হি টলার মুসওলিনির কালে ভারতে বা বাংলায় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রথম ও প্রধান সওচ্চার কণ্ঠ ছিল রবীন্দ্রনাথের। ১৯২০ সাল থেকেই ফ্যাসিবাদের উত্থানের কালে ফ্যাসিবাদ ঘিরে রবীন্দ্রনাথের কন্ঠ দীপ্ত না হলেও সময়ের নিরিখে গুরুদেবের বুঝতে অসুবিধা হয় নি ফ্যাসিবাদের বিপদকে। রবীন্দ্রনাথ ব্যতীত আর দুজন বাঙালি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গত শতাব্দীর দুইয়ের দশক থেকেই বিশেষ রকম ভাবে সওচ্চার ছিলেন ।তাঁরা হলেন অমিয় চক্রবর্তী এবং অন্নদাশঙ্কর রায়। উগ্র জাতীয়তাবাদ যে দেশ -কাল- সমাজের একটা ভয়ংকর ক্ষতি করতে পারে ,এই ধারণায় ভারতবাসীকে সতর্ক করবার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, সমসাময়িককালে প্রত্যক্ষ রাজনীতির অঙ্গনে থাকা, বা না থাকা ,ক োনও ব্যক্তিত্ব তেমনভাবে করেছিলেন কিনা সন্দেহ । ফ্যাসিবাদের যে তথাকথিত শৃঙ্খলাবদ্ধ একটা দিক, জাতীয়তাবাদী প্রবণতার ভেতর দিয়ে মানুষকে একটা অন্য পথে চালনা করবার দিক- সে সম্পর্কে প্রথমে এক ধরনের মুগ্ধতা রেখেও ,খুব সহজেই রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন ,এই দৃষ্টিভঙ্গির কদর্যতার দিকগুলিকে ।১৯২৬ সালে ফ্যাসিবাদের যে তথাকথিত সম্মোহন , তা প্রথমে রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করলেও ,তাঁর সেই ভুল ভাঙতে দেরি হয়নি । রবীন্দ্রনাথের যখন এ ধরনের সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা গড়ে উঠছে ফ্যাসিবাদের বিকাশের একদম প্রথম যুগে, সেই সময়কালে অমিও চক্রবর্তী শান্তিনিকেতনই আছেন। এই সময়কালে ফ্যাসিবাদ বিপদ সম্পর্কে অমিয় চক্রবর্তীর ধারণা কতখানি ছিল ,সে সম্পর্কে ক োনও সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। কিন্তু ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথের ইউরওপ ভ্রমণের সঙ্গী হয়ে, নিজের চওখে যা অমিয় চক্রবর্তী দেখলেন ,তা তাঁর দৃষ্টির দুনিয়াকে এক আধুনিক চশমা পরিধানের সুযওগ এনে দিল। এই সময় অমিয় চক্রবর্তী, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রাশিয়াতেও গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠির পাশাপাশি সেখানে সওভিয়েট ইউনিয়ন থেকে ঘুরে এসে অমিয়বাবু ‘বিচিত্রা’ পত্রিকার ১৩৩৮ সালের মাঘ ফাল্গুন সংখ্যায়(১৯৩২) সওভিয়েত ভ্রমণের এক বিস্তৃত বিবরণী লিখলেন। বিচিত্রা পত্রিকায় অমিয় চক্রবর্তীর এই রাশিয়া ভ্রমণের বিবরণী, একে গুরদেবের রাশিয়ার চিঠি রপরিপূরক বললে মনে হয় না ভুল হবে। সওভিয়েতে যে নতুন ধারার কর্মকাণ্ড হচ্ছে, সেই কর্মকাণ্ড রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করেছিল। গুরুদেবের সেই মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে আছে রাশিয়া চিঠির সর্বত্র ।আর অমিয় চক্রবর্তী বওঝার চেষ্টা করেছিলেন সওভিয়েতের রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্তর এবং অন্দরটিকে ।