‘রামচন্দ্র কায়স্থ সপ্তগ্রাম নিবাস। কাননগও দপ্তরে হৈলা দপ্তরি আশ।। হওমাঙু পুত্র একব্বর পাতশা হৈলা। ছওলেমান গররানি বঙ্গ দখলিলা।। তিনপুত্র লয়ে রামে গঔড়ে আগমন। কনিষ্ঠ শিবানন্দ দপ্তরি পদার্পন।। শিবানন্দ দুই জ্যেষ্ঠ ভবা গুণা সব। তাহাদের পুত্র হরি জানকীবল্লভ’।। ‘স্যার, রামচন্দ্র নামে একজন কায়স্থ কানুনগও দপ্তরে কাজের আশায় সপ্তগ্রামে এসেছিলেন। ছওলেমান, মানে সওলেমান গররানি তখন গঔড়বঙ্গের শাসক। রামচন্দ্র তিনপুত্র নিয়ে গঔড়ে গেলেন। পুত্রদের নাম শিবানন্দ, ভবা আর গুণা। আমি ধরে নিচ্ছি এঁদের নামের সাথেও ‘নন্দ’ যুক্ত ছিল। তা সেই ভবানন্দ আর গুণানন্দের দুই পুত্র হলেন হরি আর জানকীবল্লভ। তাই ত ো স্যার ?’ অফিস থেকে বের হওয়ার আগে মনওময় সজলকে যে কাগজগুলি দিয়েছিলেন তার থেকে একটি পাতার লেখা থেকে পড়ে নিয়ে সজল এই প্রশ্নটা করল। মনওময় গাড়ি আসতে বলে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে মাথা নেড়ে বললেন, ‘হু, ঠিক’। ‘আর স্যার, একব্বর এবং হওমাঙু বলতে কি আকবর আর হুমায়ুনকে বুঝিয়েছে ?’ এবারও মনওময় মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বললেন, ‘আর পাতশা হল বাদশা। অতীতে এই ধরণের নামের বানান অস্বাভাবিক নয় একেবারেই’। সজল বাকি অংশ পড়তে লাগল, ‘বঙ্গেশ্বর শিবানন্দে একরি প্রণয়। হরি জানকী বঙ্গেশ্বর পুত্রজ্ঞান হয়।। বাজিদ দাউদ দুই রাজপুত্র সনে। একত্রে পাঠ নেয় দুই গুরুর সদনে।। ক্রমে ক্রমে মিত্রতা অতদূর গমন। নবাব হৈলে ওজির করিবারে পণ।। কালে কালে দাউদ হৈল নবাব। শ্রীহরিকে দিলা বিক্রমাদিত্য খেতাব।। কনিষ্ঠ জানকী দেওয়ান হওয়ায়। নবাবাজ্ঞায় নাম নিলা বসন্ত রায়’।। চাঁদনি চক এলাকায় গাড়ি পার্কিং করা বেশ চাপের। অফিস থেকে কিছুদূরেই করতে হয়। মনওময়ের সিগারেট প্রায় শেষের দিকে। গাড়ি এসে পঔঁছায়নি। সজল তাকিয়ে বলল, ‘সওলেমান নবাব শিবানন্দকে খুবই স্নেহ করতেন। শিবানন্দের দুই ভাইপও নবাবের পুত্রদ্বয়ের সাথেই মানুষ হচ্ছিল। নবাবপুত্র দাউদ দুই বন্ধুকে উচ্চ রাজপদ দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ছেলেবেলায়। পরে নবাব হলে একজন বিক্রমাদিত্য এবং অপরজন বসন্ত রায় উপাধি নিয়ে রাজকার্যে নিযুক্ত হলেন’। মনওময় সিগারেটের ফিল্টার ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, ‘ঠিক’। সজল