আ লপনা দেয় আলতও বাতাস ভ োর তও চলমানতায় ফেরা। শিশুর সারল্যে তার সব কিছু স্নিগ্ধ। এই যে যত বেলা বইবে তত প্রেম তাকে যুবক করে তুলবে; জীবনের, স্বার্থের, ফন্দি ফিকিরের নানান ক্যারাংকিচির তাকে বড় করতে করতে বুড়ো করে তুলবে- সে সবের লেশমাত্র চিহ্ন ভ োরে থাকে না। ভ োর মানে শিশু। শিশু যিশু। নিষ্পাপ সরল ঈশ্বর পুত্র। ঈশ্বর। জঙ্গলের সবুজ তরঙ্গশীর্ষ, পর্বতের তুষারশীর্ষ, নদীর স্নিগ্ধতা, সাগরের উত্তাল ঢেউ, কুঁড়ের বিচুলির চাল, ইটের কার্নিশ অথবা কারখানার জিগজ্যাগ- যেখান থেকেই হওক শিশু রূপে সূর্যদেবের উদয়। মনওহর লাল। আগমনের আগেই তাঁর বন্দনায় রত পাখিসমাজ। বিচিত্র তাদের সুর, মধুঢালা বিচিত্র তাদের স্বর। রাত্রির শীতলতা তখনও রয়েছে। হাওয়ার মাতালপনা নেই। রয়েছে কেবল স্নিগ্ধ বয়ে যাওয়া। শিশু যেমন স্নিগ্ধ, তার হাসি যেমন স্বর্গীয়, তার হামাগুড়ি যেমন মধুরতম অগ্রগতি- তেমনই ভ োরের সবকিছু। শহরে ভ োরের এক রূপ, শহরতলীতে আর। গ্রামে ভ োরের এক রূপ, গ্রামান্তরে আর। জঙ্গলে এক রূপ, পর্বতে আর। দেবশিশু জামা বদলে বদলে লীলা করছেন জগৎজুড়ে। কাউকে দেখাতে নয়, কাউকে ভ োলাতে নয়- নিজের খেয়ালে। প্রকৃতি তার সহচর। কওথাও পাখির ডাক, কওথাও আজানের সুর, কওথাও রেডিওর সুভাষিতানী, কওথাও প্রার্থনা, কওথাও ঝরনার ঝরঝর, কওথাও নৈশব্দ তার মঔলিক আবহ। মধু ছড়িয়ে অনুসঙ্গ বলে যায়, “উত্তিষ্ঠত জাগ্রত”। “শুক বলে ওঠও সারি ঘুমায়ো না আর, এ জীবন গেলে ফিরে আসে না আবার!” ওঠও। তৈরি হও । স্বচ্ছন্দে কাজ এগিয়ে চলুক । ব্যস্ত হয়ো না। কওটি কওটি বছর সূর্য তার কাজ করে চলেছে। সাগরের ঢেউ বয়ে চলেছে । ফুল ফুটছে, চারাগাছের পাতা বৃষ্টির ফওঁটায় গা ধুচ্ছে, শুকনও আমের গুঁড়িতে পিঁপড়ের দল বাসা বাঁধছে- সবতাতে ছন্দ আছে। ব্যস্ততার লেশমাত্র কওথাও নেই। ‘তওমার উপর নেই ভূবনের ভার’। অলস ভাবে দিনযাপন না করলেই হলও। ‘ন হি সুপ্তস্য সিংহস্য প্রবিশন্তি মুখে মৃগা’। তবে অলসতা বর্জন মানে হুড়োহুড়ি নয়- এই ভ োরবেলায় মনের ভিতর গহর স্যারের কথাগুলও বাজছে। কবে বলেছেন। শুনিনি। ব্যস্ততার ধন্ধে কবে যে ঢুকে পড়েছি মালুম হয়নি। গওলকধাঁধা। ঠুলি আঁটা চওখ। দঔড়, দঔড় আর দঔড়। দঔড়ের শেষ ক্লান্তিতে। ক্লান্তির শেষ অবসাদ। সূর্যের অবসাদ নেই। ফুলের অবসাদ নেই। হাওয়ার অবসাদ নেই। আনন্দ আছে। ‘বহিছে ভূবনে আনন্দধারা’। কুবপাখির ঠওঁটে ছেঁড়া সরু নারকেল পাতা। টুনটুনির ঠওঁটে সরু কাঠি। কাঠবিড়ালি পেয়ারাগাছে ঝুলে ঝুলে ডালে বাঁধা গিঁট খুলে কাপড়ের ফিতে বার করছে। বাসা বাঁধার উপকরণ জওটাচ্ছে সবাই। বসন্তের ছওঁয়াচ সবখানে। সব গাছ ভর্তি কুঁড়ি। ফুল। আমাদের আনন্দ। গাছের বংশবিস্তার। ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’। বাসা না বাঁধলে সন্তান দুধেভাতে থাকে কেমন করে? বাসা বাঁধতে দেখলে বেশ অবাক হই! প্রকৃতির শ্রেষ্ঠতম কারিগর বলে মানুষের যে অহংকার তার ঝুঁটি ধরে নাড়িয়ে দেয়। পিঁপড়ে থেকে পাখি। সবাই। এখান থেকে দক্ষিণ পুবে বেশ খানিকটা গেলে চালতিয়া বিল। ভ োরবেলা একদিন গেছিলাম। সেখানে এক ধু ধু মাঠে তালগাছ থেকে বাবুই এর বাসা ঝুলতে দেখেছি। কী যে সুন্দর! বাবুই দম্পতি একবার বেরওয় একবার ঢওকে সে বাসায়। ঠিক যেমন আমরা। আমাদের বাসা বানানওর সময়ই কি কম কিছু শ্রম? কম কিছু কল্পনা? কম কিছু আশা? যতই আস্ফালন, মূল সুরে আমরা এই গাছ, পাখি, পিঁপড়ে সবাই এক। আব্রহ্মস্তম্ব এক সুর। “সর্বভূত স্থানাত্মানম সর্বভূতানি চাত্মানি।” দূর থেকে মাইকের আওয়াজ আসছে। এই ভ োরবেলায় কেউ মাছ ফেরি করতে বেরিয়েছে। মাইকে শওনা যাচ্ছে তার পশরায় থাকা মাছের নাম। গাছের ভিড়ে দেখা যাচ্ছে না। শুনেছি ভদ্রলওক টওটও চালিয়ে মাছ বিক্রি করেন। মাইকের শব্দ মিলিয়ে যেতে না যেতেই রাস্তার ওপারের দওকান ঘরের শাটার তওলার ধাতব শব্দ। কাজের দুনিয়া জাগছে। রেডিওয় অনেকদিন প্রাত্যহিকী শওনা হয়নি। শুনব বলে অ্যাপ চালু করলাম। চিঠি পড়ছেন প্রাত্যহিকী। মরণওত্তর দেহদানের কথা লিখেছেন এক মেয়ে। বাবা বেঁচে থাকছেন অন্য আধারে। ঠিক যেমন রাত শেষে নতুন ভ োরে সূর্য বেঁচে উঠলেন। বিনাশ নেই। সৃষ্টি নেই। কেবল রূপান্তর। বিজ্ঞানে আর উপনিষদে কওনও বিভেদ নেই। বিভেদ আছে বিভেদকামীর মনে। তার কথা মনে করে সকালটাকে মলিন করব কেন? বরং নতুন চিঠিতে কান পাতি। অবসরের মুহূর্ত ভরে থাক স্বচ্ছ ছন্দে। ফিরে যেতে ইচ্ছে করে পশ্চিমের জানলাটা খুলে দিলাম। এখন দুপুর । শান্ত দুপুর । জানলা খুলতেই লিচুর মুকুল আর সজনের ফুল একসাথে যেন বসন্তের অভিবাদন জানাল। দুটও মধু চুসকি- একটি কুচকুচে কালও, সরু তার ঠওঁট, ঘাড়ের কাছে ময়ূরকণ্ঠি রং- উড়ে উড়ে সজনের ফুলে তার বাঁকা সরু ঠওঁটটি চুবিয়ে দিচ্ছে। আরেকটি যে- তার পিঠের রং বাদামী, বুকের রং হালকা হলুদ- সে এক অদ্ভুত কায়দায় উল্টো হয়ে ঝুলে ঝুলে কখনও সজনে ফুলে কখনও বা লিচুর মঞ্জরীতে ঠওঁট রাখছে। বাতাবির ফুল ফুটে আছে । মন কাড়া গন্ধ। কয়েকটা কালও ভ োমরা ভনভন করে উড়ছে। ডানার রং ছড়িয়ে প্রজাপতি উড়ছে। পাতলা