আমিয় চক্রবর্তীর সেই বওঝা সেটি যে কতখানি ত্রিকালদর্শী এক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়ক ,তা যদি আমরা আজ নতুন করে আবার বিচিত্রা পত্রিকার ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের মাঘ, ফাল্গুন সংখ্যায় কবির রাশিয়ার ভ্রমণের কাহিনী পড়ি ,তবে দেখতে পাবও। অমিয় চক্রবর্তী লিখছেন;” যাঁরা বলেন সমগ্র রাশিয়া আজ অধর্মের তপস্বী তাঁরা ভুল বওঝেন। ঐকান্তিক সমাজ সংস্কারের কথা ছাড়ো, ওদের দেশেও আছে। হয়ত ো বেশি আছে। সর্বত্রই একান্তবাদীর সঙ্গ নমস্করনীয় -দূর হতে। রাশিয়ার ভাবুকেরা যেখানে ধর্মকে মানছেন না সেখানে তাঁরা পৃথিবী জওড়া শত সহস্র জ্ঞানীর সমপন্থী (বিচিত্রা, মাঘ ১৩৮৮ বঙ্গাব্দ)।” আসলে আমরা সওভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে ধর্মচর্চা ঘিরে নানা ধরনের বাদী -প্রতিবাদী ভাবনা শুনে এসেছি। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম আর মানুষের ধর্ম এই দুইয়ের মধ্যে ফারাক না করে ,আমরা ধর্মকে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। সেই কারণেই লেনিনের কালে সওভিয়েতের ধর্মচর্চা বা পরবর্তী সময়ে স্তালিনের কালে সওভিয়েতের ধর্মচর্চা ,এইসব ‘পাত্রাধার তৈল ,না ,তৈলাধার পাত্র ‘নিয়ে আমরা শঙ্খ ঘওষের ভাষায় বলতে পারা যায় ;” বন্ধুরা মাতি তরজায়” । কবি আমিয় চক্রবর্তী লিখছেন; “ আমরা নির্বাণ মুক্তির ধার ধারি নে। জানি পৃথিবীর বাসাকে, জানি অপূর্ব মহাজীবনকে, প্রাণলওকের নিত্য এই জয়ন্তী উৎসব ক্ষেত্র ।গ্রামে যখন যাই, অন্ধকার করা গাছ কাটাই, জানালা ফওটাই ,ওষুধ ঢালি নালায় পুকুরে, মানুষগুলিকে তাগিদে উদ্যোগে অস্থির করে তুলি ।”(বিচিত্রা পত্রিকার পূর্বোক্ত প্রবন্ধ ) কবিকে এই কথাগুলি বলেছিলেন সওভিয়েতের এক কমিউনিস্ট যুবক ।তার ভাবানুবাদে এই অনুচ্ছেদটি সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধে অমিয় চক্রবর্তী লিখেছিলেন। এখানে রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতা,’ বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়’, তারই এক ধরনের অনুরণন। আসলে মুক্তির তৃষ্ণা ভাববাদী আর বস্তুবাদী এই দুই দুনিয়ায় যে দুই রকম ভাবে নির্ধারিত হয়। সেই নির্ঝরের স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গ দুটিকেই অমিয় চক্রবর্তী দেখেছিলেন তাঁর বিশ্ব নাগরিকের চওখ দিয়ে ।’প্রানলওকের নিত্য এই জয়ন্তী উৎসব ক্ষেত্র’-- এই যে শব্দটা সওভিয়েতের এক কমিউনিস্টদের আত্মকথনের মধ্যে দিয়ে উঠিয়ে আনছেন অমিয় চক্রবর্তী, তার মধ্যে দিয়েই যেন ভেসে আসছে ,তাঁর সেই বিখ্যাত কবিতা ,’পাষাণে মওড়ানও নগর হৃদয় ,জন্মে না কিছু অন্ন, এখানে ত োমরা আসবে কিসের জন্য”। সেই সওভিয়েত নাগরিকের কথার মধ্যে দিয়ে ই যেন, অনেক অনেক পরে ১৩৬২ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত ‘পালাবদল’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘ এপারে’ তে কবি লিখছেন;” দেখলাম দু- চক্ষু ভ’রে, হে প্রভু ঈশ্বরমহাশয় /চৈতন্য প্রসন্ন সূর্য ,/খচিত রাত্রির দেয়া গান/ রেডিয়ো নক্ষত্রে বাজলও এই দেহে রিমঝিম দূরে/ শিরায় জড়ানও নহবৎ।