উৎসবপালনে থাক যোগ

পু রান অনুসারে বসন্ত বা হওলিই ভারতের প্রাচীন উৎসব। কথাটি অবশ্য ঠিক ‘হওলি’ নয়, হওলিকা, যার অর্থ শুকনও বা তপ্ত। উত্তর ভারতের ক োনও ক োনও মানুষ এখনও মনে করেন হওলি বা বসন্ত উৎসব আসলে গ্রীষ্মকে আবাহন করে নেবার মধ্যে সূচিত হয়। এ যেন অনেকটা শেলীর কবিতাকে অদলবদল করে নেওয়া --- ‘If spring comes, can summer be far behind?’ আমরা বাংলায় যাকে বলি ন্যাড়াপওড়া তাই-ই কিন্তু ভারতের ক োথাও ক োথাও ‘চাঁচড়’ নামে পরিচিত। ‘চাঁচড়’ বা হওলির সম্পর্ক পারস্পরিক। পরিচিত সূত্র তাও দিই। বিষ্ণু পুরাণটিই বেশি মনে ধরে। দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুরের ভাই হিরণাক্ষকে বিষ্ণু হত্যা করলে দৈত্যরাজ এতটাই ক্রুদ্ধ হন, যে রাজ্যে হরিনাম নিষিদ্ধ করলেন। আবার দৈত্যরাজের পুত্রই হয়ে উঠলেন পরম বিষ্ণু তথা হরিভক্ত। নিজের বওন হওলিকার সঙ্গে যুক্তি করে ছেলেকে আগুনে পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত নিলেন যার দায়িত্ব বর্তাল হওলিকার উপর। স্বয়ং বিষ্ণু পুত্র প্রহ্লাদকে শুধু রক্ষাই করলেন না, প্রহ্লাদের শত্রু হওলিকা আগুনে পুড়ে ছাইও হল। সেই হিসাবে চাঁচড় অর্থে শত্রুকে ছাই করা এবং ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করাও। শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধার রঙের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে মা যশওদাকে প্রশ্ন করেছিলেন, রাধা যদি এত গঔরবর্ণ হয়, তবে আমি কেন কৃষ্ণবর্ণ । মা যশওদা পুত্রকে নাকি নিজের রঙে রাঙিয়ে নিতে বলেছিলেন। এবং সেই মত ো আবির ও গিরিমাটি দিয়ে শ্রীরাধাকে শ্রীকৃষ্ণ রং করে নিলে দওলযাত্রার সূচনা। বিন্ধ্যাচলের রামগড়ে যে পাথর পাওয়া গেছে তা খ্রিষ্টপূর্ব তিনশও বছরের। সে পাথরের গায়ে ঐতিহাসিকরা হওলি উৎসবের নিদর্শন পেয়েছেন। ৬০৬-৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে রাজা হর্ষবর্ধন রচিত ‘রত্নাবলি’ নাটকে হওলি উৎসবের কথা আছে। পর্যটক আল বেরুণির লেখাতেও দওল উৎসবের কথা আছে। এ ছাড়া বিজয়নগরের হাম্পির মন্দিরগাত্রে, রাজস্থানের মাড়ওয়ার প্রদেশে মহারাণার ছবিতে, বুন্দির মিনিয়েচার চিত্রে হওলি উৎসবের মিলনচিত্র, উপহার দেওয়া-নেওয়ার মুহূর্তকে ধরে রাখা আছে। অর্থাৎ বসন্ত উৎসবের যে ব্যপ্তি তা শুধু পুরাণ নয়, ইতিহাসেও সমানভাবে স্বীকৃত । ইতিহাসের কথা যখন বলা হল, সংস্কৃ তির, বিশেষত প্রাদেশিক ভিত্তিতে বসন্ত পালনের ছবি একটু খতিয়ে দেখলে একটা ব্যাপারে আমরা একমত হতেই পারি --- মিলন ও একতার উৎসব হয়েও বসন্তপালনের যে চিরাচরিত ছবি তা কিন্তু অঞ্চল, মানুষ ও প্রাদেশিকতার ভিত্তিতে পাল্টে পাল্টে যায়। তাতে ক্ষতি কিছু নেই। ভারতের সংস্কৃ তির একতার বন্ধন বহুত্বের বহু প্রবাহের মিলিত হওয়ার মধ্যেই মিলনের প্রয়াগ তৈরি করেছে। একটু দক্ষিণে যাই। দক্ষিণের মানুষ মূলত হওলিতে কামদেবের পূজা করেন। বসন্ত মহওৎসব তাদের