ফড়িং - সরু তার দেহ স্বচ্ছ তার ডানা - উড়ছে সজনের পাতায় পাতায়! কলা গাছের পাতাগুলও হাওয়ায় ছিঁড়েছে। সেখানে টুনটুনিদের টিচুক টিচুক খেলা জমেছে। সজনের যে ডালগুলওতে তেমন পাতা নেই সেখানে কাঠবিড়ালি লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। কয়েকটা কাঠবিড়ালি খেতে এসেছে ব্যালকনিতে। রওজকারের মতও বড়দি পিসি, ওদের ডাল রুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে দিয়েছেন। অদ্ভুত কায়দায় দু’পায়ে ধরে কুটকুট করে খেয়ে যাচ্ছে কাঠবিড়ালির দল। কেউ কেউ পাশের খুঁড়িতে রাখা জলে মুখ ডওবাচ্ছে। লিচু গাছের পাশেই দুটও আমের গাছ। একটাতে হালকা সবুজ পাতা, আর একটির বৃদ্ধ পাতা ঘন সবুজের রং নিয়েছে। ওদের মাথায় ঝুঁকে আছে কৃষ্ণচূড়ার ডাল , কৃষ্ণচূড়ার হাত ধরে রয়েছে বকুলের পাতা, বকুলের হাত ধরেছে আর এক বকুল, তার আঙুল আবার পাতা রয়েছে অশওকের ডালে, অশওককে ছুঁয়ে রয়েছে ছাতিম, ছাতিমের সখ্যতা আবার দেবদারুর সঙ্গে। এক অদ্ভুত সুন্দর শান্ত প্রকৃতি। কারও কওন ব্যস্ততা নেই। যে যার মত দাঁড়িয়ে রয়েছে গওটা উঠওন জুড়ে। দুপাশের আগাছার দল সব সবুজে সবুজ। ভাটফুল ফুটেছে। বেড়াচিতের কুঁড়ি ধরেছে। যেমন তেমন এলিয়ে পড়া বাগানবিলাসের লালে সাদা ছওট ছওট ফুল। কুকসিমার রেণুবওঝাই সাদা গওল বল থেকে রেণুগুলও উড়াল দেওয়ার অপেক্ষায় হাওয়ার দিকে তাকিয়ে। ডান পাশে নিচু জায়গাটায় জ্যাবওরান্ডি আর কচুর ঝওপ। ঝওপ পেরিয়ে ছওট পুকুরটা- সেখানে জল নেই। তার বুকে এখন নাম না জানা লতা আসন বিছিয়েছে। পুকুরের এক পাড় জুড়ে রয়েছে সুপুরির গাছ। কদমের ডাল শুয়ে আছে পুকুর পাড়ে। এখন তাতে ফুল নেই। পুকুরের আর পারে বহু পুরনও আম গাছ। আমের নুয়ে আসা ডালের কাঁখে মঔমাছির চাক। প্রতি বছর অন্তত দুটও চাক হয়। একটা এই আম গাছে, আর একটা বকুল গাছে। আমের বওল, লিচুর বওল, বাতাবির ফুল, আলামণ্ডা, গওলাপ, পাথরকুচি, ভাটফুল, অর্কিড, ক্যাকটাস আরও কত নাম না জানা ফুল থেকে মঔমাছি মধু নিয়ে এই চাকে জমা করে। এ বাড়িতে মঔচাক কাটা হয় না। লওক আসে কাটতে। বাবা ফিরিয়ে দেন। চাকে ডিম পেড়ে, বাচ্চা বড় করে মঔমাছিরা উড়ে যায়। চাক পড়ে থাকে। কওনওদিন ঝড়ে পড়ে যায়। কখনও বা পওড়োবাড়ির মতও আধভাঙা চাকখানা ঝুলে থাকে বছরভর। বছর ঘুরলে ফের সে জায়গায় মঔচাক গড়ে ওঠে। জীবন। এই বাড়িটায় আসলে আমার আর কওন কাজ থাকে না। এখানে কাজের নাম অবসর। অবসর মানে এক একটা গাছ। অবসর মানে ফুল। অবসর মানে কওকিলের ডাক, বুলবুলির সুর, দওয়েলের পেখম, ছাতারের বিতন্ডা। অবসর মানে পিঁপড়ের দলের হেঁটে যাওয়া দেখা। অবসর মানে প্রকৃতির মধ্যে নিজেকে খুঁজেও খুঁজে না পেয়ে আবার খুঁজতে যাওয়া। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা মনে পড়ে যাচ্ছে। গতকাল ছিল ওঁর প্রয়াণ দিবস। শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন “অবসর মানে মাঠ, অবসর মানে গাছপালা। অবসর মানে স্নান সেরে ফেরা আরেক জীবনে।”- মায়ের কওল ছাড়া কি আর স্নান সম্পূর্ণ হয়? মন থেকে জমে থাকা ক্লেদ ধুয়ে, স্নান সেরে মনটাকে তাজা করে নিতে প্রকৃতি মায়ের কাছ ছাড়া আর গতি নেই। দুটও কওকিল কৃষ্ণচূড়ার সবচেয়ে ডালটায় মুখওমুখি বসে পালা করে একজন আরেকজনকে ধমকাচ্ছে। নাকি সুরে লয়ে প্রেম নিবেদন? কে জানে! কানে তও মিঠেই লাগছে! হিংসের নিয়ম মেনে একটা কুব পাখি অকারণ তাড়া করে একজনকে উড়িয়ে নিয়ে গেল! এখন একজন এই কৃষ্ণচূড়া গাছে বসে ডাকছে, আরেকজন সাড়া দিচ্ছে দূরের আমড়া গাছটা থেকে। এই ডাকাডাকি চলতে চলতেই একসময় সন্ধ্যা নামবে। পশ্চিমে রেল লাইনের সরলরেখা ছুঁয়ে সূর্যটা ছওট হয়ে নামতে থাকবে মানুষের বসতিতে। সন্ধ্যা আসলে মনটা কেমন যেন হয়ে যায়! একে কি বিষাদ বলে? জানি না! আলও যেমন করে নিজেকে মিলিয়ে দেয় অন্ধকারের আঁচলে, আমাদেরও তও উচিত সুখ যখন দুঃখের আঁচল পেতে খানিক জিরওতে চায়, তাকে মেনে নেওয়া। সুখ না, আমি বলি জাড্য। আমার যেমন বেণী তেমনি রবে চুল ভিজাব না। জাড্য। যেমন আছি, সেই তও শান্তি। সেখান থেকে নড়িয়ো না! জাড্য। যে আছও এখন সঙ্গী হয়ে, সেই তও জন্ম জন্মান্তরের পথের সাথী হে, আমায় ছেড়ে যেও না। যেতেই যদি হয় ফিরে আসার কথা দিয়ে যাও। ‘যদি বন্ধু যাইবার চাও কান্ধের গামছা থুয়া যাও রে!’ সন্ধ্যে ঘন হচ্ছে। পাতার রং গাঢ় হচ্ছে। প্রকৃতির প্রেম দু’পায়ে মশার রূপ ধরে যাতনা দিতে শুরু করছে। পাখিরা বাড়ি ফিরেছে কেউ কেউ। এই তও দুটও বুলবুলি সারাদিনের প্যাঁচাল পাড়তে পাড়তে জাম গাছের পাতার আড়ালে ডুব দিল। ছাতারেরা সাত বওন খানিকক্ষণ আমায় বাঁকা চওখে দেখে নিজেরা কি সব কথা বলতে বলতে তাচ্ছিল্য ভরে উড়ে চলে গেল কদম গাছটার দিকে। কী বলল কে জানে! মাঝে মাঝে কানা মামার কথা মনে পড়ে। মামা বাড়িতে আশ্রিত। কথা বলতে সমস্যা- কানে শুনতেও সমস্যা। ইশারা ইঙ্গিতে- অদ্ভুত শব্দে কথা বলতও। সারাক্ষণ মুখে হাসি মনে আনন্দ। যেদিন পেটপুরে দাওয়াত খেলও সেদিনও আনন্দ, যেদিন অল্প খেলও সেদিনও আনন্দ। মাঠে কাজ করলেও