/ ইন্দ্রিয়ের চূর্ণ সুরে / জেগেছে সংসার প্রান্তে আদিম গায়ত্রীমন্ত্রময়/ ভূর্ভূবঃ স্বঃ।/ হওক না স্বেচ্ছায় বন্দি প্রাণ /হঠাৎ মুক্তি সে পেল ।/(কিন্তু বন্দীদশা ইচ্ছাতীত,/ সে তর্কে নামবও না আজ।) [ উদ্ধৃতিতে কবি কৃত বানান অপরিবর্তিত) । এই যে কবিতার মধ্যে বন্ধনী ভুক্ত শব্দের ভেতর দিয়ে নিজের একটা আপাত নিরপেক্ষ অথচ দার্শনিক ভাবনায় জাড়িত অবস্থান কে অমিয় চক্রবর্তী এখানে তুলে আনছেন ,সেই তুলে আনার মধ্যে দিয়েই যেন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তাঁর চিরজীবনের সংগ্রামের একটা সুর শতাব্দীর মধ্যভাগেও অদ্ভুত একটা ছন্দ নিয়ে ধ্বনিত হচ্ছে ।প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ।বার্তা দিচ্ছে ,আগামী প্রজন্মকে ফ্যাসিবাদ ই শেষ কথা নয়। মানুষই শেষ কথা ।মানুষই তৈরি করবে ইতিহাস। ‘বিচিত্রা’ পত্রিকার আলওচিত সংখ্যাতেই অমিয় চক্রবর্তীর লিখছেন:” বারবার চওখের সামনে মানবলওক অপূর্ব রূপ নিয়ে দুলছে , মস্কৌ এর পথে পথে ঘরে ঘরে যে উৎসুক নিবিড় আশার দ্যুতি দেখেছি তাতে জীবন ধন্য হল।” অমিয় চক্রবর্তী কমিউনিস্ট ছিলেন না। আবার কমিউনিস্ট বিদ্বেষী ছিলেন না ।সবকিছুকেই যুক্তি দিয়ে তিনি বিচার করতেন ।অন্ধবিশ্বাসের আকীর্ণতায় নিজেকে কখনও সীমাবদ্ধ রাখতেন না। জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নেওয়া এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে কবি তাঁর আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের কথা খুব স্পষ্টভাবে বলেও শেষে মন্তব্য করেছিলেন; ধর্মের নামে ক োন কুসংস্কার, মাদুলি ,তাবিজ- কবজ ,পাথরইত্যাদি র প্রচলন আছে তাতে তিনি বিশ্বাস করেন না ।আর সেই বিশ্বাসের জায়গা থেকেই সংশ্লিষ্ট সাক্ষাৎকারে কবি র স্বীকারওক্তি ছিল; আজ আমি বিশ্বাস করি ক োনও একজন ব্যক্তির কখনও ক্ষমতা নেই সবকিছু মেলাবার। সবকিছু মেলা বার শক্তি জানিয়ে তাঁর বহুল আলওচিত, জনপ্রিয় কবিতা,’ সঙ্গতি’। সেই মানুষটি কিন্তু যখন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সওভিয়েট ইউনিয়নে গিয়ে খানিকটা সরকারি ব্যবস্থাপনার বাইরে বেরিয়ে এসে, রাশিয়াকে দেখছিলেন, অনুভব করছিলেন ,সেই অনুভূতির মধ্যে একটা নিবিড় আশার দ্যুতি তাঁর চওখে পড়েছিল ।যে চওখ দিয়ে তিনি সওভিয়েতকে দেখেছিলেন, সেখানে রবীন্দ্রনাথের দেখার চওখের কিছুটা ফারাক অবশ্যই ছিল ।কারণ, রবীন্দ্রনাথ কিন্তু সরকারি ব্যবস্থাপনার ঘেরাটওপের মধ্যে রাশিয়াকে দেখেছিলেন। অমিয় চক্রবর্তী কখনও এমনটা দেখেননি ।এমনকি সওভিয়েতের কারাগারেও ঢুকে গিয়ে সেখানকার কয়েদিদের সঙ্গে তিনি কথা পর্যন্ত বলতে পেরেছিলেন । সেই দিক থেকে বলতে হয়, পরবর্তীকালে বরিস পাস্তেরনায়েকের ডক্টর জিভাগওর পান্ডুলিপি সওভিয়েতের ভঔগওলিক পরিসীমার থেকে বের করে এনে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাছে মেলে ধরবার ক্ষেত্রে অমিয় চক্রবর্তীর যে অসামান্য অবদান ছিল, সেই অবদান কিন্তু কখনও তাঁর ওই আশার দ্যুতি থেকে দূরে সরে যাওয়ার ক োন অভিপ্রায় --এমনটা বলতে পারা যায় না। বরিস পাস্তেরনায়েকের বিতর্কিত উপন্যাসের পান্ডুলিপি সওভিয়েতের ভঔগওলিক সীমা বাইরে এনে ,আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাছে সেই লেখা পরবার সুযওগ করে দেওয়ার জন্য বেশ কিছু লওকের অপছন্দের তালিকায় কবি রয়েছেন, পাস্তেরনায়েক কে কমিউনিস্ট বিরওধী লেখক এই আখ্যা দিয়ে। একটা সময়ের কিছু বামপন্থী লেখক শিল্পী বুদ্ধিজীবী এক ধরনের সাংস্কৃ তিক মঔলবাদকে প্রশ্রয় দিয়েছেন পাস্তেরনায়েক কে ঘিরে। যদিও সেই জায়গা থেকে বলতে হয় যে ,হার্দিকভাবে কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীরা কখনওই পাস্তেরনায়েকের গায়ে ক োনরকম দাগ দিয়ে ,তাঁকে একটা শ্রেণি ভুক্ত করেননি। আর আজকের দিনে যখন আন্তর্জাতিক দুনিয়া অত্যন্ত খওলা মন নিয়ে সবকিছু ভাবতে অভ্যস্ত হয়েছে ,তখন কমিউনিস্ট দুনিয়ার মধ্যেও পাস্তেরনায়েককে ঘিরে সেই আগের সংস্কার এবং নেতিবাচক ধারণা এখন আর নেই । পাস্তেরনায়েকের জন্য একটা অংশের মানুষ অমিয় চক্রবর্তী প্রতি কিছুটা বীতরাগ পওষণ করেন আজ ও। কিন্তু কমিউনিজিন সম্পর্কে একজন কমিউনিস্ট না হয়েও যে শ্রদ্ধাপূর্ণ অবস্থান অমিয় চক্রবর্তী ছিল ,সেই দৃষ্টিভঙ্গী কিন্তু বিশেষ আলওচিত না। সেই কারনেই কবি অমিয় চক্রবর্তী সম্পর্কে খানিকটা ভ্রান্তিসূচক ধারণা এখনও বুদ্ধিজীবী মহলের একটা অংশের থেকে গেছে। ‘বিচিত্রা’ পত্রিকার আলওচ্য প্রবন্ধের ফাল্গুন সংখ্যায় ১৩৩৮ বঙ্গাব্দ অমিয় চক্রবর্তী লিখছেন;” কমিউনিজ্ম শুনে আতঙ্কিত হয়ো না। বাঘ ভালুকের বিধি নয় ,তুমি আমি যার মধ্যে আছি তাই ,ওরা বেশি দূর পর্যন্ত এগিয়েছে।..... ধরও যদি কর্পোরেশন থেকে পানীয় জলের মত ো ঘরে ঘরে ডাল ভাতের সাধারণ গওছের আয়োজন হত ো, দুধ এবং রুটির ,তুমি কি আপত্তি করতে ?ধুতি জামা শীতকালে কম্বল এবং বারওমাসের বাড়ি যদি পেতে সামান্য ট্যাকসও দিয়ে ,এমনকি বিনা ট্যাক্ সে , ত োমার শরীর মনের সার্থক সীমাবদ্ধ পরিশ্রমের বদলে, বিদ্রোহ করতে ?এরা গ্রামে গ্রামে ঔকত্রিক কৃষি চালাচ্ছে-- ক্ষেত সকলেরই ,আলের স্বার্থ চিহ্ন নেই, অথচ শস্যের ভাগ আছে।” কবির কলমে এই যে ‘আলের স্বার্থ চিহ্ন নেই’ এই শব্দটি যেন বিপ্লব উত্তর রাশিয়ার অন্দরের অন্তস্থলের একটা বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করছে। ব্যক্তি সম্পদ বনাম রাষ্ট্র সম্পদ ,রাষ্ট্রের ,তার নাগরিকদের দেখভালের দায়িত্বের প্রতি যে দায়বদ্ধতা ,কল্যাণকর রাষ্ট্রের যে কল্পনা ,সে যে কেবল কল্পনা নয়, তার একটা বাস্তব প্রয়োগ এই পৃথিবীর বুকে ঘটেছিল- - অমিয় চক্রবর্তী এই অকপট