দু র্গোৎসবের মত োই পবিত্র ঈদ বাঙালির অন্যতম সেরা উৎসব ।বাঙালি মানে ক োনও ধর্মীয় সত্তা নয় ।ভাষা- সংস্কৃ তির সত্তা দিয়ে যে বাঙালির সম্যক বিকাশ-- এটাকে সার্বিকভাবে বাঙালির সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত করবার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে একইসঙ্গে সমান মর্যাদায় হিন্দু বাঙালির দুর্গোৎসব পালন করে ।তেমনিই সমান মর্যাদায় মুসলমান বাঙালির ঈদ পালন করে। ‘ ৪৭ এর দেশভাগের পরবর্তী সময়ের নানা রাজনৈতিক উত্থান পতন, পাকিস্থানি হানানাদার বাহিনীর ভয়াবহ নারকীয়তা, সবকিছুকে অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যে অখন্ড বাঙালি জাতীয়তাবাদ স্থাপন করেছিলেন, তার মধ্যে থেকেই বাঙালি জাতিসত্তার সম্যক বিকাশ ঘটেছে ।এখানে ধর্মীয় পরিচয়টা কখনও প্রধান হয়ে উঠে আসেনি ।উঠে এসেছে সাংস্কৃ তিক পরিচয় ।উঠে এসেছে ভাষাগত ঐক্যের বিষয়টা । বিভাগওত্তোর কালে ,এপার বাংলায় এই চিন্তা চেতনার প্রসারের ক্ষেত্রে অন্নদাশঙ্কর রায় কাজী আবদুল ওদুদ, গঔরকিশওর ঘওষ ,গঔরী আইয়ুব , মৈত্রেয়ী দেবী প্রমুখ অনেক মানুষেরা সেই ধারাটা এপার বাংলাতে স্রোতস্বিনী করে তুলেছিলেন। বিভাগ কালের বহু বিবাদ -বিসংবাদ কে একটা অপূর্ব মানবিক প্রলেপ দিয়ে ,হিন্দু মুসলমান উভয় ধর্মীয় সত্তার বাঙালিকে কাছাকাছি আনবার জন্য তাঁরা নানা ধরনের সামাজিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এই সামাজিক প্রয়াসগুলও কিন্তু সেই সময়ের রাজনৈতিক দলগুলিরও নেওয়া খুব প্রয়োজন ছিল। রাজনৈতিক দলগুলি বিশেষ করে, প্রগতিশীল দলগুলি, তাঁদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে হিন্দু মুসলমানকে একসাথে রেখেই রাজনৈতিক দাবিদাওয়া আদায়ের প্রশ্ন টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন ।বিশেষ করে, ছিন্নমূল হিন্দু বাঙালিদের মধ্যে দেশভাগজনিত ক্ষতকে কেন্দ্র করে মুসলমান সমাজ সম্পর্কে যে একটা সাময়িক বৈরতার মনওভাব তৈরি হয়েছিল, সেটার উপশমের ক্ষেত্রেও ,সেই সময়ের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলির রাজনৈতিক আন্দোলন একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল। এখানে অবশ্য একটা কথা বলা খুব দরকার যে ,দেশভাগের কালে ছিন্নমূল হিন্দু বাঙালিদের মধ্যে মুসলমান সমাজ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণাটা প্রবেশ করানও হয়েছিল, সেই সময়ের শক্তিমান হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করা লওকেদের মাধ্যমে । অন্নদাশঙ্কর, গঔরী আইয়ুবদের সেই ধারাটা এখন এপার বাংলায় আগের মত আর বেগবান নয়। হিন্দুদের দুর্গোৎসব ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলি কেউ প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন ,কেউবা প্রত্যক্ষভাবে অংশ না নিলেও ,উৎসবকে ঘিরে যে জনসমাগম, তাকে নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শ প্রচারের স্বার্থে ব্যবহার করেন ।বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যাঁরা যুক্ত ,তাঁরা দুর্গা পুজও মণ্ডপের গায়ে বা যেসব অঞ্চলে উৎসবকে কেন্দ্র করে ব্যাপক জনসমাগম হয় , মেলা বসে, সেখানে বইয়ের স্টল করেন। সমসাময়িক বিষয় থেকে শুরু করে ,প্রগতিশীল সাহিত্য, কবিতা সহ রাজনীতির বহু বিষয় ঘিরে তাদের সেই বইয়ের স্টল হয় ।প্রচুর বেচাকেনা হয়। বেচাকেনা ঘিরে এ পাড়ার স্টলের সঙ্গে একটা প্রতিযওগিতা হয় ওপাড়ার স্টলের। কিন্তু ভাবতে যন্ত্রণা হয় , বাঙালি মুসলমান অধ্যুষিত যে এলাকাগুলিতে পবিত্র ঈদ ঘিরে একটা বড় জনসমাগম ঘটে, ক োনও ক োনও জায়গায় মেলা হয় ,সেই সব জায়গায় কিন্তু আমরা ওই রাজনৈতিক দলগুলিকে কখনও দেখতে পাই না বইয়ের স্টল করতে ।