াবী স্মৃতির অঞ্চল। একটু ভেবেই নিই বরং! মাঝে মাঝে ভেবে সত্যিই পুলক বওধ হয়; যে আমরা, মানে এই আজকের দিনে জীবনের শতকরা হিসেবে এক-চতুর্থাংশ পার করে ফেলা ছেলে-মেয়েরা, এমন একটা সময়কে দেখতে দেখতে বড় হয়ে উঠেছি, যে প্রকৃতি ও নিয়তির সুস্পষ্ট বাঁক-বদলগুলও পরিষ্কার চওখে পড়েছে। আধুনিক যন্ত্র-সভ্যতা এবং বিশ্বায়নের দাপট ক্রমশ থাবা বসাচ্ছে অর্থনীতির সাম্রাজ্যে, চওরাগওপ্তা ঘনিয়ে উঠছে পশ্চিমি দঔরাত্ম্যের সস্তা বঙ্গীয়করণ। রাস্তা বদলাচ্ছে, বদলাচ্ছে নিত্যনতুন সমীকরণ। আমাদের হাফ প্যান্টের কৈশওরে একটু একটু লাগতে শুরু করেছে লজ্জার রেশ, বয়ঃসন্ধির সমানুপাতে চুলের ভাঁজ, জামার হাতা খুঁজে নিতে চাইছে আরেকটু নতুনত্বের ছওঁয়া। বাংলা সিনেমার গান বিচ্ছিরি লাগছে, দুঃখ- বিলাসের বিষাদাশ্রয়ী সুরে উদাস হয়ে যেতে চাইছি আমরা। ঠিক এরকমই একটা সময়ে পয়লা বৈশাখ আমাদের কাছে একটা অনালাপী মঔতাতের রসধারা বয়ে আনত অজান্তেই। আমরা তখন পকেটে এক টাকা-দু’টাকা নিয়ে স্কুল যেতাম। আইসক্রিমের দওকান থেকে কিনতাম রঙিন বরফের ‘পেপসি’ বা অস্থায়ী ঠ্যালাগাড়ি থেকে কিনে নিতাম এক কাপ রঙচঙে বরফ। হাইজিনও মানিনি, ডাইজিনের নামও জানিনি। কী স্বাদ সে-সবের! বাড়িতে কমপ্ল্যান-মলটওভা-বর্নভিটার ত্রিশক্রি আঁতাতকে হার মানিয়ে এক কাপ চা পেতে রীতিমত ো যুদ্ধ করতে হত ো। টিভিতে ব্যাটম্যান, সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান তখনও সুস্পষ্ট বিদেশি খেয়াল, আমাদের কাছে হিরও তখন শক্তিমান। সেই স্টান্টগুলও বাড়িতে করতে যাওয়ার গওপন অভ্যেস প্রকাশিত হয়ে পড়লে জুটত তালঢ্যাঙা সাইজের বকুনি, কখনও ম্যাজিকের মত ো লাল হয়ে উঠত মওচড়ানও কান। বড় যে হইনি বা হচ্ছি না একটুও- তা বুঝে যেতে হত প্রতিক্ষণেই। এই সময়েই পয়লা বৈশাখের স্মরণীয় সন্ধ্যেগুলওয় আমরা প্রস্তুত হয়ে নিতাম হঠাৎ বড় হয়ে যাওয়ার জন্য। চৈত্রের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই চিঠি আসা শুরু হত ো। দওকানে আমন্ত্রণ – হালখাতা। মানে বুঝতাম না ঠিকই, কিন্তু এটুকু নিশ্চিত হতাম, দুর্গাপুজওর অষ্টমীর লুচি যেমন আলাদা স্বাদ বয়ে আনে, এই দিনটাও আমাদের জন্য স্বর্গীয় তৃপ্তি বয়ে আনবে এইবার। হলুদ বা লাল পাঞ্জাবি, গিঁট সামলাতে হিমশিম খাওয়া পাজামা। বয়স যত কমই হওক, ঠাটেবাটে যেন কমতি না হয়! কে বলতে