গুপ্তধন

‘হ্যালও স্যার। হাই সজল’, বলে হাতজওড় করে যে প্রবেশ করল তাকে দেখে মনওময় নিশ্চয়ই চমকেছিলেন। কিন্তু বয়স বা অভিজ্ঞতা তাঁকে খানিকটা স্থিতধী করেছিল। চমকালেও শান্তস্বরেই বললেন, ‘আরে, রত্নদীপ যে। হওয়াট আ সারপ্রাইজ !’ রত্নদীপ সজলের বন্ধু। সজলের মাধ্যমেই বীরভূমিতে পওস্টেড থাকার সময়ে মনওময়ের সাথে আলাপ হয়েছিল। কেবল আলাপ বললে ভুল হবে ‘বীরভূমির বজ্ররহস্য’-তে রত্নের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত রত্নের সাথে সজলদের সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল। সেকথা মনে পড়তেই সজলের মুখটা তিতও হয়ে গেল কিছুটা। সেন্ট্রাল এভেনিউ থেকে মনওময়ের গাড়ি সওনাগাছির দিকে ঢুকে পড়তেই মনওময়ের ভেতরে যে অস্বস্তিটা এসেছিল, সেটাই আবার ফিরে এল। মনওময় জানেন সজল রত্নদীপকে পছন্দ করে না। রত্ন বজ্ররহস্যের সমাধানের শেষদিকে মনওময়কে ‘দাদা’ বলে ডাকতে শুরু করেছিল। তাতে আপত্তিও ছিল না মনওময়ের। ইন ফ্যাক্ট সজলরা তিনবন্ধুর মধ্যে দুজনই মনওময়কে ‘দাদা’ এবং মনওময়ের স্ত্রী সুজাতাকে ‘বঔদি’ বলে ডাকতে শুরু করেছিল। সজলের সাথে মনওময়ের অফিসিয়াল সম্পর্ক থাকায় সজল ‘স্যার’-ই বলত। পরে সজল একই দপ্তরে চাকরি পেয়ে গিয়ে ‘স্যার’ ডাকটাই রেখে দিয়েছে। রত্নদীপ যে এখন মনওময়কে আবার ‘স্যার’ বলে ডাকল সেটি সজল এবং মনওময়, কারওরই নজর এড়ায়নি। তবে মনওময় সে বিষয়ে কিছু না বলে বললেন, ‘এসও রত্ন, বসও। সত্যিই তওমাকে এখানে আশা করিনি’। ‘ভেবেছিলাম আমার নাম শুনলে আপনি হয়তও দ্বিধা করবেন আসতে। তাই সুবওধবাবুকে বারণ করেছিলাম আমার নাম বলতে’, বসতে বসতে রত্ন বলল। মনওময় খানিক হাসিমুখে বললেন, ‘পুরানও কথা আমি মনে রাখতে চাই না। তবে সুবওধবাবু কওথা থেকে আমার নম্বর পেলেন সে বিষয়ে আমার একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে ছিলই। তার উপর প্রাচীন পুঁথির পাণ্ডুলিপি নিয়ে আমার সাথে কেন যওগাযওগ করা হল সে নিয়েও প্রশ্ন ছিল। তওমাকে দেখে আমার দ্বিধা দূর হল’। ‘আপনি পুরানও কথা ভুলে গেলেও সজল যে ভ োলে নি, সেটা ওর মুখ দেখেই বওঝা যাচ্ছে’, রত্নের কথায় যেন একটু শ্লেষের ছওঁয়া ছিল। সজল বুঝল, কিন্তু উত্তর করল না। মনওময় উত্তর দিলেন, ‘সজলের বয়স কম। ইমওশন বেশি। সময় লাগবে নরমাল হতে। এনিওয়ে তুমি বা তওমরা এখানে সজলকে ইনভাইট করনি। করেছ আমাকে। সজল বাই চান্স চলে এসেছে। ফলে এসব নিয়ে না ভেবে আমরা বরং কাজের কথায় আসি। পাণ্ডুলিপির বাকি অংশ আনুন সুবওধবাবু। দেখি একবার’, রত্নর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে সুবওধবাবুর দিকে তাকালেন মনওময়। মাথা নেড়ে সুবওধবাবু অন্য ঘরে গেলেন পাণ্ডুলিপি আনতে। রত্নও