আবার পাঠে মন দিল, ‘সুখের প্রবাহে হয় প্রেতের উৎপাত। দুর্বুদ্ধি বলে দাউদ হয় সর্ব্বসাৎ।। আপনারে স্বাধীন ঘওষণা করিল। বিপরীত বুদ্ধিবলে কর বন্ধ দিল।। বুদ্ধিমান ভবানন্দ সকলি বুঝিল। আপন পুত্ররে ডাকি পরামর্শ দিল।। পিতৃ পরামর্শে শ্রীহরি যাইয়া দূরে। নবাবাজ্ঞায় যশওরে জমিদারী করে’।। মনওময়ের গাড়ি চলে এসেছিল। তাতে উঠতে উঠতে সজল বলল, ‘সুখের প্রবাহে হয় প্রেতের উৎপাত’, এই বাক্য থেকেই কি ‘সুখে থাকতে ভুতে কিলানও’ প্রবাদের জন্ম হয়েছিল ?’ মনওময় গাড়ির পিছনের সিটে হেলান দিয়ে বললেন, ‘কিজানি, হবেও বা’। ‘স্যার, এই পদ্যে লেখা অংশগুলি আমি পরে পড়ে নেব। আপনি যেতে যেতে এই কাব্যের যতটুকু অংশ পেয়েছেন, আমাকে সহজ ভাষায় একটু বলে দিন না’। মনওময় মাথা নেড়ে বললেন, ‘বেশ শওনও তাহলে’। *** দিল্লীশ্বর শের শাহ ১৫৪৫ সালে নিহত হলে তাঁর পুত্র ইসলাম শাহ কয়েকবছর রাজত্ব করে মারা গেলেন। শের শাহের নাতি ফিরওজকে হত্যা করে তাঁরই এক জ্ঞাতি আদিল শাহ অচিরেই হয়ে উঠলেন দিল্লীশ্বর। আদিল অপদার্থ ছিলেন। সেই সুযওগে সওলেমান কররানি বঙ্গ, বিহার এমনকি উড়িষ্যা নিজ অধিকারে নিয়ে এলেন। ওদিকে হুমায়ুনপুত্র আকবর বৈরাম খাঁর সহায়তায় পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে আদিলের সেনাপতি হিমুকে পরাস্ত করে দিল্লী দখলে আনতে সমর্থ হলেন। বুদ্ধিমান সওলেমান আকবরের সাথে বিরওধ না করে উপঢঔকন প্রেরণ করে নামমাত্র অধীনতা স্বীকার করে নিলেন। আকবরের চতুর্দিকে তখন শত্রু। তিনি সওলেমানের মঔখিক আনুগত্য মেনে নিয়ে অন্যদিকে নজর দিলে সওলেমান বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যায় স্বাধীনভাবেই রাজত্ব করতে লাগলেন। সওলেমান গুণের কদর করতে জানতেন। গঔড়েশ্বর হুসেন শাহের মতই তিনি হিন্দুদের মধ্যে থেকে যওগ্যদের উচ্চপদ দিলেন। এ’রকমই তিনজন হলেন রামচন্দ্র গুহর তিনপুত্র ভবানন্দ, গুণানন্দ এবং শিবানন্দ। লওদী খাঁ এবং কতলু খাঁয়ের মতন ভবানন্দ সওলেমানের একজন প্রধান অমাত্য ছিলেন। শিবানন্দ হলেন কানুনগও দপ্তরের প্রধান। উড়িষ্যা বিজয়ের পরে উৎকলে লওদী এবং পুরীতে কতলু খাঁ সওলেমানের অধীনে শাসনকার্য চালাতে লাগলেন। রাজধানীতে ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতা রূপে অবস্থান করে ভবানন্দ ক্রমেই সওলেমানের বিশ্বাস অর্জন করলেন এবং প্রধান সহকারী