পারে, পুলকারে আমার ঠিক উল্টোদিকে বসা মেয়েটা আজ সেজেগুজে বেরিয়ে পড়বে না কাকু-কাকিমার সঙ্গে? অতএব, চুলে তিনবার হাত বুলিয়ে, ঝাঁ-চকচকে হবার ক্রম-ব্যর্থ চেষ্টা নিয়েই এগিয়ে পড়তাম। মফস্বলের দওকানঘরেরা মওটামুটি তাদের রওজকার খদ্দেরদের চেনে। সেই দওকানগুলওই কেমন অপার্থিবভাবে সেজে উঠত এই সময়। ক োথাও টুনি বালব লুটওচ্ছে দওকানের নাম থেকে রাস্তার ধুলও পর্যন্ত, ক োথাও ফুলের চাপে ঢেকেই গেছে দওকানের নাম। ভেতরে বিগলিত-বদনে হাত-জওড় মালিক আমাদের ডেকে আনতে তৎপর। ভেতরে যেতেই সস্তা প্লাস্টিকের গ্লাসে ফ্রুটি, স্প্রাইট, ক োকা ক োলা বা লিমকা, বা কখনও একটা স্টিলের ড্রাম থেকে ক োনও কর্মচারী ঢেলে দিচ্ছেন আমপওড়ার শরবত। গওটা গরমকালে ওই স্বাদ বওধ হয় ওই একবারই পেতাম। শরবতের সঙ্গে কখনও বা আইসক্রীমও পেয়েছি। বড় টু-ইন-ওয়ানের বার থেকে বড় করে কাটা আয়তঘনাকৃতি টুকরও; খেতে খেতে খেয়ালই থাকত না, কখন সে টুকরওর ষাট শতাংশই গলে গিয়ে পাঞ্জাবিকেও খানিক স্ট্রবেরি-ভ্যানিলার স্বাদ পাইয়ে দিয়েছে। মুখে-হাতে-গায়ে মাখামাখির একশা কাণ্ডের পর হয়ত চওখে পড়ত, পুলকারে ঠিক পাশে বসা আমার বয়সের মেয়েটাই আমার নাস্তানাবুদ হাল দেখে হেসে কুটিপাটি হচ্ছে। সেই মুহূর্তে পকেট থেকে বের করতাম রুমাল – আমাদের খামখেয়ালি শৈশবের অন্যতম ‘স্টাইল-স্টেটমেন্ট’-এর উপাদান। কিন্তু ততক্ষণে সে হাওয়া, আর রুমালও আইসক্রিম মেখে পুনরায় পকেটে চালান। সবথেকে আনন্দ হত ো, সারা- বছর “খওকা”, “বাবু” ডাকা দওকানিকাকুরা সে-দিন বেশ সম্ভ্রমের সঙ্গে আপ্যায়ন করতেন। ছওট বলে মওটেই উপেক্ষা করতেন না। বাবা-দাদুরা এগিয়ে যেতেন খাতার দিকে, গান্ধীজীর হাতবদল হত ো- আর আমি দেখতাম শুভ্র-সফেন আলওর ডিগবাজিতে কেমন পালটে গেছে রওজকার পরিচিত সনাতন দওকানের গৃহস্থ-ঘর। দওকানগুলওর রংবদলও এই সময়ের এক বাড়তি আয়ওজন। আয়তন আর সামর্থ্য যেমনই হওক, প্রতিটা দওকানই চেষ্টা করত আতিশয্যে একটু নবাবিয়ানার পারদ চড়াতে। বড় গদিতে আদ্দেক ঢাকা শাড়ির দওকান হওক বা বয়ামে-গুদামে ধাক্কাধাক্কি করা মুদিখানা, চকচকে মলাটে ঠাসা আলমারিসমৃদ্ধ বইয়ের দওকানই হওক বা কাচের শও-কেসে লওভ-ছুঁড়ে-দেওয়া মিষ্টির – যে যেমনভাবে পারত, নিজেকে গুছিয়ে নিত প্রগলভভাবে। আজীবন যে-সমস্ত গুমটি কেক-লজেন্স- বিস্কুটে র দওকানে টিমটিমে চল্লিশ পাওয়ারের, ফিলামেন্ট দেওয়া হলুদ আলওর ছাড়া আর কিছুই দেখিনি, পয়লা বৈশাখে সে দওকানের বাসিন্দাও হাসি- মুখে এগিয়ে দিতেন পাঁচ টাকার ক্রিম-কেক বা দুটও এক্লেয়ার্স। আসলে উদ্দীপনা জমত মনে, ক্যাশবাক্সে নয়। তাই, আদতে মানুষজনের সঙ্গে এই সুগভীর আলাপের আদানপ্রদানই মুখ্য হয়ে উঠত, মিষ্টির দাম কদাচ নয়। দওকান থেকে বেরিয়ে আসার পর যখন হাতে ঝুলত নতুন, টানটান কাপড়ের মজবুত ব্যাগ, আর বেশ ভার-ভার লাগত ভেতরের মিষ্টির ওজনে বা আনন্দের অগ্রিম উল্লাসে- সে এক অনন্য স্মৃতি। ব্যাগে তেরচা হয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে পড়ে থাকত বাংলা অক্ষরে সজ্জিত ক্যালেন্ডার- যার একেকটা পলকা পাতায় স্টেপলড পিনে আটকানও তিনটে করে মাস, প্রতি তিন মাসে ছিঁড়ে ফেলতে হত ো একেকটা পাতা। ওপরে সাক্ষাৎ মা ভবতারিণীর দর্শন বা কখনও পরমপুরুষ রামকৃষ্ণে র দাড়িভর্তি নিঃস্পৃহ মুখ। ইচ্ছে করে ব্যাগটা বেশি করে দওলাতে দওলাতে অন্য দওকানে গিয়ে ঢুকতাম, যাতে সেখান থেকেও এই একই জিনিস প্রাপ্তি হয়। এমনও হয়েছে, আমন্ত্রণ না থাকা দওকানের সামনে গিয়েও উঁকি- ঝুঁকি মেরেছি, এই বছরআষ্টেক আগেও একবার পয়লা বৈশাখে সন্ধ্যেবেলা বেরিয়ে দু’একটা দওকানে গিয়ে ইচ্ছে করেই তাদের খওঁজ-খবর নিয়েছি ওই লাড্ডুর আশায়। তবে দিন যত বদলেছে, গুড়ে বালির পরিমাণ সমানুপারে বেড়েছে। অতিমারির আগে থেকেই যে আশঙ্কা আস্তে আস্তে ঘনীভূত হচ্ছিল, তা-ই ক্রমান্বয়ে দুশ্চিন্তার আকার ধারণ করল। ব্যবসা-বাণিজ্যে গ্রাস করল অর্থনৈতিক সংকট, দৈনিক বাজার মূল্যের ঊর্ধ্বমুখী আয়েশে বিপন্ন হয়ে পড়ল আমাদের ক্রম-ন্যাতানও মফস্বল, আর সেই আঁচ এসে লাগল পয়লা বৈশাখের লঔকিক উদযাপনে। আসলে এই নববর্ষের উৎসব যে আসলে শাস্ত্রীয় চিন্তার ফলাফল ছিল না, বরং তা মূলত আন্তরিক আহ্বান করত এলাকায় ছড়িয়েছিটিয়ে লঔকিক এবং সামাজিক সম্পর্ককে। সখ্য ত ো থাকতই সারা বছর, কিন্তু এই বিশেষ দিনের আলাপচারিতা শুধু পরওক্ষ উত্তেজনার নিরীখে বিনিময় প্রথা নয়। আদতে পয়লা বৈশাখ একটা মিলনওৎসবের অপর নাম ছিল। উদযাপনে ছিল না ক োনও ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক বিভেদ। আদ্যোপান্ত লওকাচার থেকে সামাজিক সংস্কৃ তি হয়ে ওঠাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য, আর তা হত োও। বৈষয়িক চিন্তনের আপামর বিচরণ নয়; আদতে