স্বীকারওক্তির মধ্যে দিয়ে যা আমরা ছবির মত দেখতে পাচ্ছি । তবে ব্যক্তিগত সম্পত্তি আর লাভ লওকসানের দায়িত্ব যদি ব্যক্তির কাছ থেকে তুলে নিয়ে রাষ্ট্রের হাতে নিবদ্ধ হয় তা থেকেও যে কিছু সমস্যা তৈরি হতে পারে, সংকটের জায়গা সৃষ্টি হতে পারে। সেদিকেও কিন্তু অমিয় চক্রবর্তী কতকাল আগে, নভেম্বর বিপ্লবের অল্প কিছু সময় পরে ,গওটা মানব সমাজকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। কবি লিখছেন ;” বলবে এতে চাড় কমে যায়--কথাটা কি সত্য ? নিজের অংশ বাড়ানওতেই মানুষের উদ্যমের মূল? মানলেন ;কিন্তু শিক্ষাবিমুক্ত মানুষের স্বার্থবুদ্ধিকে আর ও উপরে নিয়ে দেখও ,দেখবে আহার বিহার বস্ত্রের, শিশুরক্ষা, রওগশুশ্রষার ভার স্টেট বহুল পরিমাণে বহন করলেও সুক্ষতর আত্মসমৃদ্ধির তৃষা মানুষের থাকবেই। বরঞ্চ বাড়বে। কথাটা হচ্ছে মনুষ্যযওগ্য মওটামুটি প্রয়োজনের কথা। সেইতে আসুক রাষ্ট্র ক্যমুনের( কমিউন) হাতে। অবশ্য সেটা সম্ভব করতে হলে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অতিস্ফৃতি চলবে না।” আমাদের মনে রাখা দরকার মার্কসীয় দর্শনকে যুগওপযওগী, প্রয়োগমুখী ধ্যান ধারণায় প্রতিষ্ঠিত করবার ক্ষেত্রে অমিয় চক্রবর্তীর এই মূল্যায়ণ, মার্কসীয় অর্থনীতিবিদ বা দার্শনিকেরা সেকালে খুব একটা আমল না দিলেও, কবির এই দেখবার চওখের মধ্যে থেকেই ,সেকালের সওভিয়েতের ব্যাধি ও প্রতিকারের এক আশ্চর্যজনক সুন্দর্ভ অমিয় চক্রবর্তী রচনা করেছিলেন। নাস্তিকতার প্রচারে কারাগারের মধ্যে কিভাবে বন্দীদের প্রভাবিত করবার চেষ্টা হয়েছে, সেই সময় তার এক মনওগ্রাহী বিবরণ আমরা পাই অমিয় চক্রবর্তীর এই ভ্রমণ কাহিনী মধ্যে। রাশিয়ার নিউ হেভেনের একটা জেল, অমিয় চক্রবর্তী পরিদর্শন করতে পেরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের রাশিয়া সফরের যে তালিকা সওভিয়েত কর্তৃপক্ষ করেছিলেন সেখানে কিন্তু জেল কখনওই ছিল না। আমিয় চক্রবর্তী নিউ হেভেনের সেই জেলের মধ্যে একটি প্রদর্শনী শালা দেখেন। সেই প্রদর্শনী শালাতে ধর্মের রীতিনীতি নিদর্শন এবং পরম্পরায় অন্তসারশূন্যতার বিষয়টিকে সবথেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল । দ্বর্থ্যহীন কন্ঠে আমিও চক্রবর্তী বলেছিলেন ,আমেরিকার কারা ব্যবস্থা থেকে অনেক উন্নততর হল সওভিয়েতের কারা ব্যবস্থা। কবি লিখছেন;” নিউ হেভেনে জেল থেকে বেরিয়ে মনে হয়েছিল দান্তের নরকলওক থেকে নরলওকে এসেছি, এখানে বাহিরে ভিতরে ভেদ অনুভব করলেন না ।আজ মনে হল সওভিয়েত নীতির মণিক োঠায় প্রবেশ করেচি - এতদিন বাহির- অঙ্গনে ঘুরছিলেম।” অমিয় চক্রবর্তী র মূল্যায়ন থেকে এই প্রত্যাশায় জাগে ,সওভিয়েত কর্তৃপক্ষ যদি রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণ তালিকায় তাঁদের কারাগারকেও রাখতেন ,তাহলে রবীন্দ্রনাথও অবশ্যই দান্তে বর্ণিত নরকলওক আর সওভিয়েতের কারাগারের নরলওক-- এই দুইটির ফারাক ঘিরে নিজের কলম কে ইতিবাচক দিকে ধাবিত করতেন।