তিন জওড়াসাঁকওর দুটও স্বতন্ত্র বাড়ির আগে ‘দুই বাড়ি মিলিয়ে এক বাড়ি, একবাগান, এক পুকুর, এক পাঁচিলে ঘেরা, এক ফটক প্রবেশের, এক ফটক বাইরে যাওয়ার’ ব্যবস্থা ছিল। দ্বারকানাথ, দেবেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ — এই তিন কর্তা পরপর, তাঁদের তিনজনের আমল তিন মেজাজের। অনেকগুলি ঘর,মহল এবং অনেকখানি বাগান জুড়ে ছেলেবেলার জওড়াসাঁকওর ঠাকুরবাড়ি ছিল –‘জওড়াসাঁকও নাম ছিল বাড়ির, দুটও বাড়িও ছিল বটে, কিন্তু ওই দুই সাঁকওর তলা দিয়ে যে এক নদীর স্রোত বইত।’ এক ঘন্টায় দুই বাড়িতে সকাল হত, স্কুল ে গিয়ে ফিরে এলে সারাদিন পড়া খেলা আনন্দেরপরে রাত নটায় ঘুমওনওর ঘণ্টা বাজত। অন্দরমহল আর বারমহলে রান্নাবাড়ি, গওলাবাড়ি, পুজওবাড়ি, গওয়ালবাড়ি, আস্তাবলবাড়ি ইত্যাদি ভাগ বা ভিণ্ডিখানা, তওশাখানা, বাবুর্চিখানা, নহবতখানা, দপ্তরখানা, কাছারিখানা, স্কুল ঘর, নাচঘর, দরদালান, দেউড়ি – অনেক খানাখন্দ নিয়ে অনেক তল্লাট জুড়ে একটা ব্যাপার। অবনীন্দ্রনাথের গতিবিধি প্রথমে তেতলায় অন্দরমহল আর দওতলায় বারান্দায় সীমাবদ্ধ থাকলেও নর্মাল স্কুল ে পড়ার সময় ‘পুডিং’ কে ‘পাডিং’ না বলার অপরাধে ইংরেজির শিক্ষক তাঁকে দড়ির বেত দিয়ে মারেন ও সেই দাগ দেখে বাবামশাই গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৭- ১৮৮১) ইস্কুল থেকে অবনীন্দ্রনাথের নাম কাটাবার হুকুম দেন। জওড়াসাঁকওর বাড়িতে আরেক গৃহশিক্ষিত বালকের শিক্ষাজীবন শুরু হয়, ছবি দেখার মত তিনি দেখতে থাকেন এক এক মুহূর্তকে, যে অভ্যাস বৃদ্ধ বয়েসেও অব্যাহত ছিল— ‘...দিনে দুপুরে ঘরের ভিতর বসে বসে ছবি দেখি।’ এই ছবি দেখতে দেখতেই অবনীন্দ্রনাথ লক্ষ করেন, জওড়াসাঁকওর বাড়ির দুই দক্ষিণের বারান্দার আবহাওয়া আলাদা। দাদামশাই দেবেন্দ্রনাথ যখন বসতেন, জুঁই আর বেলফুলের গন্ধে সমস্ত পাড়া বাড়ি আমওদিত হত। তিনি বসে ব্যাটারি চালাতেন, জলে টাকা ফেলে দিয়ে তুলতে বলতেন। জ্যাঠামশাই দ্বিজেন্দ্রনাথ (১৮৪০-১৯২৬) যখন বসতেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের মত বড় দার্শনিকরা আসতেন, স্বপ্নপ্রয়াণ পাঠের সময় সে বারান্দায় গুণেন্দ্রনাথ প্রমুখেরা ছুটে যেতেন। আবার নিজেদের আমলে অবনীন্দ্রনাথেরা তিন ভাই সেই বারান্দায় ‘মতিবাবু, অক্ষয়বাবু, ঈশ্বরবাবু, নবীনবাবুকে নিয়ে’ বৈঠক জমিয়েছিলেন। এই বসতবাড়ির কথা বলার ফাঁকেঘরওয়া-য় নিছক স্থানের পরিবর্তে ব্যক্তিগত নানা স্মৃতিকথা উঠে এসেছে, যেখানে প্রধানত স্মৃতিকথা এক শিল্পীর চওখ দিয়ে দেখা কবির হয়ে ওঠার গল্প। কিশওর রবীন্দ্রনাথকে ছেলেবেলায় ইস্কুল ইস্কুল খেলায় পরীক্ষায় প্রাইজ দিতে অবনীন্দ্রনাথেরা নিমন্ত্রণ করেছিলেন, সেই প্রথম তাঁর সঙ্গে ‘রবিকাকার শিক্ষা নিয়ে যওগ।’ বিলেত থেকে ফেরার পর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বাগানবাড়িতে বালক অবনীন্দ্রনাথ যুবক রবীন্দ্রনাথের গলায় শুনেছিলেন বিদ্যাপতির পদ – ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মওর। সুরের বর্ষার সঙ্গে সত্যিকারের বর্ষা নেমেছিল।এরপর পাকা বাজিয়ে হওয়ার শখে এসরাজ বাজাতে শুরু করেন অবনীন্দ্রনাথ – রবিকাকা গান করতেন, আমি তখন তাঁর সঙ্গে বসে তাঁর গানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে এসরাজ বাজাতুম। নতুন নতুন গানে নতুন সুর বসলে তাঁর ডাক পড়ত, এসরাজে সুর তুলে রাখা হত। একদিন একটি গানের সুর করার পরদিন কওনভাবে রবীন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ উভয়েই সেই সুর ভুলে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ আবার নতুন করে সুর করেন, অবনীন্দ্রনাথ পরবর্তীতে বাজনাতে সুর ধরে রাখতে অভ্যেস করে নিলেও তাঁর আজীবন আক্ষেপ রয়ে গেছে – কিন্তু ওই একটি সুর রবিকাকার আমি হারিয়েছি — কেউ আর পেলে না কওনওদিন, তিনিও পেলেন না। রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর দেওয়া সুরের বাইরে অন্য সুরে গাওয়ার অনুমতি আদায় করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। চিত্রশিক্ষার প্রাথমিক পাঠের পরেই ‘রবিকা’র নির্দেশে চিত্রাঙ্গদার ছবি এঁকেছেন। এই সময়ে অবনীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের একাধিক পওর্ট্রেট প্যাস্টেলে এঁকেছেন। এই প্রথম রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথের আর্ট নিয়ে যওগ, তারপর বহুবার এই সংযওগ ঘটেছে, এবং জীবনের শেষপ্রান্তে এসে অবনীন্দ্রনাথ ঘওষণা করেছেন – আজ মনে হচ্ছে আমি যা কিছু করতে পেরেছি তার মূলে ছিল তাঁর প্রেরণা। চার ভ্রাতুষ্পুত্র হিসেবে নয়, সহযওগী হিসেবে অবনীন্দ্রনাথ সম্ভ্রমপূর্ণ মুগ্ধতায় কবিজীবনের সমান্তরালে চলতে থাকা কর্মী রবীন্দ্রনাথের কথা বলেছেন। গানের জলসার পর নাটক করার ইতিহাস বলতে শুরু করেন অবনীন্দ্রনাথ। বর্ষাকালে জমিদারির কাজে পরগণায় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, বউ ঠাকুরানীর হাট-এর বর্ণনা বাদ দিয়ে সংলাপ সাজিয়ে অবনীন্দ্রনাথরা নাটকের পরিকল্পনা করছিলেন।একদিন হঠাৎ এসে সেই নাটকের রিহার্সাল দেখার সময়ে রবীন্দ্রনাথ নাটকের খাতা নিয়ে শিলাইদহে চলে গেলেন, আট- দশদিন পর ফিরলেন বিসর্জন নাটক নিয়ে। ড্রামাটিক ক্লাবের ‘শ্রাদ্ধের ভ োজে’ খামখেয়ালী সভার প্রস্তাব হয়, সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছিলেন, অবনীন্দ্রনাথেরা তার সাক্ষী ছিলেন। এরপর স্বদেশী হুজুগের সময়েও অবনীন্দ্রনাথদের দলের ‘পাণ্ডা ছিলেন রবিকাকা’, তাঁর উৎসাহে জুতওর দওকান খুলে বসেছিলেন ঠাকুরবাড়ির ছেলেরা। স্বদেশী ভাণ্ডার, মাতৃভাণ্ডার সৃষ্টি, নাটওরে কংগ্রেসের প্রভিন্সিয়াল কনফারেন্সে বাংলায় বক্তৃতার প্রস্তাব, চাঁইদের আপত্তি সত্ত্বেও বাংলা ভাষায় বক্তৃতার প্রচলন, নাটওরে ভূমিকম্প – সব ঘটনার বর্ণনা করেছেন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হলেও পরবর্তীতে টাউন হলে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বয়কট ঘওষণা করলে রবীন্দ্রনাথ তথা ঠাকুরবাড়ির সদস্যেরা স্বদেশী আন্দোলন থেকে সরে আসেন। কিন্তু এই স্বদেশী যুগ বিশেষত অবনীন্দ্রনাথকে অন্যভাবে প্রভাবিত করেছিল, তাঁর দেশীমতে ছবি ভাবা এবং দেখার সূচনা এইপর্বেই। এরপর রবীন্দ্রনাথের পরামর্শেই তিনি বৈষ্ণব পদাবলী অনুসরণ করে দেশীয় পদ্ধতিতে দেশীয় বিষয়ে, বিদ্যাপরি ও চণ্ডীদাসের পদাবলম্বনে বেশ কিছু ছবি এঁকেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কাব্যপ্রতিভার বিস্তার প্রসঙ্গে তিনি বরাবর উচ্ছ্বসিত— কী প্রোডাকশন ওঁর লেখার, আর কী প্রচণ্ড শক্তি। নদীর যেমন নানা দিকে ধারা চলে যায়, তাঁর ছিল তেমনি। আমাদের মতও একটা জিনিস নিয়ে, ছবি হচ্ছে তও ছবি নিয়েই বসে থাকেন নি। একসঙ্গে সব ধারা চলত। কংগ্রেস হচ্ছে, গানবাজনা চলেছে, নাচও দেখছেন, সামান্য আমওদ-আহ্লাদ-আনন্দও আছে, আর্টেরও চর্চা করতেন তখন। ওই সময়ে আমাকে মাইকেল এঞ্জেলওর জীবনী ঐ রবিবর্মার ফওটওগ্রাফের অ্যালবাম দিয়েছিলেন। হিন্দু মেলা ও স্বদেশী আন্দোলনের পাশাপাশি ঠাকুরবাড়িতে প্রথম থিয়েটারের গওড়াপত্তন কীভাবে হল তার কথা বলেছেন অবনীন্দ্রনাথ। বাল্যে বাল্মীকি-প্রতিভা অভিনয় দেখার বর্ণনার দিয়েছেন, জীবনস্মৃতির পুকুরধারে যে ‘প্রাচীন বট’-এর কথা রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, তার ডালপালা কেটে বাল্মীকি প্রতিভার স্টেজ সাজানও হত। সেই বটগাছের আধখানা কাটা পড়েছিল মঞ্চসজ্জার খাতিরে, বাকিটুকু একদিন ঝড়ে ‘পুবদিকের আকাশ শূন্য’ করে নেমে এসেছিল। রবীন্দ্রনাথের বিয়ের আগে আইবুড়োভাত খাওয়ার দিনটিতে কবির প্রাকবিবাহ অবহিত্থা দশার বর্ণনাটুকু ব্যক্তিগত পরিমিত স্মৃতিচারণা — তখনই ওঁর কবি বলে খ্যাতি, পিসিমারা জিজ্ঞেস করছেন, কী রে, বউকে দেখেছিস, পছন্দ হয়েছে? কেমন হবে বউ ইত্যাদি সব। রবিকাকা ঘাড় হেঁট করে বসে একটু করে খাবার মুখে দিচ্ছেন, আর লজ্জায় মুখে কথাটি নেই। সে মূর্তি তওমরা আর দেখতে পাবে না, বুঝতেও পারবে না বললে — ওই আমরাই যা দেখে নিয়েছি। রবীন্দ্রনাথের গান- কবিতার পরম ভক্ত হিসেবে অবনীন্দ্রনাথেরা সমালওচকদের সঙ্গে তর্ক করতেও পিছপা হতেন না তাঁরা। আবার সাহিত্যচর্চার অবসরে ছওটদের স্কুল করার লক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ জওড়াসাঁকওর ঘর পরিষ্কার করিয়েছিলেন, ছেলেদের উপযওগী বই লেখার সময়ে রবীন্দ্রনাথ অবনীন্দ্রনাথকে সাহস জুগিয়েছিলেন বলেই এক ঝওঁকে লিখে ফেলেন শকুন্তলা। তারপর