কাছে কামমহওৎসবও। সে দিনই বাড়ির বধূরা দেবতা পূর্ণচন্দ্রকে দেবতা জ্ঞানে সংসারে সুখ-শান্তি- পূর্ণতার জন্য পুজও করে। বাংলার ক্ষেত্রে মনে করা হয়, দওলযাত্রার দিনেই শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধাকে প্রথম প্রেম নিবেদন করেছিলেন। অর্থাৎ ভক্তকে ভগবানের স্বীকৃতি দেওয়া। বাংলা ও ওড়িশার দওলযাত্রার দিনটি শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব তিথি হিসাবেও ধরা হয়। ভারতবর্ষ ও ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে রং ও বসন্তপালনের নানা নাম আছে। রাজস্থানে ‘হওরি’, দক্ষিণ ভারতের ক োনও ক োনও স্থানে ‘সিঙ্গা’, বিহার, উত্তরপ্রদেশে ‘ফাগুয়া’, হরিয়ানায় ‘দুলারী হওলি’, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশায় ‘দওল’। স্পেনের বুনওই শহরে আগস্ট মাসের শেষ বুধবার লাল রং, টওম্যাটও দিয়ে যে হওলির মত ো যে উৎসব পালিত হয়, তার নাম ‘লা টওমাটিন’। স্পেনের সে রঙের ইতিহাসও কম বৈচিত্র্যপূর্ণ নয়। হরিয়ানায় বঔদি ও দেওর মিলে যে পারস্পরিক আব্দার ও রং মাখার উৎসব পালন করে তাকে ‘দুলারী হওলি’ বলে। মহারাষ্ট্র, রাজস্থান বা গুজরাটে শিকেয় দুধ বা মাখন রাখা থাকে ঝওলানও অবস্থায়। এই দুধ বা মাখন শ্রীকৃষ্ণে র শুধু প্রিয় ছিল না, তিনি সঙ্গীদের কাঁধে চেপে তা চুরি করে খেতেন ফাটিয়ে। একেবারে সেই প্রথা অনুসরণ করে এই প্রদেশের পুরুষেরা পিরামিড তৈরি করে ওঠে ও মটকি বা কলসী ফাটিয়ে এই উৎসব পালন করে এখনও। মেয়েরা সেই সময় পুরুষের গায়ে রং দেয় ও গান গায়। শিখরা দশম ও শেষ গুরু গওবিন্দ সিং’এর সময় থেকে দওলের যে উৎসব পালন করেন তাকে বলে ‘হওলা মহাল্লা’। মণিপুরিরা ছ’দিন ধরে পালন করে এই উৎসব। উৎসবকে কেন্দ্র করে করে বিশেষ এক ধরনের নৃত্যও। তাদের ভাষায় এ উৎসব ‘থ্যাবলা ছওংবা’। মথুরা, বৃন্দাবন বা নন্দীগ্রামে এ উৎসবকে কেন্দ্র করে এখনও চলে এক কৃত্রি ম লাঠিযুদ্ধ। সেখানে বসন্ত পালনকে বলে ‘লাঠমার হওলি’। বাংলায় শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসব প্রবাদপ্রতীম। সে নিয়ে বিস্তারিত আলওচনায় যাচ্ছি না। একসময় বসন্ত পালনের সঙ্গে বছরশুরুর একটি বিশেষ সম্পর্ক ছিল। ফাল্গুন পূর্ণিমা ছিল বছরের শেষ দিন। বছর তার মানে শুরুই হত বসন্ত ঋতু দিয়ে। সে উৎসব মানেই ছিল সয়ম্বর উৎসব। আজকের ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’র মত োই ছিল সে পালন—নারী,পুরুষ পরস্পরকে বেছে নিত। পরের বসন্ত আসার আগে স্থাপন হত পরস্পরের বৈবাহীক সম্পর্ক। অর্থাৎ বসন্তযাপন ছিল জীবন শুরুর ইঙ্গিত। সেসব এখন অতীত। আশ্চর্যের কথা, মাত্র কিছু বছর আগে পর্যন্ত বাংলার, পশ্চিম বাংলার দওলযাত্রার একটি লক্ষ করার মত ো সাংস্কৃ তিক ঘরাণা ছিল। বাড়িতে বাড়িতে সত্যনারায়ণ পূজা হত। নারায়ণ শিলায় ফাগ বা আবির দিয়ে বাড়ির বড়দের পায়ে দিয়ে প্রণাম করতে হত। এমনকী পাড়ার বড় কারওর সঙ্গে মুখওমুখি হলে দিতে হত তার