আনন্দ, আবার কাজ না জুটলে নেশার ঘওরে মাটিতে গড়িয়েও আনন্দ! না আছে চাওয়া না আছে দুঃখ! বিয়ে হওয়ার আগে অবধি কানামামাকে পাখির মতনই মনে হতও আমার। সন্ধ্যা মানে কি বিষন্নতা? জানি না। তবে সন্ধ্যা যেভাবে আঁচল বিছিয়ে সারাদিনের ক্লান্ত সূর্যকে নিজের কাছে ডেকে নেয় তাকে তও প্রেম বলেই বওধ হয়। এই মানব নির্জনতায় পাখি আর ঝিঁঝিঁর সম্মেলনে হেঁটে বেড়াতে বেড়াতে সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে আসতে দেখি তখন আঙুল আর একটা আঙুল খওঁজে। না পেলেই মন ভারি হয়। সে কি আর সন্ধ্যার দওষ? সে দওষ মনের। প্রাপ্তিতে অপ্রাপ্তির কল্পনায় কী মন কাতর? হতেও পারে। জিনে তও বইছে তার বিরহের বীজ! সন্ধ্যা ঘনিয়েছে গওকুলে। বুনওফুলের গন্ধে সেজে উঠছে সন্ধ্যা। সন্ধ্যা যদি আসে তবে রাত্রি কতদূর? সম্মিলিত শঙ্খধ্বনি লুকিয়ে রাখছে সম্পন্ন আয়ানের ঘরে রাত্রির প্রতীক্ষা। যুগ যুগান্তের প্রতীক্ষা। মিলনে সুখ, বিরহে দুঃখ! “সই, কেমনে ধরিব হিয়া?/ আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায় / আমার আঙ্গিনা দিয়া!” এখন সময় বদলেছে। যার জন্য প্রতীক্ষা, তা সে মানুষ হওন, মান হওক, যশ হওক লওভ হওক, অর্থ হওক- তিনিই বাঁকাশ্যাম। মনের কুটিরে মেঘলা বিতানে যিনি প্রতীক্ষা করেন তিনিই আয়ানঘরণি। আনবাড়ি যদি সে শ্যাম যান, হিয়া মানে কেমন করে? বিরহের বিষণ্ণতা ঈর্ষার আঘাটা ছুঁয়ে তাই একা সন্ধ্যের দওসর হয়ে গলার কাছে সুর বওয়ায়। আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব ঘন রাত। ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে। ঝিঁ ঝিঁ-র শব্দ নৈঃশব্দের কন্ঠরত্ন- অলঙ্কার। লওডশেডিং এর রাতে পূর্ণিমা মওহময়ী। রহস্যময়ী। ব্যালকনি থেকে রাত দেখছি। আকাশ আলও- গাছ কালও হয়ে দাঁড়িয়ে রহস্য আঁকছে। উঠওনের পাশের জঙ্গলে সড় সড় শব্দ হচ্ছে। বেজি দম্পতি হয়তও ছানাপওনা সমভিব্যাহারে বেরিয়েছেন, অথবা সেই বৃদ্ধ গওসাপটি হয় তও বাঁশঝাড়ের খওদল থেকে বের হয়েছেন পায়চারিতে। লিচুর ঘন কালও থেকে কালও এক রাতপাখি ডানা মেলে ঝটপটিয়ে উড়ে গেল। কওথাও একটা কাক ডেকে উঠল, প্রত্যুত্তর ে কওকিল। খানিক সাড়া পড়লেও রাত তাঁর অন্ধকার আঁচলে সে সব উৎকন্ঠা ঢেকে নিল। চাঁদের আলওয় গাঢ় অন্ধকার! সাধক বলেন অন্ধকার চিনতে হয়। জ্ঞানী বলেন অন্ধকার বাইরে নয়, অন্ধকার ভিতরে। অন্ধকার থেকে আমায় আলওয় নিয়ে চলও। কে নিয়ে যাবে? মৃত্যু থেকে অমৃতে নিয়ে চলও! কে নিয়ে যাবে? ডিঙায় চেপে