কখনও দেখতে পাই না রাজনৈতিক বিষয়, গল্প, উপন্যাস, কবিতা নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসে, জনসংযওগের ক্ষেত্রটিকে তাঁরা মুসলমান সমাজের দহলিজে প্রবেশ করাচ্ছেন। একটু ভাবতেই আশ্চর্য লাগে, জনসংযওগের যে প্রশ্নটিকে সামনে রেখে নিজেদের প্রগতিশীল বলে দাবি করা রাজনৈতিক দলগুলি হিন্দু বাঙালির অন্যতম প্রধান উৎসব দুর্গাপূজওকে ঘিরে বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেন, তাঁরাই কিন্তু বাঙালি মুসলমানের প্রধান উৎসব ঈদকে ঘিরে, সেই বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসে বাঙালি মুসলমানের সঙ্গে জনসংযওগের ব্যাপারটা করেন না। হয়ত োবা তাঁরা মনে করেন, এভাবে বাঙালি মুসলমানের সঙ্গে জনসংযওগ করতে পারা যায় না ।কিন্তু যে জনসংযওগের উদ্দেশে হিন্দু বাঙালির উৎসবকে ব্যবহার করা হচ্ছে ,সেই জনসংযওগে র বিষয় টিই মুসলমান বাঙালির ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। এমনটা কিন্তু প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই না ।সেখানে কিন্তু বাঙালি মুসলমানের অন্যতম সেরা উৎসব ঈদকে ঘিরে বাঙালি হিন্দুর মধ্যেও আবেগ, উন্মাদনা ক োনও অংশে কম থাকে না। বাংলাদেশে পশ্চিমবঙ্গের আদলে ধর্মীয় উৎসবকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলির উৎসব প্রাঙ্গণের পাশে বইয়ের স্টল দেওয়ার খুব একটা রেওয়াজ সেভাবে নেই। তবে গ্রাম বাংলায় ( বাংলাদেশে) আজও যেখানে কি দুর্গাপুজও, কি মহররম বা ঈদকে ঘিরে মেলা বসে ,সেখানে রাজনৈতিক দলগুলি ,প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র খওলেন ।যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গেই তাঁরা ওই ধরনের চিকিৎসা কেন্দ্র গুলি পরিচালনা করেন। সেটা সাধারণ মানুষের কাছে খুব গ্রহণযওগ্য হয় । এপার বাংলাতেও দুর্গোৎসবের সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র খওলেন। পানীয় জলের ব্যবস্থা রাখেন। এপার বাংলার গ্রামাঞ্চলে যেখানে মেলা বসে, সেখানে কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলির দুর্গোৎসবের কালের মত সক্রিয়তা চওখে পড়ে না ঈদকে ঘিরে। এপারের গ্রাম বাংলায় এখনও যেখানে যেখানে বাঙালি মুসলমানের উৎসব ঘিরে মেলা বসে, সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা ইত্যাদির ব্যাপারগুলি রাজনৈতিক দলের বাইরে স্থানীয় মুসলমান যুবকেরাই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বাঙালি হিন্দুদেরও ক োনও ক োনও ক্ষেত্রে এই ধরনের কাজে একটা সক্রিয়তা দেখতে পাওয়া যায় । এটা অত্যন্ত ইতিবাচক একটি লক্ষণ ।কিন্তু হিন্দু বাঙালিদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি, বাঙালি মুসলমানের উৎসবে এই ধরনের সহযওগিতা পালন করছেন এমন ক োনও দৃষ্টান্ত এখনও পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায়নি। যদিও হিন্দু বাঙালিরা পঔষ সংক্রান্তি ঘিরে গঙ্গাসাগরে যে মেলার আয়োজন করে, সেই মেলা কে ঘিরে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাধু সান্তনা সমবেত হন কলকাতায়। মূলত কলকাতার বাবুঘাটেই তাঁরা থাকেন এইসব হিন্দু সন্ন্যাসীদের দেখাশুনও ইত্যাদির জন্যে বেশ কিছুদিন ধরে মুসলমান সমাজের মধ্যে থেকে প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার কিছু যুবক সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এ দৃশ্য কলকাতার বাবুঘাটে গেলে ওই সময় সহজেই আমাদের চওখে পড়ে ।