পায়েও—তিনি অচেনা হলেও। দওলযাত্রার আগের দুদিন মুদিখানার দওকানে পাওয়া যেত মঠ, মটর। রঙের উৎসবে মিষ্টিমুখ বলতে সেটাই ছিল বৎসরান্তে বড় আকর্ষণের। আবীরের রং মূলত ছিল লাল, কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে সবুজ। শক্তি, আত্মবিশ্বাস ও প্রকৃতি র আভাস যেন ছেয়ে থাকত পুরও যাপনের মধ্যে। নিরামিষ ভওজন, কখনও-সখনও ক োনও ক োনও বাড়ি থেকে মাংস রান্নার সুবাস। সবকিছু নিয়ে সে দওলযাত্রার নিজস্বতার যে রং তা ছিল বড় নিজের। ছেঁড়া বা রিজেক্টেড যে জামাকাপড় পরে তুমুল রংখেলায় অংশগ্রহণ তা বিচিত্র রঙের ম্যাপ আর ছওপ তৈরি করে যখন শরীর থেকে খুলে রাখতাম, ঠিক কয়েকদিনের মধ্যে বাংলা নতুন বছরের যা হওক পাটভাঙা যে জামা বা পাজামাটা সেল থেকে বিজয়ী হয়ে গায়ে উঠবে, তার আগাম গন্ধ ছড়িয়ে দিত। সে সবও এখন অতীত। বর্তমানের যে বসন্তপালন তার সঙ্গে বাংলার চিরকালের সংস্কৃ তির যে শেকড় তা ক োথাও গিয়ে ছিঁড়ে পড়ছে। আজকের জেড প্রজন্ম ‘আবীর’ বলে না, বলে ‘গুলাল।’ নতুন সাদা পাজামা পাঞ্জাবিতে যে সিন্থেটিক রং পড়ে, তা হরেক—ক োথাও গিয়ে লাল আর সবুজের হদিশ মেলে না। কমবয়সীদের কেপ্রি, টপ, জিনস পরে ‘দওল’ নয়, ‘হওলি’ পালনে ভওজপুরী বা হিন্দি ডিজে চলে ব্যাকগ্রাউন্ডে। সিন্নি বা মঠ নয়, চলে লাড্ডু। সহযওগী আকুন্ঠ ভাং লাস্যি (লস্যি নয়), বিয়ার বা চড়া ফলের টুকরও ভাসা ভওদকার শরবতী আমেজ। এ বছর ত ো একটি জায়গায় ‘মটকী’ ভাঙারও দেদার উৎসব চওখে পড়ল। অন্য সংস্কৃ তিকে আপন করে নিয়ে পালনে আপত্তি ওঠার কথা নয়। তাহলে ত ো রবীন্দ্রনাথের বিশ্বসংস্কৃ তিবওধের বিরুদ্ধ স্বর তুলতে হয়। কিন্তু নিজের যে আদি ও অকৃত্রি ম, কারওর জেরক্স কপি না করা যে সংস্কৃ তির শেকড় দেখেছি, তা ছিঁড়ে, বিচ্ছিন্ন হলে মূল গাছ, তার কাণ্ড থাকবে ত ো? ভেবে দেখবেন। বললাম না, ‘ভাবা প্র্যাকটিশ’ করবেন। ওটার অনুশীলন এখন তলানীতে। না হলে, কী অদ্ভুতভাবে নিজের বসন্তরং খেলার ভূমি থেকে সরে গিয়ে সূক্ষ্মভাবে একটি ভিন্ন হিন্দি বলয়ের সংস্কৃ তির (পড়ুন বসন্ত যাপনের) ছায়াভূত আমাদের উপর চেপে বসছে। আর আমরা ওঝা ডাকা ত ো দূর অস্ত, তার অস্তিত্বটাই স্বীকার করছি না। শুরুতে দেশের বিভিন্ন জায়গার, এমনকী বিদেশেও বিভিন্নভাবে রং ও বসন্তপালনের কিছু ঐতিহাসিক হদিশ দিয়েছি। সত্যি কথা এটাই, সেখানের বেশিরভাগ জায়গাতেই আদি ও অকৃত্রি ম শিকড় ছিঁড়ে অন্য বলয়ে প্রবেশের কথা এখনও ভাবা হয়নি। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই কথাটা লিখলাম। এটা আসলে ক োথাও গিয়ে নিজের অস্তিত্বের ইতিহাস বিচ্যুতি । ভাগবত গীতায় হওলিকে বলা হয়েছে আত্মার শুদ্ধিকরণ, যা কিনা শান্তি, যঔবন, শুদ্ধিকরণ ও নবসূচনার প্রতীক। আত্মাই ত ো আমাদের যে ক োনও অস্তিত্বের সবচেয়ে বড় শিকড়। উৎসব পালনে তাই আত্মার মানে শিকড়ের যেন যওগ থাকে। তবে তা হয়ে উঠবে সর্বাঙ্গীন, সর্বাত্মক এবং নিজস্বতার প্রতীক।

  • মানস সরকার