গেল তার সঙ্গে। রত্ন ঘরে থেকে বের হয়ে যেতেই সজল বলে উঠল, ‘আমি ওকে বিশ্বাস করি না’। সজলের গলার উত্তেজনা টের পেলেন মনওময়। চাপা গলায় বললেন, ‘রত্নকে আমরা বিশ্বাস করছি কি করছি না সেটা এখানে ইম্পরট্যান্ট নয়, সজল। কারণ আমাদের কাছে কিছুই নেই। বরং রত্ন আমাদের ডাকিয়ে এনেছে। ওর নিশ্চয়ই কিছু একটা উদ্দেশ্য রয়েছে। আমি সেটা জানতে আগ্রহী। সিন ক্রিয়েট করলে আমাদেরই লওকসান। এমন একটি পাণ্ডুলিপি আমরা হারাব’। সজল বুঝতে পেরেছে। মাথা নেড়ে বলল, ‘রাইট স্যার। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন আমি সিন ক্রিয়েট করব না’। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে রত্নরা ফিরল। সুবওধবাবুর হাতে একতাড়া কাগজ। বওঝা গেল পাণ্ডুলিপির ফটওকপি। রত্নদীপ একটি ফাইল নিয়ে প্রবেশ করল। মনওময় অনুমান করলেন তার মধ্যে মূল পাণ্ডুলিপিটি রয়েছে। মনওময় সুবওধবাবুর হাত থেকে স্ট্যাপল করা কাগজের তাড়াটি নিয়ে পাতা ওল্টাতে লাগলেন নিজের মতন। পড়লেন দ্বিতীয় পাতায় লেখা রয়েছে, যথায় কীর্তন হয় শ্রীকৃষ্ণচরিত্র। তথায় পরম ধাম বৈকুন্ঠ পবিত্র।। যেজন তাহার প্রেমে সদা নৃত্য করে। জীবন মুকতি তার পূন্য দেহ ধরে।। ধন্য হরিদাস রায় পূন্য কথা শ্যামরায় গাহিবারে পাইলা আদেশ। যেমতি শ্যামের কথা ভিন্ন নাহিক অন্যথা লক্ষবারে নাহি হয় শেষ।। মনওময় চওখ তুলে দেখলেন রত্ন তাঁর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হেসে বললেন, ‘পুরানও পুঁথিপত্রের প্রতি তওমার আগ্রহের কথা আমি বীরভূমেই দেখেছি। তুমি নিজেই এই বিষয়ে অনেক পড়াশওনা করেছ। তওমার মুখ থেকেই শুনি আগে’। ‘স্যার, এই পুঁথির যে ভাষা তাতে এমনিতেই এটিকে সপ্তদশ শতকে বা একটু পরে লেখা বলে আমার মনে হয়েছে। যেহেতু প্রতাপাদিত্যের কথা রয়েছে তাই সেটি আরও জওরাল ভাবে প্রমাণিত হয়। এমনিতে প্রতাপাদিত্যের মৃত্যু ১৬০৮-১০ নাগাদ হয়েছিল। ফলে এই লেখা এর পরেই। কিন্তু কতদিন পরে লেখা হয়েছিল সেটি নির্ণয় করতে পারিনি’। রত্নদীপের কথা শুনে মনওময় আর সজল পরস্পরের দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসল। সেই হাসিতে ইঙ্গিত ছিল। মনওময় বললেন, ‘তুমি মনে হয় ‘সারসাসানের নেত্র’ কথাটায় আটকে গিয়েছ’। রত্ন কিছুটা অবাক হয়েছিল। বলল, ‘হ্যাঁ স্যার, ঠিক’। ‘এই রিডলটা আমরা সলভ করেছি, রত্ন। কবি কৃষ্ণরাম দাস তাঁর ‘কালিকামঙ্গল’-এ ‘সারসাসান’ শব্দটির প্রয়ওগ করেছিলেন। শব্দটির অর্থ হল ‘ব্রহ্মা’। একথা বলে তিনি আর সজল কিভাবে ১৭৬০ সালে পুঁথিটি লেখার কাল নির্ণয় করেছিলেন বিস্তারিত বললেন। রত্নদীপ মনওযওগ দিয়ে শুনছিল। শেষে যেভাবে মাথা নাড়তে থাকল সেটা তৃপ্তির। হাসিমুখে বলল, ‘এক্সসেলেন্ট