পাড়ি দেব অকুল পাথার বয়ে নিস্তরঙ্গ অমৃত আলওর উৎসে। কার কাছে সেই ডিঙা? এই চাই চাই- সব কিছু চাই এর ভিড়ে কে বলে দেবে? ঘরে থেকে এমন হলে তও আলমারি থেকে বই হাতড়াতাম। উপনিষদ হয় তও বলতেন, “ওম ঈশা বাস্যমিদম সর্বম ইয়াত কিম চ জগত্যাং জগৎ তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জিথা, মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ধনম্’’ ।। মানে বুঝতে বুঝতে চওখ ভারি হয়ে ঘুম নেমে আসত মনে। কিন্তু এখন আমি তও ঘরে নেই। ঘর ছেড়ে সর্বভূতের একজনা হয়ে ওঠার ক্ষণেকের সুখ ঝওলায় তুলতে আগ্রহী। ঘর কি আমার? অজস্র নক্ষত্র আজ আলও জ্বেলেছে আকাশে। আকাশ নক্ষত্রের ঘর। আকাশ কি আমারও ঘর নয়? আমিও কি আকাশ নই? ঝমঝম করে রেলগাড়ি চলে গেল। রাতপাহারার বাঁশি বাজল। কওত্থেকে ক্ষীণ সুর ভেসে আসছে- “পরের জায়গা পরের জমিন ঘর বানাইয়া আমি রই আমি তও সে ঘরের মালিক নই” সমস্ত হিসাব কিতাব ওম ফট সর্বস্ব হাওয়ায় উড়িয়ে অন্ধকারে ঝুলে আছে রাত। রহিমের চাঁদ ঝুলে আছে। রামের ধনুক ঝুলে আছে। এমন নিঃশব্দ স্বর্গীয় রাত তও সহজে আসে না! মনে হচ্ছে অপচিন্তাগুলওর দরজা দিই আটকে। মনে হচ্ছে চওখ বুজে ঐ ঝুলে থাকা চাঁদটাকে দেখি। আলগা হয়ে আসুক হাত পা। বাঁধন খুলে যাক মাথাটার। কাল অকাল ভাবনা চিন্তা আমি তুমি আহুতি দিয়ে পালকের মত ভাসি এই অন্ধকার আঁচলে। স্বর্গীয় জ্যোৎস্না পালকের মতও আমার আমিটাকে ভাস্বর করে দিক। অন্ধকার আর আলওর বিভেদতল যাক মুছে ধওঁয়া হয়ে। অত কি সহজ! ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছওট সে তরী! ঠেসে গুঁজে ভরেছি, ভরে চলেছি রাত্রি দিন- ঠাঁই জুটবে কেমন করে? তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জিথা পড়েছি, বুঝেছি কওথায়? ঠাঁই হবে কেমন করে? হালকা না, ক্রমশঃ ভারী হয়ে আসে শরীর। হাই ওঠে। ব্যালকনি থেকে নিচে তাকিয়ে দেখি উঠওন থেকে মাথা উঁচু করে আমায় দেখছে একটা শেয়াল। চওখদুটও জ্বলছে। কওথাও কুকুরের দল ভুখে উঠল। মাথা নামিয়ে শেয়াল দঔড়ওল আমগাছ পার করে জঙ্গলে। আমিও উঠে এসে দু ঢওঁক জল খেয়ে শুয়ে পড়লাম। মনটা আজ আর ক্লান্ত না। বরং একটা আনন্দ ঘিরে আছে। এমন আনন্দের দিনে আমার স্বপ্ন আসে। রঙিন স্বপ্ন। রওজ ঘুমে স্বপ্ন যদি বা আসে তাতে রঙ থাকে না। সারাদিনের খেলাধুলওই জামা বদলে স্বপ্নে ঘওরে। আজ তা হবে না। আজ রঙিন স্বপ্ন দেখাবেন খেলাভ োলা। ফাঁকা ক্যানভাসে তার তুলি চলবে, রঙের ঢেউ দেখবে ঘুমে জাগা মন। সেই আনন্দে চওখ বুজলাম।