অনেক ক্ষেত্রে সেইসব সাধু সন্ন্যাসীরা মুসলমানের ,’স্পর্শ বাঁচায়ে পণ্যের পথে ‘ হাঁটতে চাইলেও এমনও বহু সাধু- সন্ন্যাসী আছেন ,উদ্যোগী যুবকদের ওই ধরনের ইতিবাচক ভূমিকায় তাঁদের প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করেন ।তাঁদের নিয়ে আসা খাবার খান। সঙ্গে করে নিয়েও যান। অনেক না হওয়ার মধ্যেও এই যে ছওট ছওট হয়ে ওঠা জিনিস ,যেমন; বীরভূমের পাথরচাপড়িতে যখন দাতাপীরের মাজারকে কেন্দ্র করে মেলা বসে, তখন সেখানকার প্রায় সব রাজনৈতিক দলগুলিরই একটা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরি করেন, যাঁরা বহু ক্ষেত্রে দূর দূরান্ত থেকে আসা তীর্থযাত্রী, এমন কি দেশের বাইরে থেকে আসা তীর্থযাত্রীদেরও প্রয়োজনীয় সহযওগিতা করে থাকেন। আমি নিজে জন্মসূত্রে হিন্দু ব্রাহ্মণ ঘরের মানুষ হয়েও যে জিনিসটা আমাকে বারবার মুগ্ধ করে ,সেটি হল; মুসলমান সমাজের অভিজাত ধনী ব্যক্তিদের এই ঈদকে ঘিরে ভূমিকাটি। এইপারের হিন্দু বাঙালির একটা বড় অংশই হয়ত ো জানেন না, পবিত্র ইসলাম জাকাত এবং ফেরত নামক দুটি বিধি-বিধান সুনির্দিষ্ট করেছেন মুসলমান সমাজের জন্য। যে বিধি- বিধান অনুযায়ী ধনী মুসলমানেরা তাঁদের আয়ের একটা অংশ সমাজের গরীব ,দুস্থ, অসহায় মানুষদের জন্য খরচ করে থাকেন। এপার বাংলায় বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, মালদাহ ,বর্ধমান, হুগলি, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা ইত্যাদি জেলাগুলিতে এই পবিত্র ঈদের সময় গেলে, যে ক োনও মানুষ দেখতে পাবেন, এলাকার গরিব মানুষেরা পবিত্র ঈদের উৎসবের দিন আদঔ মলিন মুখে থাকে না। আর দশ জন ধনী ব্যক্তির মত প্রচুর দামি পওশাক আষাক না পড়তে পারলেও, তাঁরা কিন্তু নতুন একটি কাপড়- জামা পায় এলাকার ধনী ব্যক্তিদের জাকাত ফেরতের মাধ্যমে দেওয়া টাকা থেকে ।তাঁরা কিন্তু উৎসবের দিনে দুটও ভালও-মন্দ খেতে পায় পবিত্র ইসলামের নির্দেশিত এই জাকাত ফেরতের বিধি-বিধানের মধ্যে দিয়েই। রাজনৈতিক কারণে মুসলমান সমাজকে ঘিরে বেশ কিছু বছর ধরে নানা ধরনের অপপ্রচার পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুরু করে গওটা ভারত জুড়ে আছে। কিন্তু যা রা এই ধরনের অপপ্রচার গুলি করেন, তারা একটি বা র ও ভেবে দেখেন না, হিন্দু সমাজে, তাঁদের সমাজেরই গরিব- অসহায়- দুঃস্থ মানুষদের জন্য, ধনী ব্যক্তিরা ধর্মীয় উৎসবের কালে এভাবে বা ধ্যতামূলক ক োনও অর্থ প্রদান করেন কিনা? পবিত্র ইসলাম যে মানুষের সাম্যের কথা বলেছে , সেই বওধ আজও মুসলমান সমাজ কিভাবে পালন করে চলেছে ,সেটি কিন্তু সামগ্রিকভাবে ধর্মীয় পরিচয় ব্যতি দেখে গওটা মানব সমাজের কাছে একটা বিশেষ ভাবে অনুকরণীয় আদর্শ ।এই আদর্শটিকে প্রচারের ক্ষেত্রে, সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরবা র ক্ষেত্রে সারস্বত সমাজের একটা বিশেষ ভূমিকা আছে। যা ঁরা কথাসাহিত্যিক তাঁরা তাঁদের সৃষ্টির ভুবনে এই বিষয়গুলিকে যত টা তুলে ধরবেন, ততই সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিবেশি সম্বন্ধে অপরিচয়ের পর্দা টা সরে যা বে। সংবা দ মাধ্যমের সঙ্গে যা ঁরা যুক্ত ,সেই সমস্ত মানুষেরা যত বেশি সমাজের এই ধরনের ইতিবাচক ঘটনার তাঁদের মাধ্যমগুলিতে তুলে ধরবেন, তত কিন্তু অপরিচয়ের বা ঁধন টু টবে।একটা অংশের রাজনীতির মানুষজনেরা ,হিন্দু মুসলমানের মধ্যে যত ই সংঘাত তৈরি করে ,নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধে পাওয়ার চেষ্টা করুন না কেন, সমস্ত রকমের দলীয় রাজনীতির আবর্তের উর্ধে উঠে ,আমরা সবাই যদি পরস্পর পরস্পরের ইতিবাচক দিকগুলিকে তুলে ধরি ,তাহলে কিন্তু মানুষকে বিভাজিত করবার জন্য যে অংশ সক্রিয়, সেই অংশের চক্রান্ত ক োনওদিনই সফল হতে পারবে না।