একটা সদালাপী সময়ের খওলসকে পারম্পর্যের স্বীকৃতিকে জারিত করে তুলে মানুষে-মানুষে ক োলাকুলির উপাখ্যান তৈরিই হত ো নববর্ষের প্রারম্ভিক চর্চায়। সময় পালটায়, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খসে পড়ে অস্তিত্বের অঙ্গীকার। বাস্তবিক বৈচিত্র্যের রসে উপভওগ্য পয়লা বৈশাখও ধীরে ধীরে বহিরঙ্গের ক্রমবর্ধমান চাপে থিতিয়ে পড়ছে লুপ্তপ্রায় সংস্কৃ তির মন্থকূপে। ক্যালেন্ডারের দিনমতে আছে ঠিকই, কেবল ক্ষয়ে গেছে তার ঐশ্বর্য। বাধ্যতামূলক রীতি- নীতির পাল্লায় পড়তেই চায়নি যে, তাকে যেন কেমন একটা অতীব পরজীবী করে ত োলার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন পক্ষ থেকে। ধুলও পড়ছে হালখাতার হিসেবের খাতায়, লাড্ডুর রঙে মরচে ধরছে প্রতি বছর। আর নেই সে জঔলুস, নেই সেই ফুর্তির আধার। নাগরিক সভ্যতার হিসেবের জটিল খতিয়ানে মুছে যেতে পারেনি সে, কিন্তু নববর্ষের নব জওয়ারে এখন শুধুই ফ্যাকাশে আলওর ম্লান হয়ে রওশনাই, যেখানে একবিংশ শতকের উত্তরাধুনিক তারুণ্যের খওয়াবনামা রচনার আর সুযওগ নেই। আজ আসি তবে। ওঠার সময় হল। চমকে উঠলাম। কত বেলা হয়ে গেছে, খেয়ালই নেই। চওখ মুছে দেখলাম, হনুমান টুপির আড়ালে ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে পয়লা বৈশাখ। সময়ের ভারে ন্যুব্জ, বৃদ্ধ সামাজিকতার মায়ালঔকিক প্রতীক আজ বড্ড একলা হয়ে পড়েছে। শুধু কি সে? একলা হয়েছি আমরাও। আজ আমরা লওকজন দেখলেই পালাই, একা থাকার বৃত্তে সংকীর্ণ হয়ে থাকার আনন্দে মশগুল হতে চেয়ে লঔকিকতার দায়ভার থেকে মুক্ত হতে চাইছি। শুধু মিস করি ওই হলুদ-সাদা আলওয় মওড়া চিকচিকে সন্ধ্যেগুলওকে, যাদের সঙ্গী করে বড় হতে চাইতাম বরাবর। গত দুয়েক বছরের নববর্ষেও বেরিয়েছি বটে, কিন্তু সে-সব সন্ধ্যের ম্রিয়মাণতা দেখে ধাঁধা লেগে গেছে নিজেরই। অন্য দিনের মত োই কাৎ হয়ে পড়ে থাকা পলেস্তারা-খসা দওকানঘর, যেখানে এক কালে আলওর প্রলেপে ঢেকে যেত মিয়ওনও ক্যাশবাক্স, সেখানে এখন শুধুই ছাপওষা সন্ধ্যার উগ্র-গন্ধের ধূপ জ্বলে একা। আমপওড়ার শরাবি আমেজে হওক বা আইসক্রিমের নবাবি মুন্সীয়ানায়, তিথির চকমেলানও সন্ধ্যেয় হওক বা পাঞ্জাবির মেজাজি সাম্পান - আমাদের আনমনা কৈশওরের রংচটা মফস্বলকে এক পলকেই রাজা করে দিত পয়লা বৈশাখ। সে আশীর্বাদ আজ আর ক োথায়!

  • রক্তিম ভট্টাচার্য