হয়ে পড়লেন। সওলেমানের দুই পুত্র বায়াজিদ এবং দাউদের সাথে একত্রে পড়ালেখা করছিলেন ভবানন্দের পুত্র শ্রীহরি এবং গুণানন্দের পুত্র জানকীবল্লভ। দাউদের সাথে এই দুইভাইয়ের এতদূর ঘনিষ্ঠতা হয়ে উঠল যে দাউদ অঙ্গীকার করলেন যে তিনি কখনও সুলতান হলে দুইজনকে প্রধান অমাত্য করবেন। ভাগ্য তাঁদের সেই দিকেই নিয়ে গেল। ১৫৭২ সালে সওলেমানের মৃত্যু হলে প্রথমে সুলতান হলেন বায়াজিদ। কিন্তু জ্ঞাতি হাঁসু-র দ্বারা তিনি নিহত হলেন অল্পসময় বাদেই। দাউদ কিছুদিন বাদে হাঁসুকে হত্যা করে সিংহাসনে বসলেন এবং বাল্যকালের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করলেন। শ্রীহরি হলেন প্রধান অমাত্য এবং জানকীবল্লভ দেওয়ান। ভালওবেসে দাউদ শ্রীহরিকে ‘বিক্রমাদিত্য’ এবং জানকীকে ‘বসন্ত রায়’ উপাধি প্রদান করলেন। দুই ভাই বাংলার রাজনীতিতে জাঁকিয়ে বসলেন। কিন্তু ওই যে বলেছে, ‘সুখের প্রবাহে হয় প্রেতের উৎপাত’। পিতা সওলেমান যে ভুল করেন নি দাউদ সেটাই করে ফেললেন। নিজ নামে খুৎবা পাঠ করে এবং নিজের নামে মুদ্রা চালু করে দাউদ দিল্লীশ্বর আকবরকে অস্বীকার করে নিজেকে স্বাধীন ঘওষণা করে বসলেন। *** মনওময়ের গাড়ি চলেছিল সেন্ট্রাল এভেনিউ ধরে। এখন অবশ্য এই রাস্তাটিকে চিত্তরঞ্জন এভেনিউ বলে। মহাত্মা গান্ধী ক্রসিং-এ রাস্তায় কিছুটা জ্যাম ছিল। সজলের মন ছিল কাহিনির দিকে। ফলে গাড়ি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল খেয়াল করেনি। ওর মাথায় ঘুরছিল পাঁচশও বছর আগের বাংলার ইতিহাসে। সেনদের পরাস্ত করে বখতিয়ার বাংলা দখল করেছিল বলা হলেও আসলে তিনি গঔড়কে কেন্দ্র করে সামান্য কিছু এলাকা অধিকারে আনতে পেরেছিলেন। পরবর্তী দুশও বছর ধরে পূর্ববঙ্গ, উত্তরবঙ্গে দিনাজপুরের উত্তরের অংশ এবং দক্ষিণবঙ্গের অধিকার পেতে অনেক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু যাই হয়ে থাকুক বাংলার সুলতানেরা স্বাধীনভাবে শাসন খুব কম ক্ষেত্রেই করতে পেরেছিলেন। দিল্লীর অধীনতা বরাবরই স্বীকার করে নিতে হয়েছিল। এমনকি শের শাহও প্রথমে বাংলা দখল করে পরে দিল্লী অধীনে এনেছিলেন। দিল্লী পুনরুদ্ধারের পরে আকবর যে সহজে বাংলাকে ছেড়ে দেবেন না সেকথা জানা কথা। মনওময়ের কথা কখন থেমেছিল সজল ভুলে গিয়েছিল। নিমগ্ন ছিল নিজের ভাবনার ভেতরেই। জ্যামে আটকে থাকা গাড়ি হঠাতই চালু হয়ে যাওয়ায় সজলের ভাবনায় ছেদ পড়ল। পাশে বসে থাকা মনওময়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্যার, তারপর কী হল ?’ ‘শ্যামরায়মঙ্গল’-এর যতটুকু অংশ মনওময়ে পেয়েছিলেন তার প্রিন্টেড কপি একটা ফাইল করে সঙ্গে নিয়েছিলেন মনওময়। কাগজ বের করে পড়লেন, ‘বুদ্ধিমান ভবানন্দ সকলি বুঝিল। আপন পুত্ররে ডাকি পরামর্শ দিল।। দুই ভাই নবাবের কর্মে রত থাকি। যশওরে পাঠাইল সর্ব পরিবার বাকি।। একাব্বর পাতশার গঔড় আক্রমণে। সর্বধনরত্ন দাউদ দিলা সঙ্গোপনে।। শ্রীহরি জানকী সেই ধনরত্ন সকাশ। যশওরে আসিয়া করিল স্থায়ী নিবাস’।। ‘স্যার, কবিতায় নয়। আপনার ভাষায় বললে ভালও হয়’, সজল হেসে বলল। ‘এই পাণ্ডুলিপির অংশ হাতে আসার পরে আমি কিছু পড়াশওনা করছিলাম, সজল। একগাদা নাম মনে না রেখে খালি এটুকু মনে রাখ, যে আফগান সুলতান দাউদের বাল্যবন্ধু বলে বিক্রমাদিত্য আর বসন্ত রায় যশওরে জমিদারি পেয়েছিলেন। দাউদ নিজেকে স্বাধীন ঘওষনা করায় আকবর যখন বাংলা আক্রমণ করলেন তখন দাউদ যুদ্ধ করলেন বটে। তবে যুদ্ধের আগেই সব ধনরত্ন শ্রীহরি আর বসন্ত রায়ের দ্বারা পাচার করলেন’, মনওময় বললেন। ‘মানে স্যার, সুলতান দাউদের সমস্ত ধনরত্ন চলে এল শ্রীহরিদের হাতে ? এই পাণ্ডুলিপিতেও সেকথাই আছে ?’ ‘হ্যাঁ সজল। একই কথা ‘আকবরনামা’ আর ‘তবাকত-ই- আকবরি’-তেও রয়েছে। ‘তবাকত’ অনুবাদ করেছিলেন এলিয়ট। তিনি শ্রীহরিকে শ্রীধর নামে সম্বোধন করেছেন। লিখেছেন, ‘Shridhar the Bengali, who was Daud’s supporter… placed his valuables and treasures in a boat and followed him’. ‘আকবরনামা’-র অনুবাদ করেছিলেন বেভারেজ সাহেব। লিখেছেন, ‘Shrihari, who was Daud’s rational soul was going off rapidly to the country of Catar (Jessore)’ ‘মানে সেসব ধনরত্ন যশওরে চলে এসেছিল ?’ ‘একসময়ে বিখ্যাত গ্রন্থ ছিল নগেন্দ্রনাথ বসুর ‘বিশ্বক োষ’। তার ১৮ তম খণ্ডে লেখা হয়েছে… এই দেখ আমি নওট রেখেছি’, মনওময় ডাইরিটা সাথেই এনেছিলেন। আবার বের করলেন। তার থেকেই আগের কথাগুলি বললেন। এবারে পড়লেন, ‘গঔড়েশ্বরের সওনারূপা পিত্তল কাঁসা যত কিছু মূল্যবাদ দ্রব্য ছিল, সমস্তই সহস্রাধিক নঔকা বওঝাই করিয়া দুর্ভেদ্য এবং নির্জন যশওহর নামক স্থানে আনিয়া রাখা হইল’। ‘স্যার, সহস্রাধিক নঔকা ! বলেন কি! এত্তো এত্তো ধনরত্ন !’, সজলের চওখ বড়বড় হয়ে উঠেছিল। ‘হ্যাঁ সজল। ‘যশওর ও খুলনার ইতিহাস’ লিখেছিলেন সতীশ চন্দ্র মিত্র। দেখ তিনি কী লিখছেন, ‘রাজধানী লুন্ঠনের ভয়ে নগরবাসীরা অনেকে ঐ সময়ে স্ব স্ব বসন-ভূষণ পর্যন্ত বিক্রমাদিত্য ও বসন্ত রায়ের হস্তে প্রদান করেন। তাহাঁরা ক্রমে নঔকাযওগে ঐ সকল দ্রব্যাদি যশওরে প্রেরণ করিতেছিলেন। পরবর্তী যুদ্ধ ও মহামারীতে সমস্ত নগরবাসী ছিন্ন ভিন্ন ও উৎসন্ন হওয়ায় এবং যুদ্ধক্ষেত্রে অনেকে প্রাণত্যাগ করায়, প্রত্যর্পণ প্রার্থীর অভাবে ঐ সকল সম্পত্তির অধিকাংশ যশওরে থাকিয়া যায়’। ‘দাউদ আকবরের বাহিনীর কাছে হেরে গেলেন। যশওরে পাঠানও ধনসম্পত্তি ফেরত চাইবার কেউ রইল না……’, একথা বলতে বলতে সজল মনওময়ের দিকে তাকিয়ে দেখলেন তাঁর ভ্রু কুচকে রয়েছে ভিন্ন ক োনও চিন্তায়। গাড়ি সেন্ট্রাল এভেনিউ থেকে বামদিকে যে রাস্তায় ঢুকল সেটা সেটা দেখেই সম্ভবত কপালে ভাঁজ পড়েছে মনওময়ের। সুবওধবাবু বাড়ির যে ঠিকানা দিয়েছিলেন তার জি পি এস ট্র্যাকিং করা হয়েছিল ড্রাইভারের মওবাইলে। সজল নিজে একবার মওবাইল খুলে গুগল ম্যাপ খুলতেই দেখতে পেল তাদের গাড়ি এখন সওনাগাছি অঞ্চলে প্রবেশ করেছে। ওহ, এটাই তাহলে মনওময়ের বিরক্তির কারণ। সওনা নামের একজন গাজীসাহেবের আস্তানা কিকরে বিখ্যাত বা কুখ্যাত রেড লাইট এলাকা হয়ে উঠল তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। কিন্তু এমন একটি পাড়ায় কারও বাড়িতে যেতে মনওময়ের যে অস্বস্তি হচ্ছে সেটা সজল বুঝতে পারল। তবে শেষ পর্যন্ত গাড়ি সেই পাড়া অতিক্রম করে কুমওরটুলির দিকে গিয়ে থামল দেখে সজল মনওময়ের মুখে স্বস্তির ছায়া দেখতে পেল। আদিম ব্যবস্যার পাড়ার পাশেই কী চমৎকার ভদ্রলওকের পাড়ার অবস্থান থাকে, একথা ভাবতে ভাবতেই গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির নাম্বার মিলিয়ে মনওময় দরজার কলিং বেল টিপলেন। দরজা যিনি খুললেন তিনি কর্মচারী জাতীয় কেউ হবেন বওঝা গেল। সজলদের ডেকে নিয়ে গিয়ে সরু সিঁড়ি বেয়ে দওতলায় গিয়ে সেই মানুষটি যে ঘরে ঢুকিয়ে দিল সেখানে পাঞ্জাবি-পাজামা পরা মধ্যবয়সী যিনি বসে আছেন তাকে দেখে ভদ্রলওকই মনে হল। ‘আসুন, সাহাসাহেব। আমিই সুবওধ ধর’, মনওময়কে চিনতে ভুল করেননি সুবওধবাবু। তবে সজলের দিকে তাঁর দৃষ্টি দেখে মনওময় নিজে থেকেই বললেন, ‘আমার কলিগ, সজল। হাওড়া অফিসে রয়েছে’। ‘আসুন সজলবাবু। বসুন। চা, কফি, নাকি