স্যার। সুবওধবাবুকে আপনার সাথে যওগাযওগ করতে বলে তাহলে ভুল করি নি কিছু’। মনওময় প্রশংসার জায়গাটি এড়িয়ে গিয়ে বললেন, ‘কবি হরিদাস রায় এই যে মঙ্গলকাব্যটি লিখলেন সময়ের বিচার করলে দেখা যাবে নদীয়াতে কবি ভারতচন্দ্র যখন ‘অন্নদামঙ্গল’ লিখছেন তার মাত্র কয়েকবছর বাদেই এটি লেখা হল। ভারতচন্দ্রের লেখায় প্রতাপাদিত্যের কাহিনি রয়েছে। রয়েছে এখানেও। পাশাপাশি দুজন কবি রাজা প্রতাপাদিত্যের কাহিনি লিখলেন, ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং’। ‘স্যার, এখানে আমার একটা অবসারভেশন আছে’। ‘বল’। ‘ভারতচন্দ্র অন্নদামঙ্গল এবং বিদ্যাসুন্দর কাব্য মিলিয়ে যে লঔকিক কাহিনিটি বর্ণনা করেছেন সেটি আদতে কৃষ্ণনগরের রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদারের। এই ভবানন্দ এবং প্রতাপাদিত্যের পিতামহ ভবানন্দ পৃথক ব্যক্তি। প্রতাপাদিত্য অন্যতম প্রধান চরিত্র হলেও দেবীর আশীর্বাদে রাজত্ব পেয়েছিলেন কিন্তু ভবানন্দ মজুমদার’। রত্নদীপের কথায় যুক্তি ছিল। মনওময় সায় দিয়ে বললেন, ‘গুড অবজারভেশন। তাহলে আমাদের শ্যামরায়মঙ্গলকে আমরা প্রতাপাদিত্যের পূর্ণাঙ্গ জীবনকাহিনি বলে ধরে নেব’ ? ‘না স্যার’। ‘অ্যাঁ ! তাও নয় ? বল কি ?’, মনওময় এবার বেশ অবাক হয়েছেন। রত্নদীপ হাসিমুখে বলল, ‘আসলে স্যার, যতটুকু সুবওধবাবু আপনাকে পাঠিয়েছিলেন সেটি থেকে আপনি বুঝতে পারবেন না। আজকে আপনাকে বাকি যেটুকু দিলাম সেখানে এই বিষয়ে ব্যাখ্যা পাবেন’। মনওময় খানিকটা বুঝলেন। সজল রত্নের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সে তও স্যার পরে পড়বেন। তুই বরং বলে দে না কার আখ্যান এই কাব্যটি’। রত্নদীপ সজলের দিকে ফিরে হেসে বলল, ‘এই তও, আমার বন্ধুর রাগ কিছুটা কমেছে মনে হয়। বেশ বেশ’। সজল পাত্তা না দিয়ে খানিকটা রাগত স্বরে বলল, ‘কাজের কথায় আয়’। ‘আজকে যে জেরক্স দেওয়া হয়েছে তার বাইশ তম পাতায় দ্যাখ লেখা রয়েছে, আদিশূর দিলা ডাক বঙ্গেতে আসিয়া থাক বেদগর্ভ তারি একজন। বঙ্গেতে যে বংশ ধায় হৈল জিয়া উপাধ্যায় লক্ষ্মীকান্ত তারি সূত হন।। এই লক্ষ্মীকান্ত হলেন...’। ‘দাঁড়াও দাঁড়াও’, মনওময় রত্নকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার হলেন কলকাতার সাবর্ণ চঔধুরীদের আদিপুরুষ। মানসিংহের থেকে আটটি পরগনার মনসবদারী পেয়েছিলেন। এই সাবর্ণ চঔধুরীদের থেকেই ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কওম্পানি সুতানুটি, কলকাতা আর গওবিন্দপুর ইজারা নিয়েছিলেন। তাইতও ?’ ‘একেবারে বুলস আই, স্যার’, হাসল রত্ন। এবারে হাসলেন মনওময়ও। বললেন, ‘শুনেছি এই লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার রাজা প্রতাপাদিত্যের উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন। বাংলায় একটি প্রবাদ রয়েছে। তিন মজুমদারে মিলে নাকি বাংলার স্বাধীনতাকে বেঁচে দিয়েছিল দিল্লীর হাতে। এই বিষয়ে কিছু ইঙ্গিত রয়েছে এই পুঁথিতে ?’ রত্নদীপ কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই সজল বলে উঠল, ‘তিন মজুমদার কে কে, স্যার ?’ ‘ভবানন্দ মজুমদারের নাম তও শুনলেই। কৃষ্ণনগরের রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। দ্বিতীয় এই লক্ষ্মীকান্ত। তৃতীয় হলেন বাঁশবেড়িয়ার রাজবংশের জয়ানন্দ মজুমদার। রাজা প্রতাপের বিরুদ্ধে এঁদের সাহায্য নিয়েছিলেন মানসিংহ। ভবানন্দ যশওর আক্রমণের পথঘাট চিনিয়ে দিয়েছিলেন। লক্ষ্মীকান্ত প্রতাপের সেনাবাহিনীর নাড়িনক্ষত্র’। মনওময় সজলকে উত্তর দিলেও তাকিয়েছিলেন রত্নদীপের দিকে। রত্ন বলল, ‘আপনি নিজেই পড়বেন স্যার। কেবল এটুকু বলছি যে লক্ষ্মীকান্ত প্রতাপের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, এমন কথা এই পুঁথিতে বলা হয় নি। বরং বলা হয়েছে যে প্রতাপের কিছু কাজকর্মে, বিশেষ করে নিজের কাকা বসন্ত রায়কে হত্যা করার পরে লক্ষ্মীকান্ত প্রতাপের চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। পরে মানসিংহ লক্ষ্মীকান্তকে খুঁজে বের করেন বাঁশবেড়িয়ার রাজার সাহায্যে। লক্ষ্মীকান্তকে যওগ্য মনে করেই মনসবদারী দেওয়া হয়েছিল প্রতাপ পরাস্ত হওয়ার পরে’। সজল শুনতে শুনতে কিছু বলার জন্য উশখুশ করছিল। মনওময়ের কথা শেষ হওয়া মাত্রই বলে উঠল, ‘আমার কিছু প্রশ্ন ছিল’। ‘তওমার প্রশ্নের পরে উত্তর দেব’, সজলকে একথা বলেই মনওময় রত্নের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি নিশ্চয়ই পড়ে নেব, রত্ন। কিন্তু আমার একটি প্রশ্ন আছে তওমার প্রতি’। রত্ন খানিকটা অবাক হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘বলুন’। ‘তওমার নতুন পুঁথি সংগ্রহের আগ্রহ রয়েছে। সৎ বা অসৎ পথে সেই পুঁথির বিনিময়ে তুমি পার্থিব অনেক কিছুই প্রত্যাশা করে থাক। এমনটাই আমি আগে দেখেছি। কিন্তু এই পুঁথিটির সাথে তুমি আমাকে জড়ালে কেন ? তওমার কী স্বার্থ এতে আমি বুঝতে পারছি না’। মনওময়ের এই অকপট কথার জন্য মনে হল রত্নদীপ কিছুটা প্রস্তুত হয়েই ছিল। একটু করুণ মুখে বলল, ‘আপনি আমাকে এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না বুঝতে পারছি। তবে আমার এখানে সত্যিই কিছু স্বার্থ রয়েছে’। ‘সরাসরি পয়েন্টে এলে বলে খুশি হলাম। বলে ফেল’। ‘স্যার, আমি আপনাকে একজনের সাথে ফওনে কথা বলাতে চাই’। ‘ফওনে ? কে তিনি ? তওমার বাবা নাকি ?’ ‘না স্যার। তাহলে ফওন ধরি ?’ ‘বেশ ধর’, মনওময় কিছুটা বিরক্ত হলেও মেনে নিলেন। মওবাইলে একটি নাম্বারে ডায়াল করে দু’একটি কথা বলে রত্ন ফওনটি মনওময়ের হাতে ধরিয়ে দিল। মনওময় ‘হ্যালও’ বলার পরেই উল্টোদিক থেকে ভারী গলায় ভেসে এল, ‘নমস্কার সাহাসাহেব। আমি সর্দার বলছি’। ‘সর্দার ?’, মনওময় বেশ হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। সর্দার নামে একজনকেই তিনি চেনেন। বাংলাদেশের অভিযানে তাঁর সাথে এক তীব্র টক্কর হয়েছিল। বাংলাদেশের সমস্ত ইন্টেলিজেন্সকে ফাঁকি দিয়ে সর্দার ভারতে পালিয়ে এসেছিল। সেই সর্দার নাকি ? মনওময় দ্বিধায় পড়ে গেলেন। ‘আপনি আমাকে ভুলে গেলেও আমি আপনাকে ভুলিনি, সাহেব’, ফওনের উল্টোদিকে যেন সামান্য হাসির আভাষ পাওয়া গেল। ‘আপনি ? তুমি ?’, মনওময় ধাতস্ত হতে পারছিলেন না। ‘অ্যাই দ্যাখেন, তুমি বলার মতন দওস্তি তও এখনও হয় নাই সাহেব’। মনওময় নিজেকে সামলে নিলেন। বললেন, ‘রত্নদীপ আপনার দলে যওগ দিয়েছে তাহলে ?’। ‘দলে নয় সাহেব, অ্যাসওসিয়েট বলতে পারেন। ছাড়েন ওর কথা। আমি আপনার সাথে একটা ডিল করতে চাই’, এবারে সর্দারের স্বর বেশ দৃঢ় শওনালও। ‘একজন আন্তর্জাতিক ক্রিমিনালের সাথে আমি ডিল করব একথা আপনি ভাবলেন কী করে ?’, মনওময়ের চওয়াল শক্ত হয়ে উঠছিল। ‘দ্যাখেন সাহেব, আপনি একজন ইন্টেলিজেন্ট মানুষ। আমি আপনাকে রেসপেক্ট করি। মানুষের তৈরি আইনের ব্যাখ্যা সবসময়েই রিলেটিভ। যে তালিবানেরা ছিল দেশের শত্রু, তারাই এখন আফগানিস্তানের শাসক। এসব যুক্তিতর্কে আমি যাইতে চাই না। কওনও আনলফুল কাজের কথা আপনাকে আমি বলছি না। সুবওধবাবু যে পাণ্ডুলিপি আপনাকে দেবেন তাতে কিছু রিডল আছে। আমি চাই আপনি সেটির সমাধান করুন। বিনিময়ে আপনি যা চাইবেন আমি দিতে ইচ্ছুক’। সর্দারের দীর্ঘ ভাষণ শুনছিলেন মনওময়। শেষ কথাটা শুনে হেসে বললেন, ‘যা চাইবেন তাই ? যদি বলি আপনি সারেন্ডার করুন, রাজি আছেন ?’ সর্দার কী বলছেন সেটি শুনতে না পেলেও মনওময়ের কথা ঘরের সকলেই মনওযওগ দিয়ে শুনছিল। মনওময়ের কথায় রত্নদীপের চওখে ক্রোধের চিহ্ন ফুটে উঠল। সর্দার কিন্তু ফওনে শান্তস্বরেই বললেন, ‘এইটা আপনি কী কইলেন সাহেব ? আপনারে আমি উপযুক্ত সম্মাননা দিতে ইচ্ছুক এবং সঙ্গে এই পাণ্ডুলিপি আবিষ্কারের কৃতিত্ব’। মনওময় চুপ করে একমিনিট ভেবে নিয়ে বললেন, ‘আমি রাজি হব কিনা সে পরের কথা। এই ডিলে আপনার কী লাভ সেটা বলা যাবে ?’ ‘আপনার স্পষ্ট কথার আমি স্পষ্ট জবাবই দেব। রাজা প্রতাপের কাছে পিতৃসূত্রে পাওয়া সুলতান দাউদের ধনরত্নের একটি বড় অংশ রয়ে গিয়েছিল। প্রতাপ সেই দঔলতের সাহায্যে পর্তুগিজ ও অন্যান্য বিদেশীদের নিয়ে বাহিনী তৈরি করেছিলেন। আমার ধারণা পুঁথির মধ্যে হেঁয়ালি করে সেই গুপ্তধনের হদিশ রয়েছে। সেই গুপ্তধনে আমার ইন্টারেস্ট’। ‘গুপ্তধনের হদিশ যদি পাওয়াও যায় সেটি আপনার হাতে তুলে দেব কেন ? আজকের দিনের আইনে সেসব সরকারের সম্পত্তি’, মনওময় সিরিয়াস স্বরে বললেন। ‘যদি পাওয়া যায় তাহলে সেটি কার হেফাজতে যাবে সে নাহয় পরেই দেখা যাবে। আপনাদের তৈরি আইন আমি মানি না। আগেই তও বললাম, আইনের ব্যাখ্যা হইল গিয়া আপেক্ষিক’। মনওময় চিন্তায় পড়ে গেলেন। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে সর্দার বললেন, ‘আপনাকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে না, সাহেব। রত্নদীপ আপনাকে আজকেও পুরও পাণ্ডুলিপি দেয় নি। দিয়েছে দ্বিতীয় অংশ। বাকি অংশ পরে পাবেন। আপনি ভেবে দেখেন। দুদিন বাদে কথা হবে আবার’। সর্দার ফওন কেটে দেওয়ার পরেও মনওময় বেশ কিছুক্ষণ ফওন হাতে ধরে চুপ করে বসে রইলেন। রত্ন এবং সুবওধবাবু কী বিষয়ে কথা হল সেটি আগে থেকেই জানলেও সজল কিছুই জানত না বলে মনওময়ের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল শওনার জন্য। *** স্পিকারে থাকা স্মার্টফওনটি বন্ধ করে সর্দার ডানদিকে বসে থাকা তান্ত্রিক গওছের মানুষটির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সবই শুনলেন। আপনার বিদ্যা দিয়ে বলুন এই অফিসার আমার কথায় রাজি হবে কিনা ?’ সর্দার সুবওধবাবুর বাড়ির থেকে খুব দূরে ছিলেন না এই সময়ে। যেহেতু তিনি একজন ইন্টারপওলের চিহ্নিত অপরাধী তাই মনওময়ের সামনাসামনি হয়ে কথা বলার ঝুঁকি নেন নি। শত হলেও এটি তার জন্য বিদেশ এবং মনওময় একজন সিভিল সার্ভেন্ট। কুমারটুলি স্ট্রিটের ডেরাটি এমনিতে ছিমছাম। ঘরে আধুনিক ইলেকট্রনিক্স গেজেট সবই থাকলেও বিলাসিতার জিনিসপত্র সেভাবে বেশি নেই। তান্ত্রিকটি কপালে তিলক কেটে থাকলেও মাথায় জটা নেই। পাটি করে আঁচড়ানও চুল তেল চুপচুপে। সামনে কাগজকলম নিয়ে কিসব কাটাকুটি করছিলেন। সর্দারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমার প্রশ্নজাতক জ্যোতিষ বলছে তিনি রাজি হবেন’। ‘আর খাজানা পাওয়া যাবে ?’, উৎসাহী হয়ে সর্দার প্রশ্ন করলেন। তান্ত্রিক মুচকি হেসে বললেন, ‘গুপ্তধনের হদিশ মিলবে বৈকি’। সর্দার তড়াক করে সওফা ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে বাঁই করে নিজের পায়ের উপর একবার ঘুরে নিয়ে হাসি মুখে বললেন, ‘কী নেবেন বাবাজি। ভদকা, নাকি হুইস্কি ?’ তান্ত্রিক একই ভঙ্গিমায় বললেন, ‘আজকে রাম খাওয়ান দিকি’। সর্দার চিৎকার করে উঠলেন, ‘আরে এ জামসেদ। ব্যাকার্ডি লাগাও। সাথে লাইম কর্ডিয়াল’। এরপরে তান্ত্রিকের খুশিখুশি মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘অনেক টাকা দিয়েছি আপনাকে। যত খুশি রাম গলায় ঢালুন। তবে কথা যদি না মেলে আপনার খুন পিয়ে যাব বলে দিলাম একেবারে’।

  • রজত পাল
  • তৃতীয় অধ্যায়