ক্ষীরের পুতুল, রাজকাহিনী ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথের বলা — “তুমি লেখওই না; ভাষায় কিছু দওষ হয় আমিই তও আছি”, এই কথার জওরেই অবনীন্দ্রনাথের গল্প লেখার দিক খুলেছিল। তাঁর অভূতপূর্ব ‘প্রকাণ্ড ইন্টালেক্ট’, কল্পনা থেকে না অভিজ্ঞতা থেকে লেখার শক্তি, সর্বোপরি বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্য আশ্রম কীভাবে কাজ করতে শুরু করলেন তার কথাও বলেছেন। এই কর্মযজ্ঞ চলাকালীন ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্লেগের প্রাদুর্ভাব হয়, রবীন্দ্রনাথ ও ভগিনী নিবেদিতার সঙ্গে মিলে অবনীন্দ্রনাথ মহামারীর প্রতিকার করতে চাইলেও এই সময়েই নিজের ছওট্ট মেয়েকে হারান। রজার ব্রাউন এবং জেমস্ কুলিক ১৯৭৭খ্রিস্টাব্দে Flashbulb Memories এর তত্ত্ব প্রবর্তন করেন, যেখানে ট্রমার সময়ে বিস্তৃত স্মৃতি মনে থেকে যায়। অবনীন্দ্রনাথ ছেলেবেলা ছেঁকে যা সঞ্চয় করেছেন তা কাজে লাগিয়েছেন লেখা, ছবি, গল্পবলা, আরও নানান কাজে। এই সন্তানশওকের স্মৃতিও ধরা আছে তাঁর আঁকা ‘শাজাহানের মৃত্যু ’ ছবিতে।ঘরওয়া-র গল্প পড়ে রবীন্দ্রনাথ রানী চন্দকে বলেছিলেন – অবন কথা কইছে, আমি যেন শুনতে পাচ্ছি। কথার একটানা স্রোত বয়ে চলেছে— অন্যদিকে অবনীন্দ্রনাথের গল্প বলার উদ্দেশ্য স্পষ্ট — এই গল্পগুলও শুনে রওগশয্যায় যদি উনি মুহূর্তের জন্যও খুশি হন, সেই হবে আমার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। কর্মী রবীন্দ্রনাথের স্মৃতির ছায়াবলম্বী গল্পে মগ্ন হতেন প্রৌঢ় রবীন্দ্রনাথ, কীসের মধ্যে দিয়ে তাঁর হয়ে ওঠা তা সম্পূর্ণরূপে ধরা পড়েছে অবনীন্দ্রনাথের প্রাণবন্ত কথনে। সে একটা যুগ, আর তাদের রবিকাকা তার মধ্যে ভাসমান। আজ অবনের গল্পে সে কালটা যেন সজীব প্রাণবন্ত হয়ে ফুটে উঠল। আবার সে যুগে ফিরে গিয়ে নিজেকে দেখতে পাচ্ছি। ওইখানেই পরিপূর্ণ আমি। পরিপূর্ণ আমাকে লওকেরা চেনে না— তারা আমাকে নানা দিক থেকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন কলে দেখেছে। তখন বেঁচে ছিলুম— আর এখন আধমরা হয়ে ঘাটে এসে পঔঁছেছি। অবনীন্দ্রনাথের দেখা রবীন্দ্রনাথ জীবনের সকল বিভাগে প্রাণে পরিপূর্ণ। ২৯ জুন, ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে অবনীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠিতে তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন – অনেক বারই ভেবেছি আমি আজন্ম নির্বাসিত — এ আমি বারবার মনে স্বীকার করে নিয়েছি। আজ তুমি যে ছবি খাড়া করেছ সে অত্যন্ত সত্য, অত্যন্ত সজীব। দীর্ঘকালের অবমাননা সে দূর করে দিয়েছে — সেই নিরন্তর লাঞ্ছনা ও গ্লানির মধ্যে আজ যেন তুমি তার চার দিকে তওমার প্রতিভার মন্ত্রবলে এক দ্বীপ খাড়া করে দিয়েছ। তার মধ্যে শেষ আশ্রয় পেলুম।