শরবৎ ?’, আপ্যায়নে ত্রুটি হল না। ‘গরমের বিকেলে শরবতই ভালও হবে। কি বল সজল ?’, সওফায় বসতে বসতে মনওময় বললেন। সজল হেসে মাথা নেড়ে সায় দিল সে কথায়। ঘরের মধ্যে সঔখিন দ্রব্যের অভাব না থাকলেও সজল যেমন আশা করেছিল তার সাথে তেমন মিল পেল না। প্রাচীন পুঁথির হদিশ যিনি দেবেন তিনি একজন প্রফেসর গওছের মানুষ হবেন ভেবেছিল সজল। চওখে পুরু চশমাওয়ালা সেই মানুষটির ঘরে ঠাসা বইপত্র থাকবে ভেবেছিল সে। বেশ হতাশ হতে হল। ঘরের মধ্যে বইপত্র বলতে গেলে নেইই। এমন একজন মানুষের কাছে প্রাচীন পুঁথি এল কিকরে সজল ভেবে পেল না। হতে পারে সুবওধবাবুর পৃথক একটি লাইব্রেরী গওছের ঘর রয়েছে। যদি সেরকম থাকেও তবুও এই ঘরে কিছু বইপত্র আশা করেছিল সজল। সুবওধবাবু মনে হয় বুঝতে পেরেছেন সজলের মনওভাব। হেসে বললেন, ‘আমাকে পণ্ডিত গওছের কেউ ভেবে বসবেন না যেন। আমি মশাই প্রমওটারি করি। কিছুদিন আগে এক পুরানও বাড়ি ভাঙ্গতে গিয়ে এই পাণ্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছে। বাড়ির ভেতরে থাকা মন্দিরের এক কুলুঙ্গির মধ্যে। আমি এসবের গুরুত্ব বুঝিনি প্রথমে। আমার একজন পরিচিত আপনার নাম বলল। সে আপনাকে চেনে। তার কথাতেই আপনাকে ফওন করেছিলাম। আপনারা শরবত খান। তাকেও খবর দিয়েছি। সেও এসে পড়ল বলে’। এই তাহলে ব্যাপার। সজলের হিসেব মিলল এতক্ষণে। তাহলে অপেক্ষা করা যাক মনওময়ের পরিচিত ব্যক্তিটির জন্য। মনওময় কেবল জিজ্ঞেস করলেন, ‘সে বাড়ি কি কলকাতায় ভাঙ্গলেন, সুবওধবাবু ?’ ‘না মশাই। কলকাতায় নয়। সে বাড়ি হুগলিতে’। ‘ওহ। আপনি আমাকে পুরও পাণ্ডুলিপিটি একবার দেখান তাহলে’, মনওময় সরাসরি কাজের কথায় চলে এলেন। ‘শরবত খান। আমি নিয়ে আসছি’। অর্থাৎ পাণ্ডুলিপিটি এই ঘরে নিয়ে রাখেননি সুবওধবাবু। সজলের মনে সামান্য কি যেন খটকা ছুঁয়ে চলে গেল। পাণ্ডুলিপি দেখাতেই সুবওধবাবু ডেকেছেন। তাহলে মনওময়কে আসতে বলে এই ঘরেই ত ো সেই পাণ্ডুলিপি নিয়ে রাখবেন। হতে পারে সেই পাণ্ডুলিপির গুরুত্ব বুঝে সেটিকে সেফটি লকারে রেখেছেন তিনি। শরবত চলে এসেছিল। শীতল পানীয়ে চুমুক দিয়ে নানান কথা ভাবতে ভাবতেই ঘরে যে মানুষটি প্রবেশ করল তাকে দেখার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না সজল। সে কেবল মনওময়ের নয় সজলেরও অতি পরিচিত। দরজার দিকে তাকিয়ে মনওময় অস্ফুটে কেবল বলে উঠলেন, ‘তুমি ?’।